Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধ (পর্ব–২): আজারবাইজানি ও আর্মেনীয় ভূরাজনীতি

“আমরা ন্যায়ের পক্ষে আছি, এবং আমরা বিজয়ী হবো! ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপটে আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার সময় এমনই বক্তব্য রাখেন। প্রাক্তন সোভিয়েত উপপ্রধানমন্ত্রী হায়দার আলিয়েভের ছেলে ইলহাম আলিয়েভের এই উক্তিটি স্মরণ করিয়ে দেয় ১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মানি কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের প্রেক্ষাপটে সোভিয়েত জনসাধারণের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিয়াচেস্লাভ মলোতভের সেই বিখ্যাত উক্তি, আমরা ন্যায়ের পক্ষে আছি! বিজয় আমাদেরই হবে!

আলিয়েভের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তব হবে কি না, সেটা একমাত্র সময়ই বলে দিতে পারে। ১৯১৮–২০ সালে এবং ১৯৮৮–৯৪ সালে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে যে দুটি যুদ্ধ হয়েছিল, তার কোনোটিতেই আলিয়েভের রাষ্ট্র, অর্থাৎ আজারবাইজান, বিজয়ী হতে পারেনি। প্রথম যুদ্ধের শেষে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া উভয়েই সোভিয়েত ইউনিয়নের করতলগত হয়, আর দ্বিতীয় যুদ্ধটিতে আর্মেনিয়া পরিপূর্ণরূপে বিজয়ী হয়। আলিয়েভ এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে নতুন ইতিহাস রচনা করতে আগ্রহী।

আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যকার বিরোধের মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে একটি পার্বত্য অঞ্চল, যেটির নাম ‘নাগর্নো–কারাবাখ’। অঞ্চলটি আজারবাইজানের অভ্যন্তরে অবস্থিত, এবং আর্মেনিয়ার সঙ্গে অঞ্চলটির কোনো সরাসরি সীমান্ত সংযোগ নেই। কিন্তু অঞ্চলটির অধিবাসীদের সিংহভাগই জাতিগতভাবে আর্মেনীয়, এবং তারা বরাবরই আর্মেনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। ১৯২১ সালে বলশেভিকরা নাগর্নো–কারাবাখকে আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত করে, এবং ১৯২৩ সালে অঞ্চলটিকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করে। কিন্তু ১৯৮০–এর দশকের শেষদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রাক্কালে অঞ্চলটি আর্মেনিয়ার সমর্থনে আজারবাইজানের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে।

১৯৯২ সালে নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধের সময় একদল আজারবাইজানি সৈন্য; Source: Wikimedia Commons

আজারবাইজান নিজস্ব ভূমি হারাতে রাজি ছিল না, ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যুদ্ধে আজারবাইজানিরা সম্পূর্ণরূপে পরাজিত হয়, এবং আর্মেনিয়া নাগর্নো–কারাবাখের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ এবং এর আশেপাশের ৭টি আজারবাইজানি জেলার সম্পূর্ণ অংশ বা অংশবিশেষ দখল করে নেয়। প্রাক্তন ‘নাগর্নো–কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশে’র আয়তন ছিল ৪,৩৮৮ বর্গ কি.মি. এবং এর মধ্যে ৪,০৮৮ বর্গ কি.মি. আর্মেনীয়রা দখল করে নেয়। এর পাশাপাশি তারা নাগর্নো–কারাবাখের আশেপাশে অবস্থিত আজারবাইজানের ৫টি জেলার সম্পূর্ণ অংশ, ২টি জেলার অংশবিশেষ এবং ২টি ছিটমহল দখল করে নেয়।

আর্মেনীয়রা যে ৫টি জেলা সম্পূর্ণরূপে দখল করে নিয়েছিল, সেগুলো হলো কালবাজার (১,৯৩৬ বর্গ কি.মি.), লাচিন (১,৮৩৫ বর্গ কি.মি.), কুবাদলি (৮০২ বর্গ কি.মি.), জাব্রাইল (১,০৫০ বর্গ কি.মি.) এবং জাঙ্গিলান (৭০৭ বর্গ কি.মি.)। এছাড়া আর্মেনীয়রা আজারবাইজানের আগদাম জেলার প্রায় ৭৭% (১,০৯৪ বর্গ কি.মি.–এর মধ্যে ৮৪২ বর্গ কি.মি.), ফুজুলি জেলার প্রায় ৩৩% (১,৩৮৬ বর্গ কি.মি.–এর মধ্যে ৪৬২ বর্গ কি.মি.) এবং নাখচিভান ও কাজাখ অঞ্চলের দুইটি ছিটমহল (৭৫ বর্গ কি.মি.) দখল করে নিয়েছিল। আর্মেনীয়দের দখলকৃত মোট ভূমির পরিমাণ ছিল ১১,৭৯৭ বর্গ কি.মি. এবং এটি আজারবাইজানের মোট ভূমির ১৩.৬২%। অন্যদিকে, প্রাক্তন ‘নাগর্নো–কারাবাখ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশে’র প্রায় ৩০০ বর্গ কি.মি. ভূমি আজারবাইজানের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং আজারবাইজানিরা আর্মেনিয়ার একটি ছিটমহল (৫০ বর্গ কি.মি.) দখল করে নিয়েছিল।

