আফ্রিকা নিয়ে নিয়ে একটি প্রচলিত মিথ হলো, এখনো এই মহাদেশে এমন দুর্গম অঞ্চল রয়েছে যেখানে সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি। এই মিথের সত্যতা কতখানি, তা নিয়ে এখনো গবেষণা চলছে। কিন্তু প্রচলিত প্রযুক্তিগত সভ্যতার সন্ধান পেয়েও আফ্রিকার মাসাই গোষ্ঠী আঁকড়ে ধরে রেখেছে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি। কেনিয়া এবং তানজানিয়ার বিশাল অংশ জুড়ে এদের বাস। প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর এ অঞ্চল ক্রমেই নীতি নির্ধারক থেকে শুরু করে পর্যটকদের জন্য হয়ে উঠছে আকর্ষণের কেন্দ্র। এ পরিস্থিতিতে তারা কতদিন নিজেদের শেকড় ধরে রাখতে পারবে, তা বলা যায় না। তবে পুরোপুরি হারিয়ে যাবার আগে জেনে নেয়া যাক তাদের সম্পর্কে কিছু অজানা কথা।
মাসাই গোষ্ঠীর ইতিহাস
একটি গোষ্ঠীর জন্ম কবে, তা তারিখ দিয়ে বলা সম্ভব না। তাই গোষ্ঠীর ইতিকথা জানার ক্ষেত্রে আমাদের উৎস হলো ইতিহাসের লিপিবদ্ধ পাতা। ইতিহাসের পাতা বলে, মাসাইরা প্রাথমিকভাবে বাস করতো দক্ষিণ সুদানে। তারা বরাবরই যাযাবর জীবনযাপন করে। ষোড়শ শতাব্দীতে উর্বর জমির খোঁজে ঘুরতে ঘুরতে তারা বর্তমান ভৌগোলিক অবস্থানে পৌঁছায় আঠারো বা উনিশ শতাব্দীর দিকে। সেই সময় এ অঞ্চলে আগে থেকেই অন্য গোষ্ঠীর বাস ছিলো। তাদের সাথে কিছুটা কলহ, কিছুটা সমঝোতা মিলিয়ে শেষে তারা মিলেমিশে বসবাস শুরু করে।
মাসাই জনগোষ্ঠী সবচেয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠে বিংশ শতাব্দীতে। এই সময়ে তারা বিখ্যাত রিফট ভ্যালির প্রায় সবটুকু অংশ জুড়েই নিজেদের সাম্রাজ্য গড়ে নেয়। এখন কেনিয়া এবং তানজানিয়া জুড়ে মাসাইদের জনসংখ্যা এক মিলিয়নের কাছাকাছি।
ভাষা
মাসাই গোষ্ঠীর ইংরেজি নামের বানান হলো 'Maasai'। তারা এখনো পর্যন্ত ইংরেজি বা অন্য কোনো ভাষা গ্রহণ করেনি, নিজেদের মাতৃভাষা 'মা'তেই কথা বলে। এই ভাষা তাদেরকে একই ধরনের অন্য কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর সাথে যুক্ত করে। সামবুরু গোষ্ঠী হচ্ছে মাসাই গোষ্ঠীর সাথে ভাষার মাধ্যমে যুক্ত একটি গোষ্ঠী।
শারীরিক গড়ন
মাসাই ছেলে-মেয়েরা সাধারণত লম্বা হয়ে থাকে। এদের জীবনযাত্রার ধরনের কারণে শরীর পেশিবহুল হয়। ছেলেমেয়ে উভয়ের মধ্যেই মাথা কামিয়ে রাখবার একটা প্রচলন আছে। মাসাইদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় হচ্ছে, তারা যোদ্ধা। মাসাই যোদ্ধারা বড় চুলের অধিকারী হন। এছাড়াও আছে লিঙ্গ নির্বিশেষে শরীরে উল্কির প্রচলন।
সংস্কৃতি
তাদের জীবনধারণ, অর্থোপার্জনের পথ, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ঘরবাড়ি, বিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে গৃহপালিত পশুর প্রচলন, গান-বাজনা, ধর্মবিশ্বাস এবং এদের ভেতরের প্রচলিত মিথ সবই মাসাই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত।
এই আদিবাসী গোষ্ঠী পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা মেনে চলে। তবে এ সমাজে অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষদের পাশাপাশি নারীদের মাঝেও বহুগামিতার প্রচলন ছিলো বলে জানা যায়। আইন হিসেবে তারা বহু বছরের প্রচলিত মৌখিক আইন মেনে চলে। মৃত্যুদণ্ডের প্রচলন না থাকলেও জরিমানার প্রচলন আছে। এই জরিমানা দিতে হয় গৃহপালিত পশুর মাধ্যমে।
ঘরবাড়ি
মাসাইদের ঘরগুলো সাধারণত নারীরা তৈরি করেন। তাদের গ্রামকে বলা হয়ে থাকে মানয়াত্তা। গ্রামের চারপাশ দিয়ে 'ক্রাল'দেয়া হয়। ক্রাল স্থানীয় গাছ থেকে সংগ্রহ করা একধরনের কাঁটা। একে বেড়া হিসেবে ব্যবহার করা হয় ঘরবাড়িকে বন্যপ্রাণী, বিশেষ করে সিংহের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। এই বেড়া দেয়ার কাজ ছেলেরা করে থাকে।
