Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কিম জং ন্যামকে মালয়েশিয়ায় যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল | পর্ব ১

কিম জং ন্যাম যখন ছোট ছিলেন, তার বাবা উত্তর কোরিয়ার স্বৈরশাসক একদিন তাকে অফিসের চেয়ারে বসিয়ে বলেন, “বড় হলে তুমি এই চেয়ারটাতে বসেই সবাইকে নির্দেশ দেবে।” ওই শিশুটি যদি সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারতো, আর তার সৎ ভাই কিম জং উন যদি তার সিংহাসন দখল না করতো, তাহলে আজ তিনিই আড়াই কোটি জনগণকে শাসন করতেন। তার মোটাসোটা আঙুলগুলো পারমাণবিক বোমার বোতামগুলোর স্পর্শ পেত। তাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, সেটা নিয়ে বিতর্ক করত আমেরিকা আর চীন।

কিন্তু জং ন্যাম যখন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ডিপার্চার বোর্ডের দিকে তাকালেন, ধাক্কাধাক্কি করে যাওয়া জনতা তাকে কোনো গুরুত্বই দিলো না। তিনি আর দশ জন ৪৫ বছরের মধ্যবয়স্ক পুরুষের মতোই মাথার টাক অংশটা ক্যাপ দিয়ে ঢেকে অবশিষ্ট চুলগুলো বের করে রেখে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দজন সুন্দরী নারী ঠিকই তাকে মেরে ফেলার জন্য তার ওপর নজর রাখছিল।

মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে সিসিটিভির ফুটেজে কিম জং ন্যামকে দেখা যাচ্ছে;  Image Source: REUTERS/FUJI TV

২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা ৫৯ মিনিটে জং ন্যাম যখন অলস গতিতে নিকটবর্তী এয়ারএশিয়ার চেক-ইনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ফিটফাট জিন্স ও ধূসর রঙের স্লিভলেস টপ পরিহিতা এক ইন্দোনেশিয়ান নারী এক থামের পেছন থেকে বের হয়ে আসলেন। তিনি চোখ দুটো ঢেকে রেখেছিলেন। এরপর তার হাতটা জং ন্যামের মুখে নিয়ে তেল জাতীয় কিছু একটা ফেলে দিলেন।

জং ন্যাম জিজ্ঞেস করলেন, “কে আপনি?”

ওই মহিলাটি “দুঃখিত! দুঃখিত!” বলে ভীড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলেন।

এক সেকেন্ড পর এক ভিয়েতনামি নারী তার হাত জং ন্যামের কাঁধের ওপর দিয়ে নিয়ে তার মুখে ডলা দিয়ে দিলেন। তিনিও ক্ষমা চেয়ে ইন্দোনেশিয়ান নারীর বিপরীত দিকে দ্রুত চলে গেলেন।

ইতোমধ্যে ওই মহিলার দেওয়া তরল তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ল। তার মাংসপেশীর রিসেপ্টরগুলোতে গিয়ে পেশীকে সক্রিয় করে দিলো। এতে তার মাংসপেশীগুলো ক্রমাগত সংকোচিত হতে থাকল। ওই তরলটি ছিল ভিএক্স (VX)। এটা একটা রাসায়নিক অস্ত্র, যাকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা সিডিসি ‘সবচেয়ে শক্তিশালী নার্ভ এজেন্ট’ ও জাতিসংঘ গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাকে লিথাল ডোজ দেওয়া হয়েছিল, যার জন্য এক ফোঁটা যথেষ্ট।

জং ন্যাম শৌচাগার খুঁজে বের করার চেষ্টা করলেন। তথ্য কেন্দ্রে গিয়ে গোঙাতে গোঙাতে বললেন, “খুব ব্যাথা, খুব ব্যথা, আমাকে বিষের স্প্রে মারা হয়েছে।” তাকে যখন এক পরিচারক তিন জন পুলিশের কাছে নিয়ে গেলেন, তিনি তখন কেবল অসংলগ্নভাবে আর্তনাদ করছিলেন আর দুই হাত দিয়ে নিজের মুখ খোঁচাচ্ছিলেন। পুলিশরা ভিড় নিয়ন্ত্রণের চেয়ে গল্প করাতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন।

ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট। একে জাতিসংঘ গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করেছে; Image Source: Chuck Robinson/Associated Press

