Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

তাজিকিস্তানে ভারতীয় সামরিক উপস্থিতি এবং সংশ্লিষ্ট ভূরাজনৈতিক জটিলতা

প্রাক্তন কমিউনিস্ট পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত মুসলিম–অধ্যুষিত মধ্য এশীয় প্রজাতন্ত্রগুলো স্বাধীনতা লাভ করে। প্রাক্তন সোভিয়েত মধ্য এশিয়ায় ৫টি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল কিন্তু বিপুল পরিমাণ হাইড্রোকার্বনে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটিতে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরী রাষ্ট্র রাশিয়ার পক্ষে একাকী এই শূন্যতা পূরণ করা সম্ভব ছিল না।

ফলে বিভিন্ন বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তি মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টা শুরু করে, এবং এটি ‘নিউ গ্রেট গেম’ (New Great Game) নামে পরিচিতি অর্জন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপান, ইরান, তুরস্ক, পাকিস্তান এবং ভারত– বিভিন্ন রাষ্ট্র অঞ্চলটিতে নিজস্ব প্রভাব বলয় সৃষ্টির চেষ্টা শুরু করে। উল্লেখ্য, ‘গ্রেট গেম’ বলতে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার নিয়ে ব্রিটেন ও রাশিয়ার মধ্যেকার প্রতিযোগিতাকে বোঝানো হতো, এবং এজন্য বর্তমানে মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতাকে ‘নিউ গ্রেট গেম’ হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মধ্য এশিয়ায় যে নতুন রাষ্ট্রগুলোর সৃষ্টি হয়, সেগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্রতম, দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে অস্থিতিশীল রাষ্ট্র ছিল তাজিকিস্তান। রাষ্ট্রটি মধ্য এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র থেকে ব্যতিক্রম, কারণ মধ্য এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রগুলো জাতিগতভাবে ‘বৃহত্তর তুর্কি’ জাতির অংশ, কিন্তু তাজিক জাতি ‘বৃহত্তর ইরানি’ জাতির অংশ। অবশ্য মূল ইরানিদের সঙ্গে তাজিকদের নানাবিধ পার্থক্য রয়েছে, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হচ্ছে– ইরানিরা মূলত ইসলামের শিয়া মতবাদের অনুসারী আর তাজিকরা মূলত সুন্নি মতবাদের অনুসারী।

মানচিত্রে তাজিকিস্তান; Source: Pinterest

স্থলবেষ্টিত তাজিকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য দেশটি ভূকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাজিকিস্তানের উত্তরে কিরগিজস্তান, পূর্বে চীন, দক্ষিণে আফগানিস্তান এবং পশ্চিমে উজবেকিস্তান অবস্থিত। অর্থাৎ, দেশটির প্রায় চতুর্দিকে ‘ট্রাবল স্পট’ অবস্থিত। আফগানিস্তানে একটি গৃহযুদ্ধ চলছে, চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে উইঘুররা একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে লিপ্ত, কিরগিজস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই অস্থিতিশীল এবং উজবেকিস্তানের সঙ্গে তাজিকিস্তানের সীমান্ত দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। তদুপরি, আফগানিস্তানের অন্তর্গত সংকীর্ণ ‘ওয়াখান করিডোর’ পাকিস্তান (এবং পাকিস্তান–নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির) থেকে তাজিকিস্তানকে পৃথক করেছে। কিন্তু কার্যত তাজিকিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যবর্তী দূরত্ব মাত্র ১৬ কি.মি.। উল্লেখ্য, ঊনবিংশ শতাব্দীতে রুশ তুর্কিস্তান থেকে ব্রিটিশ ভারতকে ভৌগোলিকভাবে পৃথক করার জন্য ‘ওয়াখান করিডোর’টির সৃষ্টি করা হয়েছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মধ্য এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর মতো তাজিকিস্তানেও প্রভাব বিস্তারের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারত। ঐতিহাসিকভাবে ভারতবর্ষের সঙ্গে বর্তমান তাজিকিস্তান অঞ্চলের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল, এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর ভারত এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য উদগ্রীব ছিল। কার্যত নয়াদিল্লি থেকে মুম্বাইয়ের দূরত্বের (১,৪০১ কি.মি.) চেয়ে নয়াদিল্লি থেকে তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবের দূরত্ব (১,৩৫১ কি.মি.) কম। অবশ্য ঐতিহাসিক সংযোগের চেয়ে ভারতের জন্য তাজিকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তাজিকিস্তান আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নিকটবর্তী ছিল। এজন্য ১৯৯০–এর দশকে ভারত তাজিকিস্তানের সঙ্গে বিস্তৃত সামরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে।

আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ, এবং ১৯৪০–এর দশকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত ও আফগানিস্তান পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। ১৯৭০ ও ১৯৮০–এর দশকে আফগানিস্তানে চলমান গৃহযুদ্ধে ভারত আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে সমর্থন করে, এবং ১৯৯২ সালে আফগান কমিউনিস্ট সরকারের পতনের পর পাকিস্তানি–সমর্থিত তালিবানের বিরুদ্ধে আফগান ‘নর্দার্ন অ্যালায়েন্স’কে সমর্থন করে। এক্ষেত্রে ভারতের মূল উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানে পাকিস্তানি প্রভাব হ্রাস করা এবং তদস্থলে ভারতীয় প্রভাব বৃদ্ধি করা। রাশিয়া, ইরান, উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তানও নিজ নিন স্বার্থে এই যুদ্ধে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সহায়তা করছিল, এবং ভারত এই রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে নিজেদের কার্যক্রমকে সমন্বিত করে। উল্লেখ্য, এসময় তাজিকিস্তানেও গৃহযুদ্ধ চলছিল, এবং আফগানিস্তানকেন্দ্রিক ধর্মভিত্তিক তাজিক মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে দমন করা ছিল তাজিকিস্তানের সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। স্বাভাবিকভাবেই ভারত ও তাজিকিস্তান পারস্পরিক সহযোগিতার সাধারণ ক্ষেত্র খুঁজে পায়।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর (বামে) সঙ্গে তাজিকিস্তানি রাষ্ট্রপতি এমোমালি রাহমোন (ডানে); Source: The Jamestown Foundation

আফগানিস্তানের সঙ্গে ভারতের কোনো সীমান্ত নেই, এজন্য ভারত তাজিকিস্তানের মধ্য দিয়ে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র সরবরাহ করত। কিন্তু তাজিকিস্তান একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র, এজন্য ভারতকে ইরানের চাবাহার সমুদ্রবন্দর দিয়ে তাজিকিস্তানে এসব পৌঁছে দিতে হত। এসময় দক্ষিণ–পশ্চিম তাজিকিস্তানের ফারখোর শহরে ভারত একটি ছোট্ট সামরিক হাসপাতাল স্থাপন করে, যেখানে ভারতীয় সামরিক চিকিৎসকরা যুদ্ধাহত নর্দার্ন অ্যালায়েন্স যোদ্ধাদের চিকিৎসা করতেন। ২০০১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর যখন নর্দার্ন অ্যালায়েন্সের বিখ্যাত নেতা আহমদ শাহ মাসুদ আল–কায়েদা সদস্যদের আত্মঘাতী বোমা হামলায় গুরুতরভাবে আহত হন, তখন তাকে চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারযোগে ফারখোরের এই ভারতীয় হাসপাতালেই আনা হচ্ছিল, কিন্তু তিনি পথিমধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। সামগ্রিকভাবে, আফগানিস্তানে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে প্রক্সি যুদ্ধ চলছিল, সেটি পরিচালনার ক্ষেত্রে তাজিকিস্তান ছিল ভারতের জন্য ঘাঁটিস্বরূপ।

নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সহায়তার প্রেক্ষাপটে তাজিকিস্তানে ভারতীয় সামরিক ও গোয়েন্দা সংস্থার উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৬–৯৭ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং’ (R&AW) তাজিকিস্তানি সরকারকে প্রস্তাব করে যে, নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে রসদপত্র সরবরাহ, হেলিকপ্টার মেরামত এবং আফগানিস্তান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ফারখোর বিমানঘাঁটি ভারতকে ইজারা দেয়া হোক। উল্লেখ্য, ফারখোর বিমানঘাঁটি ছিল মূলত সোভিয়েত বিমানবাহিনীর একটি ঘাঁটি, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ঘাঁটিটি পরিত্যক্ত হয়। ভারত এই ঘাঁটি সংস্কার করে সেখানে এক স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান মোতায়েন করার পরিকল্পনা করে।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাজিকিস্তানকে জানায় যে, আফগান গৃহযুদ্ধে নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সহায়তা করার জন্য তারা ফারখোর বিমানঘাঁটি ব্যবহার করতে চায়। কিন্তু এটি স্পষ্ট ছিল যে, ভারতের মূল লক্ষ্য পাকিস্তানকে কৌশলগতভাবে ঘেরাও করে ফেলা। ফারখোর বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হলে সেগুলো নতুন একটি ভারতীয়–পাকিস্তানি যুদ্ধের ক্ষেত্রে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানের ওপর বোমাবর্ষণ করতে সক্ষম হবে। এর ফলে সম্ভাব্য ভারতীয়–পাকিস্তানি যুদ্ধের ক্ষেত্রে আফগানিস্তানকে ‘কৌশলগত গভীরতা’ (strategic depth) হিসেবে ব্যবহার করার জন্য পাকিস্তানি রণকৌশলবিদদের যে পরিকল্পনা ছিল, সেটি অকার্যকর হয়ে যাবে। কারণ তখন ভারতীয় যুদ্ধবিমান তাজিকিস্তান থেকে আফগানিস্তানের ভূমিতে পশ্চাৎপসরণরত পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালাতে পারত। উল্লেখ্য, পাকিস্তানি সমরবিশারদদের পরিকল্পনা ছিল, সম্ভাব্য ভারতীয়–পাকিস্তানি যুদ্ধে যদি পাকিস্তানি সৈন্যরা পাকিস্তানের মাটি থেকে বিতাড়িত হয়, তাহলে তারা আফগানিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করবে। এজন্যই পাকিস্তান বরাবর আফগানিস্তানে নিজেদের পছন্দনীয় একটি সরকারকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হিসেবে দেখতে চেয়েছে।

মানচিত্রে ফারখোর বিমানঘাঁটি, যেটি তাজিকিস্তানি ও ভারতীয় বিমানবাহিনী যৌথভাবে নিয়ন্ত্রণ করে; Source: Sand Prints

তাজিকিস্তানে বিমানঘাঁটি স্থাপনের মাধ্যমে যেসব ভূকৌশলগত সুবিধা অর্জন করা সম্ভব, সেগুলো ভারতীয় সরকারের কাছে পরিষ্কার ছিল। সুতরাং এই প্রচেষ্টা সফল করার জন্য নয়াদিল্লি সেসময় কোনো প্রচেষ্টা বাদ রাখে নি। তারা তাজিকিস্তানকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সামরিক সহায়তা প্রদান করে। গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত তাজিকিস্তানের সামরিক বাহিনী তখন বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিল, এবং তাজিকিস্তান–আফগানিস্তান সীমান্তে সক্রিয় মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলোকে মোকাবেলা করার সামর্থ্য তাদের ছিল না। এমতাবস্থায় ভারত তাজিকিস্তানের সশস্ত্রবাহিনীকে ২টি ‘এমআই–৮’ হেলিকপ্টার, বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জামের জন্য অতি প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, ট্রাক ও অন্যান্য যান, ১০,০০০ উর্দি এবং কম্পিউটার বিনা মূল্যে সরবরাহ করে। ১৯৯৮ সাল থেকে ভারতের ‘ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যাকাডেমি’তে তাজিকিস্তানি সৈন্য ও অফিসাররা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা শুরু করে, এবং তাদের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার ভারতীয় সরকার বহন করে। দুশানবেতে ‘তাজিক সামরিক ইনস্টিটিউট’ স্থাপনের ক্ষেত্রেও ভারত অর্থায়ন করে।

