Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বর্ণিল ইতালিতে ছড়িয়ে পড়েছে বর্ণবাদের বিষবাষ্প

গত ৫ ডিসেম্বর (বৃহস্পতিবার) বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে বিতর্কের ঝড় তোলে ইতালির ক্রীড়া দৈনিক কোরিয়ের দেলো স্পোর্ত। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে বর্ণবিদ্বেষ ছড়ানো এবং গ্রহণযোগ্যতার সীমা ছাড়ানোর।

পরের দিন, শুক্রবার, সিরি এ-তে অনুষ্ঠিতব্য ইন্টার মিলান ও রোমার বিরুদ্ধে ম্যাচকে সামনে রেখে দৈনিকটি ছাপে রোমেলো লুকাকু ও ক্রিস স্মলিংয়ের ছবি, সাথে শিরোনাম “ব্ল্যাক ফ্রাইডে”।

আর এতেই ক্ষেপে যায় বর্ণবাদবিরোধী গোষ্ঠী ‘ফেয়ার’, যারা টুইটারে কোরিয়ের দেলো স্পোর্তের শিরোনামটি রিটুইট করে লেখে, “প্রতিদিনই বর্ণবাদের আগুনে ঘি ঢালছে গণমাধ্যম।”

এছাড়া রোমার ইংরেজি ভাষার টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকেও এই শিরোনামের প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে লেখা হয়, “ফুটবল হলো আবেগ, সংস্কৃতি ও ভ্রাতৃত্ববোধ। আমরা সবসময়ই যেকোনো ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলাম, এবং থাকব।”

ইন্টার মিলানের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী এসি মিলানও টুইটারে লেখে, “বর্ণবাদের প্রতি এ ধরনের অবজ্ঞা একদমই গ্রহণযোগ্য নয়, এবং আমরা কখনোই এ ধরনের ইস্যুতে নীরব থাকব না।”

বিতর্কিত সেই শিরোনাম; Image Source: Corriere dello Sport

কোরিয়ের দেলো স্পোর্ত অবশ্য এ ঘটনায় নিজেদের দায় স্বীকার করেনি। বরং তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত বিবৃতিতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলেছে, তাদের লেখক নাকি ফুটবল দুনিয়ার বৈচিত্র্যকে ‘উদযাপন’ করতে চেয়েছিল।

“এটি ছিল খুবই নিষ্পাপ একটি আর্টিকেল, যেখানে বিষয়টিকে সাংবাদিক রবার্তো পেরেরো খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যারা একে বিষাক্ত করে তুলেছে, তাদের নিজেদের মনেই আসলে বিষ আছে।”

এ পর্যন্ত পড়ে আরো অনেকেরই নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে, আসলেই তো, একজন শ্বেতাঙ্গ ও একজন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়ের ছবি ছেপে পাশে “ব্ল্যাক ফ্রাইডে” লেখায় কী এমন বর্ণবাদ হলো! এ তো তিলকে তাল করার মতো অবস্থা!

কিন্তু না। আপনি যদি ইতালির সমাজ-সংস্কৃতি সম্পর্কে অবগত থাকেন, তাহলে আর আপনার এমন শিরোনামকে নিছক বিচ্ছিন্ন ঘটনা কিংবা অনুদ্দেশ্যপ্রণোদিত মনে হবে না। আর যদি সেরকম কিছু হয়ও, তারপরও ইতালির মতো একটি দেশে এমন শিরোনাম দেয়ার আগে যেকোনো সম্পাদকের দশবার ভাবা উচিৎ, কেননা সেখানে এই শিরোনামকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

কেন বলছি এ কথা? চলুন তাহলে সাম্প্রতিক আরো কিছু উদাহরণ দেয়া যাক।

বারবার বর্ণ বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন লুকাকু; Image Source: Getty Images

উপরের ঘটনার সাথে জড়িত লুকাকুকেই এই মৌসুমের শুরুতেও বর্ণবাদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। বেলজিয়ান ফরওয়ার্ড যখন কাগলিয়ারিতে সিরি এ-র একটি ম্যাচে ইন্টার মিলানের হয়ে পেনাল্টি কিক নিতে যাচ্ছিলেন, তখন দর্শকরা তাকে উদ্দেশ্য করে ‘বানর’ বলে চিৎকার দিতে থাকে। বলাই বাহুল্য, তাকে এমন ডাকার পেছনে প্রধানতম কারণ তার গায়ের রঙ।