বিরক্তিকর অভিব্যক্তি নিয়ে এক অফিসার তাকে এয়ারপোর্টের মেডিকেল ক্লিনিকে নিয়ে যান। কিন্তু প্রায় তিন মিনিটের মতো হাঁটাহাঁটি করায় জং ন্যামের হাঁটু শক্ত হয়ে গিয়েছিল, পা আর চলছিল না। নার্ভ এজেন্ট তার মাংসপেশীগুলোকে ক্রমাগত উত্তেজিত করে চলছিল। শ্বাসযন্ত্র আর হৃৎপিণ্ড দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল।

ক্লিনিকে গিয়ে তিনি একটা কালো চেয়ারের ওপর পড়ে যান। তার নীল টি-শার্ট ওপরের দিকে ওঠে পেট বের হয়ে গেল। শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ায় জোরে জোরে শ্বাস নেওয়া বুকের ওপর স্ত্রী-সন্তানের অবয়ব খচিত করা সোনালী চেনটা যেন লাফাচ্ছিল। তার খিঁচুনি শুরু হলো। তার শ্বসনযন্ত্রের পেশীগুলো যেহেতু শুধু সংকোচিত হচ্ছিল, প্রসারিত না হওয়ায় ফুসফুস থেকে বের হচ্ছিল না। সেখানকার নার্সরা তখন একটা অক্সিজেন ট্যাংক সংযোগ করলেন তার সাথে। তাকে যখন স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হলো, প্যারামেডিকসরা টের পেলেন তার হার্টবিট দুর্বল হয়ে পড়েছে। হাসপাতালে যাওয়ার পথেই তার হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেল। বিষ প্রয়োগের ১৫ মিনিটের সামান্য বেশি সময় তিনি টিকেছিলেন।

কিম জং ন্যামের জীবনের শুরুর দিকে তার সাথে দেহরক্ষীর বহর থাকত। কিন্তু আকস্মিকভাবে তাকে সেই বিশেষ অধিকার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তিনি প্রথম সন্তান হিসেবে উত্তর কোরিয়ার শাসক হওয়ার লক্ষ্যেই বেড়ে ওঠছিলেন। তার বাড়িতে ১০০ জন চাকর আর ৫০০ প্রহরীর ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু তার বাবা কিম জং ইল নতুন স্ত্রী নিয়ে আসলে তার দুই ছেলে সন্তান হয়। জং ন্যামকে তখন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় এক অভিজাত স্কুলে প্রেরণ করা হয়। তখনো পরবর্তী শাসক হওয়ার পথে তিনিই ছিলেন। তার ২৪তম জন্মদিনে তাকে জেনারেলের ইউনিফর্ম দেওয়া হয়। দ্রুতই তাকে সিক্রেট পুলিশ ও ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের পোস্ট দেওয়া হয়। তার বাবার উত্তরসূরি হিসেবে তাকে গড়ে তোলার জন্য তাকে মহিমান্বিত করা হয় এবং তার অবিশ্বাস্য সব কীর্তির কথা প্রচার করা হয়।  

কিন্তু উত্তর কোরিয়ায় তার অনেক ক্ষমতা থাকলেও তার বাল্যবন্ধুরা তাকে হতাশাগ্রস্ত হিসেবেই বর্ণনা করেন। তিনি পশ্চিমা সমাজে যে স্বাধীন জীবনের সাথে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন, সেটার অভাব অনুভব করেন। তিনি যখনই সুযোগ পেতেন, বিলাসবহুল ছুটি কাটানোর জন্য বিদেশ চলে যেতেন।

কিম জং ইল সম্ভবত উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তার ছেলের স্বৈরতন্ত্র পরিচালনা করার মতো খুনে মানসিকতা নেই। তাকে দেশটির হিট স্কোয়াড পরিচালনা করার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে তথ্য প্রযুক্তি খাতে নিয়ে আসা হয়। ২০০১ সালে তিনি জাপানে গ্রেপ্তার হন ডমিনিকান জাল পাসপোর্ট দিয়ে ভ্রমণ করার জন্য। এতে দিয়ে রেখেছিলেন মান্দারিন ছদ্মনাম ‘মোটা ভালুক’। তিন দিনের জেরা শেষে স্বীকার করেন তিনি কেবল টোকিওর ডিজনিল্যান্ডে ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন।

