Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জাপানের কামিকাতসু: বিশ্বের প্রথম আবর্জনা মুক্ত শহর

সবুজ শ্যামল ধানক্ষেত ও বন-পাহাড়ের কোল ঘেঁষে, জাপানের পশ্চিমাঞ্চলের শিকোকু দ্বীপে অবস্থিত, সবচেয়ে ছোট্ট শহরটির নাম কামিকাতসু। ১০৯.৬৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ শহরে জনসংখ্যা মাত্র ১৩৭৩ জন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১৩ জন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই জিরো ওয়েস্ট প্রসঙ্গে বিশ্ববাসীর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে জাপানের এই ছোট্ট শহরটি।

প্রচলিত পদ্ধতিতে আবর্জনা পুড়িয়ে, মাটি চাপা দিয়ে কিংবা পানিতে ফেলা এড়িয়ে পুনর্ব্যবহার করার পরিবেশবান্ধব প্রক্রিয়াকে জিরো ওয়েস্ট বলা হয়। ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানে প্রথম জিরো ওয়েস্ট কর্মসূচী হাতে নেওয়ার মধ্য দিয়ে কার্যোপযোগী বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে কামিকাতসু।

শহরজুড়ে পথে ঘাটে কোথাও নেই ময়লা ফেলার জায়গা। এমনকি শহরটিতে কোনো ময়লার গাড়িও নেই। তবুও কোথাও চোখে পড়বে না এক টুকরো ময়লা আবর্জনা। কারণ এখানকার বাসিন্দারা নিজেরাই তাদের আবর্জনা পরিষ্কার করে নিয়ে আসেন ওয়েস্ট রিসাইকেলিং সেন্টারে। সেখানে এসব আবর্জনা সুনির্দিষ্টভাবে ৩৪টি ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ করে রিসাইকেলিংয়ে পাঠানো হয়।

আবর্জনা পরিষ্কার করে প্রয়োজনে ধুয়ে শুকিয়েও নিতে হয়; Image Source: DailyMail

কামিকাতসু শহরের ওয়েস্ট কালেকশন সেন্টারে খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, কার্টন, ফ্লায়ারসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজ জাতীয় দ্রব্যের জন্য নির্দিষ্ট ঝুড়ি আছে। একইভাবে, অ্যালুমিনিয়াম, স্প্রে, স্টিল এসবের জন্য ভিন্ন ভিন্ন জায়গা আছে। এমনকি প্লাস্টিক বোতল ও বোতলের ক্যাপের জন্যও আছে নির্দিষ্ট স্থান। এগুলো সহ মোট ৩৪টি ক্যাটাগরিতে বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থকে সাজাতে হয় কামিকাতসুর বাসিন্দাদের। নিঃসন্দেহে এটি বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এ পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হতে তাদের বেশ সময়ও লেগেছে। কামিকাতসুর স্থানীয় এক তরুণ বলেন,

“একবার অভ্যাস হয়ে গেলে, করতে আর তেমন সমস্যা হয় না। এখন তো আমাদের খুব বেশি ভাবতেও হয় না। ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় সুনির্দিষ্টভাবে আবর্জনা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখাটা এখন আমাদের জন্য খুবই স্বাভাবিক একটি বিষয়।”

রিসাইকেলিং সেন্টারে একজন কর্মী আবর্জনা সাজানোর প্রক্রিয়াটি দেখাশোনা করেন। ঠিকঠাক জায়গায় ঠিকঠাক আবর্জনা যাচ্ছে কিনা, এটা নিশ্চিত করাই তার দায়িত্ব।

প্রতিটি বস্তুকে সাজানোর জন্য আছে নির্দিষ্ট নীতিমাল; Image Source: DailyMail

২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতিটি বস্তু খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হয় বলে শহরটির ৪০% বাসিন্দাই এ পদ্ধতি পছন্দ করতেন না। কিন্তু, তাতেও বদল হয়নি শহরের আইন। কারণ, বর্জ্য পদার্থ পোড়ানোর জন্য চুল্লি কেনা ও ব্যবহার করার চেয়ে এ পদ্ধতিটি অনেক বেশি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। শহরটিতে প্রায় ৮০% বর্জ্য পদার্থই রি-সাইকেল করা হয়। ২০২০ সাল নাগাদ ‘জিরো ওয়েস্ট সিটি’ হবার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে শহরটি।

শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা চর্চায় তাদের জীবন হয়ে উঠেছে দুষণমুক্ত; Image Source: Independent.co

