বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় কী? এই প্রশ্নের বিপরীতে যে উত্তর আপনি পাবেন তা হচ্ছে 'করোনাভাইরাস'। চীনের উহান প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে যাওয়া এই ভাইরাস আতঙ্ক ছড়াচ্ছে পুরো বিশ্বে। বিজ্ঞানের এখনও যে বহু পথ পাড়ি দেওয়া বাকি, তার স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে এই ভাইরাসটি। সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, যিনি কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বেষ্টনীর ভেতরে থাকেন, তিনি থেকে শুরু করে খোলা রাস্তায় রাত্রিযাপন করা হতভাগা ব্যক্তিটিও নিরাপদ নয় এই ভাইরাস থেকে। 'বৈশ্বিক মহামারি'র আকার ধারণ করা এই ভাইরাস নিয়ে তাই পৃথিবীব্যাপী সবচেয়ে বেশি আলোচনা হওয়াটা কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়।
চীনের পর যে দেশগুলোতে নভেল করোনাভাইরাস সবচেয়ে বেশি হানা দিয়েছে তার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম। এ দেশটিতে খুব দ্রুত করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। কিন্তু অন্যান্য দেশগুলোর সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার পার্থক্য হলো দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষ সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ার পাশাপাশি ইরান ও ইতালি, এই দুটি দেশ করোনাভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতালিতে মৃত্যুর উচ্চহার দেখা যাচ্ছে। ইতালিতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে বোনের মৃত্যুতে ভয়ে কেউ তার মৃতদেহের সৎকারে এগিয়ে আসছে না, ভাই লাইভে এসে কান্নাকাটি করছে– এরকম একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তা পুরো বিশ্ববাসীকেই আবেগী করে তুলেছে। আর ইরানে ধর্মীয় নেতা থেকে সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। আল-জাজিরার দেওয়া তথ্যমতে ইতোমধ্যেই ইরানের ১২ জন সরকারি কর্মকর্তা মারা গিয়েছেন, আরও ১৩ জন আক্রান্ত হয়ে কোয়ারেন্টিনে আছেন।
দক্ষিণ কোরিয়ায় কোভিড-১৯ সবচেয়ে বেশি ছড়িয়েছে দায়েগু শহরে। দেশটির অন্য যেকোনো শহরের চেয়ে এই শহরে করোনা সংক্রমণের হার অনেক বেশি।
পুরো দক্ষিণ কোরিয়ায় যারা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের শিকার হয়েছেন, তাদের ৬৩.৫% মানুষই কোনো না কোনোভাবে 'শিনচেওনজি'র সাথে সম্পর্কযুক্ত।
শিনচেওনজি হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ায় খ্রিস্ট ধর্মের একটি সেক্ট, যাদের নিজস্ব কিছু রীতিনীতি আছে। মূলধারার খ্রিস্টানদের সাথে এদের বিরোধ রয়েছে। এই সেক্টের অনুসারীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। দক্ষিণ কোরিয়ার বাইরেও এদের অসংখ্য অনুসারী রয়েছে।
শিনচেওনজি ধারার প্রবর্তক লি ম্যান-হি নামে এক ব্যক্তি, যার বর্তমান বয়স ৮৮ বছর। তিনি ১৯৮৪ সালে খ্রিস্টধর্মের এই ধারার প্রবর্তন করেন।
লি ম্যান-হি তার অনুসারীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এক ব্যক্তিত্ব। জানা যায়, তিনি ছোট থেকেই অত্যন্ত ধার্মিক ছিলেন। অনেক অনুসারী বলে থাকেন, তিনি এ যুগে যিশু খ্রিস্টের প্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। আবার অনেকে বলেন, কয়েকশো বছর আগে যারা দক্ষিণ কোরিয়া শাসন করতেন, লি ম্যান-হি তাদেরই বংশধর। তার জন্মস্থানে প্রতিবছর তার অনুসারীরা ভ্রমণ করেন।
