ব্ল্যাক হক ডাউন চলচ্চিত্রটি দেখে থাকলে সোমালিয়া রাষ্ট্রের কথা অজানা থাকবার নয়। হর্ন অব আফ্রিকার এই দেশটি সারা বিশ্বে ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে পরিচিত। সরকারের নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত দুর্বল, অর্থনীতি বেহাল, প্রতিষ্ঠানগুলো অথর্ব, জঙ্গীগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং জনগণের মৌলিক সুযোগ সুবিধার একান্তই অভাব। আবার ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের ক্রমাগত হানা দেওয়া বৈশ্বিক মানচিত্রে সোমালিয়াকে বিশেষ কুখ্যাতি দিয়েছে। আর যাই হোক, সোমালিয়াকে কোনো সূচকেই বিশেষ উন্নত বলার সুযোগ নেই।
কিন্তু সোমালিয়া কি বরাবরই এমন ছিল? উত্তর না। আমরা সোমালিয়া নামে যে ভূখণ্ডকে চিনি তা প্রাচীন আমলে অর্জন করেছিল দারুণ প্রসিদ্ধি। খোদ ফারাওদের মিশরে এই সোমালিয়া থেকে রপ্তানি হত সোনা, হাঁতির দাঁত এবং পশুপাল। সোমালিয়ার দরবেশের দল ব্রিটিশদেরকে চার-চারবার পর্যদুস্ত করেছে ঊনিশ শতকের শেষাংশে। ইতালী ও ব্রিটেন সোমালিয়াকে দু’ভাগে ভাগ করে নেওয়ার পরেও প্রাচীন সব স্থাপনা, সুরম্য মসজিদ এবং সমৃদ্ধির জোরে রাজধানী মোগাদিসু অর্জন করেছিল ‘আফ্রিকার মুক্তো’ খেতাব। সব আজ অতীত।
কী ঘটেছিল সোমালিয়ার ভাগ্যে? কেন আজ দেশটি ব্যর্থ হিসেবে পরিচিত?
সোমালি সমাজ
সোমালিরা ঠিক আরব নয়, আবার তাদেরকে অন্যান্য আফ্রিকানদের মধ্যেও ফেলা চলে না। ঊষর অঞ্চলে পশুপালননির্ভর যাযাবর সোমালি সমাজ প্রচলিত গ্রাম-শহর কেন্দ্রিক অর্থনীতির সাথে তুলনামূলক অপরিচিত। সোমালি গোত্রগুলোর আভ্যন্তরীণ কলহ ও সংঘর্ষ চলে আসছে সুপ্রাচীন কাল থেকে। মজার বিষয় হলো; এসব সংঘর্ষ কতিপয় নিয়ম বা জির মেনে চলে। যুদ্ধরত পক্ষগুলো তেমন অবস্থা বুঝলে সমবেত হয়। ক্ষতি বা উপঢৌকনের বিষয়গুলো সমঝোতা করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে নেয়। এভাবেই যুদ্ধ, শান্তি, গোত্রভিত্তিক বন্ধন আর পশুপালন অনাদিকাল থেকে সোমালিদের সামাজিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে বর্তমান। সোমালি ভূখণ্ডের দক্ষিণাংশের অবস্থা অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। জুবা আর ওয়াবি শেবেল নদীর কল্যাণে ভূমি এখানে উর্বর। তাই চাষাবাদ আর গ্রামভিত্তিক অর্থনীতির উপস্থিতি লক্ষণীয়।
উপনিবেশ থেকে স্বাধীনতা
১৮৮৫ সালে ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো নির্লজ্জের মতো আফ্রিকাকে নিজেদের মধ্যে কেটেকুটে নেওয়ার একটা পরিকল্পনা করে। ফলস্বরূপ সোমালিদের বাসস্থান পাঁচ খণ্ডে ভাগ হয়ে যায়। বর্তমান জিবুতি চলে যায় ফরাসী অধিকারে। উত্তর সোমালিয়া নিল ব্রিটেন, আর মধ্য-দক্ষিণে কব্জা জমালো ইতালী। দক্ষিণ-পশ্চিমের সোমালী অধ্যূষিত একটা অঞ্চল কেটে ব্রিটেন জুড়ে নিল কেনিয়ার সাথে। আর ইথিওপিয়া নিয়ে নিল ওগাদেন অঞ্চল। যাযাবর সোমালিরা এই কাঁটা-ছেড়ায় শক্ত প্রতিরোধ গড়লেও আধুনিক অস্ত্রের মুখে তা ব্যর্থ হয়। অবশ্য সোমালিদের মধ্যে রাষ্ট্রের ধারণা তখনো অনুপস্থিত। নিজেদের অঞ্চল আর পশুপালন নির্বিঘ্নে রাখার উদ্দেশ্যে; আর কতকটা ধর্মীয় কারণে এই প্রতিবাদ।