সেপ্টেম্বর মাসে এই লুকাকুকে নিয়েই মজা করেছিলেন এক অভিজ্ঞ ইতালিয়ান ফুটবল বিশেষজ্ঞ। এক টকশোতে তিনি বলেছিলেন, “কেবল কলা খেতে দিলেই লুকাকুতে থামানো যাবে।” আবারো সেই ‘বানর’ রেফারেন্স, যা পক্ষান্তরে লুকাকুর কৃষ্ণবর্ণকেই নির্দেশ করে। যথারীতি এটি নিয়েও যথেষ্ট জলঘোলা হয়, এবং টক-শো থেকে বাদ পড়ে যান ঐ বিশেষজ্ঞ।

এছাড়া নভেম্বরের শুরুতেও ইতালিতে বর্ণবৈষম্যের শিকার হয়েছিলেন ব্রেশার স্ট্রাইকার মারিও বালোতেল্লি। সিরি এ-তেই হেল্লাস ভেরোনার বিরুদ্ধে ম্যাচে দর্শকরা তার গায়ের রঙ নিয়ে কটূক্তি করতে শুরু করলে তিনি মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দেন।

ঘটনা শুধু এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরে সিরি এ-র আরেক ম্যাচ চলাকালীন সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে ব্রেশার প্রেসিডেন্ট বলেন, বালোতেল্লির সমস্যা হলো তিনি একজন “কৃষ্ণাঙ্গ”, এবং তিনি “ফরসা হওয়ার চেষ্টা করছেন।” অবশ্যই এমন মন্তব্যে বালোতেল্লির আরো খারাপ লাগার কথা, যদিও ক্লাব কর্তৃপক্ষ পরবর্তীতে দাবি করে যে মন্তব্যটি ছিল উপহাসমূলক, এবং এটি করা হয়েছিল বালোতেল্লির সমালোচকদের উদ্দেশ্য করে।

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন বালোতেল্লিও; Image Source: Daniele Mascolo/Reuters

সুতরাং একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার, গত কয়েক বছর ধরে ইতালির ফুটবলে যে বর্ণবাদের কালো ছায়া নেমে এসেছে, সেটি বিন্দুমাত্র হ্রাস পায়নি চলতি বছরও। বরং সাম্প্রতিক সময়ে এমন ঘটনার প্রবণতা আরো বেড়েছে।

ইতালিতে বর্ণবাদের বিষয়টি যে শুধু ফুটবলেই দেখা যায়, তা কিন্তু নয়। বর্ণবাদ ঢুকে গেছে ইতালীয় সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে। সেটির একটি প্রামাণ্য দৃষ্টান্তের দেখা আমরা পাই নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত নিকোল ফিলিপের লেখায়। ইতালিতে কাটানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি লেখেন:

“পাঁচ বছর আগেও, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে উপস্থিতির অভিজ্ঞতা আমার খুব একটা ছিল না। মানে আমি বলতে চাচ্ছি, কয়েকবার পরিবারের সাথে ছুটি কাটাতে ক্যারিবিয়ান ও মেক্সিকোতে আমি গিয়েছিলাম বটে, কিন্তু তারপরও আমার জানা ছিল না একজন কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে সম্পূর্ণ একা একা দেশের বাইরে কাটানোর অনুভূতি কেমন হতে পারে।

তারপর আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমার জুনিয়র ইয়ারের ফল সেমিস্টারটা দেশের বাইরে, ফ্লোরেন্স, ইতালিতে কাটানোর। সফোমোর ইয়ারে থাকতে আমার দুই রুমমেটই পড়াশোনা করেছিল ইতালিতে, এবং তারা তাদের ইতালিতে কাটানো অভিজ্ঞতা নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিল। তারা ইতালিতে ছবির মতো সুন্দর ভিলায় থাকা, মজাদার পার্টি করা আর ইতালিয়ান রোমান্স নিয়ে গালভরা গল্প করত। তাই আমিও প্রস্তুত হয়ে গেলাম ইতালিতে আমার নিজের আনন্দ, খাদ্যরস এবং ইউরোপিয়ান প্রেম কাহিনীর জন্য।

