Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

করোনাভাইরাসের আগ্রাসন ও নিও-লিবারেলিজম: ব্যর্থতা, শুধুই ব্যর্থতা

সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের হাত ধরে যে নিও-লিবারেলিজম বা নব্য-উদারনীতিবাদের গোড়াপত্তন হয়েছিল, সেটির জয়জয়কার দেখেছে পুরো বিশ্ব। বর্তমানে বিশ্বের সব পুঁজিবাদী দেশের অর্থনীতি পরিচালিত হয় নিও-লিবারেলিজমের বহুল আলোচিত নীতিগুলোর আলোকে। অর্থনীতি ও রাজনীতি যেহেতু একে অপরকে সবসময় প্রভাবিত করে চলে, তাই রাজনীতির ক্ষেত্রেও এখন নিও-লিবারেলিজমের বিশাল ছায়া এড়িয়ে বিচ্ছিন্ন থাকার উপায় নেই। তাই গত সিকি শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে ‘একচ্ছত্র অধিপতি’ হিসেবে নিও-লিবারেলিজম বা নব্য উদারনীতিবাদকে আখ্যায়িত করা হলে কম বলা হবে না।

করোনাভাইরাসের প্রকোপে পুরো বিশ্বই বলা চলে কার্যত লকডাউনে চলে গিয়েছে। অথচ এ বছরের শুরুর দিকেও কল্পনা করা যায়নি যে, পুরো পৃথিবী এক ভাইরাসের কবলে পড়ে কার্যত অচল হয়ে পড়বে। করোনাভাইরাস স্বাস্থ্যখাতের সাথে সম্পৃক্ত ইস্যু হলেও ক্রমান্বয়ে অর্থনীতি ও রাজনীতিকে যেভাবে থমকে দিয়েছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, নিও-লিবারেলিজম বা নব্য উদারনীতিবাদ কি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ? বিশ্লেষকেরা নানা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে করোনাভাইরাসের মতো বিপর্যয় মোকাবেলায় নিও-লিবারেলিজমের ভূমিকা পর্যালোচনা করছেন।

নিও-লিবারেলিজম নিয়ে একটু জানাশোনা থাকলে করোনায় সেটির ব্যর্থতা-সফলতার হিসেব কষতে সুবিধা হবে। নিও-লিবারেলিজম একটি অর্থনৈতিক নীতি হিসেবে যাত্রা শুরু করে গত শতাব্দীর আশির দশকে, আমেরিকা-ব্রিটেনের যৌথ প্রচেষ্টায়। এর ভিত্তি হিসেবে ধরা হয় লেইসেজ-ফেয়ার নীতিকে, যেখানে সমাজ ও ব্যক্তির অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ একেবারে কমিয়ে আনার কথা বলা হয়। এই অর্থনৈতিক পদ্ধতিতে বাজার সম্পূর্ণ পুঁজিপতিদের হাতে ছেড়ে দিতে হয়, যেখানে রাষ্ট্র একেবারে গৌণ হয়ে পড়ে। যত রাষ্ট্রায়ত্ব খাত আছে, সবগুলো ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেয়ার নীতির কথাও বলা হয়েছে এই নীতিতে।

সনসননসগসসগগসব
যাদের হাত ধরে নিও-লিবারেলিজমের যাত্রা শুরু; image source: prospect.org

বিশ্বায়নের পরিপ্রেক্ষিতে নিও-লিবারেলিজম যে নীতিগুলো রয়েছে, সেগুলোর আন্তর্জাতিকীকরণ ঘটেছে– এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। পুঁজি, পণ্য ও বাজারের ক্ষেত্রে এখন সীমানা কোনো বাধা নয়। আর্থিক বিবেচনায় এক দেশ আরেক দেশ থেকে অনায়াসে শ্রম কিংবা সেবা কিনতে পারে অর্থের বিনিময়ে। নিজ দেশের বাজারে আজ শুধু নিজেদের পণ্য থাকে না, সব দেশের পণ্য পাওয়া যায়।

করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর সব নিও-লিবারেল অর্থনীতির ধারক দেশগুলো বিশাল সংকটের মুখে। যেসব দেশের সরকার স্বাস্থ্যখাতকে পুরোপুরি ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দিয়েছিল, সেসব দেশই সবচেয়ে ভোগান্তিতে রয়েছে এই মুহুর্তে। পুঁজিপতিদের হাতে ছেড়ে দেয়ার ফলে কোনো দেশই করোনাভাইরাস মোকাবেলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয়ভাবে ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারেনি। যার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সেসব দেশের জনগণকে। ইউরোপের যেসব উন্নত দেশ, যেমন- ইংল্যান্ড, ফ্রান্স কিংবা বিশ্ব গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদের অভিভাবক আমেরিকায় করোনা সংক্রমণে ব্যাপকহারে মৃত্যু নিও-লিবারেল অর্থনীতির ব্যর্থতকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

নিও-লিবারেলিজমের নীতির কারণে প্রতি বছরই দেশগুলো তাদের স্বাস্থ্যখাতের জন্য বাজেটে যে বরাদ্দ থাকে তা কমিয়ে এনেছে, বিনিময়ে সামরিক খাতের দিকে বেশি টাকা ঢেলেছে। করোনাভাইরাসের এই সময়ে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা পঞ্চম প্রজন্মের ভয়াবহ দ্রুতগতির ফাইটার প্লেন কোনো কাজে আসছে না। এগুলো দিয়ে করোনা ঠেকানো গেলে হয়তো আমেরিকা কিংবা যেসব দেশের অত্যাধুনিক মারণাস্ত্রের সম্ভার রয়েছে সেসব দেশে করোনা ঢুকতেই পারতো না, উন্নয়নশীল দেশগুলোতেই শুধু তান্ডব চালাতে পারতো। কিন্তু সংক্রামক ভাইরাস তো মারণাস্ত্র দিয়ে ঠেকানোর বিষয় নয়। প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও পর্যাপ্ত মেডিক্যাল সুবিধার নিশ্চিতের মাধ্যমে ঠেকানো যেতে পারে।