১৯৬০ সাল নাগাদ ব্রিটিশ আর ইতালীয় অঞ্চল মিলে গঠিত হয় স্বাধীন সোমালি প্রজাতন্ত্র। আফ্রিকার অন্যান্য যেকোনো অঞ্চলের তুলনায় সোমালি ভূখণ্ডে জাতিগত ভিন্নতা ছিল কম। অন্তত ৮৫ শতাংশ মানুষই ছিল সোমালি, আবার তাদের ভাষাও এক। কাজেই সাদা চোখে সোমালি প্রজাতন্ত্র গৃহবিবাদ থেকে মুক্ত হবে এমনটাই আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু সমস্যার মূল ছিল আরো গভীরে।
ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে সোমালিদের ঐতিহ্যবাহী জীবনধারায় হস্তক্ষেপ হয়নি বললেই চলে। কিন্তু ইতালীয় অংশে আবার ইউরোপীয় শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, সাথে নির্মম দমন-পীড়ন। কাজেই সোমালি জাতীয়তাবাদ ছিল ইউরোপীয় ঘরানার কৃত্রিম জাতীয়তাবাদ। মূলধারার সোমালি সমাজ আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণার সাথে কখনোই মানিয়ে নিতে পারেনি। সোমালি প্রজাতন্ত্রের আদর্শগত ভিত্তিটি ছিল অত্যন্ত দুর্বল, এবং এই দুর্বলতা প্রকট হতে থাকে স্বাধীনতার পরপর।
একজন সিয়াদ বারে
১৯৬০ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত সোমালিয়া হ-য-ব-র-ল ভাবে শাসিত হয়। ব্রিটিশ মদতপুষ্ট সোমালি ইয়ুথ লীগ ছাড়াও অন্তত ৬০টি রাজনৈতিক দল উঁকি দিল। এরা মূলত একেকটা গোত্রভিত্তিক দল ছিল এবং সবাই সোমালি ইয়ুথ লীগের সাথে খাতির জমিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রের ননীর ভাগ পেতে উদগ্রীব। সৃষ্টি হলো প্রচণ্ড দুর্নীতি আর বিশৃংখলা। নাসেরপন্থী একদল সেনা অফিসার সামরিক অভ্যুত্থান ঘটালেন। তাদের নেতা ছিলেন সিয়াদ বারে।
জাল্লে মোহামেদ সিয়াদ বারের জন্ম ১৯১০ সালে, বর্তমান ইথিওপিয়ার ওগাদেন অঞ্চলে। ইতালীয় আর ব্রিটিশদের কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই অফিসার ১৯৬৯ এ ক্ষমতা দখল করে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। সোমালিয়াকে একটা আধুনিক রাষ্ট্রে রূপ দেওয়ার খুব চেষ্টা করেছিলেন এই বামপন্থী নেতা।
বারে দেখলেন ঐতিহাসিকভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত সোমালিদেরকে একটা জাতীয় পরিচয়ে আবদ্ধ করতে হবে। তিনি সোমালি ভাষার লিখিত রূপ প্রচলন করলেন। দেশজোড়া রাস্তাঘাট বানালেন। সোমালি অধ্যূষিত অনেক অঞ্চল ইথিওপিয়া, জিবুতি আর কেনিয়ার অংশ ছিল। বারে এই অঞ্চলগুলোর পুনরুদ্ধার সোমালি জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপুর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে প্রচার করতে শুরু করেন। সে আমলে জিবুতি ছিল ফ্রান্সের উপনিবেশ। ইথিওপিয়া আর কেনিয়াও পশ্চিমা শিবিরের অংশ হওয়ায় সিয়াদ বারে হাত বাড়ালেন সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে।
একদলীয় শাসনব্যবস্থা, শ্রমিক-যুবা-মহিলাদের বড় বড় সংগঠন এবং সোমালিয়ার হারানো অংশ পুনরুদ্ধারের শ্লোগানকে পুঁজি করে সিয়াদ সোমালি ঐক্য গঠনের প্রয়াস পেলেন। গোত্র পরিচয় মুখে নেওয়া তখন মানা, সম্বোধন করতে হবে জাল্লে বা কমরেড বলে। তবে হাজার বছরের পুরানো সমাজ অত সহজে পিছু হটলে তো হতোই! ব্রিটিশ সোমালিয়া তার ঐতিহ্যগত রূপ ধরে রাখলেও ইতালীয় সোমালিয়া আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে কিছুটা মানিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এখন সোমালিয়ার শাসনযন্ত্রে এই দক্ষিণীর প্রাধান্য দেখা দিল। তাতে রুষ্ট হল মধ্য ও উত্তর সোমালিয়ার যাযাবর গোত্রগুলো।
ওগাদেন যুদ্ধ এবং সমস্যার সূত্রপাত