কিম জং ন্যাম ২০০১ সালে জাপানে গ্রেপ্তার হন; Image Source: AP

এই ঘটনা নিয়ে মিডিয়াতে যে সংবাদ প্রচারিত হয়, তা কিম জং ইলকে অপমানিত করে। কিম জং ন্যামের হীরা দিয়ে আবৃত রোল্যাক্স ঘড়ি আর তার নারী সঙ্গীদের লুই ভুইতোঁ ব্যাগের দিকে দৃষ্টিগোচর করে দুর্ভিক্ষে ভোগা দেশটির শাসকদের অপচয়ের দিকটা তুলে ধরা হয়। কিম জং ইল অবিলম্বে তার ছেলের চীনে কূটনৈতিক সফর বাতিল করেন। কিম জং ন্যাম অন্তত এক বছর উত্তর কোরিয়ায় প্রবেশ করতে পারেননি। তিনি পিয়ংইয়ংয়ে আবার কাজ করতে চাইলেও তার ভ্রমণের নেশা শেষ পর্যন্ত তাকে ম্যাকাওতে স্থায়ীভাবে নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়, যে স্থানকে বলা হয় চীনের লাস ভেগাস।

২০০৮ সালে কিম জং ইল যখন স্ট্রোকে আক্রান্ত হন, তখন কে তার উত্তরসূরি হবেন, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। কিন্তু ২০১০ সালে সেই অনিশ্চয়তা দূর হয়ে যায়। তার সবচেয়ে ছোট ছেলে কিম জং উনকে সর্বোচ্চ সামরিক পদে এবং রাজনৈতিক পদমর্যাদা দেওয়া হয়। কিম জং ইল তার মেজ ছেলেকে রেখে ছোট ছেলেকে দায়িত্ব দেন, কারণ মেজ ছেলেকে তার কাছে ‘মেয়েলি’ মনে হয়েছিল। ২০১১ সালে কিম জং ইল মারা গেলে ক্ষমতায় আসেন কিম জং উন। তিনি উত্তারাধিকারসূত্র ও প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে তার ক্ষমতা দৃঢ় করতে থাকেন। বাবার কফিনের পাশে কিম জং উন থাকলেও কিম জং ন্যামের অনুপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়।

এর কিছুদিন পরই কিম জং ন্যাম এক জাপানি সাংবাদিকের কাছে ইমেইলে ছোট ভাইকে নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি তাকে ‘বহির্বিশ্বের কাছে এক ভাঁড়’ বলে আখ্যায়িত করেন এবং সে সময়ের আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোর মতো তিনিও ২৭ বছর বয়সী স্বৈরশাসকের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, “এই কিম জং উনের শাসনামল বেশি দিন টিকবে না।”

বাবা কিম জং ইলের সাথে কিম জং উন; Image Source: Kyodo News/AP Photo

কিন্তু কিম জং উন কোনো প্রকার দ্বিধা ছাড়াই জন্মগতভাবে অত্যাচারী শাসকের মতো নির্মমতা দেখানো শুরু করেন। তার অনুগত নয় এমন কর্মকর্তাদের হত্যা করতে এন্টি-এয়ারক্রাফট গান ব্যবহার করেন। এছাড়া আমেরিকায় আক্রমণ করতে সক্ষম নিউক্লিয়ার মিসাইল তৈরি করতে থাকেন খুবই আক্রমণাত্মকভাবে।

জং ন্যামের জানা উচিত ছিল তার ওপর কী আসতে যাচ্ছে। প্রথমে সরকার থেকে তার কাছে ফান্ড আসা বন্ধ হয়ে গেল। এরপর তাকে আক্রমণ থেকে পালিয়ে বেড়ানো শুরু করতে হলো। ২০১০ সালে চীনে এক উত্তর কোরিয়ার এজেন্টকে নির্দেশ দেওয়া হয় একটা ট্যাক্সি চালককে এক বস্তা অর্থ দিয়ে একটা দুর্ঘটনার নাটক সাজাতে। কিন্তু জং ন্যাম ওই স্থানে আসেননি। ২০১২ সালে আরেকটা হত্যা চেষ্টা থেকে পালান। ওই বছর তিনি কিম জং উনের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে চিঠিতে লিখেন,

দয়া করে আমাকে ও আমার পরিবারকে শাস্তি দেওয়ার নির্দেশ তুলে নাও। আমাদের কোথাও পালানোর জায়গা নেই। আমরা কেবল আত্মহত্যার মধ্য দিয়েই পালাতে পারি।

(এরপর দেখুন ২য় পর্বে)

Related Articles