১৯৮৮–৯৪ সালের যুদ্ধের পর আর্মেনিয়া নাগর্নো–কারাবাখ ও আর্মেনিয়ার সঙ্গে অঞ্চলটিকে যুক্তকারী করিডোরটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে দখল করে নেয়নি, বরং সেখানে ‘আর্তসাখ প্রজাতন্ত্র’ নামে একটি স্বাধীন, কিন্তু আর্মেনিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত, রাষ্ট্র স্থাপন করেছে। এর পিছনে আর্মেনিয়ার উদ্দেশ্য ছিল, ভবিষ্যতে আজারবাইজানের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যেন প্রয়োজনীয় ছাড় দেয়া যায়। অন্যদিকে, আর্মেনিয়াসহ জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্র আর্তসাখকে স্বাধীন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি, ফলে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে অঞ্চলটি এখনও আজারবাইজানের অংশ।

মানচিত্রে বিরোধপূর্ণ নাগর্নো–কারাবাখ ও সংশ্লিষ্ট আজারবাইজানি করিডোর; Source: Modern Diplomacy

১৯৮৮–১৯৯৪ সালের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলেও কার্যত আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আজারবাইজানের সঙ্গে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের বিক্ষিপ্ত সীমান্ত সংঘর্ষ অঞ্চলটিতে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি আরম্ভ হওয়া যুদ্ধটি ১৯৯৪ সালের পর থেকে সংঘটিত সকল সংঘাতকে ছাপিয়ে গেছে এবং একটি বৃহৎ মাত্রার আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ নেয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।

নতুন এই যুদ্ধ শুরুর জন্য আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া একে অপরকে দায়ী করেছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধ শুরু করেছে আজারবাইজান, কারণ ১৯৯৪ সালে বিজয়ী আর্মেনীয়রা তাদের প্রয়োজনীয় সকল ভূমি দখল করে নিয়েছিল, সুতরাং তাদের নতুন করে যুদ্ধ শুরু করার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তদুপরি, যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে আজারবাইজানি সৈন্যরা যেভাবে আক্রমণাভিযান পরিচালনা করেছে, তাতে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল এবং পরিকল্পিতভাবেই এই যুদ্ধের সূচনা করেছে। কিন্তু আজারবাইজান কেন এই সময়ে যুদ্ধ শুরু করল?

প্রথমত, ১৯৮৮–৯৪ সালের যুদ্ধে পরাজয় আজারবাইজানের জন্য ছিল একটি ‘জাতীয় বিপর্যয়’। যুদ্ধটিতে আজারবাইজানের বিপুল পরিমাণ সামরিক ক্ষয়ক্ষতি (২৫,০০০–৩০,০০০ সৈন্য নিহত, ৫০,০০০ সৈন্য আহত, ৪,২১০ সৈন্য নিখোঁজ) হয়, রাষ্ট্রটি বিপুল পরিমাণ ভূমি হারায়, প্রায় সাড়ে ৭ লক্ষ আজারবাইজানি উদ্বাস্তুতে পরিণত হয় এবং আর্মেনীয় সৈন্যরা আজারবাইজানি জনসাধারণের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ‘হত্যাযজ্ঞ’ (massacre) চালায়। আজারবাইজানিদের কাছে যেটি আরো অবমাননাকর ছিল এই বিষয়টি যে, আর্মেনিয়ার জনসংখ্যা আজারবাইজানের এক–তৃতীয়াংশেরও কম হওয়া সত্ত্বেও তারা আজারবাইজানকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়।

২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নতুন করে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ বাকুতে ভাষণ দিচ্ছেন; Source: Azerbaijan Presidential Press Office/AP via Daily Sabah

