Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গ্রাফিতি: অপরাধ নাকি প্রতিবাদ?

সহজ ভাষায় গ্রাফিতি বলতে দেয়ালে আঁকা ছবিকে বোঝায়। গ্রাফিতি হলো সাধারণ কোনো চিত্রকর্ম বা দেয়াল লিখন, যাতে শিল্পীর সূক্ষ্ম বার্তা লুকনো থাকে। দেশে দেশে সামাজিক অবিচার, সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা যুদ্ধের বিরুদ্ধে শিল্পীরা গ্রাফিতির মাধ্যমে তাদের বার্তা সমাজে পৌঁছে দিয়ে থাকেন। শান্তির পক্ষে অবস্থান নেয়ার আহ্বান ফুটে ওঠে কোনো কোনো দেয়ালচিত্রে। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপাত্মক চিত্রের মাধ্যমে সমাজের বাস্তবতাও শিল্পী তার তুলির আঁচড়ে নিখুঁতভাবে তুলে আনেন। মানব সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে গ্রাফিতিও বিকশিত হয়েছে, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমানের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রাচীন গুহাচিত্র থেকে শুরু করে আজকের বাংলাদেশের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা ‘সুবোধ’ পর্যন্ত পথচলায় গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে সাধারণ চিত্রকর্ম থেকে প্রতিবাদের ভাষা।

ব্যাঙ্কসি স্টিভ জবসকে আমেরিকান রিফিউজি হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছেন দেয়ালে © Philippe Huguen 

গ্রাফিতির ইতিহাস বহু পুরনো। প্রাচীন রোম থেকে পম্পেই নগরীর বিভিন্ন সমাধিক্ষেত্রের দেয়ালে গ্রাফিতির চিহ্ন পাওয়া যায়। আধুনিক সময়ে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে গ্রাফিতি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে ‘Kilroy was here’ নামক গ্রাফিতি আমেরিকার দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ে। টাকমাথার লম্বা নাকওয়ালা এক লোক দেয়াল ধরে বসে আছে- এটাই ছিল কিলরয়ের উপজীব্য। সাদামাটা এই গ্রাফিতিটি আমেরিকান সেনাদের ব্যবহারে জার্মানদের ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তারা মনে করে, এটা আমেরিকান সেনাবাহিনীর গোপন কোনো কোড। যদিও আজ পর্যন্ত এর সুপ্ত অর্থ জানা যায়নি। কিলরয় দেয়ালচিত্রে ব্যবহৃত মি. চ্যাড নামক চরিত্রের অবয়ব গ্রিক অক্ষর ওমেগা থেকে অনুপ্রানিত বলে ধারণা করা হয়। কিলরয়ের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুসন্ধান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অস্ত্রের ঝনঝনানির মাঝেও হয়ে উঠেছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

বিশ্বজুড়ে গ্রাফিতি আঁকা হয়েছে গুহা ও ভবনের দেয়াল, রাস্তা, ট্রেনসহ নানা জায়গায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, আর্জেন্টিনা, ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই আছে এই দেয়ালচিত্র বা গ্রাফিতি। বিভিন্ন দেশে গ্রাফিতি আঁকা জনগণের সম্পত্তি বিনষ্টকারী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, আছে বিভিন্ন মেয়াদে সাজার আইনও। তা সত্ত্বেও শিল্পীদের গ্রাফিতি আঁকা থেকে বিরত রাখা যায়নি। অনেক দেশেই নগর কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নেয় নগরের দেয়াল জুড়ে থাকা এসব গ্রাফিতি মুছে দিতে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ থেকে ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে। যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরের মতো দেশেও গ্রাফিতি আঁকার শাস্তি হিসেবে কারাদণ্ডের বিধান প্রচলিত।

বেথেলহামের দেয়ালে আঁকা ‘টার্গেট ডোভ’ © Getty

কর্নব্রেড নামে পরিচিত মার্কিন গ্রাফিতি আর্টিস্ট ডেরিল ম্যাকক্র্যায়কে অনেকেই আধুনিক দেয়াল লিখনের জনক বলে থাকেন। উত্তর ফিলাডেলফিয়ার অধিকাংশ দেয়ালে জুড়ে লেখা আছে তার নাম। মজার ব্যাপার হলো, এর পেছনে একটি প্রেমের কাহিনী আছে। তিনি সিনথিয়া কাস্টাস নামে এক মেয়ের প্রেমে পড়ে এই গ্রাফিতি আঁকা শুরু করেন। এলাকাব্যাপী তার প্রেমের বার্তা পোঁছে দেন ‘Cornbread Loves Cynthia’ নামক দেয়াল লিখন দিয়ে। উৎসাহিত হয়ে তিনি জ্যাকসন ফাইভের জেট বিমানের গায়ে এবং স্থানীয় চিড়িয়াখানার একটি হাতির গায়েও লিখে ফেলেন তার নাম, ফলে তাকে গ্রেফতার করা হয়।

