যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র কোনটি, তাহলে অনেকেরই উত্তর হবে আমেরিকা। আমেরিকা এই অবস্থানে আসার জন্য অনেক সময় এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল যা ফলাফলের দিক থেকে তাদের জন্য ভালো হলেও মানবতার দিক থেকে ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। সেরকম একটি কাজ ছিল পানামার স্বৈরাচারী শাসক ম্যানুয়েল নরিয়েগার সাথে সংশ্লিষ্টতা।
তার পূর্ণনাম ম্যানুয়েল অ্যান্টনিও নরিয়েগা মোরেনো। পানামা সিটিতে ১৯৩৪ সালে একটি গরীব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন একজন একাউন্টেন্ট এবং মা গৃহকর্ত্রী। ছোটবেলায় তার বাবা মারা যান। একপর্যায়ে মারা যান মা-ও। মা মারা যাওয়ার আগে তাকে সেখানকার একজন স্কুলশিক্ষকের কাছে দত্তক দিয়ে যান।
জীবনের একপর্যায়ে তার ভাই লুইসের খোঁজ পান এবং তার সাথে থাকা শুরু করেন। তিনি একজন সোশ্যালিস্ট কর্মী ছিলেন। নরিয়েগা তার প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে সোশ্যালিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন।
এ সময় তিনি বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তার আন্দোলন নজরে আসে সিআইএ'র। তিনি পড়তেন মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। সেই সময়েই সিআইএ তাকে গোপন সংবাদদাতা হিসেবে নিযুক্ত করে।
১৯৬২ সালে তিনি পানামা সিটিতে ফিরে আসেন এবং ন্যাশনাল গার্ডের লেফটেন্যান্ট নিযুক্ত হন। তিনি দুর্বৃত্ত ও উগ্র হিসেবে পরিচিত থাকার পরও আমেরিকানরা তার সাথে সম্পর্ক বজায় রেখেছিল। কারণ তিনি তাদের ইন্টেলিজেন্সকে সহায়তা করে যাচ্ছিলেন। আমেরিকানরা নিজেদের স্বার্থের জন্য তাকে 'স্কুল অফ দ্য আমেরিকাস' থেকে ট্রেনিং গ্রহণের সুযোগ দেয়। উল্লেখ্য, এটি পানামাতে 'স্বৈরাচারীদের স্কুল' হিসেবে পরিচিত ছিল।
এখানে থাকাকালে তিনি ওমার টরিওসের সাথে পরিচিত হন। ওমার টরিওসও পরবর্তীতে স্বৈরশাসক হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি নরিয়েগাকে তার কাজের সাথে যুক্ত করেন এবং তার অপরাধকর্মের প্রশ্রয় দিতে থাকেন। দুজন মিলে তাদের বিরোধীদের দমন করতে থাকেন। এভাবে নরিয়েগা দ্রুত পদোন্নতি লাভ করেন।
১৯৬৮ সালে ওমার তখনকার প্রেসিডেন্টকে পদচ্যুত করে নিজে প্রেসিডেন্ট হন। তার শাসনামলে নরিয়াগা পানামানিয়ান ইন্টেলিজেন্সের প্রধান হন। এ পদের অপব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও বিচারপতিকে ব্ল্যাকমেইল করে অনেক তথ্য সংগ্রহ করেন এবং সিআইএ'র কাছে পাচার করেন। তথ্য পাচারের মাধ্যমে বছরে ২ লক্ষ মার্কিন ডলারের মতো আয় করতে থাকেন।
১৯৮১ সালে রহস্যজনকভাবে প্লেন দুর্ঘটনায় ওমার মারা গেলে নরিয়েগা ক্ষমতা শূন্যতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে ন্যাশনাল গার্ডের প্রধান হিসেবে নিজেকে নিযুক্ত করেন। আর সে সময় পানামার শাসনকাজ কার্যত ন্যাশনাল গার্ডরাই করতো। সে হিসেবে তিনি হন পানামার শাসক। এভাবেই তার স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা শুরু হয়।
ক্ষমতায় আসার পর ওমারের ভুল থেকে তিনি শিক্ষা নেন এবং তার মতো সামনে থেকে শাসন না করে ন্যাশনাল গার্ডের মাধ্যমে পেছন থেকে কাজ চালাতে থাকেন। তিনি নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী ছিলেন না। বাইরে বাইরে ছিলেন জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। মানুষকে দেখানোর জন্য একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন, যার পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করে সামরিক বাহিনী।
