ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট ১৯৮৮ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর শুধুমাত্র চলচ্চিত্র নিয়ে নির্মাণ করে চলচ্চিত্রের এক জাদুঘর যার নাম দেয়া হয়েছিল ‘মিউজিয়াম অব মুভিং ইমেজেস’, সংক্ষেপে ‘মোমি’। চলচ্চিত্রের ক্রম বিবর্তন দর্শকদের মাঝে তুলে ধরাই ছিল এই জাদুঘরের মূল উদ্দেশ্য। টেমস নদীর দক্ষিণ তীরে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক বলয়ের এক অংশ হিসেবে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। শুধু চলচ্চিত্রের নানা খুঁটিনাটি তুলে আনাই এ জাদুঘরে মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না, যেসব যন্ত্রের সাহায্যে ‘ইমেজ’ বা ছবি আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়, সেসব যন্ত্রগুলোর প্রদর্শনীরও ব্যবস্থা রাখা আছে জাদুঘরে।
কী আছে এই জাদুঘরে?
জাদুঘরে প্রবেশের মুখেই রয়েছে বিভিন্ন বাহারি যন্ত্রের প্রদর্শনী। পদার্থবিদ্যার ‘পারসিসটেন্স অব ভিশন’ তত্ত্ব প্রথম আবিষ্কার করেন ফরাসি আবিষ্কারক শেভালিয়ার দ্য আর্সি। একটি চাকায় এক টুকরো জ্বলন্ত কয়লা লাগিয়ে তা দ্রুত ঘোরালে যেন আলোর রেখার একটি কাল্পনিক,অথচ মনে হয় সত্যি, ছবি মনের পর্দায় তৈরি হচ্ছে।
আর্সির আবিষ্কার এই ‘ঘুরন্ত আগুন’ মোমির অন্যতম প্রধান দ্রষ্টব্য। পারসিসটেন্স অব ভিশন তত্ত্বের কৌশলকে কাজে লাগিয়ে তৈরি হয়েছে ‘জোইট্রোপ’–এর মতো যন্ত্র। একটি দন্ডের সাতে লাগানো গোলাকার একটি কাগজ, তাতে পরপর আঁকা কোনো ঘটনার ক্রমিক ছবি। হাত দিয়ে কাগজটি দন্ডের চারপাশে ঘোরালে মনে হবে, ছবিগুলো চলন্ত। মোমি’তে দর্শকেরা নিজেরাই চালিয়ে জোইট্রোপের মজা পেতে পারেন।
মোমির পরবর্তী পর্যায়ে রয়েছে ফটোগ্রাফি আর ক্যামেরার আবিষ্কার এবং আবির্ভাব। প্রাচীনতম কাচের প্লেটের ক্যামেরা থেকে আধুনিকতম ক্যামেরা ফিল্মের প্রদর্শনী- যন্ত্রের এসব বিবর্তন সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে এই বিভাগে। এই সময়ে সিনেমারও জন্ম।
এ জাদুঘরে আবিষ্কর্তা টমাস আলভা এডিসন ও তার সমসাময়িক এডওয়ার্ড মায়ব্রিজ, এতিয়েন জুল মারি, এদের ছবি সংক্রান্ত নানা ধরনের কাজের পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে তাদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিদর্শন রাখা আছে। এছাড়া চলচ্চিত্র শিল্পের এমনই অনেক বিবর্তনের নিদর্শন, যেমন- নির্বাক ছবিতে শব্দের রূপায়ণ বা পরবর্তী সময়ে অত্যাধুনিক স্টেরিও সাউন্ডের আবির্ভাব, সিনেমাস্কোপের ব্যবহার ইত্যাদি প্রযুক্তিগত দিকগুলোকেও উজ্জ্বল করে রেখেছে এই জাদুঘর।
টেলিভিশনের জন্ম ইতিহাস