এসবের বিনিময়ে ২০০২ সালে তাজিকিস্তান ফারখোর বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় সৈন্য মোতায়েন করতে দিতে রাজি হয়। কিন্তু ঘাঁটিটি ভারতের একক মালিকানাধীনে ন্যস্ত করা হয়নি, বরং সেটিকে তাজিকিস্তানি ও ভারতীয় বিমানবাহিনীর যৌথ কর্তৃত্বাধীনে রাখা হয়। ২০০৬ সালে ভারত ঘাঁটিটিতে মিগ–২৯ যুদ্ধবিমানের একটি স্কোয়াড্রন মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত একটি বিশেষ সামরিক সুবিধা অর্জন করত, কিন্তু প্রক্রিয়াটি স্তিমিত হয়ে যায়।

ফারখোর বিমানঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি লাভের পাশাপাশি ভারত তাজিকিস্তানে আরেকটি বিমানঘাঁটি ইজারা লাভের প্রচেষ্টা চালায়। এই ঘাঁটিটি হচ্ছে দুশানবে থেকে ১০ কি.মি. দূরে অবস্থিত আয়নি বিমানঘাঁটি। সোভিয়েত আমলে এটি সোভিয়েত বিমানবাহিনীর একটি বড় ঘাঁটি ছিল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ফারখোর বিমানঘাঁটির মতো এটিও পরিত্যক্ত হয়। ভারত ঘাঁটিটি সংস্কারের কাজ হাতে নেয়, এবং ২০০২ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ভারতীয় সরকার আয়নি বিমানঘাঁটির সংস্কারের জন্য ৭ কোটি (বা ৭০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার ব্যয় করে। প্রথমে একটি ভারতীয় কোম্পানিকে এই কাজ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু কোম্পানিটি নির্ধারিত সময়ে কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। এরপর ভারতের আধা–সামরিক সংগঠন ‘বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন’কে ঘাঁটিটি সংস্কারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। ভারতীয়রা ঘাঁটিটির রানওয়ে প্রশস্ত করে এবং সেখানে অত্যাধুনিক বিমান চালনা সংক্রান্ত ও এয়ার ডিফেন্স সরঞ্জাম মোতায়েন করে।

মানচিত্রে ফারখোর ও আয়নি বিমানঘাঁটিদ্বয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে; Source: Wikimedia Commons

কিন্তু তাজিকিস্তানের মাটিতে ভারতীয় ঘাঁটি স্থাপনের প্রচেষ্টাকে অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তি ভালো চোখে দেখেনি। পাকিস্তান এটিকে তার নিজস্ব নিরাপত্তার প্রতি বিরাট এক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে, এবং ২০০৩ সালেই পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি পারভেজ মুশাররফ তাজিকিস্তানের নিকট আনুষ্ঠানিকভাবে দেশটিতে ভারতীয় বিমানঘাঁটি স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। চীনা–ভারতীয় ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে চীনও নিজের পশ্চিম সীমান্তে (অর্থাৎ অস্থিতিশীল জিনজিয়াং অঞ্চলের দোরগোড়ায়) ভারতীয় বিমানঘাঁটি স্থাপনকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখে। অবশ্য এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল রাশিয়ার ভূমিকা।

আফগানিস্তানে তালিবানবিরোধী যুদ্ধ পরিচালনার জন্য রাশিয়া মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সম্মতি প্রদান করেছিল। কিন্তু ২০০০–এর দশকের শেষদিকে মার্কিনিরা এতদঞ্চল থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে শুরু করে, এবং রাশিয়া এই শূন্যতা অন্য কাউকে পূর্ণ করতে দিতে আগ্রহী ছিল না। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে, কিন্তু ২০০০–এর দশক থেকে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ক্রমশ সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রেক্ষাপটে তাজিকিস্তানে ভারতীয় বিমানঘাঁটি স্থাপন প্রকারান্তরে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানকেই শক্তিশালী করবে বলে মস্কো বিবেচনা করছিল। এজন্য রাশিয়া আয়নি বিমানঘাঁটি ভারতকে ইজারা না দেয়ার জন্য তাজিকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। তাজিকিস্তান অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল, ফলে রুশ চাপ উপেক্ষা করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।