এই পরাজয় আজারবাইজানিদের মধ্যে বিদ্যমান আর্মেনীয়ভীতিকে (Armenophobia) তীব্রতর করে তোলে। আজারবাইজানের আনুষ্ঠানিকভাবে গণতান্ত্রিক, কিন্তু কার্যত একনায়কতান্ত্রিক, সরকার নিজেদের শাসনকে ন্যায়সঙ্গত প্রমাণ করার জন্য জনসাধারণের মধ্যে আর্মেনীয়ভীতি আরো উস্কে দিয়েছে। আর্মেনীয়দের দখলকৃত ভূমি উদ্ধারের ক্ষেত্রে আজারবাইজানি সরকারের ব্যর্থতা রাষ্ট্রটির জনসাধারণকে ক্রমশ ক্ষিপ্ত করে তুলেছে এবং ২০২০ সালের জুলাইয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে সীমান্ত সংঘর্ষের পর হাজার হাজার আজারবাইজানি রাজধানী বাকুতে দখলকৃত অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিক্ষোভ করে। এছাড়া, নাগর্নো–কারাবাখ থেকে উদ্বাস্তু হওয়া আজারবাইজানিরাও সরকারের ওপর ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে আসছে।

দ্বিতীয়ত, ১৯৮৮–৯৪ সালের যুদ্ধের সময় অদক্ষ সেনানায়কদের দ্বারা চালিত, দুর্নীতিগ্রস্ত ও মনোবলহীন আজারবাইজানি সৈন্যবাহিনী তুলনামূলকভাবে দক্ষ, কম দুর্নীতিগ্রস্ত ও মনোবলসম্পন্ন আর্মেনীয়দের কাছে পরাজিত হয়। কিন্তু এই তিন দশকে পরিস্থিতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। জ্বালানিসমৃদ্ধ আজারবাইজান অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করতে সক্ষম, এবং আজারবাইজানের সামরিক বাজেট আর্মেনিয়ার সম্পূর্ণ বাজেটের চেয়েও বেশি। বিগত তিন দশকে আজারবাইজান প্রচুর নতুন সামরিক সক্ষমতা অর্জন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে ড্রোন, ইনডিরেক্ট ফায়ার, টার্গেট অ্যাকুইজিশন, ইন্টেলিজেন্স এবং কমান্ড, কন্ট্রোল ও কমিউনিকেশন সক্ষমতা।

তেল ও গ্যাস রপ্তানি থেকে লব্ধ অর্থের মাধ্যমে আজারবাইজান রাশিয়া, ইসরায়েল, তুরস্ক ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় করেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রুশ ও ইসরায়েলি বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র, ইসরায়েলি ও তুর্কি অ্যাটাক ও গোয়েন্দা ড্রোন এবং ইসরায়েলি ও দক্ষিণ কোরীয় ট্যাঙ্ক–বিধ্বংসী ক্ষেপনাস্ত্র। আজারবাইজানি সৈন্যরা তাদের আর্টিলারি ও মাল্টিপল রকেট লঞ্চার সিস্টেম ব্যবহার করে নির্ভুল গোলাবর্ষণের জন্য ড্রোন ও স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করতে শিখেছে। ফলশ্রুতিতে আজারবাইজান সামরিক দিক থেকে গুণগত ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে আর্মেনিয়ার চেয়ে অগ্রসর হয়েছে, এবং আজারবাইজানি কৌশলবিদদের ধারণা, সামরিক ভারসাম্য এখন আজারবাইজানের অনুকূলে।

সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় একজন আজারবাইজানি সৈন্য; Source: RIA Novosti/Novaya Gazeta

তৃতীয়ত, আজারবাইজানের অর্থনীতি বহুলাংশে জ্বালানি তেলের মূল্যের ওপর নির্ভরশীল এবং ২০১৪ সালের পর তেলের মূল্যহ্রাস রাষ্ট্রটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। আজারবাইজানের সরকারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভিন্নমত দমন, রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নির্যাতন এবং নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে, এবং এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই জনসাধারণের একাংশ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ। তদুপরি, সাম্প্রতিক বৈশ্বিক কোভিড–১৯ মহামারী আজারবাইজানের অর্থনীতিকে আঘাত করেছে। এমতাবস্থায় আজারবাইজানের ক্ষমতাসীন ‘আলিয়েভ পরিবার’, যেটি ১৯৬৯ সাল থেকে (মাঝখানে কিছু সময় ব্যতীত) আজারবাইজানের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, জনসাধারণের মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নিতে আগ্রহী