সিয়াদ বারে জিবুতি এবং ইথিওপিয়ার ওগাদেন অঞ্চল, কেনিয়ার সোমালি অধ্যূষিত অঞ্চলের বিদ্রোহী দলগুলিকে সহায়তা করতেন। ১৯৭৪ সালে ইথিওপিয়ায় গৃহযুদ্ধ বেঁধে গেলে বারে এই সুযোগটা নিলেন। ওগাদেনের ওয়েস্টার্ন সোমালি লিবারেশন ফ্রন্টকে সাহায্য করবার জন্য বারে ইথিওপিয়া আক্রমণ করে বসলেন। সালটা তখন ১৯৭৭। শুরুতে সোমালিরা সোভিয়েত অস্ত্রের জোরে দুর্দান্ত সাফল্য পেলেও পাশার দান উলটে গেল অযাচিতভাবে।
ইথিওপিয়ার গৃহযুদ্ধে জিতে ক্ষমতা দখল করে বসলো বামপন্থী দের্গ। কাজেই সোভিয়েত শিবিরের সামনে দেখা দিল সমস্যা। ইথিওপিয়া আর সোমালিয়া দুটি দেশই মিত্র। সোভিয়েত শিবির সমর্থন দিল ইথিওপিয়াকে। সোমালিয়া ছেড়ে উপদেষ্টারা ওদেশে গেলেন। কিউবা, পূর্ব জার্মানীর মতো দেশগুলোও ইথিওপিয়ার পাশে দাঁড়ালো। সোমালিয়ার সেনাদল যুদ্ধে হেরে টুকরো টুকরো হয়ে গেল কয়েক মাসের মধ্যে।
ওগাদেনের যুদ্ধ সিয়াদ বারের ঐক্যবদ্ধ সোমালি রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়। তার সেনাদল ছিন্নভিন্ন, ওদিকে যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ আর অনটনের ফলে তার বিরুদ্ধে দেখা দিল তীব্র অসন্তোষ। রাজনীতির ময়দানে বারের হাতে কোনো ঘুঁটি রইলো না। ফাটল দেখা দিল সর্বত্র।
গোত্রবিবাদ, বারের পতন, সোমালিয়ার চূড়ান্ত দুর্ভোগ
১৯৭৮ সালে মাজেরতিন গোত্রের একদল অফিসার ব্যর্থ অভ্যুত্থান চালালে বারে গোত্রটির ওপর ব্যাপক দমন-পীড়ন চালান। উত্তর-পূর্ব সোমালিয়ার এই বাসিন্দারা ইথিওপিয়ায় গিয়ে কর্নেল ইউসুফের অধীনে গড়লেন সোমালি স্যালভেশন ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট। গতিক দেখে সিয়াদ ঐক্যবদ্ধ সোমালিয়ার খোয়াব বাদ দিয়ে নিজের হাত শক্তিশালী করায় মত্ত হলেন। ওগাদেন, মারেহান এবং উত্তরের দোলবাহানতে গোত্রের সমন্বয়ে গড়লেন সরকার ও সেনাদল। গোত্রভিত্তিক এই খেলা কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক ফল নিয়ে এলো।
ওগাদেনের যুদ্ধে ইথিওপিয়া থেকে বহু ওগাদেন গোত্রভূক্ত সোমালি পালিয়ে এসেছিল। সিয়াদ এসব শরণার্থীদের অস্ত্র-শস্ত্রসহ উত্তর সোমালিয়ায় বসালেন। সেখানকার ইসাক গোত্রের লোকেরা এতে ভয়ানক গোস্বা করে ১৯৮১ সালে গঠন করলো সোমালি ন্যাশনাল মুভমেন্ট (এসএনএম)। এসএনএমকে শায়েস্তা করবার জন্য বারের সেনাদল হাজার হাজার ইসাক গোত্রভূক্ত মানুষকে খুন করলে সারা দেশে সরকারের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
হাওয়িই গোত্রের লোকেরা শীঘ্রই সেনাদল ছেড়ে ১৯৮৯ সালে গঠন করলো ইউনাইটেড সোমালি কংগ্রেস, নেতা জেনারেল ফারাহ আইদিদ। পরের বছর বারের নিজস্ব ওগাদেন গোত্রই ভরসা হারিয়ে গঠন করলো সোমালি প্যাট্রিওটিক মুভমেন্ট। সিয়াদ বারের সরকার দেশের মাত্র দশ কি পনেরো শতাংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে রইলো। ১৯৯১ এর জানুয়ারি মাসে এই বিদ্রোহী দলগুলো মোগাদিসুতে ঢুকে পড়ে ও সিয়াদ বারে ট্যাংকে চড়ে কেনিয়ায় পালিয়ে যান। ইতি ঘটে তার ২২ বছরব্যাপী শাসনের। সোমালিয়ার ভাগ্যচক্রেও এক অদ্ভুত রাষ্ট্রহীনতার পর্যায় শুরু হয়। (পরের অংশ ২য় পর্বে)
The article is about the process by which Somalia became a failed state.
Reference:
Somalia: civil War, Intervention and Withdrawal 1990-1995 by Gerard Prunier
NO MERCY IN MOGADISHU: The Human Cost of the Conflict & The Struggle for Relief report by Africa Watch
Featured Image: defencetalk.com/AP