Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কাতার কীভাবে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হলো?

পারস্য উপসাগরের এককোণায় চোখে পড়বে ছোট্ট একটা দেশ, আয়তন মাত্র ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের তুলনায় সামান্য বেশি। আয়তনের দিক থেকে বিশ্বে ৯০তম বাংলাদেশের তুলনায়ও প্রায় ১৩ গুণ ছোট এই কাতার। বাংলাদেশের মতো কাতারও স্বাধীনতা লাভ করেছিলো ১৯৭১ সালে, গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে। স্বাধীন হওয়ার সময় তৎকালীন সময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গরীব দেশগুলোর একটি ছিল কাতার, এবং এটা মোটেই কোনো অবাক করা বিষয় নয়।

গ্রীষ্মকালে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা উঠে যাওয়া আর আয়তনের সিংহভাগ মরুভূমির দখলে থাকা কাতার তখন পৃথিবীর অন্যতম বসবাসের অনুপযোগী স্থান। কিন্তু স্বাধীনতার ৫০ বছর পর দেশটির চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন, কাতার এখন গ্রহের সবচেয়ে ধনী দেশ! ঠিকই পড়েছেন, বিশ্বের অন্যতম এই ছোট দেশের মাথাপিছু বার্ষিক আয় প্রায় ১,২০,০০০ ডলার, যেটি কিনা ফ্রান্সের চেয়েও তিনগুণ বেশি!

৫০ থেকে ৬০ বছর আগের স্কাইস্ক্র্যাপারবিহীন কাতার; Image Source: Daily Gulf News 

প্রায় বাসের অযোগ্য, উপসাগরের মাছ বিক্রি করে পেট চালানো জেলেদের দুর্বল অর্থনীতি এখন রূপ নিয়েছে আলীবাবার গুহায়। বিশ্বের প্রতিটি কোণায় চোখে পড়বে কাতার সরকারের আর্থিক বিনিয়োগের চিত্র। আরব বিশ্বের সবচেয়ে বড় মিডিয়া কোম্পানি আল জাজিরার জন্মও হয়েছে এখানে, আর এরপর রয়েছে দোহা, গগনচুম্বী অট্টালিকা, শপিং মল আর বিলাসবহুল গাড়ির স্রোতে ভেসে যাওয়া কাতারের রাজধানী।

মোনাকো আর লাস ভেগাস একসাথে মিশিয়ে দিলে যা হবে তা হলো এই দোহা, কিন্তু অবশ্যই জুয়া আর অ্যালকোহল ছাড়া। এখানে সাধারণ কোনো কিছুর জায়গা নেই, সবকিছুই ব্যয়বহুল আর বিশাল।

অ্যাঞ্জেল সাস্ত্রে, সাংবাদিক, কনফ্লিক্ট এরিয়াজ

তো এখন প্রশ্নটা হচ্ছে, “কাতার কীভাবে এই অভাবনীয় পরিবর্তন ঘটালো?” চলুন এই প্রশ্নটির উত্তরই খোঁজা যাক।

প্রাকৃতিক সম্পদ

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ধনী হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে এর সমৃদ্ধ প্রাকৃতিক সম্পদ। কাতারও এর ব্যতিক্রম নয়, মরুভূমির বালির নিচে লুকিয়ে থাকা বিশাল জ্বালানি ভান্ডারই কাতারের অর্থের যোগানদাতা। তবে, কাতারের শুধু তেলই নয়, আরো একটি সম্পদ প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, আর তা হলো প্রাকৃতিক গ্যাস।

১৯৪০ এর দশকে কাতারে সর্বপ্রথম তেলের খনি আবিষ্কার হয়, কিন্তু ১৯৬০ এর দশকেই তা প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। গরীব কাতারের ভাগ্যেরও সামান্য পরিবর্তন ঘটেছিল, কিন্তু খুব একটা বেশি নয়। সত্তরের দশকে শেল কোম্পানি দেশটির সবচেয়ে বড় সম্পদ আবিষ্কার করে: ‘দ্য নর্থ ফিল্ড’, বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র! কিন্তু তখন প্রাকৃতিক গ্যাস খুব একটা লাভজনক ব্যবসা নয়। তখনকার দিনে গ্যাস শুধুমাত্র পাইপের মধ্যেই সরবরাহ করা সম্ভব ছিল, আর মধ্যপ্রাচ্যের কোণায় পড়ে থাকা কাতার তখন শিল্পোন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক দূরে, যেখানে এই গ্যাস ব্যবহার করা হবে। শেল কোম্পানিও তাই এদিকে আগ্রহ দেখায়নি।

দ্য নর্থ ফিল্ড, বিশ্বের সর্ববৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র; Image Source: Lloyd’s List