নাগর্নো–কারাবাখ সমস্যাটিকে আজারবাইজানের জনসাধারণ তাদের ‘অস্তিত্বে’র সঙ্গে সম্পৃক্ত হিসেবে বিবেচনা করে এবং বিষয়টি তাদের আবেগের সঙ্গে জড়িত। আজারবাইজানের প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল নাগর্নো–কারবাখ ও আশেপাশের আজারবাইজানি অঞ্চল পুনরুদ্ধার করার পক্ষে। আজারবাইজানিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা এই মুহূর্তে অনেক বেশি। এমতাবস্থায় আজারবাইজানি সরকার এই বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে অভ্যন্তরীণ জনপ্রিয়তা অর্জনে ইচ্ছুক। যদি আজারবাইজান নাগর্নো–কারাবাখ ও সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের অংশবিশেষও পুনরুদ্ধার করতে পারে, তাহলে সরকারের জনপ্রিয়তা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে এবং এটি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভের জন্য একটি ইতিবাচক অর্জন হিসেবে বিবেচিত হবে। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে বেলারুশের রাষ্ট্রপতি আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কো তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলনের সম্মুখীন হয়েছেন এবং ইতোপূর্বে বেশ কিছু প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রের একনায়ক ধাঁচের শাসকদের পতন ঘটেছে। আলিয়েভ এই পরিস্থিতি এড়াতে চান এবং এজন্য নাগর্নো–কারাবাখের অন্তত কিছু অংশ পুনরুদ্ধার করতে চান।

চতুর্থত, আজারবাইজান সম্প্রতি সামরিক দিক থেকে আর্মেনিয়ার চেয়ে গুণগত ও প্রযুক্তিগতভাবে এগিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু তাদের এই সুবিধা কত দিন বহাল থাকবে সেই বিষয়টি নিশ্চিত নয়। সুতরাং আজারবাইজানি সামরিক কৌশলবিদদের মতে, আর্মেনিয়া এই প্রযুক্তিগত ব্যবধান দূর করে ফেলার আগেই আজারবাইজানের আঘাত হানা উচিত।

আজারবাইজানি ড্রোন কর্তৃক আর্মেনীয় আর্টিলারি ব্যাটারির ওপর আক্রমণের দৃশ্য; Source: Times of Israel

পঞ্চমত, ২০১৬ সালের এপ্রিলে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে ৪ দিনব্যাপী একটি সংক্ষিপ্ত যুদ্ধ হয়, এবং এই যুদ্ধে উভয় পক্ষই নিজেকে বিজয়ী বলে দাবি করলেও কার্যত আজারবাইজান ৮ থেকে ২০ বর্গ কি.মি. ভূমি পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়, যদিও আর্মেনীয়দের মতে, আজারবাইজানিদের দখলকৃত ভূমির কৌশলগত গুরুত্ব সামান্য। কিন্তু এই সংঘর্ষটি আজারবাইজানিদের নিজেদের শক্তি সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছে এবং আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের বিরুদ্ধে বড় ধরনের একটি আক্রমণ পরিচালনা করতে উৎসাহিত করেছে।

ষষ্ঠত, ২০২০ সালের মে মাসে আর্তসাখে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আরায়িক হারুতিউনিয়ান প্রজাতন্ত্রটির রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন এবং তিনি আর্তসাখের আইনসভার কেন্দ্র রাজধানী স্তেপানাকার্ত থেকে শুশা শহরে স্থানান্তরিত করেছেন। আর্তসাখকে যেহেতু আজারবাইজান নিজস্ব ভূমির অংশ হিসেবে মনে করে, সেহেতু আজারবাইজানি সরকারের কর্তৃত্বের বাইরে তাদের ‘নিজস্ব ভূমি’তে নির্বাচন অনুষ্ঠানকে বাকু অবমাননাকর হিসেবে বিবেচনা করে। তদুপরি, শুশা কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সেখানে আইনসভা স্থানান্তরের মাধ্যমে শহরটির ওপর আর্মেনীয় কর্তৃত্ব সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টাকে বাকু একটি ‘উস্কানি’ হিসেবেই বিবেচনা করেছে

এছাড়া, আর্মেনিয়ার বর্তমান নিকোল পাশিনিয়ান ক্ষমতা লাভের পর থেকে আর্মেনিয়ার ‘কারাবাখ গোত্রে’র (নাগর্নো–কারাবাখ থেকে আসা আর্মেনীয় রাজনীতিবিদ শ্রেণী) বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন এবং এর ফলে ইয়েরেভান ও স্তেপানাকার্তের মধ্যে প্রচ্ছন্ন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। বাকু এই বিষয়টিকেও কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে, যদিও আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের মধ্যে বড় ধরনের কোনো দ্বন্দ্ব ঘটানো যে সম্ভব নয়, এই ব্যাপারে আজারবাইজান অবগত।

আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভ এবং আর্মেনীয় প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান; Source: Asbarez.com

সপ্তমত, আর্মেনিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনিয়ান ২০১৮ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের (‘রঙিন বিপ্লব’) মাধ্যমে তদানীন্তন আর্মেনীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন। আর্মেনিয়া রাশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, কিন্তু রাশিয়ার বর্তমান নেতৃবৃন্দ প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে ‘রঙিন বিপ্লবে’র বিরুদ্ধে এবং এজন্য পাশিনিয়ানের ক্ষমতায় আরোহণের পর মস্কো ও ইয়েরেভানের মধ্যে সম্পর্ক কিছুটা শীতলতা দেখা দিয়েছে। এজন্য বাকুর নীতিনির্ধারকদের ধারণা, আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে এখন কোনো অভিযান পরিচালনা করলে মস্কো আর্মেনিয়াকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করবে না

অষ্টমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে তেমন সক্রিয় নয় এবং কোভিড–১৯ মহামারী, আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে মগ্ন। অনুরূপভাবে, ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোও কোভিড–১৯ মহামারীসহ অন্যান্য সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত। তাদের কার্যত অনুপস্থিতি বাকুকে একটি আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহিত করেছে। তদুপরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর্মেনীয় লবির প্রভাব হ্রাস করার জন্য আজারবাইজান মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগ করেছে এবং মার্কিন ইহুদি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলেছে, যার ফলে যুক্তরাষ্ট্রে একটি অত্যন্ত শক্তিশালী আজারবাইজানি লবির সৃষ্টি হয়েছে।

সর্বোপরি, আর্মেনিয়ার সঙ্গে বিরোধের ক্ষেত্রে আজারবাইজান একটি রাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন অর্জন করেছে, এবং সেটি হলো তুরস্ক। তুরস্কের নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, তুর্কি ও আজারবাইজানিদের মধ্যেকার জাতিগত ও সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য এবং আর্মেনীয়দের প্রতি তুর্কিদের ঐতিহাসিক শত্রুভাবাপন্নতার কারণে আঙ্কারা এই যুদ্ধে আজারবাইজানকে পরিপূর্ণ সমর্থন প্রদান করেছে। অন্যদিকে, আর্মেনিয়াকে অনুরূপ কোনো শক্তি প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়নি। বহু বিশ্লেষকের ধারণা, তুরস্কই এই যুদ্ধ শুরু করার জন্য আজারবাইজানকে প্ররোচিত করেছে।

২০২০ সালের জুলাইয়ে আজারবাইজানের মাটিতে আজারবাইজানি ও তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর যৌথ মহড়া অনুষ্ঠিত হয়; Source: Middle East Observer

যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই তুরস্ক আজারবাইজানকে ব্যাপক সামরিক, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন প্রদান করেছে। আজারবাইজানিদের ব্যবহৃত তুর্কি–নির্মিত ড্রোন এই যুদ্ধে আর্মেনীয়দের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছে, এবং ধারণা করা হচ্ছে, এই ড্রোনগুলো চালনার ক্ষেত্রে তুর্কি অপারেটররা আজারবাইজানি অপারেটরদের সহায়তা করছে। এছাড়া, প্রায় ১৫০ তুর্কি সামরিক বিশেষজ্ঞ আজারবাইজানি সামরিক অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে সহায়তা করছে এবং তুর্কি বিমানবাহিনী সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে বলেও আর্মেনিয়া অভিযোগ করেছে। তদুপরি, তুরস্ক সিরিয়া থেকে শত শত ‘মার্সেনারি’কে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ করেছে

এ পর্যন্ত আজারবাইজানি সৈন্যরা ১৪টি বসতি অধিকার করেছে বলে বাকু দাবি করেছে, এবং এর মধ্যে কিছু অঞ্চল আর্মেনীয় ও আর্তসাখ সৈন্যরা পুনরুদ্ধার করেছে বলে ইয়েরেভান পাল্টা দাবি করেছে। প্রাথমিকভাবে নাগর্নো–কারাবাখের বাইরে ফুজুলি ও জেব্রাইল জেলা দুইটি অধিকার করা আজারবাইজানিদের উদ্দেশ্য ছিল বলে সামরিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, কারণ এই অঞ্চল দুইটি পার্বত্য নয় এবং সেজন্য এখানকার প্রতিরক্ষা তুলনামূলকভাবে দুর্বল। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই কিছু কিছু বিশ্লেষক আজারবাইজানের বড় ধরনের কোনো বিজয় অর্জনের ক্ষেত্রে আশাবাদী নন।

