২০১৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচনকে সামনে রেখে নরেন্দ্র মোদি ও ভারতীয় জনতা পার্টির নির্বাচনী প্রচারণার একটি বড় অংশ জুড়ে ছিল তরুণ প্রজন্মের জন্য পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির প্রতিশ্রুতি। প্রতি বছর দুই কোটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবেন বলে তরুণ ভোটারদের মাঝে তুমুল সাড়া জাগিয়েছিলেন মোদি। ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন নতুন পদ্ধতি ও পরিকল্পনা হাতে নিয়ে সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার চেষ্টা অব্যহতও রাখেন তিনি, এবং ২০১৮ সালের আগস্টে দাবি করেন, "গত অর্থবছরে শুধু ফরমাল সেক্টরেই ৭০ লক্ষ চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।"
কিন্তু ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ভিন্ন চিত্রই উঠে এসেছিল। তারা জানিয়েছিল, ২০১৮ সালে ভারতের ১.১ কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছে। আর ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে বেকারত্বের হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৪ শতাংশে, যেটি কি না ১৫ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। এদিকে ভারতের শ্রম অধিদপ্তর থেকে করা বার্ষিক পরিবার জরিপের ফলাফল থেকে জানা গিয়েছিল, ২০১৩-১৪ থেকেই দেশটিতে বেকারত্বের হার ধারাবাহিকভাবে ঊর্ধ্বমুখী, এবং ২০১৮ সালে এসে সেই ধারা আরো প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
তবে মোদি সরকার কখনোই দেশের বেকারত্বের এই ভয়াবহ চিত্র মেনে নিতে চায়নি। যেমন- সেই ২০১৮ সালের আগস্টেই মোদি বলেছিলেন, বেকারত্বের পরিসংখ্যান এত বেশি, কারণ "চিরাচরিত জরিপ পদ্ধতি ভারতের নতুন ধাঁচের অর্থনীতি ব্যবস্থায় সৃষ্ট নতুন চাকরিসমূহকে পরিমাপের জন্য উপযুক্ত নয়।" কিন্তু তার এই সকল কথাকেই এই মুহূর্তে ফাঁকা বুলি মনে হচ্ছে, বিশেষ করে গত মাসের শেষ দিনে বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ভারতের সাম্প্রতিক কর্মসংস্থান জরিপের প্রতিবেদন ফাঁসের মাধ্যমে।
কী আছে সেই প্রতিবেদনে?
ভারতের ন্যাশনাল সার্ভে অফিস থেকে পরিচালিত জরিপের ফলাফল বলছে, এই মুহূর্তে ভারতে বেকারত্বের হার ৬.১%, যা কি না ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে, অর্থাৎ বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। অবশ্য ৪৫ বছর না হয়ে সংখ্যাটি আরো বাড়তে পারত, কিন্তু তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরবার মতো এর চেয়ে পুরনো কোনো পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া যায়নি।
৬.১% বেকারত্বের হার অনেকের কাছেই খুব বড় কিছু মনে না হতে পারে, কিন্তু যখন আপনারা শুনবেন যে ২০১১-১২ অর্থবছরেও ভারতের বেকারত্বের হার ছিল মাত্র ২.২%, অর্থাৎ মাত্র এই কয়েক বছরের ব্যবধানেই সেটি বেড়েছে প্রায় তিনগুণ, তখন বিস্ময় জাগতে বাধ্য।
এই প্রথমবারের মতো, ভারতের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর (যাদের বয়স ১৫ বা তার বেশি) প্রায় অর্ধেকই জাতীয় অর্থনীতিতে বিন্দুমাত্র অবদান রাখছে না। এই প্রবণতা ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি- শহুরে ভারতে এই বয়সশ্রেণীর ১৮.৭% পুরুষ ও ২৭.২% নারী চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অপরদিকে গ্রামীণ ভারতেও চাকরিপ্রত্যাশী এই বয়সশ্রেণীর ১৭.৪% পুরুষ ও ১৩.৬% নারী।
জানিয়ে রাখা ভালো, এটিই কিন্তু সেই জরিপের ফলাফল, যেটি মোদি সরকার অপ্রকাশিত রাখার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছিল, এবং যার সূত্র ধরে জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশনের দুজন বেসরকারি কর্মকর্তা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন অনেকেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারছে যে, কেন নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে সরকার এমন একটি জরিপের ফলাফল সাধারণ মানুষের কাছ থেকে লুকাবার চেষ্টা করেছিল।
বিষয়টি কতটা তাৎপর্যপূর্ণ?