টেলিভিশনের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে মোমিতে পুরো একটি বিভাগ আছে। এ কক্ষে টেলিভিশনের স্রষ্টা জন লোগি বেয়ার্ড এবং তার পরবর্তী সময়ে টেলিভিশনের বিবর্তনের সাথে জড়িত অন্য আবিষ্কারকদের কথা তথ্যচিত্র ও ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, টেলিভিশনের প্রযুক্তিগত নানা বিবর্তনের কথাও জানা যায় এখানে। এই বিভাগে ‘ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন’ বা বিবিসির সাংবাদিকরা কীভাবে কাজ করেন, খবর তৈরি করেন ও তা প্রচার করেন জনসমক্ষে, সে সম্পর্কে বিশদ জানা যায়।
চলচ্চিত্র বিভাগ
ক্যামেরা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষারই পরবর্তী ধাপে চলচ্চিত্রের আবির্ভাব ও আবিষ্কারের কথা জানা যাবে। জর্জ লুমিয়ের ও মেলিজের প্রথম যুগের সিনেমার বিভিন্ন কাজের নিদর্শন রাখা আছে মোমিতে। লুমিয়েরের এক কারখানা থেকে শ্রমিকদের বেরোনোর দৃশ্য, যা বিশ্বের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে অনেকেই মনে করে থাকেন- তা দেখানোর ব্যবস্থা আছে।
লে জার্ডিনারের প্রথম কাহিনীচিত্রও এখানে দেখানোর ব্যবস্থা আছে। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ডি গ্রিফিথের যুগান্তকারী চলচ্চিত্র ‘বার্থ অব এ নেশন’, যেখানে প্রথম ‘ক্লোজ আপ’-এর ব্যবহার হয়েছে বা ‘ক্যারিবিয়া’র মতো বিখ্যাত ছবির অংশবিশেষ, এসবের মাধ্যমে বিশ্ব-ইতিহাসে সিনেমার বিবর্তনকে এই জাদুঘরে ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।
যুদ্ধের চলচ্চিত্র ও তথ্যচিত্র নিয়ে ডকুমেন্টরি বিভাগ
পৃথিবীতে যেসব উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক পরিবর্তন ঘটে গেছে, তাকেও উপেক্ষা করেনি মোমি। যেমন, সিনেমা দুটি বিশ্বযুদ্ধকে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাস্তব দলিল চিত্র নিয়ে নির্মিত বেশ কয়েকটি তথ্যচিত্র এখানে দর্শকদের দেখানো হয়।
সের্গেই আইজেনস্টাইন, জিগা ভার্টভ, লেভ কলেশভ প্রমুখ দুর্ধর্ষ পরিচালকদেরকে আধুনিক তথ্যচিত্র ও চলচ্চিত্রশিল্পের জনক হিসেবে ভাবা হয়। এসব চলচ্চিত্রকারদের বিভিন্ন কাজের এখানে নিদর্শন পাওয়া যাবে। তথ্যচিত্র নির্মাণের অতীত ইতিহাস, বাস্তব পরিস্থিতি ও বিকাশমান ধারা হিসেবে এর অগ্রগতির প্রেক্ষাপট এ বিভাগে তুলে ধরা হয়েছে। দর্শকদের মাঝে প্রশংসিত হওয়া বিখ্যাত সব তথ্যচিত্রের পোস্টার ও সেসব তথ্যচিত্র দেখানোর বিশেষ ব্যবস্থা রাখা আছে।
হলিউড চলচ্চিত্র বিভাগ
মোমিতে হলিউডের চলচ্চিত্র নিয়ে আলাদা একটি কক্ষ আছে। বিশাল এই কক্ষটির নাম ‘টেম্পল অব গডস’। বিখ্যাত চিত্র তারকাদের ছবি, চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা, বিভিন্ন জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের অংশবিশেষ এখানে সযত্নে রাখা আছে। এই কক্ষে বিভিন্ন সময়ে জনপ্রিয় হওয়া ও ক্রিটিকদের কাছে প্রশংসিত হওয়া হলিউডের বেশ কিছু চলচ্চিত্রের পোস্টার দিয়ে পুরো কক্ষ সাজানো হয়েছে। এখানে হলিউডের প্রখ্যাত সব চলচ্চিত্রকারদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে।