য়নসনয়নসন
অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র যেগুলোর পেছনে জনগণের প্রচুর টাকা টাকা ঢালা হয়েছে, সেগুলো এই করোনার সময়ে কোনো কাজে আসবে না; image source: militaryserospace.com

করোনাভাইরাস কর্তৃত্ববাদী উগ্র-ডানপন্থী নিও-লিবারেল অর্থনীতি গ্রহণকারী শাসকদের ব্লেম-গেম খেলার সুবিধা করে দিয়েছে। চীনের উহান শহর থেকে যখন করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলো এবং ধীরে ধীরে ইউরোপ-আমেরিকায়ও থাবা প্রসারিত করা শুরু করলো, তখন ট্রাম্প ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা নিজেদের স্বাস্থ্যখাতের রুগ্নদশার চিত্র থেকে জনগণের মনোযোগ সরিয়ে নিতে চীনকে দোষারোপ শুরু করেছিলেন। এমনকি করোনাভাইরাসকে ‘উহান ভাইরাস’ ও ‘চীনা ভাইরাস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন তারা, যেটা স্পষ্ট বর্ণবাদী আচরণ। জাতীয়তাবাদী প্রোপাগান্ডায় যখন আর শেষ রক্ষা হয়নি, তখন কর্তৃত্ববাদীরা পূর্বের সরকারের উপর দায় চাপানোর আশ্রয় নিয়েছেন। মূল অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতেই যে বড় গলদ রয়েছে, এদিকে কেউই দৃষ্টি দেননি। অবশ্য পুঁজিপতিরা যখন প্রশাসনেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন, তখন সেদিকে পরিকল্পিতভাবেই দৃষ্টি দেয়া হবে না।

শমনসনসব
পরিকল্পিত স্বাস্থ্যনীতি, সতর্কতা ও চিকিৎসা সামগ্রীর পর্যাপ্ততায় করোনাকে সফলভাবে রুখে দিয়েছে ভারতের কেরালা রাজ্য;
image source: technologyreview.com

নিও-লিবারেল অর্থনীতির অনেক দেশের ব্যক্তি মালিকানায় পরিচালিত অসংখ্য প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধের জন্য আরোপিত লক-ডাউনের ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এসব কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে কোনো আগাম নির্দেশনা ছাড়াই। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন অনিশ্চিয়তার মুখে পড়েছে। প্রাথমিক চাহিদাগুলো মেটাতে প্রতিনিয়ত হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। স্বাস্থ্যখাতের সাথে জড়িত হাজার হাজার কর্মীদের অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে ন্যূনতম পিপিই দেয়া হয়নি, অথচ কাজে উপস্থিত থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। নিও-লিবারেল অর্থনীতির রাষ্ট্র যেহেতু পুঁজিপতিদের হাতের পুতুল, তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছুই করা যায়নি।

এবার একটু ভিন্ন দিকে যাওয়া যাক। চীনের মতো এত বড় একটি দেশ যেখানে করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি সেখানেও মৃত্যুর সংখ্যা খুব বেশি হয়নি, যেমনটা কম জনসংখ্যার ইউরোপের ক্ষেত্রে অনেক বেশি হয়েছে। এর কারণ, ভাইরাসের সংক্রমণের খবর পাওয়ার সাথে সাথে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। ফলাফল– করোনা আগ্রাসন রুখে দিতে সফল হওয়া এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় আনতে সক্ষম হওয়া।

কিউবার রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্যখাতের সফলতার কথা আমাদের সবারই জানা। কিউবার স্বাস্থ্যসেবা বিশ্বমানের। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ ডাক্তার বের হয় কিউবা থেকে, যাদেরকে জনশক্তি হিসেবে বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। করোনার এই সময়েও তারা তাদের চিকিৎসকদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছে সেবা দেয়ার জন্য। ভিয়েতনামের কথাও বলা যায়। সমাজতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ভিয়েতনাম করোনা সংক্রমণ সফলভাবে রুখে দেয়া অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি। আমাদের পাশের দেশ ভারতের কেরালার রাজ্য যেখানে বামপন্থীরা ক্ষমতায় আসীন, তারা বিশ্বের কাছে করোনা ভাইরাস রুখে দেয়ার জন্য রোল মডেল।

সহহসমনসন
নিও-লিবারেলিজম মানেই করোনার আগ্রাসন ঠেকাতে ব্যর্থতার গল্প; Image Courtesy: Youtube

এতদিন ধরে নিও-লিবারেল অর্থনীতির ভগ্ন রূপটি কেউই দেখতে পায়নি। করোনাভাইরাস এসে সেই রূপ আমাদের সামানে উন্মোচিত করে দিয়েছে। ধনীরা আরও ধনী হয়, গরীবরা আরও গরীব হয়– পুঁজিবাদী অর্থনীতির এই চিরন্তন সত্য কথাটি নিও-লিবারেলিজমের ক্ষেত্রে আরও বেশি সত্য, আরও বেশি বাস্তব। করোনাভাইরাসে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষেরা। কিন্তু নিও-লিবারেল অর্থনীতিতে এই মানুষদের রক্ষা করার কোনো চেষ্টা দেখা যায় না। করোনার আগ্রাসন মোকাবেলায় নিও-লিবারেলিজমের সকল চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে, এ কথাটি বললে বোধহয় অতিশয়োক্তি হবে না।

Related Articles