তাদের ঘরের আকৃতি আয়তাকার হয়ে থাকে। সব ঘর মিলে একটি বৃত্তের মতো তৈরি করে। এই ঘরগুলোকে বলা হয়ে থাকে বোমা। কাদা-বিষ্ঠা-ছাই সব মিলিয়ে ঘর বানানোর উপাদান তৈরি করা হয়। মেয়েরা রান্নার জন্য অথবা স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ছোট ছোট কিছু ঘর তৈরি করে, যার নাম এনকাজি।
খাদ্যাভ্যাস
মাসাই গোষ্ঠীর প্রিয় খাবার হলো মাংস। অল্প সংখ্যক মাসাই লোকেরা প্রধান খাদ্য হিসেবে শাকসবজি গ্রহণ করে। এছাড়া তাদের প্রিয় খাবারের তালিকায় আছে গরু, মহিষ বা ছাগলের দুধ। তাদের মাঝে প্রাণীর রক্ত খাবার প্রচলনও রয়েছে। তবে সেটা বিশেষ উপলক্ষ অনুযায়ী; যেমন- কেউ অসুস্থ থাকলে অথবা নারীরা সন্তান জন্মদানের পর।
যোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ থাকে ওলকিরটি গাছ থেকে তৈরি বিশেষ ধরনের পানীয়।
পোশাক
পোশাকের ব্যাপারে এই জনগোষ্ঠী খুবই রঙিন। তাদের পোশাকের নাম স্যুকা। পোশাকের ক্ষেত্রে দেখা যায় রঙের খেলা এবং প্রতিটি রঙ আলাদা আলাদা অর্থ বহন করে। সাধারণত রঙিন থান প্যাঁচ দিয়ে পোশাক বানানো হয়। ছেলেদের এই প্যাঁচ দেবার ধরনকে বলা হয় কিকই। মেয়েদের প্যাঁচ দেবার ধরনটা ছেলেদের থেকে ভিন্ন এবং একে বলা হয় কাংগা।
নারী-পুরুষ নির্বিশেষে রঙিন গহনার ব্যবহারও দেখা যায়। সবাই হাতে কাঠের ব্রেসলেট জাতীয় জিনিস পরে। তাদের গহনা এবং সাজ থেকে অনেক সময় সামাজিক অবস্থান আন্দাজ করা যায়। যেমন- ভারি কাজের গহনা গণ্যমান্য ব্যক্তিরা পরেন। যোদ্ধাদের জন্য বরাবরই বিশেষ ব্যবস্থা থাকে। যেমন- একমাত্র যোদ্ধারাই মাথায় পালকের মুকুট পরতে পারেন।
তাদের শরীরের থান অথবা গহনার সাদা রঙের অর্থ হচ্ছে তা শান্তির প্রতীক। বলা বাহুল্য, লাল রঙ যোদ্ধার প্রতীক। লাল রঙ তাদের জন্য বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাদের অস্ত্রেও লাল রঙের ছোঁয়া রাখা হয়। বর্মের ওপরে থাকে বিভিন্ন ধরনের কাদা এবং লাল মাটির প্রলেপ।
বিয়ে এবং বংশবিস্তার
মাসাই গোষ্ঠীর মাঝে বহুগামিতার প্রচলন আছে এখনো। এবং এই বহুগামিতা তাদের কাছে শখের চেয়ে প্রয়োজন বেশি। কেননা মাসাই সম্প্রদায়ে অর্থবিত্তের পরিমাপক হচ্ছে সন্তান এবং গৃহপালিত পশু। যে যত বেশি সম্পদশালী, তার সন্তান এবং পালিত পশুর সংখ্যা ততটাই বেশি। তাদের মাঝে জন্মনিয়ন্ত্রণের কোনো প্রচলন নেই। তাই সংসার এবং এই গৃহস্থালি একসাথে দেখাশোনা একজন বউয়ের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই কঠিন কাজকে সহজ করতে ঘরে নতুন বউ আনা হয় আগেরজনের সহকারী হিসেবে। এখনো তারা এই চর্চা বেশ শান্তিপূর্ণভাবেই চালিয়ে যাচ্ছে।
তবে এই প্রচলনেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। যেমন- অতীতে মেয়ের বাবা পাত্র ঠিক করতো। কিন্তু এখন অনেকেই নিজেরা পছন্দ করছে নিজেদের সঙ্গী। এবং বহুগামিতাতেও তাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে সংসারের বড় বউ হতে পারা সবসময়ই সম্মানের বিষয় হিসেবে দেখা হয়।
তাদের মাঝে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার প্রচলন আছে। ছেলেরা চেষ্টা করে মেয়েদের মন জয় করতে। বিয়ের ক্ষেত্রে মেয়ের বাবাকে সম্মান দেয়াও তাদের রীতি। সাধারণত ছাগল বলি দেয়ার মাধ্যমে সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
ধর্মবিশ্বাস
এই সম্প্রদায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী। 'লাইবন' নামে একজন থাকেন, যিনি একইসঙ্গে ধর্মযাজক এবং সামাজিক অভিভাবক। তাদের ঈশ্বরের নাম এনকাই। যদিও তারা এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তবু নীতেরকব নামে একজনকে তারা গৌণ দেবতা হিসেবে মানে। ধারণা করা হয়, এই দেবতা মানুষ এবং ঈশ্বরের মাঝে মধ্যস্থতাকারী।
আচার অনুষ্ঠান এবং উদযাপন