কিন্তু তখন আমি এতটাই উত্তেজিত যে, তাদের সাথে আমার একটি বড় পার্থক্যই আমার নজরে আসেনি। সেটি হলো, আমার রুমমেটরা কিংবা দেশের বাইরে যারা পড়াশোনা করতে যায় তাদের বেশিরভাগই শ্বেতাঙ্গ। অন্যদিকে আমি হলাম একজন আফ্রিকান-আমেরিকান নারী, যার গায়ের রঙ ডার্ক চকোলেটের মতো, আর ঠোঁট পরিপূর্ণ।

ফ্লোরেন্সে অবস্থিত ৫৭ একর জুড়ে বিস্তৃত নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে পৌঁছে সেখানকার সৌন্দর্যে আমি বিমোহিত হয়ে গেলাম। এরপরই এলো আমাদের ওরিয়েন্টেশন। ইতালীয় নির্দেশকরা আমাদেরকে বললেন সেখানকার রীতিনীতি ও প্রথা সম্পর্কে, কী করা যাবে আর কী করা যাবে না। তবে যে জিনিসটি আমার সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে তা হলো এক নারী আমাদেরকে বললেন মনে রাখতে যে ইতালীয়রা কথাবার্তায় খুবই ‘সাহসী’, ‘ঠোঁটকাটা’, এবং ‘পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট’।”

ইতালিতে উচ্চশিক্ষার্থে যাওয়া শিক্ষার্থীদের মোকাবেলা করতে হয় বর্ণবাদের; Image Source: Eleni Kalorkoti/New York Times

এরপর গোটা আর্টিকেল জুড়ে লেখিকা বর্ণনা করেছেন কীভাবে ইতালিতে কাটানো সময়গুলোতে প্রতি পদে পদে তাকে বর্ণবৈষম্য মোকাবেলা করতে হয়েছে, কীভাবে ইতালির স্থানীয় মানুষজন কৃষ্ণাঙ্গ বলে তাকে অবজ্ঞা করেছে, হয়রানি করেছে, বৈষম্য করেছে। এছাড়া কথায় কথায় কৃষ্ণাঙ্গ বলে অপমান কিংবা আকারে-ইঙ্গিতে বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়া তো ছিলই। এই বিষয়গুলো কেমন হতে পারে, তা তো নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন। আপাতত তাই মনে রাখুন ওরিয়েন্টেশন অনুষ্ঠানে এক নারী নির্দেশকের বলা ওই কথাটুকু: “ইতালীয়রা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট।”

গায়ের রঙের ফলে করা বৈষম্য থেকে এবার আমরা নজর ফেরাই ইতালিতে অন্য আর যে কারণে বৈষম্য করা হয় সেটির দিকে। বলছি অ্যান্টি সেমিটিজম বা ইহুদিবিদ্বেষের কথা।

গত নভেম্বরেই লিলিয়ানা সেগরে নামে ৮৯ বছর বয়সী হলোকাস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া এক নারীকে পুলিশি সুরক্ষার আওতায় আনতে হয়েছে। কেননা ইতালির ইহুদিবিদ্বেষীরা তাকে ক্রমাগত হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। অবশেষে তিনি গণমাধ্যমের সামনে এসে বিষয়টি খোলাসা করলে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় সবাই। একে একে সামনে আসতে থাকে এমন নানা উদাহরণ, যেগুলো নিয়ে ইতোপূর্বে খুব একটা আলোচনা হয়নি।

যেমন- অক্টোবরে পাবলিক প্রসিকিউটররা প্রকাশ করেছিলেন “শোয়াহ পার্টি” নামের একটি প্রাইভেট হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের অস্তিত্ব, যেখানে ইতালির কিশোরবয়সীরা ঘৃণা ছড়ায় অভিবাসীদের বিরুদ্ধে, প্রচার করে হিটলার ও আইএসের আদর্শ, এবং বিনিময় করে শিশু পর্নোগ্রাফিও।

এছাড়া মিলানভিত্তিক ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে কাজ করা দ্য অবজারভেটরি নামের একটি সংস্থা উপস্থাপন করে ২০১৯ সালের শুরু থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ‘ঘৃণা ছড়ানো’র ১৯০টি ঘটনা, যা ২০১৮ ও ২০১৭ সালের থেকে বেশি, এবং বেশিরভাগই ঘটেছে অনলাইনে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে।

