Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কারাকোরাম হাইওয়ে: পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা

কারাকোরাম হাইওয়ে; পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু এবং বিপজ্জনক রাস্তা। পাকিস্তান ও চীনকে সড়কপথে সংযুক্ত করেছে এই রাস্তা। প্রাচীন সিল্করোডের যে পথের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশের সাথে চীনের বাণিজ্য চলতো, সেই পথ ধরেই  চলে গেছে কারাকোরাম মহাসড়ক, পাহাড় কেটে পথ করে নিয়েছে অ্যাসফল্টের রাস্তা।

১,৩০০ কি.মি. মহাসড়কের ৮৮৭ কি.মি. পড়েছে পাকিস্তানে, বাকি ৪১৩ কি.মি. চীনে। চীনের স্বায়ত্তশাসিত এলাকা জিনজিয়াংয়ের পশ্চিম অংশ ও পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চলের মাঝে সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছে এই রাজপথ। প্রাচীন কাশগড় শহরের সাথে মিলেছে পাকিস্তানের ঝকঝকে রাজধানী ইসলামাবাদ।

ইসলামাবাদ থেকে ৫০ কি.মি. দূরে, পাঞ্জাব প্রদেশের হাসান আব্দাল শহর থেকে যাত্রা শুরু কারাকোরাম হাইওয়ের। পাকিস্তান অংশে হরিপুর, অ্যাবোটাবাদ, গিলগিট, হুনজা, সোস্ত প্রভৃতি শহরের মাঝে দিয়ে এগিয়ে গেছে খুনজিরাব পাস পর্যন্ত। তারপর চীন সীমান্ত পেরিয়ে তাশগুর্কান শহর ছাড়িয়ে কাশগড়ে গিয়ে শেষ হয়েছে হাইওয়েটি।

বিস্তৃত কারাকোরাম হাইওয়ে; Image source: istock photo

এই মহাসড়কের নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬৬ সালের দিকে। প্রায় ২১ বছর পর কয়েক হাজার টন ডিনামাইট আর বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচের মাধ্যমে ১৯৭৯ সালে শেষ হয় রাস্তা বানানোর কাজ। যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয় আরো পরে, ১৯৮৬ সালে।

হিমালয়, কারাকোরাম, হিন্দুকুশ- পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ও ভয়ঙ্কর তিনটি পর্বতমালার কোলঘেঁষে অবস্থান কারাকোরাম হাইওয়ের। এই মহাসড়কের বেশিরভাগ অংশ ৩,৫০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। এই অবিশ্বাস্য উচ্চতায়, তীব্র বিপদসঙ্কুল অঞ্চলে এত দীর্ঘ হাইওয়ে বানানো খুবই দুরুহ কাজ ছিল।

ভূমিধস, পাথরধস, বন্যা, তুষারপাত, হিমাবাহের ধেয়ে আসা- নানারকম প্রাকৃতিক দুর্যোগে বার বারই বিঘ্নিত হয়েছে নির্মাণকাজ। জীবন দিতে হয়েছে প্রায় এক হাজারের মতো শ্রমিককে। এত বাধাবিপত্তি পাড়ি দিয়ে পাকিস্তান ও চীন এই যৌথ উদ্যোগকে চলমান রেখে অসম সাহস আর ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছে।

