ইংরেজিতে একটা কথা আছে- ন্যাচারাল ল’ অব রিভেঞ্জ, অর্থাৎ প্রকৃতির প্রতিশোধ। প্রকৃতির নিজস্ব একটা নিয়ম রয়েছে। আপনি কারো সাথে অন্যায় করলে এর প্রতিদান আপনাকে দিতেই হবে। যার সাথে অন্যায় করছেন সে ক্ষমা করলেও প্রকৃতি তা কখনো ক্ষমা করবে না। করোনাভাইরাসের সংক্রমণে মানবজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়লেও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড কিন্তু তার সজীবতা ফিরে পেতে চলেছে। মানুষ যখন তার লণ্ডভণ্ড জীবনকে বাঁচিয়ে নিতে ব্যস্ত, তখন প্রকৃতিকে অগোছালো করার কিংবা দূষণ করার সময় আর তাদের নেই। আর সেই সুবাদে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে প্রকৃতির অভূতপূর্ব পরিবর্তন।
বেশ কয়েক যুগ ধরে বিশ্বের মোটামুটি সব দেশই উন্নয়ন করার নামে এমন এক প্রতিযোগিতায় নেমেছে, যেখানে জীবনধারণের মান এর গুণগত দিক থেকে বিশ্লেষণ না করে বরং টাকার অঙ্ক দিয়ে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে, উন্নয়ন করার তাগিদে নগরায়ন ও শিল্পায়নের নামে সবাই মেতে আছে পরিবেশ দূষণ করতে। এতে করে পৃথিবীর ওজোন স্তর ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে এবং দিনে দিনে দূষণের পরিমাণ পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর থেকে দূষণের পরিমাণ ও বিশ্বজুড়ে দেশগুলোর অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটছে। বর্তমানে বিশ্বে গড়ে ৫ জন ব্যক্তির একজন লক ডাউনের কারণে ঘরে বন্দি। পরিবেশ দূষণকারী প্রজাতি অর্থাৎ মানুষেরা গৃহবন্দী থাকার সুবাদে ইতিবাচক পরিবর্তন আসছে বিশ্বজুড়ে।
চীন শুধু করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থলই নয়, বরং পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বেশি বিষাক্ত ও ক্ষতিকর দ্রব্য তৈরি করারও মূল উৎস। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে লক ডাউন দেওয়ার কারণে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান, কলকারখানা ও যাতায়াত বন্ধ করা হয়, যা এখনো বেশ কিছু জায়গায় বহাল। চীনের বাস্তুসংস্থান ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের মতে, এসব কারণে ফেব্রুয়ারি মাসের বিশুদ্ধ বায়ুর গড় দিন সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২১.৫% বেড়ে গেছে। নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের গবেষক ফে লিউ জানান যে, তারা প্রথমবারের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস তথা বিষাক্ত গ্যাসের ক্ষেত্রে এত বড় পতন দেখেছে। ছোট ছোট পতন দেখা গেলেও এত বড় পতন কখনো দেখা যায়নি।
নাসার মতে, পূর্ব ও কেন্দ্রীয় চীনে সাধারণত যে পরিমাণ নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের উপস্থিতি দেখা যায়, তার চেয়ে বর্তমানে ১০-৩০% কমে গেছে। সকল প্রকার শৈল্পিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকার সুবাদে কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ক্ষেত্রেও পতন দেখা যাচ্ছে। সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি ক্লিন ওয়াটারের বিশ্লেষক লরি মিলিভারতার মতে, চীনে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে এই নিঃসরণের পরিমাণ ২৫% হ্রাস পেয়েছে। আর পাওয়ার প্লান্টগুলোতে কয়লার ব্যবহার কমেছে ৩৬%। বিশ্বের পরিবেশ দূষণের শতকরা ৩০ ভাগের জন্য দায়ী এই চীন। তাই এই পতন বিশ্বজুড়েই এক অনন্য পরিবর্তন আনতে পারে এবং আমাদের পরিবেশের জন্য অবশ্যই তা ইতিবাচক।
