Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মানবজাতিকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করতে কতগুলো পারমাণবিক বোমা প্রয়োজন?

পৃথিবীর বুকে ধ্বংসের প্রতিভূ হিসেবে উচ্চারিত অন্যতম নাম পারমাণবিক অস্ত্র। মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ এই বিধ্বংসী হাতিয়ারগুলোর একেকটিই একটি পুরো শহরকে ধ্বংস করতে পারে, হত্যা করতে পারে লক্ষ লক্ষ মানুষ, প্রাকৃতিক পরিবেশকে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত করার পাশাপাশি এর দীর্ঘমেয়াদী ভয়ঙ্কর আগ্রাসন পরবর্তী প্রজন্মগুলোতে ভয়ানক প্রভাব ফেলে। আর তাই পারমাণবিক অস্ত্রসমূহের সাথে জড়িত ঝুঁকির উৎপত্তিই ঘটে পৃথিবীতে এগুলোর অস্তিত্বের সূত্রপাত থাকে।

হিরোশিমা ও নাগাসাকির কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? ১৯৪৫ সালে শহর দুটির উপরে চালানো এই ভয়ঙ্কর পারমাণবিক হামলাই যুদ্ধকালীন এই ধরনের অস্ত্রের ব্যবহারের একমাত্র নিদর্শন। এখন পর্যন্ত মাত্র দুবার সামরিকভাবে এগুলোকে ব্যবহার করা হলেও, পৃথিবীতে মোট পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা প্রায় ২২,০০০টি এবং অদ্যাবধি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর উদ্দেশ্যে ঘটানো মোট পারমাণবিক বিষ্ফোরণের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি! এ সকল হাতিয়ারের ভয়াবহতার থেকে পরিত্রাণ পাবার একমাত্র উপায় এগুলোকে ‘অকেজো বা নিষ্ক্রিয় করে ফেলা’ হলেও, এই লক্ষ্য অর্জন করা বর্তমানে কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে।

বিভিন্ন জরিপ মতে, বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি পারমাণবিক অস্ত্র পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে। পৃথিবীর মোট ১৯৬টি দেশের মধ্যে মাত্র ৯টির এখতিয়ারে পারমাণবিক অস্ত্রসমূহ রয়েছে। পৃথিবীতে অবস্থিত এ সকল পারমাণবিক হাতিয়ারের শতকরা ৯০ ভাগেরও বেশি দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মালিকানাধীন।

পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে বিশ্বের মাত্র ৯টি দেশে; Image Courtesy: Maksimilian/Shutterstock

পারমাণবিক অস্ত্রের সমাহারকে ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশে ব্যবহার করা মানবজাতি কি সত্যিই ভেবে দেখেছে যে, একটি সামান্য পারমাণবিক দ্বন্দ্ব, ধরে নেয়া যাক এমন ধরনের যা পৃথিবীর মোট পারমাণবিক অস্ত্রের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশকে ব্যবহার করবে, পৃথিবীর জলবায়ুর ওপর কী প্রলয়ঙ্করী প্রভাব ফেলবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত করবে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি মানুষকে? পৃথিবীর বুকে একসময় ঘটে যাওয়া স্নায়ুযুদ্ধের অগ্নিতাপ অনেক আগেই নির্বাপিত হলেও পৃথিবী আজ নিজেকে আবিষ্কার করছে ক্রমবর্ধমান অশান্তি ও সংশয়ময় এক যুগে, যেখানে মানুষ হাতে ধরে বসে আছে স্বীয় ধ্বংসের দামামা। এই আলোকে ‘সেফটি‘ নামক গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বাস্তবিকপক্ষে যাচাই করা হয়েছিল কোনো একটি নির্দিষ্ট দেশ বা জাতির সঞ্চিত অস্ত্রভাণ্ডারে ঠিক কতটি পারমাণবিক অস্ত্র থাকা সমীচীন। অস্ত্রসংখ্যার সর্বোচ্চ সীমা নিরুপণে তাদের করা হিসেব অনুযায়ী সেই সংখ্যাটি হলো ১০০। এই সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র এখতিয়ারে থাকলেই এ সংক্রান্ত সব রকম ‘রাজনৈতিক সুবিধা’ পাওয়া সম্ভব, আর এর থেকে বেশি সংখ্যক হলে তার পরিণাম হতে পারে ভয়ঙ্কর, এমনকি যে দেশের পক্ষ থেকে অস্ত্রটি নিক্ষেপিত হবে সেই দেশের জন্যও।