ধীরে ধীরে অপরাধ ও ক্ষমতার অপব্যবহার বাড়তে থাকে, কিন্তু তার চাতুর্যের কারণে এসব আড়ালে থেকে যায়। ওদিকে আমেরিকার সাথেও তার বন্ধুত্ব বজায় থাকে।
তার রাজনৈতিক বিরোধী ও সমালোচক ছিলেন হুগো স্পেডাফোরা। একপর্যায়ে তাকেও নৃশংসভাবে খুন হতে হয়। এরপর নরিয়েগার সকল অপরাধের ফিরিস্তি সবার আলোচনায় চলে আসে।
হুগো শুরু থেকে তার কাজকর্মের বিরোধিতা করতেন। এটি তার শাসনব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে ওঠে। তাকে মাদক ও অস্ত্র পাচারের মতো অপরাধের সাথেও অভিযুক্ত করা হয়। পূর্ববর্তী শাসক ওমারের মৃত্যুর পেছনে তার হাত আছে- এ কথা মিডিয়ায় সরাসরি বলতে থাকেন হুগো।
এতে নরিয়েগা একটু নড়েচড়ে বসেন এবং হুগোকে গৃহবন্দি করে রাখেন। কিন্তু তাতেও হুগো থামেন না, বরং আরও বিরোধিতা করতে থাকেন। একপর্যায়ে উপায় না দেখে নরিয়েগা তাকে হত্যা করার কথা ভাবতে থাকেন। হুগো পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পরিবার নিয়ে কোস্টারিকায় চলে যান। সেখানেও তিনি নরিয়েগার বিরুদ্ধে তার আন্দোলন বজায় রাখেন।
১৯৮৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর হুগোর লাশ শিরশ্ছেদকৃত অবস্থায় পানামা ও কোস্টারিকার সীমান্ত থেকে উদ্ধার করা হয়। দেহে অনেক অত্যাচারের প্রমাণ পাওয়া যায়। হুগোর পরিবার আগেই তার নিখোঁজের খবর প্রকাশ করে এবং তদন্তের আবেদন করে। নরিয়েগা দাবি করেন, তাকে কোস্টারিকায় হত্যা করা হয়। অন্যদিকে প্রমাণ ও প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনানুযায়ী তাকে পানামাতেই হত্যা করা হয়।
পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হলে জনগণের মাঝে বিক্ষোভের সূচনা হয়। আর এটিই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বাড়তেই থাকে। ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে অনেক বিশৃঙ্খলা, আন্দোলন আর আমেরিকার চাপের তিনি ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।
আমেরিকা দীর্ঘদিন তার অপকর্মকে প্রশ্রয় দিয়ে গিয়েছিল। এসব অপকর্মের মধ্যে ছিল মাদক, অস্ত্র, অর্থ পাচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি। তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার পেছনে আমেরিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল পানামা খালে তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বজায় রাখা। এছাড়া পানামা লাতিন আমেরিকায় তাদের কমিউনিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অনেক বড় মিত্র ছিল।
হুগোর হত্যা ও ১৯৮৯ সালে নরিয়েগা ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলে আমেরিকা তাদের কৌশল বদলায় এবং পানামায় অর্থনৈতিক সহায়তা কমাতে থাকে। দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস নরিয়েগার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়- আমেরিকান সরকার অনেক আগে থেকেই এসব বিষয়ে অবগত ছিল। তৎকালীন রিগ্যান সরকার নরিয়েগাকে বোঝা মনে করা শুরু করে। ১৯৮৯ সালে মাদক পাচার মামলার জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয় এবং পানামা খাল অঞ্চলে থাকা মার্কিন নাগরিকদের জন্য তিনি হুমকিস্বরূপ বলে দাবি করা হয়।
