কোভিড-১৯ এর সংক্রমণে বিশ্বমোড়লরা যেখানে পর্যুদস্ত, বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে লকডাউনের শেকলে বন্দী হয়ে ভঙ্গুর দশায়, সেখানে ভিন্ন চিত্র এশিয়ার দেশ দক্ষিণ কোরিয়ায়। দিন দিন যেখানে নতুন নতুন দেশ লকডাউনের ছায়ায় চলে যাচ্ছে, সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিকেরা ফিরতে শুরু করেছেন স্বাভাবিক জীবনের ব্যস্ততায়।
প্রায় ৫,০০০ জন আক্রান্ত নিয়ে এই ফেব্রুয়ারিতেই তারা সর্বোচ্চ আক্রান্ত কয়েকটি দেশের একটি ছিল, তবে তা এখন ক্রমেই কমতির দিকে।
কিন্তু এই অস্বাভাবিক সংক্রামক ভাইরাসটিকে কীভাবে কোরিয়া নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারলো? তার উত্তর, কোরিয়া তার পূর্ব ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে। প্রায় পাঁচ বছর আগে, ২০১৫ সালে কোরিয়া করোনাভাইরাসের মতোই আরেকটি সংক্রামক ব্যধির মোকাবেলা করেছিল। ঘটনার শুরু এক ব্যবসায়ীর বাহরাইন ভ্রমণ নিয়ে। ভ্রমণ শেষে ব্যবসায়ী দেশে ফেরত আসার পর জ্বর, কাশি এবং শেষে নিউমোনিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। টেস্টের পর তাকে মিডল ইস্ট রেস্পিরেটরি সিনড্রোম বা মার্স নামের একধরনের ভাইরাল রোগে আক্রান্ত হিসেবে পজিটিভ ঘোষণা করা হয়।
সমস্যার শুরু সেখানেই। ততদিনে ঐ ব্যক্তির চলাচল সেই ভাইরাসের সংক্রমণ চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে এবং তা কোথায় কোথায় সংক্রমণ করেছে, সেটাও কোরীয় সরকারের পক্ষে হিসেব করা খুব জটিল হয়ে পড়েছিল। এই আক্রান্তরাই বা কোথায় যাচ্ছে কিংবা তাদের সংস্পর্শেই বা কারা আসছে, সেটা আরো জটিল হিসেবের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ালো। পুরো কোরিয়া জুড়ে মার্স ভাইরাস হয়ে গেল এক মহাতঙ্কের নাম। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও কর্মপদ্ধতির কারণে ৩৮ জন মারা যাবার হবার পর ধীরে ধীরে সংক্রমণ কমে এলো।
ভাইরাসটি নিয়ে জনগণকে শান্ত থাকতে বললেও দক্ষিণ কোরীয় সরকার জোরেশোরেই নেমেছিল একটি বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে। সরকার এটি বুঝতে পেরেছিল যে, ভবিষ্যতে এমন সমস্যা মোকাবেলায় সবার আগে তাদের প্রয়োজন দুটি জিনিস, দ্রুত রোগ শনাক্তকরণ এবং রোগের বিস্তৃতি প্রতিরোধের জন্য শক্ত পদক্ষেপ। কী ছিল দেশটির সেই শক্ত পদক্ষেপ?