দুর্গম পর্বত কেটে এগিয়ে গেছে বিপজ্জনক রাজপথ; Image source: istock photo

পাকিস্তান আর্মির ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পস আর চীনা প্রকৌশলীদের অদম্য তেজ, রাস্তা নির্মাণকারী ২৪,০০০ শ্রমিকের হাড়ভাঙা পরিশ্রম বিশাল হাইওয়েটির বাস্তবে রুপদানের মতো দুঃসাধ্য কাজ সম্ভব করেছে। বিশ শতকের মাঝামাঝিতে মহীরুহ স্থাপনার সফল নির্মাণের পেছনে অবদান রাখা প্রযুক্তির প্রশংসাও করতে হয়। গত শতাব্দীর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিস্ময় এই মহাসড়ক। পৃথিবীর একদম ছাদে, ভয়াবহ উচ্চতায় এত দীর্ঘ একটি রাজপথের কষ্টসাধ্য নির্মাণ একে ভূষিত করেছে পৃথিবীর ‘অষ্টম আশ্চর্য’ অভিধায়।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাকিস্তান-চীন সীমান্তে একটি সড়ক নির্মাণের কথা প্রথম মাথায় আসে চীনা জেনারেল জেং বিয়াও-এর। ১৯৫৬-৫৮ সালে পাকিস্তানে চীনের রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন এই ভদ্রলোক। কয়েক বছর ধরে চেষ্টা করে বেইজিংকে রাজি করেন হাইওয়ে নির্মাণে বিশাল পরিমাণ অর্থ ঢালতে। সত্যি বলতে, চীনের লাভ এত বেশি ছিল যে এতে রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। কারণ রাস্তাটি সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথে চীনকে আরব সাগরে পৌঁছে দিতে পারে, পাকিস্তানের সমুদ্রবন্দর গাওয়াদারের সাথে সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করার মাধ্যমে। চীন-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর প্রকল্পের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই সড়ক। সড়কটি শুধু পাকিস্তান ও চীনকে সংযুক্ত করেনি, দক্ষিণ এশিয়ার সাথে মধ্য এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি ইউরেশিয়া অঞ্চলের বাণিজ্যের পথ খুলে দিয়েছে।

পাকিস্তান থেকে চীনের পথে ট্রাক; Image source: Against the compass

আশেপাশের পাহাড়ে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করা তাজিক, উইঘুর, কিরঘিজ জাতির লোকজনকে সমাজের মূল স্রোতধারায় সংযুক্ত করেছে এই সড়ক। পাকিস্তানের দূরবর্তী এলাকা গিলগিট-বালটিস্তানকে সম্পৃক্ত করেছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে। তবে কারাকোরাম হাইওয়ে এখন পর্যটন আকর্ষণ হিসেবেই বেশি জনপ্রিয়।

পাহাড়ের গভীরে এই রাজপথ ধরে ছুটে চলা মানে হাতে হাত রাখা বিপদের, উপভোগ করা রোমাঞ্চের স্বাদ আর প্রাণ ভরে টেনে নেয়া মুক্তির সুবাতাস। আপনার রক্তে যদি থাকে রোমাঞ্চের নেশা আর বিপদকে আলিঙ্গন করার দুঃসাহস, তাহলে কারাকোরাম আপনার জন্য।

প্রাচীন সিল্করোডের এই পথ ধরে চলতে গিয়ে আপনি পা রাখবেন হাজার বছর আগের পথিক, বণিক, পর্যটক, অভিযাত্রী, বিশ্ববিজয়ী বীর, দুধর্ষ খুনি বা ডাকাতদলের রেখে যাওয়া পায়ের ছাপে। আঁকাবাঁকা পথ ছাড়িয়ে চোখে পড়বে পথের দু’পাশের ভয়াবহ উচ্চতার দুর্গম পর্বতশৃঙ্গ, অসংখ্য হিমবাহ আর নয়নাভিরাম কাশ্মীরের শ্বাসরুদ্ধকর সুন্দর উপত্যকাগুলো।

কারাকোরামে ভ্রমণ করার সময় সাক্ষাৎ ঘটবে বিচিত্র জাতিগোষ্ঠীর লোকজনের সাথে। পাকিস্তানের পাঞ্জাবে পাঞ্জাবি, হুনজাতে ইসলামইলি শিয়া, তাশগুর্কানে তাজিক, জিনজিয়াং-এ উইঘুর। এ যেন একসাথে ছোটখাট কয়েকটা দেশ ভ্রমণ করার মতো।

কারাকোরাম হাইওয়ে ভ্রমণের সময় আবহাওয়া যদি শান্ত থাকে, তারপরও পড়তে হবে অসংখ্য চ্যালেঞ্জের মুখে। দেখা যাবে, প্রশস্ত রাজপথ হঠাৎই সরু হয়ে গেছে, আচমকা তীক্ষ্ম বাঁক নিয়েছে, বিশাল পাথরের নিচে দিয়ে চলে গেছে রাস্তা, উপরে তাকালেই গা শিউরে উঠবে। সাথে অবধারিতভাবে থাকছে অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের দৈব আবির্ভাব!

