জৈবিক তত্ত্ব
জৈবিক তত্ত্ব অনুযায়ী সমাজকে একটি প্রাণীর সাথে তুলনা করা যায়। কোনো প্রাণীর দেহ যেমন কোনো অঙ্গ ছাড়া ঠিকঠাকভাবে কাজ করতে পারে না, ঠিক তেমনিভাবে সমাজও ব্যক্তি ছাড়া আলাদাভাবে টিকে থাকতে পারে না। ব্যক্তি (Individual) সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ব্যক্তি ছাড়া যেমন সমাজ তৈরি হয় না, সমাজ ছাড়াও ব্যক্তিও তেমনিভাবে অসম্পূর্ণ। ব্যক্তি সমাজ ছাড়া স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে পারবে না। এই তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা হার্বার্ট স্পেন্সারের মতে, “সামাজিক কাঠামোকে কোনো প্রাণীর দেহের সাথে তুলনা করা যায়, যেখানে পুষ্টি কাঠামো সমাজের শিল্প ও কৃষি ব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করে, হৃদপিণ্ড, শিরা ও ধমনীর সাহায্যে তৈরি সংবহনতন্ত্র সমাজের যোগাযোগ ও পরিবহণ প্রক্রিয়াকে জানান দেয়, স্নায়ুতন্ত্র একইভাবে সরকারকে প্রতিনিধিত্ব করে, এবং এভাবেই চলতে থাকে।”
হার্বার্ট স্পেন্সারের জৈবিক তত্ত্ব
অনেকের মতে হার্বার্ট স্পেন্সার ঠিক তা-ই করতে চেয়েছিলেন, যা অগাস্ট ক্যোঁৎ করতে চেয়েছিলেন, আর তা হলো সমাজবিজ্ঞানকে বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা। তার ‘ফার্স্ট প্রিন্সিপালস’ বইয়ে স্পেন্সার সর্বপ্রথম জৈবিক তত্ত্বের ধারণা দেন। এ কারণে স্পেন্সারকে বলা হয় ধ্রুপদী বিবর্তনবাদের জনক বা Father of the Classical Evolution। স্পেন্সারের মতে, একটি জীব যেমন শুধু কোষের সমষ্টি নয়, ঠিক তেমনভাবে সমাজ শুধু ব্যক্তির একটি সমষ্টি নয়, বরং এটি তার চেয়েও বেশি।। তিনি সমাজকে জৈবিক প্রাণী হিসেবে ধরে নেন এবং এটকেই প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।
স্পেন্সারের এই জৈবিক তত্ত্বে মূলত প্রাচীন যুগ ও মধ্যযুগের চিন্তাভাবনাই প্রতিফলিত হয়েছে। বিবর্তনের প্রাথমিক সূত্র হিসেবে তিনি সমাজ ও জীবের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে মিল খুঁজতে চেষ্টা করেছেন। স্পেন্সারের মতে, আমরা সমাজকে সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পারবো, যদি আমরা একে জীবের সাথে তুলনা করি।
তার চিন্তাভাবনা অনুযায়ী, সমাজ জীববৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার মতোই, আরো জটিল ও বড়, এবং এর প্রক্রিয়া ও কাঠামোর মধ্যেও মিল রয়েছে। নিম্নোক্তভাবে তিনি সমাজের সাথে জীবের তুলনা করেছেন।
১। বিকাশ ও উন্নতি (Growth & Development): সমাজ ও জীব উভয়েরই বিকাশ এবং উন্নতি ঘটে। এই বিকাশ এবং উন্নতির প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে ঘটে, এবং সরল থেকে জটিলতর হয়। জীববৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে জন্মের সময় জীব এককোষী থাকে, এবং ধীরে ধীরে এটি বিভাজনসহ অন্যান্য প্রক্রিয়ায় জটিল রূপ নিতে থাকে। প্রথমে এর কোনো নিজস্ব কাঠামো থাকে না, তবে ধীরে ধীরে আরো জটিলতর হওয়ার মধ্য দিয়ে এর নিজস্ব কাঠামো দাঁড়িয়ে যায় এবং বিভিন্ন কাজ শুরু করে। সমাজের ক্ষেত্রেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। যেমন: মানব ইতিহাসের শুরুতে গোত্রভিত্তিক আদিম সমাজ এখন রূপ নিয়েছে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায়, এবং তা ধীরে ধীরে বিকাশ ও উন্নতির মধ্য দিয়েই।