বিশ্লেষকদের মতে, আক্রমণের জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও আজারবাইজানি সৈন্যদের অগ্রগতি তুলনামূলকভাবে ধীরগতিসম্পন্ন, এবং অপ্রস্তুত আর্মেনীয়দের বিরুদ্ধে একটি ‘বিদ্যুৎগতির যুদ্ধ’ (ব্লিৎসক্রিগ) পরিচালনা করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তাছাড়া, আজারবাইজানি সৈন্যদের প্রচুর অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র থাকলেও তারা সেগুলোর পরিপূর্ণ ব্যবহার করতে পারেনি। আজারবাইজানের সেনাবাহিনী মূলত কনস্ক্রিপশনের ওপর নির্ভরশীল, অর্থাৎ প্রতিটি সক্ষম আজারবাইজানি যুবকের জন্য সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন বাধ্যতামূলক। কিন্তু আজারবাইজানি সেনাবাহিনীতে দলত্যাগের হার প্রায় ২০%, অর্থাৎ প্রতি ১০০ জন আজারবাইজানি যুবকের মধ্যে ২০ জনই এই দায়িত্ব এড়িয়ে যায়। তাছাড়া, নাগর্নো–কারাবাখ একটি পার্বত্য অঞ্চল এবং সেখানে আক্রমণ পরিচালনা করা আজারবাইজানিদের পক্ষে সহজ হবে না, এবং যুদ্ধ প্রলম্বিত হলে আসন্ন শীতকাল যুদ্ধরত সৈন্যদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।

সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় একটি আর্মেনীয় আর্টিলারি ব্যাটারি; Source: Armenian Ministry of Defense/Eurasia Daily Monitor

কিন্তু সামগ্রিকভাবে, আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের জন্য এই যুদ্ধ ভালো কিছু নিয়ে আসবে না। আর্মেনীয়রাও নাগর্নো–কারাবাখকে নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত হিসেবে বিবেচনা করে এবং আর্মেনীয়দের মধ্যেও এখন জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা প্রবল। ঐতিহাসিক কারণে আর্মেনীয়দের মধ্যে আজারবাইজানি ও তুর্কিদের প্রতি তীব্র বিদ্বেষ রয়েছে। আর্মেনীয়দের ধারণা, তুর্কিরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে ইচ্ছুক, এবং এক্ষেত্রে আজারবাইজানিরা তুর্কিদের দ্বারা চালিত ‘পুতুল’ হিসেবে কাজ করছে। আর্মেনিয়ার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী পাশিনিয়ান নিজস্ব রাজনৈতিক অবস্থানকে শক্ত করার জন্য জনসাধারণের জাতীয়তাবাদী মনোভাবকে ব্যবহার করেছেন এবং স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন, “কারাবাখই আর্মেনিয়া!

যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে আজারবাইজানিরা যে সাফল্য অর্জন করেছে, এর জন্য দায়ী আর্মেনিয়ার সামরিক ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা।

প্রথমত, আর্মেনিয়া আজারবাইজানের মতো জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ নয়, এবং আর্মেনিয়ার সামরিক বাজেট আজারবাইজানের সামরিক বাজেটের ছয় ভাগের এক ভাগ মাত্র। ফলে আর্মেনিয়ার পক্ষে আজারবাইজানের সঙ্গে অস্ত্র ক্রয়ের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়া সম্ভব নয়।

দ্বিতীয়ত, আর্মেনীয় সশস্ত্রবাহিনীর নিকট তুলনামূলকভাবে প্রচুর ভারী অস্ত্রশস্ত্র (ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি, আর্মার্ড পার্সোনেল ক্যারিয়ার, মাল্টিপল রকেট লঞ্চার, ট্যাকটিকাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান–বিধ্বংসী অস্ত্র প্রভৃতি) রয়েছে, কিন্তু এগুলোর সিংহভাগই সোভিয়েত আমলের, যেগুলো হয় আর্মেনীয়রা আর্মেনিয়ার ভূমিতে অবস্থিত সোভিয়েত সশস্ত্রবাহিনীর ইউনিটগুলোর কাছ থেকে ‘উত্তরাধিকার’ সূত্রে পেয়েছিল, নয়তো ১৯৮৮–৯৪ সালের যুদ্ধের সময় আজারবাইজানের কাছ থেকে দখল করে নিয়েছিল। আর্মেনিয়ার পক্ষে আজারবাইজানের মতো বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক অস্ত্র ক্রয় করা সম্ভব হয়নি।

