Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চীনের সাংস্কৃতিক প্রত্যাবর্তন: ঐতিহ্যের আড়ালে জাতীয়তাবাদী আগ্রাসন!

১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার অবসান ঘটে। ঔপনিবেশিক শাসনতন্ত্রের পর ভারত এবং পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। তারপর দুই দশকের সামান্য বেশি সময় পর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন একটি রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু হয়। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন দমন পীড়নমূলক নীতির প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যে যাত্রা তাতে সাংস্কৃতিক বৈষম্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক ছিল। 

কোনো একটি দেশের মৌলিকত্ব ধ্বংস করতে, তাদের অস্তিত্বকে বিপদের মুখে ফেলে দিতে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার। সংস্কৃতির ধর্ম হচ্ছে, এটি ক্রম বিকাশমান। এটির পরিবর্তন হবেই, সংযোজন হবে নিত্য নতুন উপাদানের, ঘটবে নানা কিছুর বিয়োজন। তবে একটি জাতিসত্তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন করার জন্য সম্ভাব্য সকল অস্ত্রের মাঝে সংস্কৃতির স্বাভাবিক স্ফুরণে বাধা প্রদানের মতো চমৎকার কিছু দ্বিতীয়টি বোধহয় নেই। বাংলা গান, কবিতা, সাহিত্য সর্বোপরি ষোল আনা বাঙালিয়ানা বলতে তখনকার সময়ে যতটুকু বোঝানো হতো সবটুকুর প্রতি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক নিষেধাজ্ঞা জারির মাধ্যমে বাঙালির বিনাশের পথ রচিত হয়েছিল। অর্থাৎ শোষণের একটি হাতিয়ার হিসেবে সংস্কৃতির চর্চায় শাসকের অযাচিত হস্তক্ষেপ প্রকারান্তরে দমন-পীড়নের পথকে সুগম করে দেয়।

এবারে কিছুটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। মূল বিষয়টা সংস্কৃতিই তবে এর দমন না বরং উৎসাহীকরণ। চীনের অধিপতি শি জিনপিং। মিডিয়াতে সাবলীল, বলিষ্ঠ উপস্থিতি; দারুণ বক্তব্য; যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কঠোর-আগ্রাসী মনোভাব; সবটা মিলিয়ে বিশ্ব রাজনীতির তপ্ত ময়দানে এক প্রবল আলোচিত-সমালোচিত ব্যক্তিত্ব। ভালো-খারাপ, নৈতিক-অনৈতিকতা ইত্যাদির সাদা কালো ছাঁচে তাকে আখ্যায়িত করাটা তর্কসাপেক্ষ তবে এ কথা অনস্বীকার্য যে কূটনৈতিকতা বিষয়টি তিনি চমৎকার জানেন! কেন এ কথা বলছি? কিংবা সংস্কৃতির গালগপ্পোর সাথে জিনপিং কীভাবে সম্পর্কিত?

চীনে জাতীয়তাবাদী আদর্শে উজ্জীবিত করার স্বপ্নে বিভোর শি জিনপিং; Image Source: aljazeera.com

চীনে চিং শাসনামলের (Qing dynasty) পূর্বে একটি পোশাকের খুব চল ছিল। চীনে বর্তমানে বসবাসরত সবগুলো জাতিসত্তার মাঝে হ্যান (Han) সম্প্রদায় জনসংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বৃহৎ। ২০০০ সাল থেকে চীনে, অনলাইনে কিছু ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এই প্রথার নবজাগরণ শুরু হয়। পুরোনো এই ফ্যাশনের খুব ক্ষুদ্র পরিসরে শুরু হওয়াকে আখ্যায়িত করা হচ্ছে হানফু মুভমেন্ট হিসেবে। দুই দশকের পরিক্রমায় ফ্যাশনের এই পুনর্জাগরণ শুরুর দিকের চেয়ে বৃহৎ আকার ধারণ করেছে। দেশটির আপামর জনসাধারণের মাঝে এখনও পোশাকের এই ধারাটি স্থান করে নিতে না পারলেও মাঝেমাঝেই চীনের রাস্তায় কিংবা দোকানে কোনো কোনো ভক্তকে দেখা যায় এই পোশাকে। 

চওড়া হাতা এবং ক্রস কলার বিশিষ্ট এসব জামার নাম হানফু অনুসারেই ফ্যাশনের এই ছড়িয়ে যাওয়াকে বলা হচ্ছে হানফু মুভমেন্ট। হানফু শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো হ্যান ক্লদিং অর্থাৎ হ্যান সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যসূচক পোশাক। হানফু পোশাকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, এটি বডি বা ফিগার হাগিং ড্রেস অর্থাৎ যিনি হানফু পরছেন তার দেহের অবয়ব সম্পূর্ণভাবে বোঝা যাবে।