চীনকে ছাড়িয়ে ইতালিতে করোনাভাইরাসের কারণে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গিয়েছে এখন পর্যন্ত। ইতালিতে একেবারেই থেমে গেছে জীবনযাত্রা। ঘর থেকেই বের হওয়া অসম্ভব হয়ে গেছে মানুষের জন্য। এর মাঝে কলকারখানা খোলা থাকা কিংবা অতিরিক্ত জরুরি কারণ ছাড়া যানবাহন চলাচল করার তো প্রশ্নই ওঠে না। এসব কারণে মিলান ও উত্তর ইতালির বেশ কিছু অংশে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ ৪০% কমে গেছে। ভেনিস শহরের দূষিত পানি পরিষ্কার হতে শুরু করেছে৷
কোপারনিকাস আবহাওয়া সার্ভিসের পরিচালক ভিনসেন্ট হেনরি পিউক জানান যে, তাদের জন্য এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। অতীতে তারা এক বা দুই দিনের জন্য বড় ধরনের পরিবর্তন দেখলেও তা টেকসই ছিল না। আর বিষাক্ত গ্যাসের নিঃসরণের পরিমাণও কখনোই এত কম ছিল না। ইউরোপে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের একটি বড় অংশের জন্য মূলত ইতালির এই যানজট ও শিল্পকারখানা দায়ী। লক ডাউনের কারণে পুরো ইতালি জুড়েই এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ছবিতে বিষয়টি আরো পরিষ্কার হয়ে ফুটে ওঠে এসব তথ্য। পিউকের মতে, এসব তথ্য ও পরিসংখ্যান আরো কিছু দিন পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন এই প্যাটার্নটি বোঝার জন্য।
যুক্তরাজ্যে করোনাভাইরাস ছড়াতে শুরু করে ইতালিতে শুরু হওয়ার প্রায় ৭-৮ দিন পর থেকে। তবে তারা সতর্কতা অবলম্বন করার জন্য আগেভাগেই জনগণের চলাচলের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেন। সময়োপযোগী নির্দেশনার কারণে পুরো যুক্তরাজ্যেই পরিবেশ দূষণ কমে গিয়েছে। উল্লেখ্য যে, যুক্তরাজ্যে ৮০% নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের কারণ যানবাহন চলাচল। লক ডাউনের জন্য একটি ডিজেল চালিত গাড়ি থেকে গড়ে ৫২ মিলিগ্রাম দূষণকারী পদার্থ বায়ুতে মিলিত যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গত বছরের তুলনায় নিউ ইয়র্কে যানবাহনের চলাচল ৩৫% কমে গিয়েছে। যাতায়াত বন্ধ থাকায় কার্বন মনোক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ৫০% কমে যায়। কার্বন ডাই-অক্সাইড নিঃসরণের ক্ষেত্রে ৫-১০% হ্রাস দেখা যায় এবং মিথেনের ক্ষেত্রেও হ্রাস দেখা যায়। দক্ষিণ কোরিয়াতেও বায়ু দূষণের হার কমে গিয়েছে। এদেশে চীনের দূষণেরও প্রভাব সবসময় পড়ে। চীনে বায়ু দূষণের হ্রাস দক্ষিণ কোরিয়াকেও প্রভাবিত করে।
পৃথিবীর সুন্দর সব জায়গায় পর্যটকের সমাগম নেই, তাদের ফেলে যাওয়া ময়লার স্তূপও নেই। অর্থাৎ কোনো প্রকার দূষণও নেই। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ও নির্মল বায়ুর উপস্থিতি সকল প্রাণীকেই আকৃষ্ট করে। সেই সুবাদে জাপান ও থাইল্যান্ডে বানর ও হরিণ দিব্বি ঘুরে বেড়াচ্ছে। জনশূন্য ও দূষণ মুক্ত কক্সবাজারেও ভেসে উঠেছে ডলফিন। সংক্রমণের ভয়ে কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পাঁচ দিনের মাথায় প্রকৃতি তার নিজ রূপ ফিরে পায়। দেখা মিলে ১০-১২টি ডলফিনের।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায় যে, গত তিন দশকে এরকম দৃশ্য কারো দৃষ্টিগোচর হয়নি। লক ডাউনে আমরা মানুষেরা ঘরে থাকার পর থেকে বিভিন্ন দেশেই এরকম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পশুপাখিদের দেখা মিলছে। মানুষের কর্মকাণ্ডে যে তারাও অতিষ্ঠ- তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে।