উচ্চাকাঙ্ক্ষী স্বপ্ন ছোঁয়ার লক্ষ্যে কাজ করে ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে কামিকাতসু। কিন্তু, কামিকাতসু ছাড়াও জিরো ওয়েস্ট সিটি হবার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে আরও কয়েকটি শহর। সিটি-ল্যাবকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইন্সটিটিউট ফর লোকাল সেলফ রেলায়েন্স এর কো-ফাউন্ডার ও প্রেসিডেন্ট নিল সেল্ডম্যান বলেন,

‘ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলিতে কয়েক লক্ষ মানুষ আছে। সেখানে প্রায় ৮০ শতাংশ বর্জ্য রিসাইকেল করা হয়। স্যান ফ্রান্সিসকোতে ৭০ শতাংশ। এছাড়াও, আমেরিকার বেশ কয়েকটি শহরে এ হার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ইতালিতেও এখন কামিকাতসুতে ব্যবহৃত পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে।’

কিন্তু, সেল্ডম্যানের মতে এসব নিয়ে মূলত কাজ করে যাচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠনগুলো। এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সিগুলোর প্রকাশিত সর্বশেষ তথ্যানুসারে, আমেরিকায় রিসাইকেলিং রেট এখন ৩৪ শতাংশ। ওয়াশিংটন ডিসিতে তো অবস্থা আরও ভয়াবহ। শহরটিতে মাত্র ১৬ শতাংশ বর্জ্য রি-সাইকেল করা হয়।

ওয়াশিংটন ডিসির পথ ঘাটের অতিসাধারণ একটি দৃশ্য; Image Source: Vox

সেল্ডম্যানের মতে এ সমস্যার পেছনে প্রধান কারণ দুইটি। প্রথমত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বাজার দখল করে রাখা কোম্পানিদ্বয়ের সিংহভাগ আয় আসে ল্যান্ডফিল থেকে। তাই, ব্যবসার সাথে সাংঘর্ষিক কোনো পদ্ধতিতে তারা আগ্রহী নয়। বর্জ্য পদার্থ মাটি চাপা দেয়ার ব্যবস্থাপনাই ল্যান্ডফিল নামে পরিচিত। আর দ্বিতীয় কারণটি হলো রাজনীতি।

‘রিপাবলিকানরা মনে করে সমুদ্রের উচ্চতা মোটেও বাড়ছে না। বাড়লেও তাদের কিছু যায় আসে না। ওদিকে বার্নি স্যান্ডার্স বাদে, বাকি দুই ডেমোক্র্যাট প্রার্থীরও এসব নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই।’

 বর্তমানে জাপানে প্রতিটি ব্যবসা পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সবার আগে বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হয়। আর জাপানের সর্টিং সিস্টেমও বর্তমানে ব্যাপকতার দিক থেকে সারা বিশ্বে অন্যতম। জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ইয়োকোহামার জনসংখ্যা ৩.৭ মিলিয়ন। সম্প্রতি সেখানকার বাসিন্দাদেরকে ২৭ পাতার একটি ম্যানুয়াল দেওয়া হয়েছে। নতুন এ নীতিমালায় বিস্তারিত বলা হয়েছে, কীভাবে তাদের নিত্যদিনকার বর্জ্যকে ৫০০টি ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ করতে হবে।

নিয়মিত নিজ নিজ বর্জ্য নিয়ে আসেন কামিকাতসুবাসীরা; Image Source: KhaosodEnglish

কামিকাতসুর রিসাইকেলিং স্টেশনটিকে রি-সাইকেল এক্সচেঞ্জ শপও বলা যায়। শহরের বাসিন্দারা নিয়মিত এখানে এসে তাদের অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে যাবার পাশাপাশি, পছন্দসই জিনিসপত্র বিনামূল্যে বাড়িতে নিয়ে যাবার সুযোগও পান। 

রাস্তার শেষ মাথার একটি ফ্যাক্টরিতে স্থানীয় এক নারী ফেলে দেওয়া জিনিসপত্র ব্যবহার করে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করেন। যেমন, পুরনো কিমোনোর কাপড় ব্যবহার করে বানানো হয় টেডি বিয়ার। শহরের ৬০ শতাংশ অধিবাসীই নতুন এই পদ্ধতি নিয়ে সন্তুষ্ট। পাশাপাশি ২০২০ সালের মধ্যে জিরো ওয়েস্ট সিটি হবার লক্ষ্য অর্জনেও আশাবাদী। প্রচলিত পদ্ধতিতে, ধানক্ষেত এবং চুল্লিতে বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য পদার্থ পোড়ানো হতো জাপানে। এখন আর সে অবস্থা নেই। 

