Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড: বিশ্বের সবেচেয়ে পুরনো পাতাল রেলপথ

প্রায় ১৭৭ বছর আগে তৈরি করা একটি টানেল আজকের লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড। নদীর নিচে তৈরি করা দ্য থেমস টানেল হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম টানেল। এটিকে বর্ণনা করা হয়েছিলো পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে। লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড শুধু সবচেয়ে পুরোনোই নয়, বিশ্বের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহীও। রূপক হোক কিংবা ভৌগলিক বিচারে হোক, এটি লন্ডনের হৃদয়ে গিয়ে পৌঁছেছে। ব্রিটেনের রাজধানী ঘুরে দেখার শুধু একটা উপায়ই নয়, লন্ডন শহরের প্রতীকও এটি।

তৈরির ইতিহাস

দ্য থেমস টানেল তৈরি করা হয়ে ছিল কার্গো ট্রান্সপোর্ট করার জন্য। ১৮৪৩ সালে। ইঞ্জিনিয়ার স্যার মার্ক ব্রুনেল এবং তার ছেলে ইসাম্বারড মিলে প্রায় ১৭ বছর ধরে তৈরি করেছিলেন এটি। তাদের প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রথম পাতাল রেলপথ তৈরি করা হয়। কিন্তু তাদের কাজ অর্থায়নের অভাবে থেমে গিয়েছিল। যার ফলে এটি শুধু পথচারীদের আকর্ষণ হিসেবেই উন্মুক্ত হয়। প্রথম দিনে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ চলাচল করে এই টানেল দিয়ে। মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়তে থাকে। ৩ মাস নাগাদ প্রায় ১০ লাখ মানুষ এটির মধ্য দিয়ে যাতায়াত শুরু করে। পর্যটকদের জন্য তখন এটি বিশ্বের সেরা আকর্ষণ হয়ে দাড়ায়।

Picture of thames
দ্য থেমস টানেলের চিত্রায়ন; Image Source: Getty Images

১৮৬৩ সালের ১০ জানুয়ারি, দ্য মেট্রোপলিটান রেলওয়ে (একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান) পৃথিবীর প্রথম পাতাল রেলপথ উন্মুক্ত করে। প্যাডিংটন (তখন বিশপস রোড বলা হতো) থেকে ফ্যারিংডন স্ট্রিট পর্যন্ত এটি তৈরি করা হয়েছিল। এরপর ১৮৬৪ সালে হ্যামারস্মিথ, ১৮৭৭ সালে রিচমন্ড, ১৮৮৪ সালে সেন্ট্রাল লন্ডনের কাছাকাছি চলে যায়। পুরো নেটওয়ার্কটি তৈরি করার জন্য প্রায় ৫০ বছর ধরে কাজ চলে এবং ভারনি  জংশনে গিয়ে পৌঁছে।

এরমাঝে বেকার স্ট্রিট, মিডলসেক্স, হার্টস অ্যান্ড বাকস এ এর শাখা তৈরি হয়। প্রথমদিকের এই টানেলগুলোতে কোনো ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা না থাকায় বাষ্পীয় ইঞ্জিনের কারণে টানেলের ভেতর প্রচুর ধোঁয়া তৈরি হতো। যার ফলে ট্রেনচালকদের অসুবিধা হতো। ইলেক্ট্রিক রেল আসার পর এ সমস্যার সমাধান হয়।

থেমস টানেলের ভেতরে স্টিম ইঞ্জিন; Image: Wikipedia

১৮৯০ সালের ১৮ ডিসেম্বরে ‘দ্য সিটি অ্যান্ড সাউথ লন্ডন রেলওয়ে’ পৃথিবীর প্রথম ‘ডিপ-লেভেল’ বা ‘টিউব’ ইলেক্ট্রিক রেলওয়ে উদ্বোধন করে। থেমস নদীর নিচ দিয়ে কিং উইলিয়াম স্ট্রিট থেকে শুরু করে স্টকওয়েল পর্যন্ত এর যাত্রাপথ ছিল। ইলেকট্রিক রেলওয়ে আসার পর টিউব প্রযুক্তি আরো উন্নত হতে থাকে। এছাড়া এটি অনেক গভীরে নির্মিত রেলপথ এবং একটির উপর আরেকটি রেলপথের ধারণার দুয়ার খুলে দেয়।