তবে মানবজীবনের বিপর্যয় ডেকে আনা করোনাভাইরাস যে প্রকৃতির জন্য পুরোপুরি মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসছে ব্যাপারটা সেরকমও নয়। করোনাভাইরাস ধ্বংসে প্রতিনিয়ত জীবাণুনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। এসব রাসায়নিক দ্রব্য মিলিত হচ্ছে নদনদী, খাল-বিল এবং সাগরে। প্লাস্টিকের প্যাকেট সাগরে দু-একটা কম পড়লেও জীবাণু নাশের খাতিরে এসব রাসায়নিক দ্রব্যের আগমন ঘটেই চলেছে। করোনাভাইরাসের মতো প্রাণঘাতী ভাইরাস ধ্বংস হোক সেটা আমাদের সকলেরই কাম্য। সেই সাথে এই মহামারি থেকে কিছু শিক্ষা নেয়া আমাদের জন্য অনিবার্য।
এই ভাইরাসে মৃতের সংখ্যা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণে ব্যস্ত বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তাদের ও সাধারণ জনগণকে এটা ভুললে চলবে না যে, পরিবেশ দূষণ প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। প্রতি বছর চীনে ৯ মিলিয়ন তথা ৯০ লাখ মানুষ পরিবেশ দূষণের কারণে মারা যায়। মাত্র দুই মাসের দূষণ-মুক্ত জীবনযাত্রা চীনের ৪,০০০ শিশুকে যাদের বয়স ৫ বছরের নিচে এবং ৭৩,০০০ বয়স্ক ব্যক্তি; যাদের বয়স ৭০ বছরের বেশি তাদের বাঁচাতে সক্ষম। শুধু দুই মাসের নজরদারি ও সীমিত ভোগের কারণে এই বিশাল পরিবর্তন আনা সম্ভব হলে ভাবুন একটি সুষ্ঠু নিয়ম পালন করে চললে বিশ্বজুড়ে কত মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হবে।
Image source: orfonline.org
আর এক্ষেত্রে শুধু বিশেষজ্ঞ নয়, বরং সকলের সাহায্য কাম্য। করোনাভাইরাস আমাদেরকে কিছু শিক্ষা তো অবশ্যই দিচ্ছে। যেমন- অফিসের কিছু কিছু কাজ ঘরে বসেই সেরে ফেলা সম্ভব। এর জন্য তেল পুড়িয়ে, বায়ু দূষণ করে অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এভাবে প্রতি অফিস থেকে যদি একজন করে হলেও একদিন গাড়ি ব্যবহার না করে বা তেল পুড়িয়ে যাতায়াত না করে, সেটাও দূষণ কমাতে সহায়ক হবে। প্রযুক্তির কারণে পাঠদানের কিছু অংশও অনলাইনে পরিচালনা করা সম্ভব। মানুষের অপ্রয়োজনীয় যাতায়াত কিছুটা সীমিত করা গেলে তা পরিবেশের জন্যই ভালো। সীমিত করা মানে কিন্তু জোরপূর্বক ঘরে বসিয়ে রাখা নয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অফিসের কারণেই বেশিরভাগ মানুষ ঘরের বাইরে যায়। অপরিহার্য কাজগুলো করতে যাওয়া কিছু মানুষকেও ঘরে রাখা গেলে বায়ু দূষণ, মাটি দূষণ, পানি দূষণ তথা পুরো পরিবেশ দূষণ কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাছাড়া বাইরে গেলে কিভাবে চলা উচিত, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় কী করা উচিত বা নিজেকে ও পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে কী কী করা যেতে পারে, তা এই করোনাভাইরাস আমাদেরকে ভালো করেই শিখিয়ে দিচ্ছে।
This article is in Bangla language. It's about how coronavirus is beneficial for the environment. Sources have been hyperlinked in this article.
Featured image: orfonline.org