২০১৯ এর ডিসেম্বর। চীনের উহানে শনাক্ত হলো কোভিড-১৯ সংক্রমিত প্রথম রোগী। যে সময়ে চীনে এই সংখ্যা ৭৫ হাজারের কাছাকাছি ততদিনে দক্ষিণ কোরিয়ায় সেটি মাত্র ৩০ জন। কিন্তু ছোট সংখ্যা বলে দক্ষিণ কোরীয় সরকার বসে থাকেনি। ততদিনে তাদের গণস্বাস্থ্য বিভাগ সেদেশের বায়োটেকনোলোজি কোম্পানিগুলোর সাথে যৌথ উদ্যোগে কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রথম কাজই ছিল টেস্ট কিট তৈরি করা এবং বাস্তবিকভাবেই হাজার হাজার টেস্ট কিট হাসপাতালগুলোতে পৌঁছে গেল। সরকার প্রস্তুত ছিল ভাইরাসের ভয়াবহ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে এবং হলোও তা-ই। ১৭ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৩০ জন রোগী থাকলেও ২৯ ফেব্রুয়ারি সেটা হলো প্রায় তিন হাজারেরও বেশি।
এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের সূত্রপাত কোরিয়ার দক্ষিণের শহর দেগু থেকে। এক নারী জ্বরের উপসর্গ নিয়ে পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে গেলেন চিকিৎসা নিতে। কোরিয়া যেহেতু আগে থেকে প্রস্তুত ছিল এ অবস্থার জন্য, তারা তার ভ্রমণ ইতিহাস থেকে জানতে পারল, দিনকয়েক আগে তিনি এক চার্চে গিয়েছিলেন এক শেষকৃত্যানুষ্ঠানে যোগ দিতে। তাৎক্ষণিকভাবে লক্ষণ দেখা দিক বা না দিক, তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি এবং চার্চে উপস্থিত সেদিনের সকলকে আনা হলো টেস্টের আওতায়। এদের মধ্যে কয়েকজনকে কোভিড-১৯ পজেটিভ হিসেবে পাওয়া গেলো এবং সাথে সাথে তাদের ভ্রমণ ইতিহাস জেনে তাদের সংস্পর্শে আসা সকলের আবারও টেস্ট করা হলো।
চিহ্নিত করা হলো তাদের সকল গতিবিধি। এই প্রক্রিয়ার নাম কন্টাক্ট ট্রেসিং। এই প্রক্রিয়ায় কোরীয় সরকার প্রায় ৯,০০০ জনকে টেস্ট করল, যারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে এসেছিলেন। দেগুর এই বিপর্যয় মোকাবেলা চলা অবস্থাতেই সম্পূর্ণ কোরিয়াতে সকল স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সরকারি ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান একটি টাস্কফোর্স তৈরি করে সম্পূর্ণ দেশকে কোভিড-১৯ টেস্টের আওতায় নিয়ে আসতে শুরু করে।
ছোট্ট দেশ কোরিয়ার ৬০০ স্থানে প্রতিদিন ২০ হাজারেরও বেশি মানুষকে টেস্ট করা শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় যখনই কোনো আক্রান্ত ব্যক্তি পাওয়া যাচ্ছিল, সরকার সাথে সাথে তার সকল গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে তার সংস্পর্শে আসা সকলে আবারো নিবিড় পরীক্ষায় নিয়ে আসছিল। এতকিছুর মাঝেও একটি 'কিন্তু' রয়ে যাচ্ছে। হয়তো সকল মানুষকে কোরিয়া ট্রেস করতে পারছে, কিন্তু এ পরীক্ষায় একটি ফাঁক রয়ে যাচ্ছিল। ধরা যাক, একজন করোনা আক্রান্ত রোগী ১০ জনের সংস্পর্শে এসেছিলেন এবং এই ১০ জনের সাথে একটি রেস্তোরাঁয় খাবার পথে পার্কে বসেছিলেন। সমস্যা হয়ে গেল এক্ষেত্রে মানুষকে ট্রেস করা গেলেও যেসকল বস্তুতে তারা সংক্রমণ ছড়িয়েছেন, সেগুলো সেই টেস্টের আওতায় ছিল না।
তবে কোরিয়া সরকার এ ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে ভুল করেনি। মার্স সংক্রমণের সময়েই স্বাস্থ্যবিভাগ সরকার থেকে সংক্রমিত রোগীর সকল তথ্য এবং সিকিউরিটি ফুটেজে প্রবেশাধিকার পায়। তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে যখনই কোথাও কোভিড-১৯ পজেটিভ কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল, সে এলাকার সকলের মোবাইলে মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল সতর্কতার জন্য।