ডেরিল মেকক্র্যায় © Widewalls

ব্যান্ড সংগীতের সাথে গ্রাফিতির সম্পর্ক বেশ পুরনো। রক এন্ড রোল গ্রাফিতির একটি উল্লেখযোগ্য শাখা। সত্তরের দশকে লন্ডনের ইসলিংটন আন্ডারগ্রাউণ্ড স্টেশনের দেয়ালে গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাপ্টনের কোনো অজানা ভক্ত ‘ক্ল্যাপ্টন ইজ গড’ শিরোনামে একটি গ্রাফিতি আঁকেন, যা পরবর্তীতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সত্তরের দশকের ‘পাঙ্ক রক মুভমেন্ট’ নামক আন্দোলনে গ্রাফিতি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। মার্কিন ব্যান্ড দল ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ ম্যানহাটন এলাকায় তাদের নাম ও লোগো সম্বলিত গ্রাফিতি আঁকতে শুরু করে, যা পরবর্তীতে অন্যান্যদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়ে। আশির দশকে ক্রাস নামক ব্রিটিশ ব্যান্ড দল লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনগুলোতে গ্রাফিতির মাধ্যমে সমাজে যুদ্ধ, নৈরাজ্যবাদ এবং পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বার্তা পৌঁছে দিত।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে নানা ধরনের বিখ্যাত সব গ্রাফিতি। পৃথিবীর নামকরা গ্রাফিতি আঁকিয়েদের মধ্যে ‘ব্যাঙ্কসি’ একটি পরিচিত নাম। ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতি মানবতার কথা বলে, ন্যায়ের পক্ষে প্রতিবাদ করে। যদিও ব্যাঙ্কসি কে বা কারা তা বিতর্কিত থেকে গেছে চিরকাল। ব্যাঙ্কসি তার গ্রাফিতিতে ‘স্টেনসিল’ (লেখা বা আঁকার জন্য ছিদ্রযুক্ত পাত) পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ব্যাঙ্কসি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলী দখলদারিত্ব নীতির বিরোধিতা করে গ্রাফিতি এঁকেছেন। সম্প্রতি কলঙ্কিত বেলফোর ঘোষণার ভিত্তিতে স্থাপিত ইহুদিদের জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইলের জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের জন্য তথাকথিত স্বতন্ত্র আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন, যা বেলফোর ঘোষণা নামে পরিচিত। প্রতিবাদী ব্যাঙ্কসি বেথেলহাম পর্যন্ত পৌঁছে গেছেন, তার আঁকা ‘টার্গেট ডোভ’- বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরিহিত সাদা কবুতর মুখে একটি গাছের ডাল নিয়ে যাচ্ছে আর ইসরাইলী স্নাইপারের বন্দুকের ভিউপয়েন্ট তাকে অনুসরণ করছে অবরুদ্ধ পশ্চিম তীরের ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিভেদকারী দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। যেখানে শান্তির দূতেরা জন্মেছেন, সেই জায়গা আজ অশান্তির আগুনে পুড়ছে। তাই তো বেথেলহামের দেয়ালে ব্যাঙ্কসির গ্রাফিতি বলছে, ‘পৃথিবীর উপর শান্তি বর্ষিত হোক’; পাশেই তারকা চিহ্ন দিয়ে লেখা শর্ত প্রযোজ্য।

বাংলাদেশে এতদিন গ্রাফিতি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা ছিল না। কিন্তু বছরখানেক আগে ঢাকার আগারগাঁও এলাকার দেয়ালে আঁকা একটি চিত্রকর্ম সবার মনোযোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মাথা ভরা উস্কখুস্ক লম্বা চুল, রুক্ষ চেহারা, হাতে একটি খাঁচায় বন্দি সূর্য নিয়ে বসে আছে এক যুবক, পাশে লেখা ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, তোর ভাগ্যে কিছু নেই’। পাশে লোগো হিসেবে লেখা ‘হবে কি?’।

কে এই সুবোধ? মানুষের মনে এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সুবোধের কোনো পরিচয় পাওয়া যায় না, পাওয়া যায় না এই গ্রাফিতির শিল্পীরও কোনো হদিস। মানুষের মনে প্রশ্ন জেগে ওঠে- সুবোধ কে? কেনই বা তাকে পালাতে হবে? কী এই চিত্রকর্মের অন্তর্নিহিত অর্থ? কেউ বলছেন সুবোধ সংখ্যালঘুদের দুর্দশা বোঝাচ্ছে, আবার কেউ কেউ বলছেন রাষ্ট্রের নিপীড়নে পিষ্ট জনগণই সুবোধ। ঢাকার এই দেয়ালচিত্র একটি সিরিজ আকারে বিভিন্ন দেয়ালে আঁকা রয়েছে। কোনোটাতে সুবোধ সূর্যবন্দী খাঁচা হাতে পালাচ্ছে, কোনোটায় সে জেলে আর কোনোটায় এক শিশু সুবোধকে জিজ্ঞেস করছে, “কবে হবে ভোর?“। সুবোধ সিরিজটিও ব্যাঙ্কসির আঁকা গ্রাফিতিগুলোর মতো স্টেন্সিল পদ্ধতিতে আঁকা। অনেক স্থানে কে বা কারা যেন মুছে দেওয়ার চেষ্টাও করেছে সুবোধ নামক এই দেয়ালচিত্রটি।

ঢাকার দেয়ালে আঁকা ‘সুবোধ’ © Daily Prothom Alo

সম্প্রতি বাংলাদেশের দেয়ালে দেয়ালে আরও কয়েকটি গ্রাফিতি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। যেমন- রোকেয়া হল আর জগন্নাথ হলের দেয়ালে আঁকা ‘সহমত ভাই’ আর ‘হেলমেট ভাই’। দর্শনার্থীরা ‘সহমত ভাই’কে সম্পর্কিত করছিলেন সমাজে বিদ্যমান তোষামোদকারীদের সাথে, যেখানে তারা ‘হেলমেট ভাই’কে ভাবছিলেন ওই তোষামোদকারীদের পক্ষে কাজ করা নিপীড়ক। এছাড়া বাংলাদেশের মানচিত্রের উপর রিমান্ড কক্ষের বাতি, পাশে লেখা ‘বাংলাদেশ রিমান্ডে’। এই চিত্রটিও ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

হবে কি? © Daily Star

দুনিয়ার প্রতিবাদী মানুষের প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছে এই গ্রাফিতি। সমাজের অন্যায়, অবিচার আর রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি যেন এক সৃষ্টিশীল প্রতিবাদের ভাষা।

Related Articles