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা শুধু সে দেশেরই নয়, গোটা বিশ্বের মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়িয়েছে। আর এর অন্যতম প্রধান কারণ ছিল, ভারতের ১৩৫ কোটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৬৫ শতাংশেরই বয়স ৩৫ বছরের কম, যে কারণে দেশটিতে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি। ধারণাটি ছিল এমন যে, প্রতি বছর ১ থেকে ১.২ কোটি তরুণ নতুন করে কর্মক্ষেত্রে যোগ দেবে, এবং যখন থেকে তারা উপার্জন ও ব্যয় শুরু করবে, তারা নিজেরা তো স্বাবলম্বী হবে, সেই সাথে আরো কোটি কোটি মানুষের দারিদ্র্য বিমোচন হবে।
কিন্তু এই জরিপের ফলাফল থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ভারতের তরুণ প্রজন্মের মাঝেই বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি- প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনই চাকরি খুঁজে পাচ্ছে না। অর্থাৎ ভারতের তথাকথিত 'জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশের' টিকিটিরও দেখা মিলছে না।
নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে এমন একটি জরিপের ফলাফল ফাঁস হওয়া বিষয়টিকে আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছে। নিঃসন্দেহে সরকার এই ফলাফল লোকচক্ষুর আড়াল করতে চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখেনি, কিন্তু এখন যেহেতু থলের বিড়াল বেরিয়ে গেছে, তাই এটি তরুণ চাকরিপ্রত্যাশী ভোটারদের মনে বর্তমান সরকারের ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাবের জন্ম দিতে বাধ্য।
দায়ী কে- সরকার না অর্থনীতি?
ভারতের অর্থনীতি ও আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও নতুন চাকরি সৃষ্টির পথে প্রধান অন্তরায়। আর এর জন্য কেবল মোদি সরকারকেই দোষারোপ করে লাভ নেই। মূল সমস্যার উৎস আরো প্রাচীন ও গভীর। তবে যেহেতু মোদি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন 'ন্যূনতম শাসন ও সর্বোচ্চ পরিচালন'-এর, যা মূলত দক্ষতা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক বিকাশকে ইঙ্গিত করে, তাই বেশ অনেকটা দায় তার উপরও বর্তায়। কারণ তিনি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। তার সরকার আরো দুটি কাজ করেছে, যা ভারতের অর্থনীতিতে এখন পর্যন্ত মারাত্মক রকমের বিরূপ প্রভাব ফেলেছে।
২০১৬ সালে মোদি সরকার সকল ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিলের ঘোষণা দেয়। এর মাধ্যমে দেশের মোট মুদ্রার ৮৬ শতাংশই অকেজো হয়ে যায়। অবৈধ নগদ অর্থের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল বটে, কিন্তু ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরবর্তীতে জানায় যে, সেই অর্থের বেশিরভাগই পুনরায় ব্যাংকিং খাতে ফিরে এসে।
ডিমনিটাইজেশন নামে পরিচিত এই ব্যবস্থা ভারতের অর্থনীতির বিশাল অংশকে নাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে সেসব ক্ষুদ্র ও মাঝারি অর্থনীতিকে, যেগুলো প্রাত্যহিক নগদ অর্থের আদান-প্রদানের উপর নির্ভরশীল ছিল। কৃষি ব্যবস্থাও মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়, কেননা কৃষকরা নগদ অর্থ আদান-প্রদানেই অভ্যস্ত ছিল। অনেক ছোটখাট ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। যারাও বা টিকে থাকতে পারে, তারা বেশিরভাগ চাকরির সুযোগ ও বিদ্যমান পদ বাতিল করে দেয়। ফলে বিষয়টি এমন দাঁড়ায় যে, তরুণরা নতুন চাকরি তো পাবেই না, বরং তাদের মধ্যে অনেকেও চাকরি হারাবে।