১৯০২ সালে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড ইলেক্ট্রিক রেলওয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা পায়। মেট্রোপলিটান লাইন বাদে সব রেলপথ এর অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯০৫ সালের মধ্যে সার্কেল এবং ডিস্ট্রিক্ট লাইনগুলো বৈদ্যুতিক লাইনে রূপান্তর করা হয়। এরপর ১৯০৬ ও ১৯০৭ সালে রেলপথ বর্ধনের কাজ চলে এবং বর্তমান বেকারলু, ল্যাম্বেথ, পিকাডিলি আন্ডারগ্রাউন্ড রেলপথের আওতায় আনা হয়।

১৯০৮ সাল ছিল ‘টিউব নেটওয়ার্ক’ এর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছরে সর্বপ্রথম স্টেশনগুলোতে ‘UNDERGROUND’ শব্দ এবং লোগো ব্যবহার করা শুরু হয়। এই লোগোটি আজও ব্যবহার হয়ে আসছে। সে বছরই প্রথম ইলেক্ট্রিক টিকেট মেশিন তৈরি হয়। ১৯১১ সালে আরলস কোর্ট স্টেশনে লন্ডনের প্রথম এস্কেলেটর স্থাপন করা হয় এবং ১৯২৯ সালে টিউবে স্বয়ংক্রিয় দরজা লাগানো হয়। টিউবের সাথে আরেকটি বিখ্যাত জিনিস হচ্ছে বিভিন্ন রঙে রঞ্জিত টিউবের ম্যাপ। 

আন্ডারগ্রাউন্ড লোগো; Image Source: Instagram

লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাপ ডিজাইন

১৯৩৩ সালে হ্যারি বেক নামে এক ব্যাক্তি আজকের আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাপের প্রথম ডায়াগ্রাম উপস্থাপন করেন। তিনি তার ডিজাইনটি তৈরি করেন ইলেক্ট্রিক্যাল সার্কিটের উপর ভিত্তি করে। ১৯৩২ সালে কয়েকটি স্টেশনে পরীক্ষামুলক এটি বিতরণ করা হয় এবং পরের বছর প্রায় ৭০০,০০০ কপি প্রিন্ট করা হয়। এই ম্যাপটি তুমুল সফলতা লাভ করে এবং ১ মাসের মাঝে আরো অর্ডার আসতে থাকে। ধীরে ধীরে এই ডিজাইনে আরও নতুন সংযোজন ও পরিবর্তন করা হয়।

আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাপ; Image source: Getty Images

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই রেলপথ বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যেমন মানুষজনের অবস্থান হিসেবে, নেতাদের মিলনস্থল কিংবা অস্ত্র তৈরি ও বিতরণের কাজে রেলপথের বিভিন্ন জায়গা ব্যবহার করা হতো। মাটির নিচে বলে নিরাপদ ছিল। যুদ্ধের সময় বোমাবর্ষণে মানুষ টানেলে আশ্রয় গ্রহণ করতো। যদিও সে সময় সরকার টানেলকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য নিরুৎসাহিত করে।

যখন বোমাবর্ষণ শুরু হয় তখন সরকার লন্ডনে আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি করা শুরু করে। ১০টি তৈরির কথা হলেও ৮ টি তৈরি হয়। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলো টিউব স্টেশনের পাশাপাশি থাকায় লোকজন সেগুলোও ব্যবহার করা শুরু করে। ফলে, ৩ মার্চ ১৯৪৩ সালে যুদ্ধবিমান আসার সাইরেন বেজে উঠলে বেথনাল গ্রিন স্টেশনে ঢোকার জন্য লোকজনের দৌড়াদৌড়িতে ১৪৩ জন মৃত্যুবরণ করে। আন্ডারগ্রাউন্ডের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে খারাপ একটি দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। 