এর পাশাপাশি সেসময় ভারতীয় সরকার মধ্য এশিয়ায় কূটনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় ছিল, এবং ফারখোর বিমানঘাঁটিতে পূর্বের পরিকল্পনা মোতাবেক মিগ–২৯ বহর মোতায়েন করার প্রকল্পও তারা বাস্তবায়ন করেনি। ধারণা করা হয়, সেসময় তাজিকিস্তান সম্পর্কে ভারতীয় সরকারের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি ছিল না। এর ফলে ভারত তাজিকিস্তানে তাদের তখন পর্যন্ত তাদের অর্জিত প্রভাবকে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারেনি।

একটি চীনা–তাজিকিস্তানি যৌথ সামরিক মহড়ার সময় একজন চীনা ও একজিন তাজিকিস্তানি সৈন্য; Source: Eurasianet

ইতোমধ্যে ২০১১ সালের জানুয়ারিতে তাজিকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামরোখোন জারিফি ঘোষণা করেন যে, আয়নি বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় বা মার্কিন সৈন্য মোতায়েন করা হবে না। বরং সেখানে রুশ সৈন্য মোতায়েনের ব্যাপারে তাঁরা চিন্তাভাবনা করছেন। এটি ছিল তাজিকিস্তানে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করার ক্ষেত্রে ভারতের জন্য বড় একটি ধাক্কা। বর্তমানে আয়নি বিমানঘাঁটিতে ভারতীয় সামরিক উপস্থিতি নেই, কিন্তু ফারখোর বিমানঘাঁটিতে মোতায়েনকৃত ভারতীয় ‘উপদেষ্টা’দের রসদপত্র সরবরাহ করার জন্য এই ঘাঁটিটি ব্যবহৃত হয়।

২০১০–এর দশকে ভারতীয় সরকার তাজিকিস্তানের সঙ্গে তাদের সামরিক সম্পর্ক জোরদার করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু তাদের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এখন পর্যন্ত বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে বলে প্রতীয়মান হয় না। তাজিকিস্তানে চীনা প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে, এবং দেশটির অর্থনীতি ও রাজনীতিতে চীনের ভূমিকা উত্তরোত্তর শক্তিশালী হচ্ছে। অন্যদিকে, তাজিকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক সম্প্রসারণের যথেষ্ট ক্ষেত্র রয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত ভারতীয়–তাজিকিস্তানি বাণিজ্যিক সম্পর্ক তেমন ঘনিষ্ঠ নয়। এই পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনার জন্যও ভারত বিশেষ চেষ্টা করেনি। ফলে তাজিকিস্তানে চীন ও রাশিয়ার বিপুল অর্থনৈতিক প্রভাবের মোকাবিলা করা ভারতের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।

সম্প্রতি চীন তাজিকিস্তানের অভ্যন্তরে একটি সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। এটি ভারতের জন্য একটি কৌশলগত পরাজয়, কারণ এখন পর্যন্ত ফারখোর বিমানঘাঁঁটিতে ভারতীয় উপস্থিতি থাকলেও সেখানে কোনো ভারতীয় যুদ্ধবিমান মোতায়েন করা হয়নি। ফলে ঘাঁটিটির ভূকৌশলগত অবস্থানের সুবিধা নেয়া ভারতের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তদুপরি, সাম্প্রতিক বছরে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত অংশীদারিত্ব ঘনিষ্ঠ হয়েছে এবং চীনের সঙ্গে ভারত একটি রক্তাক্ত সামরিক সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় চীন ও রাশিয়া তাজিকিস্তানে ভারতীয় অবস্থানকে শক্তিশালী হতে দেবে কিনা, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ।

Related Articles