সংক্ষেপে বলা যায়, যদি কোনো দেশ বা জাতির কাছে ১০০টির বেশি পারমাণবিক অস্ত্র থাকে, তাহলে তাদের স্বীয়-নিক্ষেপিত অস্ত্রসৃষ্ট আগ্রাসী পরিণামের জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত। “১০০টি পারমাণবিক অস্ত্রের সীমারেখার মধ্যে অবস্থান করাকালেও প্রতিপক্ষের ওপর নিউক্লীয় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা যাবে, কিন্তু সেই সাথে এই বিস্ফোরণের ফলে তৈরি ‘নিউক্লীয় হিম’ থেকে নিজেদের লোক মারা যাবার ঘটনাটি ঘটবে না।”- মিশিগান টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জশুয়া পিয়ার্স তার এক বিবৃতিতে এটিই বলেন। তার মতে, “৯/১১ এর দুর্ঘটনার পর প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়কৃত অর্থের পরিমাণই জানান দেয় আমরা আমেরিকানদের সুরক্ষা দিতে সচেষ্ট, তবে যদি আমরা কোনো জাতির বিরুদ্ধে ১০০০টি পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করি এবং কেউ ফিরতি আক্রমণ না করে, ৯/১১ এর ঘটনার তুলনায় প্রায় ৫০গুণ বেশি আমেরিকানের মৃত্যুর সাক্ষী হবো আমরা- আর সেটা আমাদের নিজস্ব হাতিয়ারেরই প্রতিক্রিয়াবশত ঘটবে।”

বর্তমানে পারমাণবিক অস্ত্রযুক্ত জাতিগত হিসেব অনুসারে, যদি এই প্রস্তাবনাটি মেনে চলা হতো, তাহলে পৃথিবীর মোট পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা হতো ৯০০টি বা তার থেকেও কম। যদিও বর্তমান অবস্থা দেখে মনে হয় আমরা সেই অবস্থান থেকে এখনো অনেক অনেক দূরে রয়েছি।

শিল্পীর তুলিতে পারমাণবিক বিস্ফোরণ; Image Source: Shutterstock

কোন কোন দেশের রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র?

সূত্রমতে, পৃথিবীতে অবস্থিত মোট ‘কার্যকরী’ পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ১৫,০০০। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দখলেই রয়েছে প্রায় ১৪,০০০ এর কাছাকাছি হাতিয়ার। বাকিগুলো সাতটি অন্যান্য পারমাণবিক অস্ত্রধর দেশের মধ্যে বিভক্ত। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য আছে (২১৫), ফ্রান্স (৩০০টি), চীন (২৭০), ভারত (১২০), পাকিস্তান (১২০), ইসরায়েল (৮০) এবং উত্তর কোরিয়া (<১০)। পারমাণবিক অস্ত্রের সম্প্রসারণ না করার মধ্যস্থতার চুক্তিপত্র অনুযায়ী আনুষ্ঠানিকভাবে চিহ্নিত পৃথিবীর ৫টি পারমাণবিক অস্ত্রধর রাষ্ট্রসমূহ হচ্ছে চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্র। এই চুক্তি তাদের অস্ত্রাগার সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখে এবং সেটিকে বৈধতা দেয়, কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী উল্লিখিত রাষ্ট্রসমূহ এগুলোকে চিরন্তনভাবে সংরক্ষণ কিংবা প্রস্তুতির মান্যতা দেয় না। উল্লিখিত রাষ্ট্রসমূহ অস্ত্রগুলোকে নির্মূল করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। পাকিস্তান, ভারত, ইসরায়েল ও উত্তর কোরিয়া এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেনি। দেশগুলোর কাছে থাকা মোট পারমাণবিক অস্ত্রের সংখ্যা ৩৪০টি।

ইতোপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, এখন পর্যন্ত রাশিয়া (৭,০০০) এবং যুক্তরাষ্ট্রের (৬,৮০০) কাছেই রয়েছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রের ভান্ডার। যৌথভাবে পৃথিবীর শতকরা ৮৮ ভাগ সঞ্চিত পারমাণবিক অস্ত্রের মালিকানা তাদের অন্যান্য দেশের ওপর আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে। তবে পরিত্যক্ত অস্ত্রগুলোর কথা হিসেবে আনলে এ সংখ্যাটি বেড়ে শতকরা ৯৩ ভাগে গিয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ব রাজনীতিতে পারমাণবিক অস্ত্রসংক্রান্ত অস্থিতিশীলতা আরো বেড়ে যায় যখন উত্তর কোরিয়া সফলভাবে হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে বলে দাবি করে। উত্তর কোরিয়ার সামরিক ক্ষমতাকে ঘিরে সৃষ্ট সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যের সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে উচ্চারিত জোরালো ইঙ্গিতবহ বাক্য সেই উত্তপ্ততারই বার্তাবাহী।

পিয়ং ইয়ং (উত্তর কোরিয়ার রাজধানী) কর্তৃপক্ষের মিসাইল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিরক্ষা বিষয়ক সচিব জিম ম্যাটিস ইতোপূর্বেই উত্তর কোরিয়াকে হুঁশিয়ার করেছেন এই মর্মে যে, যদি পিয়ং ইয়ং পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের দুঃসাহস দেখায়, তাহলে তার ‘কার্যকরী ও ধ্বংসাত্মক’ প্রত্যুত্তর দেয়া হবে। এদিকে পৃথিবীর অন্যত্র পারমাণবিক অস্ত্রাগার পুনঃসম্প্রসারণের বাচনিক আভাস পাওয়া গেছে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসেই প্রতিরক্ষা প্রধানদের সাথে বসা এক বৈঠকে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন জানান দেন, ২০১৭ সালের করণীয় মুখ্য লক্ষ্যগুলোর একটি হচ্ছে পারমাণবিক সামর্থ্যকে আরো জোরদার করা। তারই প্রতিক্রিয়ায় টুইট করে ডোনাল্ড ট্রাম্প জানান দেন, তিনিও একই পন্থা অবলম্বন করতে চলেছেন।

এসকল বক্তব্যগত ইঙ্গিতসমূহ পৃথিবীতে অবস্থিত মোট পারমাণবিক বোমার সংখ্যা এবং এ সকল বোমার মালিকানাভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর হর্তাকর্তাদের কৌশলী পদক্ষেপসংক্রান্ত অনিশ্চয়তা গোটা পৃথিবীজুড়ে উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, প্রকৃত সমস্যা উপলব্ধি করার মতো ‘হুঁশে আসা’ থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে বর্তমান পৃথিবী; সামরিক বাহিনীর কাছে গচ্ছিত লক্ষ লক্ষ কিলোটনী পারমাণবিক অস্ত্র তারই নিদর্শন।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের টুইট; Image Source: twitter.com

ইতোপূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, কার্যকরী মোট ১৫,০০০ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকাংশই যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দখলে, বাকিগুলো অন্যান্য রাষ্ট্রের এখতিয়ারাধীন। আর্মস কন্ট্রোল অ্যাসোসিয়েশনের হিসেব মতে, এগুলোর মধ্যে ১০,০০০ এর কম সংখ্যক অস্ত্র সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে, বাকিগুলো অকার্যকরকরণ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাবার অপেক্ষায় আছে।

‘মাত্র’ ১০০টি পারমাণবিক অস্ত্রই কেন?