যুদ্ধের সময় বিমান থেকে নিক্ষিপ্ত বোমা থেকে বাঁচতে মানুষের টানেলে অবস্থান; Image source: Getty Images

এ সময় কিছু টিউব স্টেশনকে সরকার প্রশাসনিক কার্যালয় এবং মিলিটারি কার্যালয়ে রূপান্তরিত করে। এর মাঝে ১৯৩৪ সালে চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্রম্পটন রোড টিউব স্টেশন ছিল অন্যতম। এটি পুনরায় খুলে দেওয়া হয় এবং অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট বিভাগে রূপান্তর করা হয়। স্টেশনের সম্মুখ ভাগটিতে নতুন করে দেয়াল করে অফিস রুম হিসেবে তৈরি করা হয়। টানেলগুলো অপারেশন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করা হতো। যুদ্ধ শেষে এটি ব্রিটিশ আর্মির কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং প্রধান ভবনটি ১৯৭২ সালে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন স্টেশন সে সময় ব্রিটিশ মিউজিয়ামের মূল্যবান সামগ্রী রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হতো।

ব্রম্পটন স্টেশন; Image source: Getty images

অল্ডউইচ টিউব স্টেশন

বন্ধ হয়ে যাওয়া স্টেশনগুলোর মাঝে একটি বিখ্যাত স্টেশন হচ্ছে এটি। ১৯০৭ সালে তীরভূমি হিসেবে এটি উন্মুক্ত করা হয়। এটি ছিল পিকাডিলি লাইনের শেষ প্রান্তে। স্বভাবতই শেষ প্রান্ত হওয়ার কারণে সে সময় যাত্রী খুব কম হতো এখানে। সময়ের বিবর্তনে ধীরে ধীরে এটি বন্ধ করে দেয়া হয়। যুদ্ধের সময়ে এটি লন্ডনের গুরুত্বপূর্ণ আর্টওয়ার্ক রক্ষণে ব্যবহার করা হতো। স্টেশনটি সুন্দর হওয়ায় প্রায়ই ফ্লিমসেট হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ১৯৯৪ সালে স্টেশনটি একেবারে বন্ধ করে দেয়া হয় কারণ এখান থেকে খুব কম আয় হতো। এরপর থেকে এটিকে সিনেমা পরিচালনায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেসব সিনেমার কিছু সিন এখানে গ্রহণ করা হয়েছে তার মাঝে উল্লেখযোগ্য হলো সুপারম্যান ফোর (১৯৮৬), প্যাট্রিওট গেমস (১৯৯২), ভি ফর ভেন্ডেটা (২০০৬), আটনমেন্ট (২০০৭), ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস ৬ (২০১৩), ডারকেস্ট আওয়ার (২০১৭)। জনপ্রিয় সিরিজ শার্লকেও এ দেখা মিলবে স্টেশনটির।

অল্ডউইচ স্টেশনে শুটিং; Image Source: Insider London

বর্তমানের টিউব

১৫৭ বছর আগে মেট্রপলিটান রেলওয়ে চালু হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ড আজকে অনেক দূর এসেছে। ২০০৭ সালে ১ বছরে ১ বিলিয়ন মানুষ এটি ব্যবহার করে বলে জানা যায়। মানুষ প্রতিনিয়ত এটি ব্যবহার করে যাচ্ছে। প্রজেক্ট ‘ক্রসরেইল’ হচ্ছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় আন্ডারগ্রাউন্ড কন্ট্রাকশন প্রজেক্ট। প্রায় ৫০ বছর পর এই প্রজেক্টের মাধ্যমে তৈরি করা হচ্ছে নতুন রেলপথ। ঐতিহ্যের অভিনবতা  লন্ডন আন্ডারগ্রাউন্ডকে করে তুলবে আরও আকর্ষণীয়।

Related Articles