সম্প্রতি রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘কাভকাজ–২০২০’ সামরিক মহড়ায় একটি আর্মেনীয় ট্যাঙ্ক; Source: Vagram Bagdasaryan/TASS via PA Images

তদুপরি, আর্মেনিয়া একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র এবং ইরান বাদে অন্য কোনো প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গেই তাদের সম্পর্ক ভালো নয়, ফলে আর্মেনিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করাও একটি কঠিন কাজ। অবশ্য সাম্প্রতিক সময়ে আর্মেনীয়রা রাশিয়ার কাছ থেকে ‘ইস্কান্দার’ ব্যালিস্টিক ক্ষেপনাস্ত্র, ‘টি–৯০’ ট্যাঙ্ক ও ‘সু–৩০’ জঙ্গিবিমান প্রভৃতি ভারী অস্ত্র ক্রয় করেছে, কিন্তু সেগুলো আজারবাইজানকে প্রতিহত করার জন্য পর্যাপ্ত নয়।

তৃতীয়ত, বিশ্বাসঘাতকতা আর্মেনিয়ার বর্তমান পরিস্থিতিতে একটি ভূমিকা রেখেছে। ২০২০ সালের ১ অক্টোবর আর্মেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘এনএসএস’ আর্মেনীয় সেনাবাহিনীর একজন প্রাক্তন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে, যে বিপুল অর্থের বিনিময়ে আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের সামরিক বাহিনী সংক্রান্ত প্রচুর তথ্য আজারবাইজানি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে পাচার করেছিল। এই বিশ্বাসঘাতকতা বিশেষত আর্তসাখের প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থাকে ভেদ করে আজারবাইজানের জন্য অনেকাংশে সহজ করে দিয়েছে।

সর্বোপরি, ১৯৮৮–৯৪ সালের যুদ্ধে পরিপূর্ণ বিজয়ের ফলে আর্মেনীয়দের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল, এবং আজারবাইজানিদের সামরিক সক্ষমতা সম্পর্কে তাদের মধ্যে নিচু ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস তাদেরকে অসতর্ক করে তুলেছিল, যেজন্য তারা আজারবাইজানের পক্ষ থেকে বড় মাত্রার কোনো আক্রমণ আশা করেনি।

২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর মার্কিন আর্মেনীয়রা যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে অবস্থিত আজারবাইজানি কনস্যুলেটের সামনে বিক্ষোভ করছে; Source; Mike Blake/Reuters

এর ফলে আর্মেনিয়া এখন তুলনামূলকভাবে আজারবাইজানের চেয়ে দুর্বল অবস্থানে রয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ফলাফল যা-ই হোক না কেন, আর্মেনিয়ার জন্য আগেরবারের মতো পরিপূর্ণ বিজয় অর্জন সম্ভব হবে না। যদি যুদ্ধ প্রলম্বিত হয়, সেক্ষেত্রেও আর্মেনিয়ার জন্য পরিস্থিতি হতাশাব্যঞ্জক, কারণ আজারবাইজান তার অঢেল তেল-সম্পদের কল্যাণে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের খরচ যোগাতে পারলেও ক্ষুদ্র অর্থনীতির আর্মেনিয়ার পক্ষে সেটি কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এছাড়া, যুদ্ধক্ষেত্রে আর্মেনিয়ার চেয়ে আজারবাইজানের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেশি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আর্মেনিয়ার চেয়ে তিন গুণেরও বেশি জনসংখ্যাবিশিষ্ট ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ আজারবাইজানের পক্ষে যে হারে হারানো সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জাম প্রতিস্থাপন করা সম্ভব, আর্মেনিয়ার পক্ষে সেটি সম্ভব নয়। 