বলা হয়, এর থেকে বেশি সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা হলে তার ফলবশত এমন এক ঘটনাক্রম আরম্ভ হবে যে, পৃথিবীর জন্য তা বয়ে আনবে ভয়াবহ দুর্যোগ! এমনকি সেই দেশটির জন্যও, যেখান থেকে অস্ত্রগুলো ছোঁড়া হয়েছে। কোনো দেশের পক্ষ থেকে একশোর বেশি পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপিত হলে তা থেকে সৃষ্ট হবে ‘নিউক্লীয় হেমন্ত’র এবং তা গড়াবে ‘নিউক্লীয় শীতলতা’য়, যার ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমে যাবে, কেননা পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট রাসায়নিক ধোঁয়া সূর্যের আলোকে পৃথিবীপৃষ্ঠে পৌঁছতে বাধা দেবে। এতে করে অতিবেগুনি রশ্মির তেজস্ক্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে এবং ফলে ওজোন স্তরের ক্ষতি হয়ে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যাবে, যার পরিণামে কৃষিকাজ থমকে যাবে এবং দ্রুত দেখা দেবে খাদ্য সংকট।

জশুয়া পিয়ার্সের মতে, “আমার মনে হয় না (সমস্যার সমাধানকল্পে) রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণে খাদ্যগ্রহণ প্রক্রিয়া ভালোমতো এগোবে। ক্যালরির অভাবজনিত কারণে মারা যাবার তুলনায় অভ্যন্তরীণ দাঙ্গায় আরও বেশি সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটবে” এবং এখান থেকে সমস্যা আরো ঘনীভূত হওয়া শুরু করবে। সহিংসতা, দাঙ্গা, অভ্যন্তরীণ বিপ্লব এবং আন্তর্জাতিক যুদ্ধের পেছনে ইন্ধন হিসেবে কাজ করবে খাদ্যাভাব। সর্বেসর্বাভাবে এই গবেষণা থেকে পারমাণবিক যুদ্ধের অন্ধকার পরিণতিই উঠে এসেছে।

পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারগুলোর বহুলাংশে হ্রাসের পাশাপাশি, গবেষকগণ এই করুণ পরিণতি আটকাতে নীতিগত প্রস্তাবনাও দাবি করেছেন। পিয়ার্সের মতে, “বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার তৈরি করা যৌক্তিক নয়, যেগুলোর ব্যবহারমাত্র আপনার দেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হতে পারে।” “অন্যান্য দেশের অবস্থা আরো শোচনীয়। যদি তারা অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রও নিক্ষেপ করে এবং তাদের ওপর কোনো পারমাণবিক অস্ত্র আঘাত না হানে ও হামলার প্রত্যুত্তরে তাদের ওপর কোনো প্রতি-আক্রমণও না হয়, তবুও উত্তর কোরিয়া এবং ইসরায়েলের ভাগ্যে যা ঘটবে তা হলো ‘জাতীয়ভাবে আত্মহত্যা’র শামিল।”

মানব সম্প্রদায়কে চিরতরে বিলুপ্ত করতে ঠিক কতটি পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজন?

গার্ডিয়ান ডাটাব্লগ ও বুলেটিন অফ এটমিক সায়েন্টিস্টস এর তথ্য মোতাবেক, পৃথিবীর শতকরা ১২.৫ ভাগেই মানুষের বসতি আছে, যার পরিব্যাপ্তি ১৮,৬১৭,৫০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে।

পৃথিবীর স্থলভাগ ও এর মানব অধ্যুষিত অঞ্চল; Image Source: David McCandless

এদিকে, বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম শক্তিশালী কার্যকরী পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রটি হচ্ছে বি-৮৩, যার রয়েছে হিরোশিমার অংশভাগ ধ্বংসকারী বোমা ‘লিটল বয়’ থেকেও ২০০ গুণ বেশি ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা। আর সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকাটির ব্যাপ্তি হবে ১৪.৯ বর্গ কিলোমিটার। চারিদিকে অন্ধকার হয়ে দৃষ্টিসীমার মধ্যে থাকা সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে, তৎক্ষণাৎ পুরোপুরি আঁধারে ছেয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দৃষ্টিসীমার সবকিছুই আড়াল হয়ে যাবে। যদি এই ধ্বংসযজ্ঞ চলা এলাকা সম্পর্কে ধারণা দিতে হয়, তাহলে অন্য এলাকার সঙ্গে সীমানাগত আয়তনের তুলনা করলেই বোঝা যাবে, যেমন- ম্যানহাটন আয়তনে ৫৮.৮ বর্গ কিলোমিটার এবং সেন্ট্রাল লন্ডন ২৬ কিলোমিটার।