অ্যানিমেটেড ছবির কক্ষ
মোমির আরেক বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সিনেমার এক দুর্দান্ত শাখা, ‘অ্যানিমেশন’ বা ‘কার্টুন ছবি’। কীভাবে অ্যানিমেশন ছবি নির্মাণ করা হয়, শুরুর দিকে অ্যানিমেশন ছবিগুলো কেমন ছিল, বর্তমান সময়ের অ্যানিমেশন ছবিই বা কেমন, কী করে ও কেমন ভাবে হাতে-আঁকা কার্টুন ছবির যুগ থেকে অত্যাধুনিক ‘ভিডিও-অ্যানিমেশন’ আর ‘পেন্ট বক্স’ প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটলো সে সব খুঁটিনাটি তথ্য এই অ্যানিমেশন-কক্ষ পরিদর্শনকালে দর্শকরা জানতে পারেন।
ওয়াল্ট ডিজনি, লটি রাইনিগার, চাক জোন্স বা উব ইওয়ার্কসের মতো দিকপাল অ্যানিমেটরদের কাজের নিদর্শন, ইতিহাস, সবই এই বিভাগে দেখানোর ব্যবস্থা রয়েছে। ইচ্ছে করলে একজন দর্শক তার পছন্দমতো একটা গোটা অ্যানিমেশন ছবি এ ঘরে বসেই তৈরি করে নিতে পারেন। শুধু কী তা-ই! কী করে একজন অ্যানিমেটর প্রতিটি ফ্রেম বা ছবি আলাদা করে এঁকে এঁকে একটি এনিমেটেড ছবি তৈরি করছেন সে সম্পর্কে দর্শকেরা ধারণা পেতে পারেন।
সায়েন্স ফিকশন অ্যান্ড ফ্যান্টাসি বিভাগ
বিজ্ঞান ও কল্পনা-নির্ভর ছবির জন্য এই জাদুঘরে আলাদা একটি বিভাগ আছে। এই বিভাগে লুমিয়েরের ‘ভয়েজ টু দ্য মুন’ থেকে ‘স্টার ওয়ারস’, স্টার ট্রেক, ‘ফ্যানটাস্টিক ভয়েজ টু থাউজেন্ড ওয়ান- আ স্পেস অডিসি’, ‘ফ্যানটাস্টিক ফোর’, স্পিলবার্গ পরিচালিত ‘’ইটি’, ‘দ্য থিং’ ইত্যাদি ছবির অংশবিশেষ দেখানো হয়। কল্পনার জগতের অবাধ লীলাভূমি এই বিভাগের নামও তাই রাখা হয়েছে ‘সায়েন্স ফিকশন অ্যান্ড ফ্যান্টাসি’।
আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র বিভাগ
ইংরেজি ভাষার চলচ্চিত্র ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার পুরষ্কারপ্রাপ্ত ও জনপ্রিয় বিভিন্ন সিনেমার পোস্টার ও আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা সব চলচ্চিত্র পরিচালকদের সম্পর্কে জানার জন্য রয়েছে মোমির ‘আন্তর্জাতিক সিনেমা’ বিভাগ। এ বিভাগে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎই চোখে পড়ে যেতে পারে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ছবির পোস্টার, আবার কোনো দর্শক আব্বাস কিয়রোস্তামির অসাধারণ কোনো সিনেমার পোস্টার দেখে থমকে যেতে পারেন।
মোমির কন্ট্রোল সেন্টার
মোমির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশগুলোর অন্যতম এর ‘কন্ট্রোল সেন্টার’। এই নিয়ন্ত্রণ কক্ষে এক জায়গায় ৩৫ মি.মি., ১৬ মি.মি. বা সুপার এইট ইত্যাদি নানা মাপের বিভিন্ন সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা আছে। তার সাথে লেজার ভিডিওর মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এই নিয়ন্ত্রণ কক্ষের মাধ্যমে সম্পূর্ণ জাদুঘরের বিভিন্ন কক্ষে সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থাসহ নানা অত্যাধুনিক প্রযুক্তিকে মোমি কর্তৃপক্ষ কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন, তা দর্শকদের সামনে তুলে ধরা হয়।
