নব্বইয়ের দশকে জনপ্রিয় এক কোমল পানীয় উৎপাদনকারী কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন ছিল এরকম, "ইট ফুটবল, স্লিপ ফুটবল…"। সারাবিশ্বের ফুটবল উন্মাদনাকেই যেন এক ট্যাগলাইনে প্রকাশ করেছিল তারা। এবার ট্যাগলাইন যদি একটু ঘুরিয়ে এভাবে লেখা হয়, "ইট সাইকেল, স্লিপ সাইকেল", আর সারাবিশ্বের জায়গায় কল্পনা করে নেন নেদারল্যান্ডসের কথা, একটু অদ্ভুত শোনাতে পারে, তবে খুব যে ভুল হবে তা বলা যায় না। কারণ, ফুটবল যেমন সারাবিশ্বের মানুষের কাছে জনপ্রিয়, তেমনই নেদারল্যান্ডসের জনগণের কাছে সাইকেল এক মহাগুরুত্বপূর্ণ বস্তু।
নেদারল্যান্ডসে আপনি যেখানে যাবেন সেখানেই সাইকেল দেখতে পাবেন। সেখানকার মানুষ প্রয়োজনীয় কাজ থেকে শুরু করে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও সাইকেলকে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। পরিসংখ্যান বলছে, নেদারল্যান্ডসে নাকি ২২ মিলিয়নের মতো সাইকেল রয়েছে, যেখানে দেশের জনসংখ্যাই ১৭ মিলিয়নের কাছাকাছি! অর্থাৎ নেদারল্যান্ডসে যত না মানুষ তার চেয়ে অনেক বেশি সাইকেল! আর এই বিশাল সংখ্যক সাইকেল সামাল দিতে সেখানে সাইকেলের জন্য আছে আলাদা রাস্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থা, টানেল, ব্রীজ, এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাইকেল পার্কিং গ্যারেজ। এত কিছুর পরেও নেদারল্যান্ডসকে সাইকেলের দেশ না বললে ভুলই হবে।
তবে হঠাৎ করে কিন্তু এমনটা হয়নি, আর সাইকেলের দেশ হয়ে ওঠার গল্পও যে সবসময় এক ছিল তা-ও না। বিশেষ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দুই দশক এবং গত শতকের সত্তর-আশির দশকের বিভিন্ন ঘটনা নেদারল্যান্ডসে সাইকেলের প্রসার প্রচুর পরিমাণে বাড়িয়ে দেয়। প্রথমে নজর দিতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরের সময়ে। কারণে সেসময় থেকেই এই গল্পের সূত্রপাত, আর সেই অম্লমধুর কাহিনিই জানানো হবে আপনাদের।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগপর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে সাইকেলের চল মোটামুটি ভালোভাবেই ছিল বলা যায়। এখনকার মতো এতটা প্রসার ও অবকাঠামোগত সুবিধা না থাকলেও তখনও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ সাইকেল চালাত। গাড়ির সাথে পাল্লা দিয়ে সাইকেলও দেখা যেত যথেষ্ট। তবে তা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। তারপর পরিবর্তিত হতে থাকে দৃশ্যপট। কমে যেতে থাকে সাইকেল আর বাড়তে থাকে গাড়ি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে প্রতিটি দেশই পুনর্গঠনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। নেদারল্যান্ডসও ব্যতিক্রম নয়। ঠিক এ সময়েই সাইকেলের জায়গা নিতে শুরু করে গাড়ি। মানুষ আস্তে আস্তে সচ্ছল হয়ে উঠতে শুরু করে। পরিসংখ্যান বলে, যেখানে ১৯৪৮-৬০ এই সময়ে মানুষের গড় আয় বৃদ্ধি পেয়েছিল ৪৪ শতাংশ, সেখানে ১৯৭০ সাল আসতে আসতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২২ শতাংশে! স্বাভাবিকভাবেই মানুষের মধ্যে সচ্ছলতা আসলে তাদের রুচিরও পরিবর্তন ঘটবে। তারা আরও শৌখিন হতে চাইবে। নেদারল্যান্ডসের মানুষের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটল না।
যেহেতু তখন তাদের ক্রয়ক্ষমতা ছিল বেশি, তাই তারা যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে গাড়িকে প্রাধান্য দিতে লাগল। এই প্রবণতার সাথে সাথে নীতি নির্ধারকরাও যেন গাড়িকেন্দ্রিক শহরায়নের দিকে মন দিলেন। যেহেতু নেদারল্যান্ডসে আগে এত গাড়ি ছিল না, তাই রাস্তাগুলোও অতটা প্রশস্ত ছিল না। গাড়ি চলার সুবিধার্থেই নতুন নতুন রাস্তা তৈরি ও আগের রাস্তাগুলোর সংস্কারকাজ শুরু হলো। এ কাজে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও নিদর্শন ভাঙতে হয়। এমনকি আগে সাইকেলের জন্য যে পথগুলো ছিল, সেগুলোও ভেঙে গাড়ি চলার রাস্তা বানানো শুরু হয়। এই সবকিছুর ফলাফল হিসেবে গাড়ির সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যায়, আর সাইকেল যেন আস্তে আস্তে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যেতে থাকে।