প্রতিদিন প্রায় ২০০ হত্যার হুমকি পান সেগরে; Image Source: Getty Images

উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ২ নভেম্বর ফ্রা-ফ্রা-ফ্রা নামের একটি অ্যাকাউন্ট থেকে ফেসবুকে পোস্ট করা একটি মিমের কথা, যেখানে লিলিয়ানা সেগরে বলছেন, “আমরা (ইহুদিরা) পুরো বিশ্বজুড়ে আমাদের সরকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছি, এবং প্রত্যেক ইহুদির অধীনে থাকবে ২,৭০০ জন করে দাস।”

“Antisemitism in Italy – 2018” নামক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে আরো চমকপ্রদ একটি তথ্য, যেখানে জানানো হয়েছে ইতালিতে ইহুদিবিদ্বেষ কোনো বিশেষ শ্রেণীতে সীমাবদ্ধ নেই। সকল শ্রেণী, পেশা এবং রাজনৈতিক আদর্শের মানুষই বিভিন্নভাবে অনলাইনে ইহুদিবিদ্বেষী কনটেন্ট পোস্ট করে থাকে।

এ থেকে আরো একবার প্রমাণ হয়ে যায়, ইতালিতে বর্ণবাদের পাশাপাশি জাতিগত বৈষম্যও কতটা তুঙ্গে। গোটা বিশ্বব্যাপী যেখানে এই বিষয়গুলো হ্রাসকরণের প্রচেষ্টা চলছে, সেখানে ইতালিতে কীভাবে এগুলো ক্রমশ বেড়েই চলেছে?

এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার চেষ্টা করা হয় সম্প্রতি পরিচালিত একটি জরিপে। এবং সেখানে দেখা গেছে, ইতালির অর্ধেকেরও বেশি মানুষের কাছেই বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যকে “ন্যায়সঙ্গত” বলে মনে হয়। অর্থাৎ ইতালির মানুষ এই কাজগুলো শুধু যে করছে তা-ই নয়, বেশিরভাগ মানুষ এগুলোকে কোনো অন্যায়-অপরাধ বলেও মনে করছে না। তাদের মতে এগুলো করা খুবই স্বাভাবিক!

১,৫০০ মানুষকে নমুনা হিসেবে ধরে জরিপটি চালানো হয়, যেখানে শতকরা ১০ ভাগ অংশগ্রহণকারী বলেছে যে সবসময়ই বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্য ন্যায়সঙ্গত। আরো শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ বলেছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই কাজগুলো গ্রহণযোগ্য হতে পারে। বিষয়টি নির্ভর করছে ওই বিশেষ পরিস্থিতির উপর। অপরদিকে বাকি শতকরা ৪৫ ভাগ মানুষ বলেছে যেকোনো পরিস্থিতিতেই এই কাজগুলো অসমর্থনীয়।

অর্ধেকের বেশি ইতালীয় বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যকে মনে করে ন্যায়সঙ্গত; Image Source: AFP

এ জরিপ থেকে হয়তো এটি প্রমাণিত হয় না যে ইতালির সব মানুষই বর্ণবাদী ও জাতিগত বিদ্বেষী হয়ে উঠেছে। তবে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির জানান দেয় এই জরিপ তা হলো: ইতালির সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের এই কাজগুলোর প্রতি নীরব সমর্থনও রয়েছে, যে কারণে অল্প কিছু মানুষ যারা কাজগুলো করে, তাদেরকেও কোনো ধরনের সামাজিক প্রতিরোধের ভয়ে থাকতে হয় না। আর এটি নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না যে একটি সমাজে কোনো অপরাধ তখনই বাড়বে, যখন সমাজের অধিকাংশ মানুষ সেটিকে অপরাধ হিসেবেই গণ্য করবে না, এবং সেটির বিরোধিতাও করবে না।

এখন প্রশ্ন হলো, কেন বেশিরভাগ ইতালীয় এমন? একটি কারণ অবশ্য এই যে তারা নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে শ্রেয় মনে করে, শিল্প-সংস্কৃতিতে নিজেদেরকে সর্বাপেক্ষা উত্তম ভাবে। তবে তারচেয়েও বড় কারণ সম্ভবত তাদের ঠোঁটকাটা বা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট স্বভাব।

সহজ কথায় বলতে গেলে, পলিটিক্যাল কারেক্টনেস অর্থ হলো এমন সব কথাবার্তা বা আচার-আচরণ এড়িয়ে চলা, যার মাধ্যমে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর অনুভূতিতে আঘাত হানা হয়। এক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নির্ধারিত হয়ে থাকে সাধারণত তাদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায় বা যৌন অভিমুখিতার উপর ভিত্তি করে।

