Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সংবান: উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের ‘জাত প্রথা’

উত্তর কোরিয়া একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। ‘সমাজতান্ত্রিক’ শব্দটি দেখে অনেকে মনে করতে পারেন দেশটিতে কোনো সামাজিক শ্রেণিভেদ নেই। কিন্তু এরকম ধারণা করলে সেটা হবে ভুল। দেশটিতে পুঁজিবাদী দেশগুলোর মতোই ধনী-দরিদ্র শ্রেণি বিভাজন বিদ্যমান আছে। আর দেশের মানুষের সামাজিক শ্রেণি ভাগ করে দিয়েছে স্বয়ং দেশটির সরকার।

১৮৯৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্যাবো সংস্কারের মাধ্যমে কোরিয়ার পুরনো শ্রেণি বিভাজনের নীতি বিলুপ্ত করা হয়। এর আগের কয়েকশত বছর কোরিয়া উপদ্বীপে একটা সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ছিল, যেখানে শক্তিশালী শ্রেণি বিভাজন বিদ্যমান ছিল। জাপানি উপনিবেশ আমল (১৯১০-৪৫), ১৯৫০-৫৩ সালের কোরীয় যুদ্ধ এবং প্রেসিডেন্ট কিম ইল সাংয়ের ভূমি সংস্কার আইনের মাধ্যমে পুরানো সমাজ ব্যবস্থা পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিম ইল সাং তখন নতুন সামাজিক শ্রেণি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইলেন, যেটা মূলত তার সরকারের প্রতি জনগণের আনুগত্যের ভিত্তিতে করা হবে।

কিম ইল সাং উত্তর কোরিয়ার সংবান প্রথার সূচনা করেন; Image Source: Sygma via Getty Images / Getty Images

উত্তর কোরিয়ার একমাত্র রাজনৈতিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির পলিটব্যুরো, ১৯৫৭ সালের ৩০ মে দেশটির সমাজ ব্যবস্থাকে তিনটি শ্রেণিতে বিভাজিত করার সিদ্ধান্ত নেয়- বিশ্বস্ত শ্রেণি, নিরপেক্ষে শ্রেণি, ও শত্রু শ্রেণি। বিশ্বস্ত শ্রেণিতে রাখা হয় যারা কিম ইল সাংয়ের হয়ে জাপানি উপনিবেশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়েছিলেন, অথবা সেনাবাহিনীর যারা কিম ইল সাংয়ের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছিলেন তাদেরকে। এছাড়া সমাজতান্ত্রিক বুদ্ধিজীবী ও বিপ্লবীদেরও রাখা হয়ে এই শ্রেণিতে। সর্বশেষ যারা কোরীয় যুদ্ধে উত্তর কোরিয়ার হয়ে লড়েছিলেন, তাদেরকেও বিশ্বস্ত শ্রেণিতে রাখা হয়। শত্রু শ্রেণিতে রাখা হয় জমিদার ও পুঁজিবাদীদের; দক্ষিণ কোরিয়ায় যাদের আত্মীয়রা অবস্থান করছিল কিংবা যাদের সাথে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রভাবশালী সম্পর্ক ছিল; খ্রিস্টান ও শামান সম্প্রদায়ের মতো ধর্মীয় গোষ্ঠীদের; এবং জাপানি উপনিবেশ শাসকদের সাথে যাদের আঁতাত ছিল তাদের। এই দুই শ্রেণির মাঝামাঝি অবস্থান করা লোকদের রাখা হয় নিরপেক্ষ শ্রেণিতে। প্রত্যেক উত্তর কোরীয় পুরুষ নাগরিকের সামরিক কার্যক্রম নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী তদন্ত হয় তখন। নাগরিকদের উপনিবেশ যুগের কার্যক্রম এবং সামন্ততান্ত্রিক ভাবধারায় কেউ তখনও আবিষ্ট ছিল কিনা তা-ও খতিয়ে দেখা হয়।