১৯৮৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর নরিয়েগার সৈন্যরা একজন মার্কিন নৌ সেনাকে নিরস্ত্র অবস্থায় হত্যা করে। পরদিন জেনারেল কলিন পাওয়েল প্রেসিডেন্ট বুশের কাছে নরিয়েগার বিপক্ষে অপারেশনের জন্য আবেদন করেন। ২০ ডিসেম্বর ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় মিলিটারি অপারেশন 'অপারেশন জাস্ট কজ' পানামায় সংঘটিত হয়। নরিয়েগা ভ্যাটিকান অ্যাম্বাসিতে পালিয়ে যান। কিন্তু মিলিটারির চাপের কারণে ১৯৯০ সালের ৩ জানুয়ারি আত্মসমর্পণ করে।
১৯৯২ সালে তাকে শাস্তি হিসেবে ৪০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিচারের সময় সিআইএ'র সাথে তার সম্পর্কের কথা গোপন করা হয়। ফলে তাকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয় এবং মায়ামির জেলে প্রেসিডেনশিয়াল স্যুইটে রাখা হয়। ১৭ বছর পর ভালো ব্যবহারের জন্য তাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক দেশ বিভিন্ন অপরাধের কারণে তাকে আটক করতে উদগ্রীব থাকে।
আমেরিকা তাকে ২০১০ সালে ফ্রান্সের কাছে হস্তান্তর করে। সেখানে তাকে ৭ বছরের সাজা দেওয়া হয়। ২০১১ সালে ফ্রান্স তাকে পানামা সরকারের কাছে হস্তান্তর করে। সেখানে তিনটি হত্যা মামলার জন্য তাকে ২০ বছর করে মোট ৬০ বছরের সাজা দেওয়া হয়। এর মধ্যে হুগো হত্যাও ছিল। ততদিনে তার বয়স ৭৭ বছর ছুঁয়েছে, এবং শারীরিকভাবে বেশ অসুস্থ।
২০১৫ সালে তিনি পানামার জনগণের কাছে তার অপকর্মের জন্য ক্ষমার আবেদন করেন। কিন্তু কোথাও সুনির্দিষ্টভাবে কোনো অপকর্মের কথা উল্লেখ করেননি। ২০১৬ সালে তার ব্রেইন টিউমার ধরা পড়ে এবং গৃহবন্দী অবস্থায় চিকিৎসার সুযোগ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি সার্জারি চলাকালে মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে তার অবস্থার অবনতি হয় এবং কোমায় চলে যান। ২৯ মে পানামার প্রেসিডেন্ট হুয়ান কার্লোস ভারেলা তার মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করেন। এভাবেই শেষ হয় এক স্বৈরশাসকের কালো অধ্যায়।
পুনশ্চ
নরিয়েগার সম্পর্কে একটি চমৎকার ঘটনা আছে। ২০১৪ সালে তিনি ভিডিও গেম কোম্পানি এক্টিভিশনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। তার দাবি, কল অফ ডিউটি: ব্ল্যাক অপস ২ গেমের একটি চরিত্রে তাকে অপহরণকারী ও হত্যাকারী হিসেবে তুলে ধরা হয়। পরে অবশ্য মামলাটি আদালতে দ্রুত খারিজ করে দেওয়া হয়।
This Bangla article is about Manuel Antonio Noriega. He was a Panamanian politician and military officer who was the de facto ruler of Panama from 1983 to 1989.
তথ্যসূত্র
- https://www.britannica.com/biography/Omar-Torrijos
- https://www.nytimes.com/1986/06/12/world/panama-strongman-said-to-trade-in-drugs-arms-and-illicit-money.html
- https://www.theguardian.com/world/2015/jun/25/manuel-noriega-apologises-over-military-rule-of-panama
- https://edition.cnn.com/2013/08/19/world/americas/manuel-noriega-fast-facts/index.html
- https://www.pbs.org/tpt/dictators-playbook/episodes/manuel-noriega/
- https://apnews.com/ManuelNoriega
- https://www.theguardian.com/world/2017/may/30/general-manuel-noriega-feared-panamanian-dictator-cia-asset
Featured Image: William Gentile