একটি পোশাকের চলকে ঠিক কেন মুভমেন্ট আখ্যা দেওয়া হচ্ছে এই প্রশ্ন পাঠকের মনে আসতেই পারে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে শুধু হানফুকে কেন্দ্র করেই সুনির্দিষ্ট পোশাকের দোকান, নকশাকারক, গবেষক এমনকি আলোকচিত্রের শাখাও গড়ে উঠেছে। একটি হানফু জামার দাম ৩০ থেকে শুরু করে কয়েক হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন গণমাধ্যম চায়না ডেইলির তথ্যানুযায়ী বর্তমানে হানফু শিল্পের স্থানীয় বাজারমূল্য প্রায় ১৫৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। হানফু মুভমেন্টের সাথে সম্পৃক্ত সকলে নিজেদের মাঝে এই লক্ষ্যে ভীষণভাবে যুক্ত। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাব গঠন, নির্দিষ্ট সময় পরপর সভা, ভিন্ন ভিন্ন প্রতিপাদ্যে ফ্যাশন শো এবং নানা রকমের লোকায়ত খেলাধুলার আয়োজন করে থাকেন তারা।

চায়না হানফু অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে ২০০৫ সালে সর্বপ্রথম হানফু সম্মেলন আয়োজিত হয় যেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন মাত্র ৫০ জন। ৫ বছর পর অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাটা বেড়ে ১০ গুন হয় এবং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়োজিত সম্মেলনে অনায়াসে সংখ্যাটা হাজার ছাড়ায়।

বেইজিং শহরে ফ্যাশন শোতে অংশগ্রহণের জন্য তরুণীরা মহড়া দিচ্ছেন; Image Source: edition.cnn.com

হানফু মুভমেন্টের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকের মতে হানফু মূলত চীনের হ্যান সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্যসূচক পোশাক। হ্যান ও হানফু যেন এক অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এই মুভমেন্টকে ঘিরে উৎসাহী অনেকেই এটিকে নিছক একটি পোশাক হিসেবে না দেখে বরং হ্যান সম্প্রদায়ের পুনর্জাগরণ হিসেবে দেখতেই পছন্দ করছেন। শি জিনপিং এর পরিকল্পনা অনুযায়ী পুরো চীনকে এখন কনফুসিয়াসের দর্শনে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রতিটি স্কুলে শিক্ষকদের নির্দেশনা এমনভাবে দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা সকল শিক্ষার্থীকে জীবনের শুরু থেকেই পদ্ধতিগতভাবে একটি সুনির্দিষ্ট মতবাদে বিশ্বাসী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন। চৈনিক সভ্যতা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্যকে এমনভাবে তাদের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে যাতে তারা নিজেদেরকে তো বটেই এমনকি পুরো পৃথিবীকেই চৈনিক ভাবধারার আলোকে দেখতে বাধ্য হয়।

আপাতদৃষ্টিতে জিনপিং এর এই উদ্যোগকে খুব চমৎকার বলে মনে হলেও বিশ্বের অধিকাংশ শিক্ষক-গবেষকদের মতে এটি মূলত উগ্র জাতীয়তাবাদেরই নামান্তর। সাহিত্য, সংস্কৃতি এসব মিষ্টি মধুর কথা বলে মূলত এক-জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছেন সাম্যবাদের এই পরাকাষ্ঠা। 

বেইজিং শহরের একটি অনুষ্ঠানের এক ফাঁকে বিশ্রাম নিচ্ছেন একজন হানফু অনুরাগী; Image Source: edition.cnn.com

মেলবোর্নের মোনাশ ইউনিভার্সিটিতে চাইনিজ স্টাডিজ বিষয়ে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কর্মরত আছেন কেভিন ক্যারিকো। ২০০০ সালে চীনে শুরু হওয়া এই হানফু মুভমেন্টের একজন কট্টর সমালোচক তিনি। হ্যান সম্প্রদায়ের উপর তার রচিত একটি উল্লেখযোগ্য বই হলো দ্যা গ্রেট হ্যান: রেস, ন্যাশনালিজম অ্যান্ড ট্র্যাডিশন ইন চায়না টুডে। হানফু মুভমেন্ট সম্পর্কে তিনি বলেন,