করোনাভাইরাসের একটি ট্র্যাকিং ম্যাপের মাধ্যমে সরকার, শনাক্তকৃত রোগীরা কোন কোন পথ অতিক্রম করেছেন এবং কোথায় কোথায় সংক্রমণ থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, সেই এলাকাগুলোকে ম্যাপে প্রকাশ করে জনগণকে সেভাবে সতর্ক হয়ে চলতে বলা হয়। ধরা যাক, আপনার বাড়ির পাশের একটি দোকান রয়েছে, আপনি চাইলেই দেখে নিতে পারবেন এই দোকানে করোনা সংক্রমিত কেউ কি ইতোমধ্যে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে কি না এবং গেলেও সেটা কখন। ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে হলে তা লাল, ২৪ ঘণ্টা থেকে ৪ দিনের মধ্যে হলে হলুদ এবং ৪ দিনের বেশি হলে সবুজ মার্ক দিয়ে সেটি ম্যাপের মধ্যে চিহ্নিত করা আছে।
যদি কেউ ভুলেও এমন কোনো লাল চিহ্নিত জায়গায় চলে গিয়ে থাকে, তবে সে সাথে সাথে টেস্টের আওতায় আসে এবং ঐ সময়ের মধ্যে হওয়া সকল সংস্পর্শের আবার কন্টাক্ট ট্রেসিং শুরু হয়। এছাড়াও, প্রতিবার সংক্রমিত কাউকে পাওয়া গেলেই, তার চলাচলের সকল জায়গায় সরকার থেকে ডিজইনফেক্ট সল্যুশন স্প্রে করে সেই জায়গাগুলোকে আবার জীবাণুমুক্ত করার কাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। জনগণের সকল চলাচলে নজর রাখা মানবাধিকারের লঙ্ঘনকারী হলেও কোরীয়রা এক্ষেত্রে নিজেদের স্বাস্থ্যকে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছিল এবং সরকারও সর্বোচ্চ গোপনীয়তার সাথে এসকল তথ্যের সুস্থ ব্যবহার করেছিল।
দক্ষিণ কোরিয়ায় ব্যাপক আকারে টেস্টের কারণেই ভাইরাসের বিস্তার নিয়ন্ত্রণ করা অনেকটা সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। লকডাউন করলেও অন্য দেশগুলোর মতো এত কঠোর ছিল না, যেহেতু সরকার এবং জনগণ, সকলেই ভাইরাসের সংক্রমন কোথায় হচ্ছে এবং কোথায় হতে পারে, তা দেখতে পাচ্ছিল। এত সতর্কতার পরেও দক্ষিণ কোরীয় সরকার আরো ভালোভাবে নিজেদের প্রস্তুত করছে এই ভাইরাসের দ্বিতীয়বার সংক্রমণ প্রতিরোধে।
কোরিয়া নিজেদের প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য অনেক বড় উদাহরণ এই সংক্রমণ মোকাবেলায়। তাইওয়ান, হংকং, সিঙ্গাপুর এই বিস্তৃত টেস্টিং অনুসরণ করে অনেকটাই এখন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে এই ভাইরাসকে।
জার্মানি এবং ইংল্যান্ডও এরই মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার এই মডেল অনুসরণ করে ব্যাপক আকারে টেস্ট শুরু করেছে। তুলনামূলক বড় জনসংখ্যার দেশগুলোতে হয়তো এই মডেল অপেক্ষাকৃত কঠিন হবে। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, অনেক দেশের জন্য এই বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার অগ্রপথিক দক্ষিণ কোরিয়া।
This is a Bangla article. This is about how South Korea became the role model for preventing Coronavirus.
Featured Image: New Age
References:
[1] The big lesson from South Korea's coronavirus response
[2] How South Korea became the ‘model’ for beating the coronavirus
[3] How a secretive church in South Korea became a coronavirus ‘super spreader’
[4] Israel and South Korea use mobile phones to track coronavirus carriers
[5] Middle East respiratory syndrome: what we learned from the 2015 outbreak in the Republic of Korea
[6] INFECTIOUS DISEASE CONTROL AND PREVENTION ACT
[7] What We Can Learn From Singapore, Taiwan and Hong Kong About Handling Coronavirus