এর নেতিবাচক দিক সামনে আসে ১৯৭১ সালে এসে। সেসময় দেখা যায়, গাড়ির সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনার হার। তখনকার পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১ সালে ৩,০০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়, যার মধ্যে ৪০০ জনেরও বেশি শিশু। এই মৃত্যুহার, বিশেষ করে শিশুমৃত্যু মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তোলে। সূচনা হয় 'স্টপ দে কিন্ডারমুর্ড' আন্দোলনের।
স্টপ দে কিন্ডারমুর্ড- শিশুহত্যা বন্ধ করুন। মূলত ১৯৭২ সালে শুরু হওয়া এই আন্দোলনের লক্ষ্যই ছিল গাড়ি দুর্ঘটনায় শিশুমৃত্যুর হার শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা। আন্দোলনের শুরুর দিকে এ নিয়ে এক পত্রিকায় প্রকাশিত এক লেখায় এই আন্দোলনকে 'স্টপ দে কিন্ডারমুর্ড' নামে অভিহিত করা হয়। সেই লেখা যেমন আন্দোলনকারীদের অনুপ্রেরণা যোগায়, তেমনি এই নামকেও ব্যাপক হারে পরিচিত করে তোলে।
১৯৭২ সালে শুরু হওয়া আন্দোলনের ফলে যদি কিছুটা হলেও সাইকেলের ফিরে আসার সুযোগ সৃষ্টি হয়, তাহলে বলতে হবে তার ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের তেল সংকট সেই সুযোগ আরও বাড়িয়ে দেয়। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে ইসরায়েলের সাথে যুদ্ধ বেধে যায় বিভিন্ন আরব দেশের। ইতিহাসে এই যুদ্ধ আরব-ইসরায়েল চতুর্থ যুদ্ধ বা অক্টোবর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই যুদ্ধে আরো কয়েকটি দেশের সাথে নেদারল্যান্ডসও সমর্থন দেয় ইসরায়েলকে। ফলাফল অনুমিত। আরব দেশগুলো নেদারল্যান্ডসসহ সেসব দেশের প্রতি রুষ্ট হয়। যেহেতু তাদের হাতে সারাবিশ্বের তেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ ছিল, তাই তারা শাস্তিস্বরূপ ঐ দেশগুলোতে তেল নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এতে নেদারল্যান্ডসে তেল সংকট দেখা দেয়।
এমন অবস্থায় নেদারল্যান্ডসের সামনে দুটো পথ খোলা ছিল। হয় তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাও, নয় তেলের অভাবে মরো। কোনো সন্দেহ নেই আপনি যদি রাস্তায় গাড়ি চালু রাখতে চান তাহলে আপনার তেল লাগবে। কিন্তু নেদারল্যান্ডসের সামনে তখন তেল ছাড়া যেন সবকিছুই আছে। তাই তারা প্রথম বিকল্প অর্থাৎ তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিল।
এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আবারও সামনে চলে আসে 'কার ফ্রি সানডে'র ধারণা অর্থাৎ নির্দিষ্ট এক রবিবারে রাস্তায় সকল প্রকার গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকবে। এটি নতুন কোনো ধারণা ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে যখন নেদারল্যান্ডসে সাইকেলের যথেষ্ট প্রসার ছিল, তখন এটা বলতে গেলে নিয়মিত ঘটনাই ছিল। মাঝের সময়ে তা হারিয়ে যায়। কিন্তু তেল সংকটের ওই সময়ে নেদারল্যান্ডসের জন্য এ ধারণার বিকল্প আর কিছু ছিল না। তাই, ১৯৭৩ সালের ৪ নভেম্বর থেকে ১৯৭৪ সালের ৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি 'কার ফ্রি সানডে' পালন করে দেশটি। যেহেতু গাড়ি বন্ধ থাকবে, তাই বিকল্প কিছু খুঁজতে হবে। সেই বিকল্প হিসেবেই সাইকেল ফিরে আসতে শুরু করে।
১৯৭২ সালে শুরু হওয়া স্টপ দে কিন্ডারমুর্ড আন্দোলন আর ১৯৭৩ সালের তেল সংকট- দুইয়ে মিলে অবশেষে সাইকেল ফিরে আসে নেদারল্যান্ডসে। নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারেন যে গাড়িকেন্দ্রিক ব্যবস্থা না, বরং পুরনো সেই সাইকেলকেন্দ্রিক ব্যবস্থাই নেদারল্যান্ডসের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। সেজন্যই ধীরে ধীরে নির্মাণ করা হতে থাকে সাইকেলবান্ধব বিভিন্ন অবকাঠামো, রাস্তাগুলো হতে শুরু করে সাইকেলবান্ধব আর সাইকেলের বিক্রিও যায় বেড়ে। মানুষ আবার সাইকেলকে নিজেদের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হিসেবে বরণ করে নেয়। এভাবেই নেদারল্যান্ডস হয়ে উঠতে শুরু করে সাইকেলের দেশ।
This Bengali article discusses how Netherlands became the country of cycles.
Reference:
1. Coca Cola Commercial World Cup 98
3. How the Dutch got their cycle paths
4. Why is cycling so popular in the Netherlands?
5. Car Free Sundays, a 40 year anniversary
6. Stop de Kindermoord Protests Led to NL Road Safety
Feature Image: https://commons.wikimedia.org