Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গোর্খা রেজিমেন্ট: ব্রিটিশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অদম্য সাহসী মার্সেনারি সৈন্যদল

“If a man says he is not afraid of dying, he is either lying or is a Gurkha”

Field Marshal Sam Manekshaw

অর্থাৎ, “যদি কোনো মানুষ বলে সে মৃত্যুকে ভয় পায় না, হয় সে মিথ্যে বলছে নয় সে একজন গুর্খা।” ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক পাঁচ তারকা সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ গোর্খা সৈন্যদের ব্যাপারে এ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ফিল্ড মার্শাল খেতাব অর্জনকারী দুজন অফিসারের একজন। ‘গোর্খা’ বা ‘গুর্খা’-দের বীরত্ব বা সাহসিকতার চিরকালীন সাক্ষী হয়ে আছে উক্তিটি। সদ্য বিদায়ী সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত এবং তার পূর্বসূরি জেনারেল দলবীর সিংও এসেছিলেন গোর্খা রেজিমেন্ট থেকে।

ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ যিনি  উঠে এসেছিলেন ৮ম গোর্খা রাইফেলস থেকে; Image Source : scrolldroll.com
ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ যিনি উঠে এসেছিলেন ৮ম গোর্খা রাইফেলস থেকে; Image Source: scrolldroll.com

কারা এই গোর্খা? গোর্খারা হচ্ছে নেপাল ও উত্তর ভারতের পাহাড়ি এলাকা থেকে আসা ভাড়াটে সৈনিক। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। ‘মার্সেনারি সোলজার’, ইংরেজিতে ‘Mercenary Soldier’। মার্সেনারি সোলজার হলো তারা যারা কোনো প্রকার রাজনৈতিক কারণ ছাড়া কোনো রাষ্ট্র বা জাতির পক্ষে লড়ে। অর্থাৎ, ভাড়াটে সৈন্য। গোর্খারা মূলত ব্রিটেন ও ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিয়ে থাকে। গত দু’শো বছরেরও বেশি সময় থেকে গোর্খারা ঐতিহ্যগতভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সেবাদান করছে। সিঙ্গাপুরের পুলিশ ফোর্সেও গোর্খাদের নিয়োগ করা হচ্ছে। তাদের অসীম সাহসিকতা ও অপরিমেয় বলের জন্য ব্রিটিশরা তাদের অনেক সম্মান করে। নেপালি হয়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি আসলেই আশ্চর্যজনক।

ঘটনার সূত্রপাত হয় ১৮১৪ সালে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ভারত শাসন করছে। কোম্পানির তৎকালীন গভর্নর জেনারেল স্যার ডেভিড অক্টারলোনির খেয়াল হলো নেপাল সাম্রাজ্য আক্রমণের। তিনি তার প্রশিক্ষিত, চৌকস ২২,০০০ সেনাকে সেদিকে অগ্রসর করলেন। বিরোধী পক্ষে তেমন ভারী অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত সেনাদল নেই। প্রায় বিনাযুদ্ধেই ব্রিটিশ সেনাদলের জয় হবে এমনটাই ভেবেছিলেন অক্টারলোনি। কিন্তু ময়দানে হিসেব এত সহজে মিলল না। বাইশ হাজার চৌকস সেনার নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল স্থানীয় ১২০০০ গোর্খালী। উচ্চতাও বেশি নয় এদের। ৫ ফুট ২ ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি।

গোর্খা তরুণেরা; Image Source : scrolldroll.com
গোর্খা তরুণেরা; Image Source: scrolldroll.com

তাদের না ছিল শক্তিশালী অস্ত্র না ছিল সুশৃঙ্খল প্রশিক্ষণ। হাতে ছিল শুধু একটি বাঁকানো ছোরা। সেই ছোরা দিয়েই এই পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ব্রিটিশ সেনাদলের সাথে বীরদর্পে যুদ্ধ করেছিল। যুদ্ধে ব্রিটিশদের জয় হলেও গভর্নর জেনারেল গোর্খালীদের অসীম সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি যেচে তাদের প্রস্তাব দিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দেওয়ার। টানা দুই বছরের যুদ্ধের অবসান হলো একটি চুক্তির মাধ্যমে। এটি Treaty of Sugauli  নামে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।

এ চুক্তি স্বাক্ষরের পর থেকে গোর্খারা পাকাপাকিভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা শেষ হওয়ার বছর খানেক আগেই প্রায় ৫০০০ গোর্খাকে নিয়ে গঠন করা হয় রেজিমেন্ট যার নাম দেওয়া হয় 1st King Georges Own Gurkha Rifles। এরপর ক্রমানুযায়ী সেকেন্ড, থার্ড ও বাকি রেজিমেন্ট গুলোও গঠিত হয়। (রেজিমেন্ট হচ্ছে সেনাবাহিনীর একটি দল। মোটামুটি ২০০০-৮০০০ জন সৈনিকের একটি দল নিয়ে একেকটি রেজিমেন্ট গঠিত হয়। একজন কর্নেল বা সমপর্যায়ের অফিসার এর প্রধান হন।)