বি-৮৩ পারমাণবিক বোমার ধ্বংসক্ষমতা; Image Source:  David McCandless

এখন বর্গ কিলোমিটার এককে এই সমগ্র আয়তনকে বি-৮৩ এর ধ্বংসসীমার ব্যাসার্ধ দিয়ে ভাগ করলে মানবজাতির তাৎক্ষণিক বিনাশে ঠিক কতটি বি-৮৩ প্রয়োজন তা জানা সম্ভব। আর তা হলো বর্তমানে যতটি পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে তার ৮২.৭৪ গুণ, যেখানে এক মিলিসেকেন্ডে আমাদের মানবজাতির প্রত্যেককে ছিন্নভিন্ন করতে প্রয়োজন ১,২৪১,১৬৬টি পারমাণবিক অস্ত্র, যার বিপরীতে পৃথিবীতে বর্তমানে রয়েছে ১৫০০০ এর মতো।

মানবসভ্যতাকে চিরতরে ধ্বংস করতে কয়টি পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োজন? Image Source:  David McCandless

গ্রাফিক ডিজাইনার ম্যাক্সিমিলান বোডের চমৎকার গ্রাফিক হিসেব থেকে দেখা যায়, পুরো সানফ্রানসিস্কো এবং সমগ্র পৃথিবীর সবকিছু নাশ করতে বিভিন্ন আকারের নানা পারমাণবিক অস্ত্রগুলোর ঠিক কতটি করে প্রয়োজন। সত্যি বলতে, এর দুটোই খারাপ, একটি তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই।

বর্গ মাইল এককে পৃথিবী, এর নানা অঞ্চল ও চাঁদের আয়তন; Image Source: gizmodo.com

প্রথমে ‘লিটল বয়’ এর কথাই ধরা যাক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মানবজাতির দ্বারা সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হওয়া এ অস্ত্রটির মাত্র চারটিই সমগ্র ডিসির চিহ্ন মুছে ফেলতে সক্ষম এবং পুরো পৃথিবীকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে প্রয়োজন ৩.৫ মিলিয়নের বেশি সংখ্যক ‘লিটল বয়’।

লিটল বয়ের ধ্বংসক্ষমতা; Image Source: gizmodo.com
ফ্যাট ম্যানের ধ্বংসক্ষমতা; Image Source: gizmodo.com

কিন্তু সময় বদলেছে, সেই সাথে আরো বদলেছে পারমাণবিক অস্ত্রের কার্যকারিতা। লিটল বয়ের ধ্বংসাত্মক ফলাফলে শিউরে ওঠা পৃথিবীর বুকে এখন লিটল বয়ের চেয়েও শক্তিশালী সংস্করণ বিদ্যমান। প্রথমে, যুক্তরাষ্ট্রের পরীক্ষা চালানো পারমাণবিক বোমা ‘আইভি কিং’ এর কথাই ধরা যাক। এটি ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনার ব্যাপারে লিটল বয়ের চেয়ে সামান্য বেশি দক্ষ। পুরো উত্তর আমেরিকাকে ধূলিসাৎ করতে মোট ৫৫,০০০ আইভি কিং ও কিছু পরিবর্তন প্রয়োজন। 

আইভি কিংয়ের ধ্বংসক্ষমতা; Image Source: gizmodo.com

এবার বি-৫৩ এর কথাই ধরা যাক, আমেরিকার তৈরি লিটল বয়ের ৬০০ গুণ বড় এই বোমাটি অবশ্যই কার্যকরীভাবে বেশি শক্তিশালী। 

বি-৫৩ এর ধ্বংসক্ষমতা; Image Source: gizmodo.com

‘ক্যাসল ব্রাভো’ থার্মোনিউক্লিয়ার হাইড্রোজেন বোমাও কিছু অংশে কম না, এর ৯,০০০টিই চাঁদে যা কিছু আছে তা ধ্বংস করতে সক্ষম।

