আমাদের চারিদিকে, এমনকি শরীরের ভেতরেও কিলবিল করছে অগণিত অণুজীব। আঁতকে উঠলেন? অণুজীব, মানে ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া? এরাই তো সব রোগবালাইয়ের মূল! হ্যাঁ এটা সত্যি যে অণুজীব থেকে অনেক রোগ হতে পারে, আবার মুদ্রার উল্টো পিঠে এদের ছাড়া পৃথিবী থেকে আমরা বিলীন হয়ে যাব।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায়, আমাদের শারীরিক প্রক্রিয়ায় এমনকি বহু রকম বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে অণুজীবের বিশাল ভূমিকা আছে। ভাবছেন এসব তুচ্ছ প্রাণী ভিআইপি হলো কবে থেকে? বলা যায়, অ্যান্টনি ভ্যান লিউয়েনহুক (Antoni van Leeuwenhoek) যেদিন থেকে মাইক্রোস্কোপের নিচে ব্যাকটেরিয়া দেখতে পেয়েছিলেন তার পর থেকেই এসব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীর গুরুত্ব প্রকাশ পেতে থাকে। কিন্তু যদি কেউ আপনাকে বলে এদের নিয়ে পুরো একটি জাদুঘর আছে, অসম্ভব নয় আপনি তাকে পাগল মনে করবেন। শাহবাগে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ফ্রান্সের বিখ্যাত ল্যুভরের নাম শুনেছি, শুনেছি বিশেষায়িত জাদুঘরের নাম, যেমন- রেল জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, যানবাহনের জাদুঘরের কথাও। কিন্তু অণুজীব জাদুঘর, সে আবার কী?
অ্যামস্টারডাম, নেদারল্যান্ডস
পৃথিবীর প্রথম এবং এখন পর্যন্ত সম্ভবত একমাত্র অণুজীবের জাদুঘর নেদারল্যান্ডসের অ্যামস্টারডাম শহরের কেন্দ্রে মাইক্রোপিয়া (Micropia)। এখান থেকে মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে ডেলফট (Delft) শহরে বসেই লিউয়েনহুক সর্বপ্রথম মাইক্রোস্কোপ ব্যবহার করে অণুজীবের এক বিচিত্রে জগতে মানুষের প্রবেশাধিকারের পথ সুগম করেন। এজন্যই তাকে অণুজীববিজ্ঞানের (মাইক্রোবায়োলজি) জনক বলা হয়।
অবস্থান
মাইক্রোপিয়া অ্যামস্টারডামের বিখ্যাত আর্টিস চিড়িয়াখানার (Artis Amsterdam Royal Zoo) অংশ, যদিও এর ভবন চিড়িয়াখানার থেকে সম্পূর্ণই আলাদা এবং প্রবেশপথও ভিন্ন। এখানে ঢুকতে হলে আলাদা করে টিকেট কাটতে হবে। শহরের এই এলাকার নাম প্ল্যান্টেজ, আর যে স্কয়ারে মাইক্রোপিয়া রয়েছে তার নাম আর্টিসপ্লেইন (Artisplein)। আর্টিস চিড়িয়াখানাতে ঢোকার মুখে দু'পাশে প্রকাণ্ড দুই ভবন, একটিতে আছে প্ল্যানেটারিয়াম (planetarium), আর অন্য ভবনটি লেডোলোক্যাল (Ledenlokalen/ শাব্দিক অর্থ সদস্যদের কক্ষ) নামে পরিচিত। ১৮৭০ সালে এই ভবন স্থাপিত হয় আর্টিস চিড়িয়াখানার কর্মকর্তাদের জন্যই। এই লেডোলোক্যাল ভবনে আছে একটি রেস্টুরেন্ট, আর অণুজীবের জাদুঘর মাইক্রোপিয়া।
পেছনের কথা
২০০৩ সালে আর্টিস চিড়িয়াখানার দায়িত্ব নিলেন এক স্বপ্নবাজ ভদ্রলোক, হাচ বালিয়ান (Haig Balian)। একবিংশ শতাব্দীর জন্যে আর্টিসকে তিনি চাইলেন ঢেলে সাজাতে। তার লক্ষ্য ছিল চিড়িয়াখানাতে রাখা প্রাণীদের থাকার স্থান বর্ধিত করা, প্রকৃতি ও প্রাণীকূলের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বৃদ্ধি এবং যুগ যুগ ধরে চলে আসা আর্টিসের ঐতিহ্য সমুন্নত রাখা। এই চিন্তার পথ ধরেই তিনি শুধুমাত্র অণুজীব নিয়ে নতুন একটি প্রদর্শনীর কথা ভাবলেন। তার পরিকল্পনা হলো কীভাবে এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীকূল আমাদের চারপাশের পরিবেশের সাথে সম্পর্কিত এবং কী উপায়ে তারা মানুষের কল্যাণ বয়ে আনতে পারে জাদুঘরের মাধ্যমে সেই বক্তব্যই তুলে ধরা।