মোমির স্টুডিও সেট
একটি পুরো ছবি দৃশ্যায়নের সম্পূর্ণ ধারণা যাতে দর্শকরা পান, সেজন্য মোমির একটি বিশাল কক্ষে তৈরি হয়েছে দৃশ্যপট সমেত একটি পুরো ‘স্টুডিও-সেট’। সেখানে ক্যামেরা আছে, আর আছে স্টুডিওতে ব্যবহৃত আলো। আলোগুলো একটি তৈরি সেটকে বিভিন্ন দিক থেকে উজ্জ্বল করে রেখেছে, ঠিক যেমনটি থাকে আসল সিনেমার শুটিংয়ে। এখানেই অন্য একটি কোণে দেখা যাবে ‘কস্টিউম’ বা রূপসজ্জা বিভাগ। বিভিন্ন বিখ্যাত ছবিতে চিত্র তারকাদের ব্যবহৃত পোশাক সংরক্ষিত আছে এখানে।
চেঞ্জিং এক্সিবিশন
মোমি দেখা শেষ হয় একটি গ্যালারি দিয়ে, এর নাম ‘চেঞ্জিং এক্সিবিশন’। এখানকার দ্রষ্টব্য বিষয়গুলো ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়। এখানে বিভিন্ন বিষয় দেখানো হয়। কখনো চার্লি চ্যাপলিন, কখনো রে হ্যারি হাউসেনের সৃষ্ট কাল্পনিক জন্তু, কখনও বিশাল আকৃতির কিং কং বা জুরাসিক পার্কের ডাইনোসর কিংবা ‘জস’ সিনেমার বিশাল হাঙর, আবার ‘পপ-রক-স্টার’ মাইকেল জ্যাকসনদের মতো তারকাদের বিখ্যাত কোনো পারফরমেন্সের অংশবিশেষ দেখানো হয়।
তাছাড়াও মোমিতে বিভিন্ন সময়ের বিশ্ব বরণ্য চলচ্চিত্রকারদের বক্তৃতা, লিখিত তথ্য, দর্শকদের সাথে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর চলচ্চিত্রের ইতিহাস, তার ধারা ও এর ভবিষ্যৎ নানা পরিবর্তন সম্পর্কে দর্শকদের ধারণা দেয়া হয়। ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউট মোমির তরফ থেকে বেশ কয়েকটি বইও প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে আছে একটি সচিত্র গাইডবুক, যা দর্শকদের এই জাদুঘরে কোথায় কী আছে বুঝতে সাহায্য করে।
আর্থিকভাবে লাভবান না হওয়ায় ১৯৯৯ সালে এই জাদুঘর সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ জাদুঘরের কয়েকটি বিভাগ নিয়ে বিএফআই সাউথ ব্যাংক ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটার কমপ্লেক্সে মোমি আবার নতুন করে যাত্রা শুরু করে। ২০১৮ সালের এপ্রিলে এই জাদুঘরের বেশ কয়েকটি বিভাগহ নতুন কিছু বিভাগ নিয়ে কেন্ট শহরে ‘কেন্ট মিউজিয়াম অফ মোভিং ইমেজ’ আত্মপ্রকাশ করে।
বর্তমানে এই দুই জায়গায় মোমি মিউজিয়ামটি বিভক্ত হয়ে গেলেও এই মিউজিয়ামের আবেদন যে কোনো অংশে কমে যায়নি তা এই মিউজিয়ামে আসা হাজারো দর্শনার্থীর পদচারণায় প্রতিনিয়ত জানান দিয়ে যাচ্ছে।
This Bangla article is about MOMI-a different types of museum of moving images. MOMI was a museum of the history of cinema technology and media sited below Waterloo Bridge in London. It was opened on 15 September 1988. Necessary references have been hyperlinked.
Featured Image: naturallydelicious.com