২। নির্ভরশীলতা (Dependency): একটি জীবের মধ্যে থাকা অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গ একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এর মানে হচ্ছে, জীবের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। একটি জীবন্ত প্রাণীর বিভিন্ন অংশ আলাদা আলাদা কাজ করলেও একে অপরের সহযোগিতা ছাড়া কাজ করতে পারে না। এবং সবগুলো কাজের সমন্বয়ের মাধ্যমেই সমগ্র দেহ একসাথে কাজ করে। সমাজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সমাজের সকল অংশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়েই সমগ্র সমাজকে একপথে চালিত করে।
৩। সমগ্র সত্ত্বার গুরুত্ব (Importance as a Whole): জীব ও সমাজের একত্রে থাকার ব্যাপারটি স্পেন্সারের দৃষ্টিতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সব অংশ একে অপরের উপর নির্ভরশীল হলেও আমরা অংশগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারবো না যদি আমরা সমাজ ও জীবের সমগ্র সত্ত্বাকে উপর থেকে না দেখি। যদি একটি অংশ নষ্ট বা ধ্বংস হয়ে যায়, তবে সে জায়গায় আবার নতুন অংশের জন্ম হয়। সমগ্র সত্ত্বার গুরুত্বের মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই। এবং এভাবেই চলতে থাকে।
৪। নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র (Centre of Control): জীব ও সমাজ উভয়েরই একটি নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র থাকে। জীবের ক্ষেত্রে এই নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র হচ্ছে মস্তিষ্ক, যেটি জীবের সমগ্র দেহকে পরিচালনা করে। একইভাবে, সমাজের ক্ষেত্রে সরকার বা কর্তৃপক্ষ এই নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। এর বিভিন্ন অংশ তা-ই করে, যা কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রিত হয়।
৫। প্রক্রিয়ার মিল (Similarities between Processes): স্পেন্সারের মতে, জীব ও সমাজের প্রক্রিয়া অনেকটা একইরকম। জীবের মধ্যে যেমন পরিপাক, সংবহন, শ্বসন ঘটে থাকে, তেমনি সমাজের মধ্যেও পরিবহন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, উৎপাদন এবং বিতরণ প্রক্রিয়াগুলো চলতে থাকে।
স্পেন্সার জীব ও সমাজকে ৩টি অংশে ভাগ করেছেন।
অমিলসমূহ:
১। জীবের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একসাথে কাজ করে, কিন্তু সমাজের সব অংশ একসাথে করে না;
২। বিবেক বা চেতনার কেন্দ্রীয়করণ জীবে থাকলেও সমাজে নেই, এর পরিবর্তে সমাজের প্রতিটি অংশের চেতনাজ্ঞান আলাদা;
৩। সমাজের সব অংশ সমাজের ভালোর জন্য কাজ করে না, ক্ষতি করার সম্ভাবনাও থাকে। কিন্তু জীবের ক্ষেত্রে সবসময় জীব নিজের ভালোর কথা চিন্তা করে;
৪। সমাজের অংশগুলো আলাদাভাবে টিকে থাকার সামর্থ্য থাকলেও জীবের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষেত্রে তা নেই।
বিবর্তনের ভারসাম্য ও পর্যায়
স্পেন্সারের মতে, বিবর্তন সীমাহীন নয়, বরং এটি একটি সাম্যবস্থায় পৌঁছায়। তার বক্তব্যানুযায়ী, “There is a tendency towards the attainment of an equilibrium or balance.” এই সাম্যবস্থায় মোট ৩টি পর্যায়ে ঘটে থাকে। পর্যায়গুলো হলো:
পর্যায়-১: সমাজ ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য;
পর্যায়-২: একটি সমাজের সাথে অন্য সমাজের ভারসাম্য;
পর্যায়-৩: সমাজের বিভিন্ন দল ও শক্তির মধ্যে ভারসাম্য।