এরপর আবার ২০১৭ সালের জুলাইয়ে মোদি সরকার প্রচলন করে পণ্য পরিষেবা কর বা জিএসটির। এই কর ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ছিল ‘এক কর, এক বাজার, এক দেশ' এর ভিত্তিতে গোটা ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামোকে একীভূত করা। এর ফলে কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগে অর্থনীতির নয়া বুনিয়াদ তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয় বটে, কিন্তু এটি নতুন করে ছোট ব্যবসাগুলোকে বিকলাঙ্গ করে দেয়, যেগুলো ডিমনিটাইজেশনের ধাক্কা সামলে নতুন করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। কেননা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কর সংস্কার ব্যবস্থাটি যতটা কার্যকরী হবে বলে মনে হয়েছিল, বাস্তব প্রয়োগের পর তার কিয়দাংশেরও দেখা মেলেনি। এর ফলে নতুন চাকরি সৃষ্টির সুযোগও সাময়িকভাবে স্থবির হয়ে পড়ে।
আমরা যে জরিপের ফলাফল নিয়ে কথা বলছি, সেটির জন্য তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল ২০১৭ সালের জুলাই থেকে ২০১৮ সালের জুনের মধ্যে। এটিই ছিল ডিমনিটাইজেশন ও নতুন কর ব্যবস্থা প্রচলনের পর ভারতে প্রথম চাকরি সংক্রান্ত জরিপ। তাই এই জরিপ অনুযায়ী দেশের চাকরির বাজারে নিম্নগামিতার আশঙ্কা একপ্রকার অনুমিতই ছিল। কিন্তু এতটা যে ধস নামবে, তা ছিল অনেকের চিন্তারও বাইরে।
নির্বাচনে প্রভাব
গত বছর একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছিলেন, পাকোড়া বিক্রিও একধরনের কর্মসংস্থান, কারণ দৈনিক পাকোড়া বিক্রি করেই ২০০ রুপি আয় করা সম্ভব। তার এই বক্তব্য দেশের তরুণ সমাজের মাঝে ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল এবং বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। বিরোধী দলও বিদ্যমান অবস্থার ফায়দা লুটে বলেছিল, মোদি সাধারণ মানুষের চাকরির সুযোগ প্রত্যাশা নিয়ে অসংবেদনশীল আচরণ করছেন।
নির্বাচনের ঠিক আগে তাই এমন একটি জরিপের ফলাফল ফাঁস হওয়া মোদি সরকারকে বড় ধরনের চাপের মুখেই ফেলেছে। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টি ইতিমধ্যেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছে যে তারা ক্ষমতায় এলে দরিদ্রদের জন্য ন্যূনতম আয়ের নিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে।
সব মিলিয়ে মোদি সরকারের সামনে এখন বিশাল বড় দায়িত্ব: যে করেই হোক আগামী দুই মাসের মধ্যে ভারতের তরুণ প্রজন্মের আস্থা ফিরিয়ে আনা। কারণ তরুণ প্রজন্ম যদি মুখ ঘুরিয়ে নেয়, তবে নির্বাচনে জয় অনেকটাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। যদিও এমনটা বলার উপায় নেই যে শুধু চাকরির বাজারই নির্বাচনী লড়াইয়ে প্রভাব ফেলবে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও এখানে একটি মুখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সকল হিসাব-নিকাশকে পেছনে ফেলে বিজেপি কিংবা কংগ্রেস যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, সবার জন্য কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হিসেবেই আবির্ভূত হবে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/
This article is in Bengali language. It is about the unemployment problem in India, and whether or not Modi government is responsible for it.
Featured Image © AFP