হাচ বালিয়ান তার মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করলেন। ২০০৫ সাল থেকে কাজ শুরু হলো। পুরো প্রজেক্টের হাল ধরার জন্য একটি টিম কাজ আরম্ভ করল। প্রাথমিক পরিকল্পনা মোতাবেক আর্টিসের বাইরে বিশেষায়িত একটি আলাদা ভবন তৈরি করে সেখানে মাইক্রোপিয়া স্থাপনের কথা ছিল। সেজন্য প্রজেক্ট টিম ফান্ড সংগ্রহ করতে লাগল। এছাড়া কীভাবে অণুজীবগুলো নিরাপদ উপায়ে প্রদর্শন করা যায় সেটা নিয়ে জোর তর্ক-বিতর্ক চলল। সিদ্ধান্ত হলো- যেসব অণুজীবের ক্ষতি করবার ক্ষমতা রোধ করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে, সেগুলো সরাসরি প্রদর্শনীতে স্থান পাবে, আর যেসব অণুজীবের ক্ষতি করবার ক্ষমতা অত্যন্ত বেশি হবার কারণে নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকবে সেগুলোকে ভার্চুয়ালি মানুষের সামনে তুলে ধরা হবে। এছাড়াও দর্শকদের আকর্ষণের জন্য এসব অণুজীবের সাথে মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর সম্পর্ক বিভিন্ন শিল্পকর্মের আকারে দেখানো হবে।
অণুজীব নিয়ে কাজ করার জন্য নিকটবর্তী বোটানিক্যাল গার্ডেনের পেছনে একটি কক্ষে সমস্ত ব্যবস্থা নেয়া হল। বিজ্ঞানীরা নানা অণুজীব নিয়ে গবেষণার পর কোনগুলো সরাসরিভাবে প্রদর্শনের উপযুক্ত তা নির্ণয় করেন।নেদারল্যান্ডসের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান তাদের কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিল। বিজ্ঞানীদের কাজ মসৃণভাবে চলতে থাকলেও গোল বাধল অন্য জায়গায়। বিশেষায়িত ভবন তৈরি করে জাদুঘর বানাতে গেলে যে পরিমাণ অর্থের দরকার তা সংস্থান করা সম্ভব হলো না। ফলে বিদ্যমান লেডোলোক্যাল ভবনটির কিছু অংশে প্রয়োজনীয় সংস্কার করে সেখানে জাদুঘর বানানো হয়। স্থানের সংকোচন, পর্যাপ্ত অর্থের অভাবে ইত্যাদি কারণে শতাধিক অণুজীব সরাসরি প্রদর্শনীতে যাওয়ার কথা থাকলেও সেখান থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে অল্প কিছু সংখ্যক বাছাই করা হল।
পরিকল্পনার করার প্রায় বার বছর পরে, দশ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় তের মিলিয়ন ইউএস ডলার) খরচের পর ২০১৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মাইক্রোপিয়া তার দরজা খুলে দিল, অভ্যাগতদের আমন্ত্রণ জানালো আমাদের চারপাশের এক আশ্চর্য জগতে যা আমরা খালি চোখে হয়তো দেখতে পাই না। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মাইক্রোপিয়ার রূপকার হাচ বালিয়ানের পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন নেদারল্যান্ডসের রানী ম্যাক্সিমা।
মাইক্রোপিয়ার অভ্যন্তরে
টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকতে গেলেই সর্বপ্রথম চোখের পড়বে লিউয়েনহুকের তৈরি করা মাইক্রোস্কোপের রেপ্লিকা, কাচের আড়ালে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর লিফটে উঠে এর ছাদের দিকে তাকালে দেখা যাবে ভিডিও স্ক্রিন। সেখানে দর্শক প্রথমে দেখবেন নিজের মুখমণ্ডল, যা জুম করে অ্যানিমেশনের মাধ্যমে আপনাকে নিয়ে যাওয়া হবে চোখের পাতা আর চামড়ার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোষের ভেতরে, সেখানে দেখানো হবে নানা ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের ছবি। তৃতীয় তলাতে লিফট থেকে বের হলেই আপনার চোখের সামনে বর্ণালি আলোতে উদ্ভাসিত হবে স্বাগত বার্তা,
আপনি যখন একটু কাছে থেকে মনোযোগ দিয়ে দেখবেন, তখন আপনার সামনে খুলে যাবে বিচিত্র আর চমকপ্রদ এক জগতের দুয়ার, মাইক্রোপিয়াতে আপনাকে স্বাগতম।
প্রায় অন্ধকারাচ্ছন্ন তৃতীয় তলার এই কক্ষে রয়েছে একসারিতে সাজানো অনেকগুলো মাইক্রোস্কোপ। এর নিচে রাখা আছে নানা প্রজাতির অণুজীব, যা দেখা যাবে প্রতিটি মাইক্রোস্কোপের সাথে সংযুক্ত স্ক্রিনে। এখানে আরো দেখতে পাবেন মেঝে থেকে ছাদ অবধি বিশাল নীল রঙের (fluorescent blue) ট্রি অফ লাইফ, যাতে তুলে ধরা হয়েছে প্রাণীজগতের বিবর্তনের সাথে অণুজীবের ওতপ্রোত সম্পর্ক। পুরো গাছে প্রধান কুশীলব এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণীরাই, মানুষ এবং অন্যান্য জীবের অবস্থান অনেকটা ফুটনোটে।