উত্তর কোরিয়ার সংবান  ধারণার ভিত্তিপ্রস্তর মূলত এই প্রক্রিয়াতেই রচিত হয়, যা দেশটিতে আজও বিদ্যমান। একে উত্তর কোরিয়ার ‘জাত প্রথা’ও বলা হয়। দেশটির নাগরিকদের জীবনযাত্রার মানের ওপর একটা বড় প্রভাব রাখে এই সংবান ব্যবস্থা। উত্তর কোরীয় নাগরিকদের ২৮ শতাংশ বিশ্বস্ত শ্রেণিতে, ৪৫ শতাংশ নিরপেক্ষ শ্রেণিতে, এবং ২৭ শতাংশ শত্রু শ্রেণিতে অবস্থান করে। নিম্ন শ্রেণি থেকে উচ্চ শ্রেণিতে ওঠা খুব কঠিন। সে তুলনায় উচ্চ শ্রেণি থেকে নিম্নস্তরে নেমে যাওয়া সহজ। কোনো ব্যক্তির সামান্য রাজনৈতিক ভুলের মাসুল গুনতে হতে পারে পুরো পরিবারকে। তার পুরো পরিবারকেই শত্রু শ্রেণিতে নামিয়ে দেওয়া হতে পারে। শত্রু শ্রেণির লোকদের নিম্নস্তরের মানুষ হিসাবে বিবেচনা করা হয় সেখানে।

উত্তর কোরিয়ার নাগরিকরা তিন ধরনের সংবান শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকেন; Image Source: Kyodo

সংবান বর্তমানে উত্তর কোরিয়ার পুরো সমাজ ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও, এর মানে এই নয় যে সেখানকার নাগরিকরা তা প্রতিদিনই এর চর্চা করে। সরকার কাউকে সরাসরি বলে না, “আপনি শত্রু শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, তাই আপনাকে ভালো চাকরি দিতে পারব না।” এমনকি, অনেক লোক তাদের আনুষ্ঠানিক সংবান সম্পর্কে অবগতই নয়। কোরীয় সমাজ ব্যবস্থা সবসময় যেভাবে বিরাজ করে এসেছে, তাতে একজনের বংশপরিচয়ের ভিত্তিতে অন্যদের চেয়ে আলাদাভাবে তোয়াজ করে চলার বিষয়টা স্বাভাবিক হিসাবেই দেখা হয়। যদিও তার মানে এই নয় যে, এরকম চর্চা সাধারণ মানুষ পছন্দ করে।

সাধারণভাবে দেখলে সংবান এক সুসংগঠিত ব্যবস্থা। নাগরিকদের সকল তথ্য সরকারি নথিতে লিপিবদ্ধ থাকে। যখনই কোনো নাগরিক পদোন্নতি বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করে, কিংবা গ্রেপ্তারকৃত হয়, তখন সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা নাগরিকদের সংবানের অবস্থান পরীক্ষা করে দেখে পরবর্তী করণীয় ঠিক করে থাকেন।

বর্তমান সময়ে উত্তর কোরিয়ায় বলতে গেলে ঘুষের মাধ্যমে সবই কেনা যায়। এর মাঝে বিরল ব্যতিক্রম হলো উচ্চ সংবানের অবস্থান কিনে নেওয়া। সংবানের অবস্থান ঠিক করে দেওয়ার জন্য খুবই পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত হয়। এর জন্য কয়েক স্তরের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা অতিক্রম করে আসতে হয়। স্থানীয় পুলিশ প্রধান, আবাসিক নিবন্ধন কর্মকর্তা, এবং জননিরাপত্তা মন্ত্রলায়ের বিভাগীয় প্রধান, সকলের একমত হতে হয় কোনো নাগরিককে একটা শ্রেণিতে স্থান দেওয়ার জন্য। যত উপরের স্তরের কর্মকর্তাদের সংশ্লিষ্ট হতে হয়, তত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিভাগও জড়িত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কোনো নাগরিক নিম্ন সংবান থেকে উচ্চ সংবানে ওঠতে গেলে যে পরিমাণ আমলাদের ঘুষ দেওয়ার প্রয়োজন পড়বে, আর যে অঙ্কের ঘুষ দিতে হবে, তা বাস্তবে কোনো সাধারণ নাগরিকের পরিশোধ করা অসম্ভব।