অ্যাসফল্টের রাস্তায় যাত্রা সাধারণত মসৃণ, তবে হিমবাহ, ভারী বর্ষণ বা বন্যা, তুষারপাত এবং ভূমিধসে মাঝে মাঝেই রাস্তাঘাট আর ব্রীজগুলো চাপা পড়ে যায়। জুলাই বা আগস্টে এসব ঘটনা বেশি ঘটে। বসন্ত বা গ্রীষ্ম কারোকোরাম ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময়।

যদি নিজে গাড়ি চালিয়ে যেতে চান, তাহলে কারাকোরাম পরীক্ষা নেবে আপনার গাড়ির সহ্যক্ষমতা, আপনার ড্রাইভিং দক্ষতা, আপনার শক্তি আর নার্ভের। সাধারণ জিপের কথা ভুলেও মাথায় আনবেন না, ফোর হুইল ড্রাইভ এক্ষেত্রে আদর্শ বাহন। তবে বেশিরভাগ ভ্রমণকারী সাধারণত বাসে চলাচল করেন। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ বা কারাকোরাম হাইওয়ে সংলগ্ন যেকোনো শহর থেকে বাসে চড়া যায়।

পাঞ্জাব পেরিয়ে কারাকোরাম হাইওয়ের সর্পিলাকার অগ্রগতি পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল গিলগিট-বালটিস্তানের ভেতর দিয়ে, যা ভারত-পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের সংঘাতময় এলাকা কাশ্মীরের উত্তরভাগে পড়েছে। গিলগিট-বালটিস্তান আধা স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল। মধ্য এশিয়া সীমান্তের কাছাকাছি এই এলাকায় অবিশ্বাস্য রকমের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। অসংখ্য ভাষা-সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার এখানে। তবে এই এলাকার মূলত এর অবারিত নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত।

মায়াময় ফেইরি মিডো; Image source: Against the compass

এই এলাকার প্রধান আকর্ষণ ছবির মতো সুন্দর উপত্যকা ফেইরি মিডো। ফেইরি মিডোর সবুজ তৃণভূমি থেকে চোখে পড়বে ৮,১২৫ মিটার উচ্চতায় দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয় সুন্দরী নাঙ্গা পর্বতের তুষারঢাকা চূড়া। গিলগিট শহর থেকে রায়কোট ব্রীজ পেরিয়ে ফেইরি মিডো যাওয়া যায়। এরপর মিনাপিনে সাক্ষাৎ ঘটবে কারাকোরাম পর্বতমালার অন্তর্গত দুনিয়ার সবচেয়ে উঁচু পর্বতশৃঙ্গের আরেকটি রাকাপসি (৭,৭৮৮ মি.)। রাকাপসিতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হিমবাহ চোখে পড়ে।

হুনজা ভ্যালিতে যাবার পর শিয়া জনগোষ্ঠীর বিচিত্র জীবনযাত্রার সাথে উপভোগ করতে পারবেন মনোমুগ্ধকর সবুজ উপত্যকার সৌন্দর্য, করিমাবাদ শহরের প্রাচীন দুর্গসমূহ আর পাসু পর্বতমালা। সোস্ত শহর পেরোলে ক্ষীণ হয়ে আসে পাকিস্তান সীমানা, দৃষ্টিসীমায় তখন চীন। পাকিস্তান-চীন সীমান্ত ঘেঁষে যাওয়ার সময় কোনো এক মুহুর্তে দৃষ্টি পড়বে ৮,৬১১ মিটার উঁচু পৃথিবীর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্তশৃঙ্গ ‘কে২’-র শ্বেতশুভ্র চূড়ার দিকে। চোখ ফেরাতে পারবেন না অনেক্ষণ।