মাসাইদের যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান উদযাপিত হয় বৃষ্টিকে কেন্দ্র করে। সবকিছুর সাথে বর্ষাকালের সম্পর্ক রয়েছে। সব অনুষ্ঠানেই নাচগানের ব্যবস্থা থাকে।
তাদের গানে আঞ্চলিকভাবে তৈরি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়। ইউনোটো, কুডো হর্ন এরকম কিছু যন্ত্র। এসব গানে মেয়েরা সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারে না। তবে তাদের অনুষ্ঠান উপভোগ করার ক্ষেত্রে কোনো বিধিনিষেধ নেই।
তাদের নাচ দেখতে হাই জাম্পের মতো লাগতে পারে। এই লাফ দেবার ধরনকে বলা হয় 'আডুমু' বা “আইগিস'। শুধু লাফ না, ঘাড়ের একটি বিশেষ ছন্দবদ্ধ মুভমেন্ট থাকে এই নাচের মাঝে।
পুরোনো ঐতিহ্য কঠোরভাবে সংরক্ষণের কিছু কুফল
মাসাই গোষ্ঠী এই সময়েও বিখ্যাত তাদের পুরোনো সব ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য। কিন্তু এর অবশ্যই কিছু কুফল আছে। প্রথম কুফল হলো বন্যপ্রাণীর বিপর্যয়।
বহু বছর ধরে বন্যপ্রাণী এবং মাসাইরা পাশাপাশি বাস করছে। সাম্প্রতিক সময়ে আধুনিকায়নের ফলে সারা বিশ্বেই বন্যপ্রাণী আলাদাভাবে সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিচ্ছে। বিশ্বের ৫০% সিংহ এই অঞ্চলে বাস করে। কিন্তু এখনো যোদ্ধাদের হাতে সিংহ মারার ঐতিহ্যের কারণে সিংহের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। তবে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন সংস্থা এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে এবং সিংহ মৃত্যুর হারও কমে এসেছে।
মাসাই গোষ্ঠীর আরেকটি ভয়ংকর চর্চা হচ্ছে মেয়েদের সারকামসিশন বা যৌনাঙ্গ ছেদের চর্চা। এই চর্চার কারণে এই অঞ্চলে নারী মৃত্যুর হার অনেক বেশি। কেনিয়াতে আইন করে এটা বন্ধ করা হলেও সবসময় তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
আবার এই সম্প্রদায়ের মনে শিক্ষা নিয়ে একধরনের অনীহা কাজ করে। এই অনীহার ফলস্বরূপ রোগ-শোক এবং কুসংস্কার এখনো তাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এখনো আধুনিক চিকিৎসা সেবার জন্য তাদের অনেক দূরে যেতে হয়। মুমূর্ষু রোগীদের তাই অনেক ক্ষেত্রেই বাঁচানো সম্ভব হয় না।
গল্পের বইয়ের বাইরে যে এমন একটি গোষ্ঠী এই সময়েও থাকা সম্ভব, তা প্রায় কল্পনাতীত। এমন না যে তারা বৈশ্বিক প্রযুক্তির কথা জানে না। জীবনের অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রযুক্তি গ্রহণ করলেও এখনও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রেখেছে। যেমন, এখন অনেক বিয়েতেই বরপক্ষ জিপ গাড়ি নিয়ে কনে পক্ষের বাসায় গেলেও বিয়ে পুরোনো রীতিতেই হয়। সামাজিক রক্ষণশীলতার বাইরে অনেকেই পড়াশোনা করার আগ্রহ প্রকাশ করে। বিভিন্ন সংগঠন, মিশনারীর বদৌলতে অনেক মাসাই খ্রিস্টান এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।
বহু বছর নানা প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে টিকে আছে এই আদিবাসীরা। তাদের মাঝে প্রচলিত কুসংস্কার যেমন দূর করা দরকার, সেভাবেই তাদের গ্রামীণ, বিশুদ্ধ, যাযাবর জীবন ও নিজস্ব কৃষ্টি সংরক্ষণ করাটাও কর্তব্য। জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং আধুনিক জীবনযাপনের চাপের মুখে ইতোমধ্যেই অনেক কিছু হারাতে বসেছে এ সম্প্রদায়। মানবাধিকার সংস্থাগুলো তাদের অধিকার আদায়ের দায়িত্ব কতখানি পালন করতে পারে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
This article is in Bangla. It is abou about African tribal clan named 'Maasai'. It tries to describe their origi, lifestyle & culture.
All sources are hyperlinked inside the article.
Featured Image Source: Eyes on Africa