উত্তর কোরিয়ার আমলারা অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন; Image Source: Reuters

নিম্ন সংবানের থাকার কারণে একজন নাগরিক বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। এক ডিফেক্টর (উত্তর কোরিয়া থেকে পালিয়ে আসা নাগরিক) দেশটির এক জাতীয় ক্রীড়া দলের অন্তর্ভুক্ত হতে পারেননি নিম্ন সংবানের নাগরিক হওয়ায়। সামরিক বাহিনীতেও নিম্ন সংবানের সদস্যদের সুযোগ দেওয়া হয় না। চাকরির ক্ষেত্রেও তুলনামূলক কম যোগ্য উচ্চতর সংবানের নাগরিকদের সুযোগ দেওয়া হয় বেশি। একইসাথে উচ্চ সংবানের নাগরিকরা অপরাধ করলেও বিচারকদের কৃপা পেতে পারেন, যা নিম্ন সংবান নাগরিকরা পান না। সেরা স্কুলগুলোতে উচ্চ সংবান নাগরিকদের সন্তানরাই কেবল পড়াশোনা করার সুযোগ পায়।  

দুই থেকে তিন প্রজন্ম ধরে সংবানের সামাজিকীকরণ ঘটায় এটা কেবল রাজনৈতিক পরিসীমাতেই আবদ্ধ নেই। কেউ যদি উচ্চ সংবান পরিবারে জন্মায়, তার পড়াশোনা ও চাকরির ক্ষেত্রে তৈরি হয় অন্যান্য উচ্চ সংবান নাগরিকদের সাথে। তাদের পড়াশোনা আর চাকরিও হয় সেরা স্কুল ও সেরা কর্মক্ষেত্রে। তারা তুলনামূলক ভদ্রস্থ অ্যাপার্টমেন্ট ভবনে থাকার সুযোগ পায়। তাদের প্রতিবেশীরাও হয় উচ্চ সংবানের। তাদের আত্মীয়রাও উচ্চ সংবানের চাকরিজীবী হয়ে থাকে। ফলে উচ্চ সংবানের নাগরিকরা কোনো ঝামেলায় পড়লে তাদের রক্ষা করার মতো সরকারের উচ্চ পর্যায়ে যথেষ্ট যোগাযোগ থাকে। সেখানকার সমাজ ব্যবস্থায় এগুলো খুব স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবেই দেখা হয়।     

উচ্চ সংবানের নাগরিকদের বিয়েও হয় সমপর্যায়ের সংবানের নাগরিকদের সাথে। কেউ যদি নিম্ন সংবানের নাগরিকের প্রেমে পড়ে, তবে নিম্ন সংবানের নাগরিক তার চেয়ে গরিব এবং সামাজিকভাবে তুলনামূলক নিচু স্তরের হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই এক্ষেত্রে পরিবারের আপত্তি ওঠার সম্ভাবনা বেশি। তবে উচ্চ সংবানের নাগরিকদের বন্ধুবান্ধবরাও সাধারণত উচ্চ সংবানের হয়ে থাকে। তাই তাদের সাথে নিম্ন সংবান নাগরিকদের প্রেম হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

উত্তর কোরিয়ার নাগরিকরা বিয়ে করেন নিজেদের সংবানের মধ্যেই; Image Source: Koryo Studio