হানফু মুভমেন্ট প্রকৃতপক্ষে সমগ্র চীন জুড়ে হ্যান সম্প্রদায়ের শক্ত ভিত প্রতিষ্ঠা করার একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্ররোচনা। পুরো চীনের ভূখণ্ডে হ্যান সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করার লক্ষ্যেই হানফু পোশাককে এতটা জনপ্রিয় করার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। চীনে স্বীকৃত জাতিসত্তা রয়েছে মোট ৫৬ টি যার মাঝে ৫৫ টিই ক্ষুদ্র জাতিসত্তা এবং একমাত্র বৃহৎ জাতিসত্তা হচ্ছে এই হ্যান সম্প্রদায়। চীনের মোট জনসংখ্যার ৯২% হ্যান সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। জিনপিং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ভালোবাসাকে পুঁজি করে তাদের মাঝে যে উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম দিতে বদ্ধপরিকর তা তিনি বস্তুত হাসিল করছেন ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এসব বুলি আওড়ে। এক-জাতিভিত্তিক স্বাদেশিকতাবোধের যে প্রবল ঢেউ আজ চীনের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে তার ধাক্কা সামলাবে দেশটির প্রতিটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা। নিজেদের সম্ভ্রম, মৌলিকত্ব, বিশ্বাস, ধর্ম, পোশাক সবকিছু হারিয়ে তারা নির্যাতনের শিকার।

জাতিগত প্রান্তিকীকরণ এবং সাংস্কৃতিক দমন-পীড়ন বর্তমানে চীনের একটি তুমুল সমালোচিত পদক্ষেপ। উইঘুরের মুসলিমদের ব্যপক আকারে নির্যাতন কেন্দ্রে চালান করা হচ্ছে শিক্ষা-প্রশিক্ষণের নাম করে। চীন সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে যে উইঘুরের মুসলিমদের মূলত মৌলবাদ বিরোধী জীবনে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উইঘুরের বেশ কিছু ভুক্তভোগীদের বক্তব্য অনুযায়ী হানফু মুভমেন্ট মূলত উগ্র জাতীয়তাবোধের আগ্রাসন ছাড়া আর কিছুই না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এসবকে সামনে রেখে আড়ালে চীনের সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক গণহত্যা চালানো হচ্ছে যাতে করে তারা বাধ্য হয়ে নিজেদের স্বকীয়তাবোধ ছেড়ে হ্যান সম্প্রদায়ের আরও নিকটবর্তী হয়। অন্তর্ভুক্তিকরণ নীতি মোতাবেক উইঘুর অধিবাসীদের সাম্যবাদের সপক্ষে ‘রেড সং’ গাইতে এবং আধুনিক নাচ নাচতে বাধ্য করা হচ্ছে।

চীনের তরুণ সম্প্রদায়ের মাঝে যারা হানফুকে ভালোবাসছেন তারা আবার এই ধারণায় বিশ্বাসী নন। তাদের মতে বিশ্বায়নের যুগে যার যা ইচ্ছে সে তাই পরিধান করার স্বাধীনতা রাখে। ফ্যাশনকে তারা জাতীয়তাবাদের মোড়কে আচ্ছাদিত করার ঘোরতর বিরোধী। পোশাক, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ইত্যাদিকে তারা একান্ত ব্যক্তিগত দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতেই ইচ্ছুক। 

দ্যা গ্রেট হ্যান: রেস, ন্যাশনালিজম অ্যান্ড ট্র্যাডিশন ইন চায়না টুডে বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: amazon.com

হানফু মুভমেন্ট মজ্জাগতভাবেই স্বাদেশিকতাবোধের পরিচায়ক কিনা তা নিয়ে এর পক্ষে বিপক্ষে দু’দিকেই যুক্তি দেখানো যাবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে আপনি আজকে যাকে ফ্যাশন বলে গণ্য করছেন, যা আপনার কাছে একান্তই ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিষয় তা বাস্তবে পুরোটাই ব্যক্তিগতবোধ বা স্বাধীনতা কোনোটারই গান গায় না। হ্যান সম্প্রদায়ের এই উত্থান সময়ের আবর্তে মূলত চীনের একজন আদর্শ (!) নাগরিকের সংজ্ঞাকে চিরতরে পাল্টে দিতে সক্ষম। ব্যক্তির কাছে যে পোশাকটি নিছক আরামের উৎস, স্বাধীনতাবোধের ঝান্ডাধারী, ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্যের পরিচায়ক সেটি প্রকৃতপক্ষে বহু রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ঘটনাবলীর ফলাফল। যুক্তরাজ্যের নর্দামব্রিয়া ইউনিভার্সিটির ফ্যাশন স্টাডিজের অধ্যাপক ওয়েসি লিং এর ভাষ্যমতে,

চীন প্রতি মুহূর্তে একটি রাষ্ট্র হিসেবে সংকুচিত হচ্ছে এর নাগরিকদের অধিকার লাভের প্রেক্ষাপটে। ঘন ঘন জাতিগত বৈচিত্র্য আর সম্প্রীতিবোধের কথা উচ্চারণ করলেই সহযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। রাষ্ট্র পরিচালনার ভার যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ-অভিজাত হ্যান সম্প্রদায়ের হাতেই ন্যস্ত তখন জাতিগত ঐক্য কেবলই একটি স্বপ্ন!

This article is about the Hanfu movement going on in China. The article is written in the Bengali language. All the references are hyperlinked within the article.

Feature Image: edition.cnn.com

Related Articles