প্রথম গুর্খা রেজিমেন্ট গঠনের দুবছরের মাথায়ই এদের যুদ্ধের ময়দানে নামানো হয়। ১৮১৭ তে প্রথম গোর্খা রেজিমেন্ট কোম্পানির হয়ে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৮২৬ সালে রাজপুতদের সাথে যুদ্ধে, ১৮৪৬ ও ১৮৪৮ সালে শিখদের সাথে যুদ্ধে এরা কোম্পানির পক্ষে বিজয় ছিনিয়ে আনে। ১৮৫৭ তে সিপাহী বিদ্রোহেও গোর্খারা আনুগত্যের পরিচয় দেয়। ব্রিটিশদের জন্য সেবার গোর্খা রেজিমেন্ট ব্যবহার করা ছিল সবচেয়ে নিরাপদ এবং নির্ভাবনাময়। সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে গোর্খারা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে সার্ভিস দেওয়া শুরু করে।

ব্রিটেনের হোয়াইট হিলের সম্মুখে গোর্খাদের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গোর্খা সৈনিকের মূর্তি; Image Source : alamy.com
ব্রিটেনের হোয়াইট হিলের সম্মুখে গোর্খাদের প্রতি সন্মান প্রদর্শন করে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গোর্খা সৈনিকের মূর্তি; Image Source: Wikimedia

গোর্খারা আসত মূলত নেপালের চারটি সম্প্রদায় থেকে। গুরুঙ, মাগার, রাইস ও লিম্বুস। প্রথম দুটোর বাস ছিল মধ্য নেপালে আর শেষের দুটোর পূর্ব নেপালে। এখন পুরো নেপাল থেকেই গোর্খারা আসে সেনাবাহিনীর নিয়োগ পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। তবুও সিংহভাগ সৈনিক নিয়োগ পায় ঐ চারটি সম্প্রদায় থেকেই। অধিকাংশ গোর্খা সৈনিক হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী হয়। নেপালের ৭৫টি জেলার একটির নাম গোর্খা জেলা। বিকাশ ক্ষেত্রের গণ্ডকী অঞ্চলের এ জেলা গোর্খা সৈনিকদের বসতির জন্য বিখ্যাত।

গোর্খা সৈনিকদের নিয়োগ পরীক্ষা অন্যান্যদের থেকে আলাদা হয়। এ নিয়োগ পদ্ধতি পৃথিবীর অন্যতম কঠিন সৈন্য নিয়োগ পদ্ধতির একটি। ইংরেজি ভাষা ও গাণিতিক যুক্তিতে দক্ষতার পাশাপাশি পদপ্রার্থীদের ডোকো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। কাঁধে পঁচিশ কেজি ওজনের ডোকো বাস্কেট ঝুলিয়ে ৪০ মিনিটে ৫ কি.মি খাড়া পাহাড়ে চড়তে হয়! এটাই বিখ্যাত ‘ডোকো ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ’। সিঙ্গাপুরের পুলিশ বাহিনীতে গোর্খাদের নিয়োগ পরীক্ষা হয় নেপালে। রিক্রুটমেন্ট পরীক্ষার সময় নেপালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসাররা এসে থাকেন। গোর্খারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সৈনিকবৃত্তি পালন করে আসছে। তরুণদের মাঝে তাদের সাহসী পূর্বপুরুষদের অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত রয়েছে। তারা তাদের আইডল।

ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রাপ্ত গোর্খাদের ট্রেনিং হয় ভারতের হিমাচল প্রদেশের সাবাথু অঞ্চলে; Image Source : penfreak.com
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রাপ্ত গোর্খাদের ট্রেনিং হয় ভারতের হিমাচল প্রদেশের সাবাথু অঞ্চলে; Image Source : penfreak.com

গোর্খাদের একটি জাতীয় অস্ত্র আছে। একে তারা ‘কুকরি’ বা ‘খুকরি’ বলে ডাকে। কুকরি হচ্ছে প্রায় ১৮ ইঞ্চির একটি বাঁকানো ছোরা। কাঠ কাটা থেকে শুরু করে যুদ্ধ প্রায় সবক্ষেত্রেই কুকরি ব্যবহার করা হয়। এই কুকরি দিয়েই গোর্খালীরা ব্রিটিশ সৈন্যদের নাস্তানাবুদ করেছিল। কুকরিকে নিয়ে একটি মিথ প্রচলিত আছে। গোর্খার খাপ থেকে কুকরি বের হলে তাকে রক্তপান করিয়ে তবেই ওটাকে আবার খাপবদ্ধ করা যাবে। শত্রুর রক্ত না পেলে বাহকের নিজের রক্তেই রঞ্জিত করতে হবে তাকে।