আর্মেনিয়ার জন্য আরো বড় সীমাবদ্ধতা হয়ে দাঁড়িয়েছে কার্যকরী বিদেশি সমর্থনের অভাব। কোনো রাষ্ট্রই খোলাখুলিভাবে আর্মেনিয়াকে সমর্থন প্রদান করেনি। আর্মেনিয়া রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’–এর সদস্য, কিন্তু এখন পর্যন্ত রুশরা আর্মেনিয়াকে কার্যকরী কোনো সহায়তা প্রদান করেনি (যদিও রাশিয়া আর্মেনিয়াকে কিছু অস্ত্র সরবরাহ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে), এবং তুরস্ক বা অন্য কোনো শক্তি আজারবাইজানের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আগপর্যন্ত মস্কো যুদ্ধক্ষেত্রে অংশ নেবে না, এটি প্রায় নিশ্চিত। তদুপরি, ‘সিএসটিও’র পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র সার্বিয়া আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়ের কাছেই অস্ত্র বিক্রি করছে, এবং আরেক পর্যবেক্ষক আফগানিস্তান আজারবাইজানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। ফলে এখন পর্যন্ত এই যুদ্ধে আর্মেনিয়া কার্যত একাকী, অন্যদিকে আজারবাইজানে তুরস্কের ব্যাপক সহায়তা লাভ করছে।

কিন্তু নাগর্নো–কারাবাখে বড় ধরনের কোনো ছাড় দেয়া আর্মেনীয় সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। যদি আর্মেনীয়রা যুদ্ধক্ষেত্রে বড় ধরনের কোনো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, কিংবা যদি বড় ধরনের কোনো ছাড় দিতে বাধ্য হয়, সেক্ষেত্রে আর্মেনিয়ার বর্তমান সরকারের পতনের সম্ভাবনা প্রবল। সুতরাং নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থেই পাশিনিয়ান এই যুদ্ধে হার স্বীকার করতে চাইবেন না। তাছাড়া, ১৯৯০–এর দশকে আর্মেনিয়ার পক্ষে আজারবাইজানকে যতটা ছাড় দেয়া সম্ভব ছিল, এখন আর সেটি সম্ভব নয়। ১৯৯০ এবং ২০০০–এর দশকে আর্মেনিয়া একটি স্থায়ী সমঝোতার বিনিময়ে নাগর্নো–কারাবাখের আশেপাশের আজারবাইজানি অঞ্চল আজারবাইজানকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিল, এবং এই উদ্দেশ্য ঐ অঞ্চলে বসতি স্থাপন থেকে বিরত ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে ভূমি সঙ্কট ও অন্যান্য কারণে এই অঞ্চলগুলোতে আর্মেনীয়রা কিছু কিছু বসতি স্থাপন করেছে, এবং এখন বহু আর্মেনীয় এগুলোকে নিজস্ব ভূমি হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে ইয়েরেভান ও স্তেপানাকার্তের পক্ষে এক্ষেত্রেও ছাড় দেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

২০১৩ সালে তুরস্কবিরোধী একটি বিক্ষোভের সময় আর্মেনীয়রা তুর্কি পতাকায় অগ্নিসংযোগ করছে; Source: Wikimedia Commons

এছাড়া, তুরস্ক কর্তৃক যুদ্ধক্ষেত্রে সিরীয় মার্সেনারি প্রেরণ আর্মেনীয়দের জন্য একটি সদ্যসৃষ্ট ক্ষতে নতুন আঘাত হেনেছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তুর্কি–সমর্থিত সুন্নি আরব মিলিট্যান্টদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে সিরিয়ায় বসবাসকারী প্রায় ২৫,০০০ জাতিগত আর্মেনীয় উদ্বাস্তু হয়ে আর্মেনিয়ায় আশ্রয় নিয়েছে। সেই সুন্নি আরব মিলিট্যান্টদেরকেই এখন আঙ্কারা ‘মার্সেনারি’ হিসেবে আজারবাইজানের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য প্রেরণ করছে। এজন্য আর্মেনীয়দের অনেকেই এটিকে তাদেরকে ধ্বংস করার জন্য ‘তুর্কিদের নতুন একটি ষড়যন্ত্র’ হিসেবে বিবেচনা করছে, যেটি আর্মেনীয়দের মনোভাবকে কঠোর করে তুলছে।

সামগ্রিকভাবে, আর্মেনীয়–আজারবাইজানি যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি একটি অনিশ্চিত দিকে মোড় নিচ্ছে। আজারবাইজান ক্রমাগত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে যাচ্ছে, অন্যদিকে আর্মেনিয়া যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করেছে এবং বিরোধপূর্ণ অঞ্চলে শান্তিরক্ষী মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে, যেটিকে ইয়েরেভানের দুর্বলতার নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু নাগর্নো–কারাবাখ আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়েরই ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু, সুতরাং রাষ্ট্র দুটি এই ব্যাপারে একে অপরকে সহজে ছাড় দিতে চাইবে না।

This is a Bengali article about the Azerbaijani and Armenian geopolitics related to the 2020 Nagorno–Karabakh War. Necessary sources are hyperlinked within the article.

Source of the featured image: Suggest the Best

Related Articles