ক্যাসল ব্রাভোর ধ্বংসক্ষমতা; Image Source: gizmodo.com

এবং ‘জার বম্বা’- রাশিয়ায় তৈরি মানবজাতির এখন পর্যন্ত ডেটোনেট করা সর্ববৃহৎ এ পারমাণবিক বোমাটির কথা না বললেই নয়। বলা হয় এটি পারতপক্ষেই ডেকে আনতে পারে পৃথিবীর প্রাণীকূলের অন্তিম দিবস। মাত্র ১৬,০০০টি জার বম্বা পুরো পৃথিবীকে টোস্ট করার জন্য যথেষ্ট।

জার বম্বার ধ্বংসক্ষমতা; Image Source: gizmodo.com

এ কথা না বললেই নয় যে, পৃথিবীর পতন সংক্রান্ত এই হিসেবগুলোর প্রত্যেকটিই তেজস্ক্রিয় ধূলিকণাসহ অন্যান্য পরিবেশগত প্রভাব ব্যতিরেকে শুধুমাত্র বর্গ কিলোমিটার এককে ধ্বংসসীমার হিসেব করা। কাজেই  প্রকৃতপক্ষে মানবজাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে এই হিসেবগুলোতে উল্লেখিত সংখ্যার চেয়ে কম সংখ্যক পারমাণবিক বোমা দরকার। তবে আমাদের নিশ্চিহ্ন করতে কতটি পারমাণবিক অস্ত্র লাগবে তার হিসেব করাটা এখন কিছুটা অবান্তরই বলা যায়। কেননা, ম্যাক্সিমিলানের মতে, “পৃথিবীতে এই মূহুর্তে প্রায় ২০,৫০০ পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, যদি সেগুলোর গড় কার্যকরী ক্ষমতা হয় ৩৩,৫০০ কিলোটন, তাহলে পৃথিবী নামক গ্রহটিই ধ্বংস করার পক্ষে যথেষ্ট পারমাণবিক বোমা ইতোমধ্যেই মানুষ তৈরি করে ফেলেছে!”

‘আর্থস ফিউচার’ নামক বৈজ্ঞানিক গবেষণা সাময়িকীতে প্রকাশিত ২০১৪ সালের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১০০টি পারমাণবিক অস্ত্রের ডেটোনেশন সমৃদ্ধ আঞ্চলিক যুদ্ধেই তৈরি হবে মোট ৫ টেট্রাগ্রাম ব্ল্যাক শুট (৫,০০০,০০০,০০০ কেজি!), যা কি না পৃথিবীর স্ট্রাটোস্ফিয়ার স্তর অব্দি পৌঁছে গিয়ে সূর্যালোকের আগমন বন্ধ করে দেবে। এতে পৃথিবীর তাপমাত্রা হঠাৎ করে কমে যাবে, যার স্থায়িত্ব হবে ২৫ বছরেরও বেশি এবং পৃথিবীর সুরক্ষাদাত্রী ওজোন স্তরের অনেকাংশ সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে করে পৃথিবীপৃষ্ঠে অতিবেগুনী রশ্মির তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা পূর্বাপেক্ষা ৮০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। ফলে, ভূপৃষ্ঠের স্থলজ ও জলজ বাস্তুসংস্থান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার ফলস্বরূপ দেখা দিতে পারে বৈশ্বিক নিউক্লিয় খাদ্যাভাব ও দুর্ভিক্ষ।

কলোরাডোর বোল্ডারে অবিস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ফর অ্যাটমসফিয়ারিক রিসার্চের আবহাওয়াবিজ্ঞানী ও অনুসন্ধান প্রকল্পের প্রধান মাইকেল মিলস এর সারসংক্ষেপ চমৎকার আকারে তুলে ধরেন:

১৯৮০ সালে আমরা জেনেছিলাম, বৈশ্বিক থার্মোনিউক্লীয় যুদ্ধ এই পৃথিবীকে ‘প্রায়’ বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে পারে। কিন্তু এখন আমরা জানি, আঞ্চলিক পর্যায়ে সংঘটিত পারমাণবিক যুদ্ধও বিশ্বজুড়ে মারাত্মক ভোগান্তি বয়ে আনতে পারে, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরের অঞ্চলেও বহু মানুষ খাদ্যাভাবে মারা যেতে পারে।

এই পারমাণবিক অস্ত্রগুলো ঠিক কতটা প্রাণনাশী?