এখন আর এ প্রথা মানা হয় না। তবুও একজন গোর্খা সৈনিকের পোশাকের আবশ্যিক অংশ হয়ে আছে কুকরি। গোর্খা ড্রেসকোডের আরেকটি আবশ্যিক অংশ গোর্খা হ্যাট। বিখ্যাত ‘গোর্খা হ্যাট’। মাথার ডানদিকে খানিকটা বাঁকা করে পরা হয় টুপিটি। গোর্খারা একটি মটোতে বিশ্বাস করে–

‘কাথার হন্নু ভান্ডা মারনু রামরো।’

‘It is better to die than to be a coward.’

অর্থাৎ, কাপুরুষ হয়ে বাঁচার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।

কুকরি হাতে টুপি পরিহিত একজন গোর্খা সৈনিক; Image Source : gurkhastories.com
কুকরি হাতে টুপি পরিহিত একজন গোর্খা সৈনিক; Image Source : gurkhastories.com

প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গোর্খা রেজিমেন্টগুলো অসামান্য বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ২০০,০০০ নেপালি গোর্খা ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে মোট গোর্খা রেজিমেন্ট ছিল দশটি। প্রথম থেকে দশম গোর্খা রাইফেল নামে। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে ব্রিটেন-ভারত-নেপাল ত্রিপাক্ষিক চুক্তি (Tripartite Agreement) স্বাক্ষর হয়। চুক্তিটির অনেকগুলো দফা ছিল। প্রধানতম দফানুসারে মোট দশটি গোর্খা রেজিমেন্টের চারটি আত্মীকৃত করা হয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। বাকি ছয়টি করা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনীতে। যারা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যায় তাদের বেতন ভাতা দেওয়া হতো ব্রিটিশ সেনাদের সমান আর যারা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে থেকেছিল তাদের দেওয়া হত ভারতীয় সেনাদের সমান। কিছু পরে, ভারত আরো কিছু গোর্খা সৈনিকদের নিয়ে ১১তম গোর্খা রাইফেলস নামক আরেকটি রেজিমেন্ট দাঁড় করায়।

দ্য গোর্খা ব্রিগেড; Image Source : penfreak.com
দ্য গোর্খা ব্রিগেড; Image Source : penfreak.com

১৮৫৭ থেকে এ পর্যন্ত গোর্খা ব্রিগেড মোট ২৬টি ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদক ‘দ্য ভিক্টোরিয়া ক্রস’ লাভ করেছে। তেরোটি পেয়েছে ব্রিটিশ অফিসাররা, তেরোটি নেপালি গোর্খারা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মোট দুজন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মোট দশজন গোর্খাকে ভিক্টোরিয়া ক্রস প্রদান করা হয়েছিল। একেকজন ভিক্টোরিয়া ক্রসপ্রাপ্ত গোর্খার বীরত্বের কাহিনী কিংবদন্তী হয়ে আছে এখনও গোর্খাদের মধ্যে।

ভারতেও বীরত্বের পদক প্রাপ্তির দিক থেকে পিছিয়ে নেই গোর্খারা। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ সামরিক পদক পরম বীর চক্র (Param Vir Chakra) পেয়েছেন এপর্যন্ত ২১ জন যার মধ্যে তিনজন গোর্খা রেজিমেন্টের।

ব্রিটিশরা ও ভারতীয়রা দুই পক্ষই মোটামুটি তাদের সব যুদ্ধে গোর্খা রেজিমেন্টগুলো ব্যবহার করেছে। ভারতের মতো বহুজাতিক রাষ্ট্রে প্রায়ই গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সক্রিয় দেখা যায়। সেরকম ঘটনাগুলোতে ইন্ডিয়ান জেনারেল ও নীতিনির্ধারকগণ গোর্খা রেজিমেন্টগুলোর ব্যবহারই সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে করেন। চীনের ও পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধেও ভারত প্রতিবারই গোর্খাদের এগিয়ে দিয়েছে। নেপালের সাথে ভারতের টানাপোড়ন ও চীনের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য ইন্দো-চীন সীমান্তে গোর্খা রেজিমেন্ট মোতায়েনকে নেপাল ইদানীং ভালো চোখে দেখছে না। প্রায় সাত দশক আগে করা Tripartite Agreement এর প্রয়োজনীয়তা নিয়েও প্রশ্ন তুলছে নেপাল।

Related Articles