শিনচেওনজি ধারার নিজস্ব রীতি করোনাভাইরাস ছড়িয়ে যেতে খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। গোপনীয়তা রক্ষা করা, একসাথে অনেকের কাছাকাছি বসে প্রার্থনা, প্রার্থনার সময় মাস্ক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি রীতি করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে যেতে মূল ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করে দক্ষিণ কোরিয়ার জনগণ ও গণমাধ্যম।
সিউল শহরের মেয়র করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য সম্পূর্ণভাবে শিনচেওনজি চার্চের নেতাদের দায়ী করেছেন। তার মতে, চার্চের অনুসারীরা করোনা সংক্রমণ সম্পর্কে জানার পরেও টেস্ট এড়িয়ে গেছে। আর তারা কর্তৃপক্ষকে করোনার বিস্তার প্রতিরোধে কোনো সাহায্য করেনি।
প্রার্থনার ব্যাপারে শিনচেওনজি চার্চগুলো খুব কড়া ভূমিকা পালন করে। অসুস্থ হলেও চার্চের প্রার্থনা থেকে অনুসারীদের রেহাই দেয়া হয় না– সাবেক অনুসারী দুহিয়েন কিম এমনটাই নিশ্চিত করেছেন সিএনএনকে। তিনি আরও বলেন, "এখানকার (শিনচেওনজি চার্চের) সংস্কৃতিটাই এমন যে, আপনি যদি প্রচন্ড অসুস্থতার জন্য রবিবারে আসতে না পারেন, তবে সোমবার বা মঙ্গলবারে এসে রবিবারের প্রার্থনায় অংশ না নেয়ার প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে।"
শিনচেওনজি চার্চে প্রার্থনা চলে কয়েক ঘন্টা ধরে। এই সময় অনুসারীরা পাশাপাশি খুব অল্প দূরত্বে মেঝেতে বসে থাকে। তাদের কোনো প্রকার মাস্ক কিংবা চশমা পরতে দেয়া হয় না, এমনকি কোভিড-১৯ এর এই মহামারির সময়ও পরতে দেয়া হয়নি। শিনচেওনজি কর্তৃপক্ষ মনে করে, মাস্ক পরলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অশ্রদ্ধা করা হয়।
এই চার্চের অনুসারীরা আবার মনে করে, তাদের অন্যায়ভাবে একতরফা করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য দায়ী করা হচ্ছে। চার্চের একজন অনুসারীর দাবি, "মিডিয়া এমনভাবে খবর প্রকাশ করছে যেন আমরাই করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী। আর এর ফায়দা তুলছে রাজনৈতিক নেতারা।"
শিনচেওনজি চার্চের সর্বোচ্চ নেতা লি ম্যান-হি ২৬ ফেব্রুয়ারি তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে একটি বার্তায় দাবি করেন, তাদের গ্রুপ সক্রিয়ভাবে সরকারকে সাহায্য করছে যাতে ভাইরাস না ছড়ায়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনায় আক্রান্তের ৩১ তম কেস রেকর্ডের আগে সবকিছু ঠিকমতোই চলছিলো। কিন্তু 'পেশেন্ট নাম্বার ৩১' কেসের পর থেকে সব ভন্ডুল হয়ে যায়। গণহারে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হতে থাকে।
সিউল ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন মহামারি বিশেষজ্ঞ জানান, "৩১ নাম্বার পেশেন্টের কেস রেকর্ডের আগে আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী সবকিছু ঠিকমতোই হচ্ছিল। কিন্তু সেই কেসের পর থেকে সব কিছু পাল্টে যায়।"
'পেশেন্ট নাম্বার ৩১' ছিলেন একজন ৬১ বছর বয়সী মহিলা, যিনি কোভিড-১৯ এর উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও দুবার ভাইরাস টেস্ট করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তার শরীরের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হওয়ার পরও তিনি চারবার শিনচেওনজি চার্চে গিয়েছিলেন। সেই মহিলার টেস্টে করোনাভাইরাস 'পজিটিভ' ধরা পড়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রচুর 'কোভিড-১৯ পজিটিভ' কেস আসা শুরু করে।