১৯৯৫ সাল, হামাদ বিন খলিফা আল-থানি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তার বাবার কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নিলেন। তার একমাত্র লক্ষ্য এই বিশাল গ্যাস সম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। আর আমির ঠিক তা-ই করলেন, গ্যাস তরলীকরণের গবেষণার উপর বিনিয়োগ করা শুরু করলেন। এর ফলে গ্যাস পরিবহণের জন্য আর পাইপের প্রয়োজন হবে না, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) সহজেই জাহাজের মাধ্যমে রপ্তানি করা যাবে, যেমনটা করা হয় তেলের ক্ষেত্রে। তবে গ্যাস তরল করতে হলে একে কমপক্ষে -১৬১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে। তাই কাতারের সামনে একটাই পথ, এই প্রযুক্তিকে আরো সহজলভ্য করা। গ্যাস তরলীকরণ প্রযুক্তিতে প্রচুর বিনিয়োগ করা শুরু হলো। আর এখন? কাতার বর্তমানে বিশ্বের সর্ববৃহৎ LNG রপ্তানিকারক রাষ্ট্র। গত বছরেই এশিয়ার সবচেয়ে শিল্পোন্নত ৪ রাষ্ট্র: চীন, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া আর জাপানে কাতার তাদের উৎপাদিত LNG-এর এক-তৃতীয়াংশ রপ্তানি করেছে। শুধু তা-ই নয়, কাতার এই প্রযুক্তিতে এতটাই বিনিয়োগ করেছে যে, তারা LNG এর উৎপাদন খরচ যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় চারগুণ কমিয়ে নিয়ে এসেছে! অর্থাৎ বিশ্বের অন্যান্য যেকোনো দেশ ১ টন LNG উৎপাদন করতে যা খরচ করে, কাতার সেই পরিমাণ খরচ করেই কম করে হলেও ৪ টন জ্বালানি উৎপাদন করে!

নর্থ ফিল্ডের মানচিত্র; Image Source: Energy Global News

কিন্তু শুধু সম্পদ থাকলেই তো হবে না, বরং সেটার সুষ্ঠু ব্যবহার আর সঠিক বিনিয়োগও প্রয়োজন। তা না হলে কাতারের অবস্থা ভেনিজুয়েলা কিংবা অ্যাঙ্গোলার চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। সম্পদ ছাড়াও কাতারের উন্নয়নের পিছনে আরো কিছু জিনিস রয়েছে। আর সেগুলো হলো-

বিনিয়োগ ব্যবস্থা

হামাদ বিন খলিফা আল-থানি ক্ষমতা গ্রহণের পর কাতারের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। তার ১৮ বছরের শাসনামলে কাতারের জনসংখ্যা বেড়েছে ৫ গুণ, একইসাথে পরিণত হয়েছে গ্রহের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে। তাই সাবেক আমির নিজের কাজের জন্য গর্ব করতেই পারে। জ্বালানি সম্পদ কাজে লাগিয়ে প্রচুর আয় করেছে কাতার, কিন্তু এই অর্থ ব্যয় হচ্ছে কোথায়?

কাতার এই বিশাল অর্থ কাজে লাগানোর জন্য গঠন করেছে ‘কাতার ইনভেস্টমেন্ট অথোরিটি’। কাতারের ক্ষমতা হিসেবে পরিচিত এই ফান্ডের হাতে রয়েছে ৩৩০ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি পরিমাণ অর্থ, যাদের কাজ হচ্ছে দেশ-বিদেশের লাভজনক ব্যবসায় বিনিয়োগ করা। আরেকটি ব্যাপার, কাতারের জনসংখ্যা মাত্র ৩০ লক্ষ, এবং তাদের মধ্যেও মাত্র ৩ লক্ষ লোক কাতারের নাগরিক! সুতরাং, কিছু অংক কষলেই তাদের এই বিশাল মাথাপিছু আয়ের কারণ বের করে ফেলতে পারবেন।

কাতারের এই ফান্ড বিশ্বের প্রতিটি কোণার রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেছে। হোটেল, অফিস, অ্যাপার্টমেন্ট কেনার মাধ্যমে লন্ডনের বেশ বড় একটা অংশ কাতারের দখলে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও বিদেশি বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রের তালিকায় কাতারের অবস্থান চার নম্বরে। আর শুধু রিয়েল এস্টেট নয়, বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতেও কাতারের বিনিয়োগের পরিমাণ আকাশচুম্বী। জার্মানির ফোক্সওয়াগেন, বারক্লেইস ব্যাংক, এমনকি রাশিয়া সরকারের তেল কোম্পানি ‘রসনেফট’-এর বিরাট অংশও কাতারের মালিকানাধীন।