ইতালির মানুষের মধ্যে এই পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের বিষয়টিই অনুপস্থিত। তারা জানে না কোন ধরনের কথাবার্তা বা আচার-আচরণ অন্যদের অনুভূতিতে আঘাত হানতে পারে, আর তাই তারা এগুলো এড়িয়ে চলারও কোনো চেষ্টা করে না। এবং এই না এড়িয়ে চলাটাই তাদের আদর্শে পরিণত হয়েছে।

পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের দিক থেকে ইতালি এতটাই পিছিয়ে আছে যে, সেখানকার সংসদে যখন বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যের অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখার জন্য একটি কমিশন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো প্রথমে সেগুলোর বিরোধিতা, এবং শেষ পর্যন্ত পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করল। কারণ তাদের মতে ঘৃণার বিরুদ্ধে কমিশন গঠনের ধারনাটি নাকি ‘অরওয়েলিয়ান’ এবং ‘সোভিয়েত’।

এ কথা কখনোই দাবি করা যাবে না যে ইতালিতে বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্য খুবই সাম্প্রদায়িক একটি বিষয়। সেই উনবিংশ শতক থেকেই দেশটিতে তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদ’-এর প্রচলন ছিল। জাতীয়ভাবে সেটি একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী শাসনামলে, যখন দেশটি নাৎসি জার্মানির সাথে সখ্য গড়ে তোলে এবং অ্যান্টি সেমিটিক আইন প্রণয়ন করে।

তারপরও আধুনিক সময়ে দেশটিতে বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যের প্রকোপ একটু যেন বেশিই দেখা যাচ্ছে, বিশেষত অন্যান্য দেশে যখন এগুলো অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। চলতি দশকের শুরুর দিকেই, ২০১১ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক প্রতিবেদনে দাবি করে যে ইতালীয় সমাজে জেনোফোবিয়া তথা বিদেশীদের প্রতি ভীতির প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৭ সালে পিউ রিসার্চ সেন্টারের আরেক গবেষণা থেকে উঠে আসে যে ইতালিই হলো পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে বর্ণবাদী দেশ। সেখানে বলা হয়েছিল যে ইতালীয়দের উগ্র জাতীয়বাদের কারণেই তারা কৃষ্ণবর্ণের অধিকারী মানুষ, অভিবাসী এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি তীব্র ঘৃণা পোষণ করে।

পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে বর্ণবাদী দেশ ইতালি; Image Source: AFP

অনেক বিশেষজ্ঞই বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্যের পেছনে ইন্টারনেটের ভূমিকাকে দায়ী করে থাকে। অবশ্যই ইন্টারনেটের বিশাল ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ইন্টারনেট তো বর্তমানে সারা বিশ্বেই বিদ্যমান। তারপরও কেন ইতালিতেই এগুলোর আধিক্য এতটা ক্রমবর্ধমান? এক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকাকেও সমানভাবে দায়ী করা যেতে পারে। শুরুতেই তো দেখেছেন কোরিয়ের দেলো স্পোর্ত কীভাবে বর্ণবাদের বিষবাষ্প ছড়ানোর চেষ্টা করেছে। এছাড়া ইতালীয় ফুটবলে নিয়মিত বর্ণবাদের উপস্থিতি সত্ত্বেও কেন তারা একে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি, বারবার আক্রান্ত খেলোয়াড়দের উপরই দায় চাপানোর চেষ্টা করেছে, সে প্রশ্নও থেকেই যায়।

পরিশেষে বলা যায়, বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্য ইতালীয় সংস্কৃতির খুব গভীরে ঢুকে গেছে। বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে সমালোচনা হলেও, এখন পর্যন্ত সে দেশে এটি প্রতিরোধের জন্য খুব বেশি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। তাই ইতালীয় সমাজ থেকে খুব শীঘ্রই যে বর্ণবাদ ও জাতিগত বৈষম্য দূর হবে না, সে পূর্বানুমানও অনায়াসে করে দেয়া যায়।

বিশ্বের চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কেঃ roar.media/contribute/

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া অবিসংবাদিত নেতা নেলসন মেন্ডেলা সম্পর্কে জানতে পড়তে পারেন এই বইটি:

১) বর্ণবাদ বিরোধী অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা

This article is in Bengali language. It discusses the ever rising racism in Italy. Necessary references have been hyperlinked inside.

Featured Image © gogga.net

Related Articles