খুনজিরাব পাস; Image source: istock photo

একটু পর আপনাকে স্বাগত জানাবে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু বর্ডার ক্রসিং খুনজিরাব পাস (৪,৮০০ মি.)। কুনুলুন, তিয়েনশান, হিন্দুকুশ, হিমালয়, কারাকোরাম- পৃথিবীর পাঁচটি বৃহত্তর পর্বতমালা মিশেছে খুনজিরাব পাস এলাকায়। চীন, পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান, কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তানের সীমান্তও মিলিত হয়েছে এখানে। অতীতে উটের কাফেলায় চলাচল করা যাত্রীরা ডাকাতির কবলে পড়ত এখানে, খুনখারাবি ছিল নিত্যঘটনা। তাই একে বলা হয় রক্ত উপত্যকা (খুনজিরাব)। তবে এই উচ্চতায় আর রুক্ষতায়ও সৌন্দর্যের কমতি নেই। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, বরফঢাকা পর্বতমালা ঢেকে ফেলবে দৃষ্টিসীমানা, নিচের তৃণভূমিতে চরে বেড়াতে দেখা যায় ইয়ক আর আইবেক্সদের।

বরফঢাকা কে২; Image source: climbing magazine

কড়া চীনা ইমিগ্রেশন পেরিয়ে চীনের ভূখন্ডে ঢুকতে পারলে আবার পাহাড়। খুনজিরাবের পর রাস্তা নেমে গেছে উপমহাদেশের অন্যতম সুন্দর গিরিখাতের মাঝে দিয়ে। একপাশে খরস্রোতা সিন্ধু নদ, অন্যপাশে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল। পাহাড়কে পাশ কাটিয়ে সন্তর্পণে একেকটা বাঁক পেরোয় ড্রাইভাররা।

কারাকোরামের হাইওয়ের ধারের চীনা শহর তাশগুর্কানে তাজিক জনগোষ্ঠীর বসবাস, কারণ পাশেই তাজিকিস্তান। রুক্ষ পর্বতমালা আর সুনীল লেক পেরিয়ে কারাকোরাম মহাসড়ক এগিয়ে গেছে কাশগড় পর্যন্ত। জিনজিয়াংয়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কাশগড়ে প্রত্যক্ষ করতে পারবেন উইঘুরদের প্রকৃত জীবনযাত্রা।

কারাকোরাম হাইওয়ে মানে পাহাড়, অকল্পনীয় উচ্চতা, রুক্ষতা, কমনীয়তা আর বিপদের আশ্চর্য সংমিশ্রণ। এখানে একমুহূর্তে আপনার বুক ভয়ে কেঁপে উঠবে, বিস্ফোরিত হবে চোখ; আরেক মুহূর্তে প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য মন ছুঁয়ে যাবে, কেটে যাবে কিছু আচ্ছন্ন প্রহর।

হিমালয়, কারাকোরাম আর হিন্দুকুশের পদে পদে পেতে রাখা বিপদের জাল সত্ত্বেও কারাকোরাম হাইওয়ে থেকে সৌন্দর্যপিপাসু, রোমাঞ্চপ্রেমী পর্যটক, হাইকার বা বাইকারদের কেউই মুখ ফিরিয়ে নেয়নি। তারা উৎসাহের সাথে এই মরণফাঁদকে আলিঙ্গন করেন, দুষ্প্রাপ্য সুন্দরের টানে ছুটে যান গহীন পাহাড়ি রাজপথে।

Language: Bangla

Topic: The most dangerous highway of the world 'Karakoram Highway'

Reference:

1. A GUIDE TO THE KARAKORAM HIGHWAY – FROM PAKISTAN TO CHINA - Against the Compass
2. KARAKORAM HIGHWAY IN CHINA - Facts & Details
3. Karakoram Highway - the mighty 'eighth wonder of the world' - Dawn
4. The Karakoram Highway: The impact of road construction on mountain societies - ICIMOD

Feature Image: bucketlistly.blog

Related Articles