বিদেশি বিনিয়োগ থেকে এবার দেশের অভ্যন্তরে কাতারের বিনিয়োগের দিকে চোখ ফেরানো যাক। ইতোমধ্যেই সড়ক ব্যবস্থা, এয়ারপোর্ট, বন্দর, গবেষণা কেন্দ্র আর বাণিজ্য কেন্দ্র তৈরিতে কয়েক বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফেলেছে কাতার সরকার। আর এর কারণ? ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হচ্ছে কাতার, যাতে প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার ফুরিয়ে গেলেও কোনো সমস্যার সম্মুখীন না হতে হয়। কিন্তু সে ধরনের সমস্যা হয়তো অনেক দূরে, কারণ অদূর ভবিষ্যতে তেলের চাহিদা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও গ্যাসের চাহিদা ক্রমাগত বেড়েই চলছে।

মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশ হয়তো দুই হাতে টাকা উড়িয়ে চলছে, কিন্তু কাতার আগে থেকেই তৈরি হয়ে আছে ভবিষ্যতের জন্য। আর এটাই পার্থক্য গড়ে দিয়েছে অন্যান্য দেশগুলোর সাথে।

কাতারের মালিকানাধীন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি; Image Source: CNN Money

আন্তর্জাতিক প্রভাব  

হামাদ আল-থানি আরো একটি লক্ষ্য নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছিলেন, আর তা হলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব বিস্তার করা। বাস্তবে কাতারকে নিয়ন্ত্রণ করতো সৌদি আরবই, তাদের হাতের পুতুল আমিরকে দিয়ে। আর উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় কুয়েতে ইরাকের আক্রমণকেও ভুলে গেলে হবে না। যদি কাতারকে ভালোভাবে টিকে থাকতে হয়, তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাতারকে নিজের পরিচয় তুলে ধরতে হবে, প্রভাব বিস্তার করতে হবে। নাহলে রিয়াদের সাথে যেকোনো ঝামেলা তাদের স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে, ২০০৩ সালে সৌদি আরব যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের দেশ থেকে মার্কিন সৈন্যদেরকে সরে যেতে অনুরোধ করলো, কাতার তাদের দেশে এসব সৈন্যকে আমন্ত্রণ জানাতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি। বরং প্রায় এক বিলিয়ন ডলার খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি ‘আল উদিদ’ তৈরি করে দিয়েছে কাতার। দোহার ২০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এই সামরিক ঘাঁটি এখন কম করে হলেও ১১ হাজার মার্কিন সৈন্যের বাসস্থান। আর আল জাজিরার কথা না বললেই নয়, আন্তর্জাতিক প্রভাব বিস্তারে এই মিডিয়া কোম্পানির অবদান কম নয়।

আল উদিদ বিমানঘাঁটি; Image Source: Wikimedia Commons

অবরোধের এক বছর

কাতারের আন্তর্জাতিক প্রভাব প্রতিবেশী দুই দেশ সৌদি আরব আর আরব আমিরাতের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ালো। গত বছরের জুন মাসে মিশর এবং বাহরাইনকে সাথে নিয়ে কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ ঘোষণা করলো তারা। অভিযোগ? মৌলবাদী সন্ত্রাসী সংগঠনকে সাহায্য করা। শুঁড়ি হয়ে মাতালের মদ খাওয়াকে হারাম বলা, তা-ই নয় কি?

এটা সত্যি যে, কাতারের অভ্যন্তরীণ কিছু গোপনীয়তা রয়েছে। কিন্তু অবরোধের মূল কারণ যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাতারের প্রভাব বিস্তার রোধ করা, তা সহজেই অনুমান করা যায়। কিন্তু বাস্তবে বলতে গেলে পুরো অবরোধটাই মুখ থুবড়ে পড়েছে, কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রথমত, বেশিরভাগ দেশই এই অবরোধকে সমর্থন করেনি, এমনকি কুয়েত কিংবা ওমানও নয়। অন্যদিকে তুরস্ক আর ইরানের সাথে সম্পর্কে আরো জোর বাড়িয়েছে কাতার, প্রমাণ করে দিয়েছে ঝড় ঠেকাতে তারা প্রস্তুত।

সম্পদের প্রাচুর্যের সাথে যোগ হয়েছে শক্তিশালী বিনিয়োগ ব্যবস্থা আর আন্তর্জাতিক প্রভাব। কাতারের অভাবনীয় উন্নয়ন আসলেই প্রশংসার যোগ্য। কয়েক বছরের ব্যবধানে জেলেদের ছোট্ট গ্রাম থেকে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া কাতার কি পারবে পারস্য উপসাগরে সৌদি আরবের সাথে টক্কর দিতে?

অবরোধকৃত সীমানা দিয়ে (লাল) কোনোরকম পণ্য পরিবহণ করতে পারবে না কাতার (হলুদ); Image Source: alaraby

ফিচার ইমেজ: Paperlief

Related Articles