এছাড়াও, কাঠের চপস্টিক, রান্নার তেল ইত্যাদি পাঠানো হয় বিভিন্ন রিসাইকেলিং কোম্পানিতে। এতে স্থানীয় সরকার যেমন লাভবান হয়, তেমনি এসব ব্যবহার করে তৈরি করা হয় কাগজ কিংবা সারের মতো পণ্য। খাদ্য বর্জ্য প্রসেস করার জন্য ব্যবহৃত হয় স্বল্প পরিসরের হোম-কম্পোস্টিং সিস্টেম। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও আর্থিক সহায়তায়, কামিকাতসুর ৯৮ শতাংশ বাড়িতেই জৈব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকায়, শহরটিতে কোনো ধরনের ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্পোস্টিং ব্যবস্থারও প্রয়োজন হয় না।

গৃহস্থালি খাদ্য বর্জ্যের ব্যবস্থাপনাও হয়ে যায় কামিকাতসুর ঘরে ঘরেই; Image Source: GreenTumble

জাপানের অনেক অঞ্চলেই আবর্জনা পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া প্রচলিত আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেসব আবর্জনা বিভক্ত করা হয় গুটিকয়েক ভাগে। এছাড়াও সব ধরনের গৃহস্থালি আবর্জনা একত্রিত করে চুল্লিতে পোড়ানো হয়। কামিকাতসুর স্থানীয় প্রশাসনিক কর্মকর্তা মিদোরি সুগা বলেন,

“আমরা ভাবলাম, শহরে যদি আবর্জনা পোড়ানোই না যায়, তাহলে রি-সাইকেল করে ফেলা যাক। এতে খরচ সাশ্রয় হবে।”

২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বেশ সফলভাবেই কাজ করে চলেছে কামিকাতসু। এ ব্যাপারে সুগা বলেন, 

“চুল্লি ও ল্যান্ডফিলের ব্যবহার শূন্যের কোঠায় নামিয়া আনতে চাই আমরা। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট না। শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কমানোর প্রচেষ্টা না থাকলে জিরো ওয়েস্ট সিটি হবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা খুবই কঠিন হয়ে যাবে। শুধু আবর্জনা নিয়ে কাজ করলেই হবে না, আবর্জনার উৎপাদন কীভাবে কমানো যায়, সেটা নিয়েও প্রচুর কাজ করতে হবে আমাদের।”

২০১৫ সালে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী বর্তমান বিশ্বে নগরায়নের চেয়েও দ্রুত গতিতে বেড়ে চলেছে আবর্জনার উৎপাদন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয় যে, ২০২৫ সাল নাগাদ পৃথিবী হবে আরও ১.৪ বিলিয়ন মানুষের আবাসস্থল। সেখানে একজন মানুষ দৈনিক ৩ পাউন্ড করে বর্জ্য উৎপাদন করলে তা বর্তমান বৈশ্বিক বর্জ্য উৎপাদন-মাত্রা দ্বিগুণ ছাড়িয়ে যাবে।

প্রবৃদ্ধির হারে নগরায়নকে বর্জ্য উৎপাদন পেছনে ফেলেছে বহু আগেই; Image Source: WorldBank

বিশ্বব্যাপী কামিকাতসুর দেখানো পথ অনুসরণ করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে পরিবেশবান্ধব করতে এখন কাজ করছে বেশ কিছু শহর। ২০১৫ সালে স্যান ডিয়েগো তাদের নগর পরিকল্পনায় জিরো ওয়েস্ট সিটি হবার লক্ষ্যে, ২০৩০ সালের মধ্যে ৭৫ ভাগ ও ২০৪০ সালের মধ্যে শতভাগ সাফল্য অর্জন করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। একইভাবে নিউ ইয়র্কও আগামী ১৫ বছরের মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।

নগরায়ন ও শিল্পায়নের আগ্রাসনের সাথে পাল্লা দিয়ে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির বিকাশ ও ব্যবস্থাপনায় উৎকর্ষের স্বপ্নদ্রষ্টাদের জন্য জাপানিজ এ শহরটি নিঃসন্দেহে একটি অনুপ্রেরণার নাম। হয়তো একটু একটু করে এভাবেই একদিন জিরো ওয়েস্ট প্ল্যানেট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার সুযোগ পাবে পৃথিবীবাসী।

বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

জাপান সম্পর্কে আরও জানতে পড়তে পারেন এই বইগুলোঃ

১) জাপান কাহিনি (৫ খণ্ড একত্রে রকমারি কালেকশন)
২) দূর পরবাস জাপান

Related Articles