পুরো জাদুঘরে তিরিশের অধিক প্রদর্শনী দেখার সুযোগ আছে, যার প্রায় অর্ধেক সত্যিকার অণুজীব দিয়ে তৈরি, আর বাকিগুলো মডেলের সাহায্যে বা ভার্চুয়ালি দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-
- সাত ফুট উঁচু একটি স্ক্যানার। এর সামনে দাঁড়ালে আপনার শরীর স্ক্যান করে তা দেখাবে দেহের কোন কোন অংশে কীরকম অণুজীব বসবাস করছে।
- প্রায় দুই তলার সমান স্ক্রিনে অণুজীবের নানা অ্যানিমেশন।
- কিস-ও-মিটার (Kiss-O-Meter), যা আপনাকে দেখাতে সক্ষম চুম্বনের মধ্য দিয়ে কী কী অণুজীব একজনের শরীর থেকে আরেকজনের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
- টারডিগ্রেড (Tardigrades) জাতীয় প্রাণীর বিরাটাকায় মডেল। টারডিগ্রেডরা পানিতে থাকা আটপেয়ে এক প্রজাতির ক্ষুদ্র প্রাণী, এদেরকে পানির ভাল্লুকও (water bears) বলা হয়।
- চরম পরিবেশে, যেখানে অন্য কোনো প্রাণীর পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়, সেখানে বসবাসকারী ব্যাকটেরিয়া (extremophile)।
- পিঁপড়ের কলোনি।
- কাচের তৈরি অণুজীবের বাস্তবানুগ প্রতিরূপ।
- মৃত একটি শিশু জিরাফের দেহ, যেখানে কী কী ব্যাকটেরিয়া বাসা বাধে তা দেখানো হয়
- পানিতে থাকা ছত্রাক, শৈবাল, পোকামাকড়ের লার্ভা
- সংরক্ষিত একটি মানব পরিপাকতন্ত্র
- দেয়াল জুড়ে পেট্রিডিশে সাজানো নানা রকম ব্যাকটেরিয়া
জাদুঘরে বর্তমানে রাখা আছে তিনশোর মতো অণুজীব। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ এবং নতুন নতুন প্রাণী প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্যে এখানে আছে আধুনিক গবেষণাগার। কাচের বাইরে থেকে এই গবেষণাগারে বিজ্ঞানি এবং টেকনিশিয়ানদের কার্যক্রম দর্শকেরা দেখতে পান।
এছাড়াও টিকেটের সাথে একটি কার্ড দেয়া হয় যেখানে প্রদর্শনীর বিভিন্ন অংশে রাখা মেশিনের সহায়তায় নানা অণুজীবের ছাপ মারা যায়। এরকম ত্রিশটি স্থান থেকে ত্রিশ রকম ছাপ মারার সুযোগ আছে।
অন্যান্য অণুজীব প্রদর্শনী
বিশেষায়িত অণুজীব জাদুঘর হিসেবে মাইক্রোপিয়া অনন্য। তবে আরো কিছু জাদুঘরেও শুধুমাত্র অণুজীবের জন্য আলাদা প্রদর্শনী আছে। আমেরিকার ওরেগন বিজ্ঞান ও শিল্প জাদুঘরের অধীনে রয়েছে তেমনই একটি প্রদর্শনী (The Zoo in You)। এখানে জীবন্ত অণুজীব না থাকলেও প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের উপকারি অণুজীবের বিষয়ে বিশদ তথ্য তুলে ধরার ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া আমেরিকান প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের 'গোপন পৃথিবী' (Secret World Inside You), হার্ভার্ড প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরের 'তুলনামূলক প্রাণীবিদ্যা' (Museum of Comparative Zoology) ইত্যাদি প্রদর্শনীতেও অণুজীবের আলাদা স্থান রয়েছে। তবে মাইক্রোপিয়ার মতো সমৃদ্ধ এবং বিস্তৃত সংগ্রহশালা এবং প্রদর্শনী সম্ভবত এখন পর্যন্ত কারও নেই।
This is a Bengali language article. This article describes the magnificent microbial museum located in Amsterdam. Necessary references are hyperlinked.
References
- Yong, E. (2015). a visit to Amsterdam's microbe museum
- Fernandez, C. R. (2018). The First and Only Museum of Microbes Captivates Amsterdam
- Antonie van Leeuwenhoek (1632 - 1723)
- Micropia Amsterdam (2020)
- Amsen, E (2017). Micropia: Amsterdam’s microbe museum
- Ward, G. (2016). A visit to Micropia - a new museum of the invisible in Amsterdam
- Artis Micropia
- Tarin, H (2014). Queen Maxima visited the Amsterdam Micropia Museum
- Age of the Microzoo (2016)
- Micropia (2016)
Feature Image Source: awesomeamsterdam.com