সংবান প্রথা তাই এমন একটা ব্যবস্থা, যেখানে মেধার মূল্যায়ন হয় না। কেবল মাত্র জন্মপরিচয়ের বিবেচনায় একজন নাগরিককে অন্যায্যভাবে সুযোগ বা শাস্তি ভোগ করতে হয়। এর সাথে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর ধনী শ্রেণিদের অন্যায্য সুবিধাপ্রাপ্ত হওয়াকে মেলানো যাবে না। এটা সরকার দ্বারা ইচ্ছাকৃতভাবেই একটা প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে একটা দেশের সামাজিক শ্রেণি তৈরি করা হয়েছে।

তবে নব্বই দশকে উত্তর কোরিয়ার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ-পরবর্তী সময়ে চিরায়ত সংবান ধারণার অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। ওই সময়ে সরকার শাসন ব্যবস্থা একটু শিথিল করলে, একটা উদ্যোক্তা শ্রেণি তৈরি হয়। বর্তমানে কেউ সফল ব্যবসায়ী হলে সে হয়তো উচ্চতর সংবান কিনে নিতে পারবে না, তবে উচ্চ সংবানের সুযোগ-সুবিধাগুলো কিনে নিতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ, লোভনীয় চাকরি, তুলনামূলক মুক্তভাবে চলাফেরার স্বাধীনতা, কঠোর শাস্তি এড়ানো- অর্থ খরচ করতে পারলে এসব উচ্চ সংবানের ফায়দাগুলো কিনে নেওয়া সম্ভব। বর্তমানের অনেক উঠতি উদ্যোক্তারাই নিম্ন সংবানের নাগরিক। তবে এটা তাদের জীবনযাপনে খুব সামান্যই প্রভাব ফেলছে। কেউ যথেষ্ট বিত্তবান হলে উচ্চ-মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারে বিয়ে করতে পারে।

বর্তমানে উচ্চ সংবানের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য চাকরিজীবীরা উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঘুষ দিয়ে থাকেন। ঘুষ দিয়ে উপরের পদে গেলে নিজেরা ঘুষ খাওয়া শুরু করেন। এভাবে তারা ঘুষের অর্থ তুলে আনেন। ঘুষকে তারা ‘বিনিয়োগ’ হিসাবে দেখে থাকেন। এভাবে সরকারের নিম্ন পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়ে ঘুষের বিনিময় হতে থাকে।           

উত্তর কোরিয়ায় উচ্চ সংবান পরিবারের শিক্ষার্থীরাই সাধারণত প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ পান; Image Source: KCNA 

তবে সংবানের প্রভাব এখন একেবারেই নেই, এমন ভাবলে ভুল হবে। যেকোনো জ্যেষ্ঠ উত্তর কোরীয় কর্মকর্তার ক্ষেত্রে দেখা যাবে, সেনাবাহিনীর উচ্চ পদে তার কোনো চাচাত ভাই কাজ করে, কিংবা তার ভাই হয়তো নিরাপত্তা বিভাগের উচ্চ পদে চাকরি করে। ওই কর্মকর্তা হয়তো খুব একটা মেধাবী চাকরিজীবীও না। উচ্চ সংবান আর পারিবারিক ক্ষমতার কারণে তার অলস প্রকৃতির কর্মকর্তা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তার মূল কাজ হচ্ছে ঘুষ সংগ্রহ করা। তিনি যে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ঘুষ সংগ্রহ করছেন, তার জীবনযাত্রার মান হয়তো আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে।

কিন্তু ওই কর্মকর্তার মতো ঘুষ সংগ্রহকারী উচ্চ সংবানের লোকরাই উত্তর কোরিয়াতে সবচেয়ে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন। সরকারের বড় বড় নির্মাণ প্রকল্পের কাজগুলো উচ্চ সংবানের লোকরাই পেয়ে থাকেন। বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উচ্চ সংবানের লোকরা বিচারকার্যে যে আনুকূল্য পেয়ে থাকেন, তা নিম্ন শ্রেণির সংবানের ক্ষেত্রে বিবেচনাতেই নেওয়া হয় না। তাই উত্তর কোরিয়ার এই জাত প্রথা সমাজের প্রতিটি স্তরে আজও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বজায় রেখে চলছে।

Related Articles