এই 'পেশেন্ট নাম্বার ৩১' কেস ছাড়াও আরেকটি ঘটনা দেশটিতে ভাইরাসের বিস্তারে মূল ভূমিকা পালন করেছে। একজন শিনচেওনজি নেতার মৃত্যুর পর তার শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে প্রচুর লোকের সমাগম হয়। এই জমায়েতের পরে করোনাভাইরাস সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়।
তবে অন্য দেশগুলোর তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়ায় মৃত্যুহার অনেক কম। ইরান ও ইতালির তুলনায় মৃত্যুহার কম রাখার ব্যাপারে দক্ষিণ কোরিয়া দারুণ দক্ষতা দেখিয়েছে। নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর দক্ষিণ কোরিয়া 'শুরুতেই নির্ণয় করো' নীতি প্রয়োগ করা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে প্রায় দুই লাখ ব্যক্তিকে টেস্টের আওতায় আনা হয়েছে। প্রতি মিলিয়নে ৩,৬৯২ জন ব্যক্তিকে দক্ষিণ কোরিয়া টেস্টের আওতায় এনেছে, যেখানে আমেরিকা আনতে পেরেছে মাত্র ২৩ জনকে!
এই শুরুতেই নির্ণয় করার যে নীতি, তার সুফল হাতেনাতে পেয়েছে দক্ষিণ কোরিয়া। তাদের মৃত্যুহার ও সংক্রমণের হার আশাব্যাঞ্জকভাবে কমে এসেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতে, "শুরুতেই নির্ণয় করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুরুতে নির্ণয় করতে পারলে আপনি একইসাথে সংক্রমিত ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টিনে পাঠিয়ে বাকিদের বাঁচাতে পারবেন, সাথে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিতে পারবেন।"
এছাড়াও করোনার বিস্তার প্রতিরোধে আরেকটি বিষয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে৷ দক্ষিণ কোরিয়া প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে এ সম্পর্কিত সকল তথ্য জনগণের সামনে তুলে ধরেছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ফোন ট্র্যাকিং করে তারা কোথায় কোথায় গিয়েছিল, সেসব জায়গা অ্যাপের মাধ্যমে জনগণকে দ্রুততার সাথে জানানো হয়েছে। ফলে সেসব স্থানে না যাওয়ার মাধ্যমে ভাইরাসের বিস্তার রোধ করা গিয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রথমদিকে প্রচুর নভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তির খবর পাওয়া গেলেও, বর্তমানে তা কমে এসেছে। অনেক শিনচেওনজি চার্চও বন্ধ করা হয়েছে এই ইস্যুতে। ভাইরাস প্রতিরোধে দক্ষিণ কোরিয়ার সাফল্য অনুপ্রাণিত করছে অনেক দেশকেই।
This is a bengali article discussing how covid-19 spread in South Korea.
References:
১) Shincheonji and coronavirus: The mysterious 'cult' church blamed for S Korea's outbreak
২) Being Called a Cult Is One Thing, Being Blamed for an Epidemic Is Quite Another
৩) How novel coronavirus spread through the Shincheonji religious group in South Korea
৪) 'Patient 31' and South Korea's sudden spike in coronavirus cases
৫) What we can all learn from South Korea’s 'super spreader' of coronavirus, Patient 31
৬) MORE INFO ABOUT PATIENT 31 IN SOUTH KOREA EMERGES & PEOPLE ARE NOW CALLING HER ‘CRAZY AJUMMA’
৭) South Korea’s coronavirus success story underscores how the U.S. initially failed
৮) Secretive church at center of South Korea's explosive coronavirus outbreak
Feature Image: ABC News