পৃথিবীতে অবস্থানকারী কার্যকর প্রায় ১৫ হাজার পারমাণবিক বোমা লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যার পাশাপাশি অসংখ্য শহরকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারে। টেলিগ্রাফের করা এক গবেষণানুসারে ধারণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার অস্ত্রভাণ্ডারে থাকা অস্ত্রসমূহের মিলিত শক্তি প্রায় ৬,৬০০ মেগাটনের সমান, যা প্রতি মিনিটে সূর্য থেকে পৃথিবীতে আগত সৌরশক্তির দশ ভাগের এক ভাগের সমতুল্য!

পারমাণবিক অস্ত্রসমূহের ব্যবহার পৃথিবীর জন্য বয়ে আনবে ধ্বংসাত্মক পরিণতি; Image Source: Composite/iStockphoto

NukeMap ওয়েবসাইটের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রসম্ভারে থাকা সবচেয়ে বড় পারমাণবিক অস্ত্র বি-৮৩ নিক্ষেপের প্রথম ২৪ ঘণ্টায়ই ১.৪ মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করে ফেলবে। পাশাপাশি অতিরিক্ত ৩.৭ মিলিয়ন মানুষকে আহত করবে, যেহেতু তাপীয় তেজষ্ক্রিয়তার ব্যাসার্ধ দাঁড়াবে ১৩ কিলোমিটারে।

তেমনি ‘জার বম্বা’ যদি নিউইয়র্কে ফেলা হয়, তাহলে তা ৭.৬ মিলিয়ন মানুষ নিধনের পাশাপাশি আরো ৪.২ মিলিয়ন মানুষকে আহত করবে। এর থেকে সৃষ্ট পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয় ধূলিকণা ঘণ্টায় ১৫ মাইল বেগে বহমান বাতাসে প্রায় ৭,৮৮০ কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ হারাতে হবে।

কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকা ও রাশিয়ার অস্ত্রভাণ্ডারগুলোতে কী প্রকারের ও কত সংখ্যক অস্ত্র থাকতে পারবে এবং সেগুলোর ব্যবহারপদ্ধতি নির্দিষ্ট ও সীমিত করে দেয়া হয়েছে। যদি এই দুটি দেশের কোনোটি তাদের পারমাণবিক ক্ষমতা এর থেকে এতটুকুও বৃদ্ধি করতে চায়, তাহলে ট্রাম্প ও পুতিনের ইঙ্গিতবহ হুঁশিয়ারি মোতাবেক এই সকল চুক্তি ভেঙে পড়ে এক নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা ঘটবে।

জার বম্বা; Image Source: Mikhail Voskresensky/Sputnik

তাই বলা যায়, সেই ১৫,০০০ পারমাণবিক হাতিয়ারের মধ্যে কিছু পরিমাণ অস্ত্র অকার্যকর করার এখনই সঠিক সময়! পৃথিবীর অনেক কিছুর ওপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ না থাকলেও আশার কথা হচ্ছে এ ব্যাপারে মানুষের অনেক কিছু করার আছে। পারমাণবিক বোমা রাখার পেছনের যুক্তিগুলো না বৈজ্ঞানিক, না প্রযুক্তিগত, এর পুরোটাই রাজনৈতিক। সারাবিশ্বের এত এত দেশের মধ্যে মাত্র নয়টির কাছেই রয়েছে সকল পারমাণবিক অস্ত্র, কাজেই বৈশ্বিকভাবে এই সংখ্যাটি শূন্যে নামাতে হলে শুধুমাত্র গুটিকয়েক (কিন্তু প্রচুর ক্ষমতাশালী) বিশ্বনেতাকেই বোঝাতে হবে। পারমাণবিক বোমা ও এর সম্ভাব্য ভয়াল পরিণতির আশঙ্কা চিরতরে বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে সকলকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এটি বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জরুরি মানবাধিকারগুলোর একটি। যদি সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া হয় তাহলে ভবিষ্যতে মানুষের চিহ্নই হয়তো পৃথিবীতে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।

This article is in Bangla Language. Its about how many nukes are required to screw humanity. For references please check the hyperlinks inside the article

Feature Image: Shutterstock

Related Articles