অ্যালেক্সেই নাভালনি; ক্রেমলিনের দূর্নীতির বিরুদ্ধে পুরো রাশিয়াজুড়ে তিনি প্রচারণা চালিয়েছেন, জনগণকে নতুন রাশিয়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। ২০১৮ সালে রাশিয়ার নির্বাচনের আগে তাকে আইনি ঝামেলা জড়ানো হয়, ফলে আর নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেননি। কিছুদিন আগে তোমস্ক শহর থেকে থেকে মস্কোতে আসছিলেন. প্লেনে থাকার সময়ে রহস্যজনকভাবে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। পরে যাত্রাপথে ওমস্ক শহরে তাকে নামানো হয়। তার দলের সদস্যরা তাকে সেই শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করে। তিন দিন ওমস্ক শহরের হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পর তাকে আরও ভালো চিকিৎসার জন্য জার্মানিতে পাঠানো হয়। জার্মানিতে একটি চ্যারিটি হাসপাতাল তার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
image source: jornaleconomico.sapo.pt/en
তার রহস্যময় হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার পেছনে তার দলের সদস্যদের পক্ষ থেকে দাবী করা হয় তাকে বিমানে ওঠার আগে চায়ের সাথে বিষাক্ত নার্ভ এজেন্ট পান করানো হয়েছিল। অ্যালেক্সেই নাভালনির স্ত্রী দাবি করেন, অসুস্থ হওয়ার পর নাভালনিকে যখন বিদেশে পাঠানোর জন্য তড়িঘড়ি করে সরকারের পক্ষ থেকে ছাড়পত্র দেয়া উচিত ছিল, সেখানে ক্রেমলিন ইচ্ছাকৃতভাবে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে, যাতে তার শরীরে নার্ভ এজেন্ট পাওয়ার প্রমাণ মুছে ফেলা যায়। এজন্য নাভালনিকে জার্মানিতে আসতে প্রায় তিন দিন অপেক্ষা করতে হয়। পরে জার্মানিতে চিকিৎসার সময় জার্মানির সামরিক চিকিৎসকেরা নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগের বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাকে এর পেছনে দায়ী করা হয়।
সের্গেই স্ক্রিপাল; একসময় রাশিয়ান সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা হিসেবে কাজ করতেন। রুশ গোয়েন্দা অফিসার হিসেবে তাকে ইংল্যান্ডে পাঠানো হয়। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি ডাবল এজেন্ট হয়ে যান এবং রাশিয়ার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ইংল্যান্ডের গোয়েন্দা সংস্থার হাতে পাচার করেন। যারা ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন, তাদের প্রচন্ড ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। ধরা পড়ার প্রচুর সম্ভাবনা থাকে, কারণ প্রতিটি গোয়েন্দা অফিসারের উপর আলাদা করে নজরদারি চালায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। ২০০৬ সালে রাশিয়ার আরেক গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিসের (এফএসবি) হাতে ধরা পড়েন। তাদের দেশদ্রোহিতার আইনে গ্রেফতার করে ১৩ বছরের জেল দেয়া হয়। তবে ছয় বছর জেল খাটার পর রাশিয়ান সরকার ২০১০ সালে বন্দী আদান-প্রদানের অংশ হিসেবে তাকে মুক্তি দিয়ে ইংল্যান্ডে পাঠিয়ে দেয়। ইংল্যান্ড তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করে।
২০১৮ সালে সের্গেই স্ক্রিপালের সাথে তার মেয়ে জুলিয়া স্ক্রিপাল রাশিয়া থেকে দেখা করতে যান। পরে স্যালিসবুরি জেলার একটি পার্কের বেঞ্চে তাদের দুজনকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। প্রায় তিন সপ্তাহ অচেতন থাকার পর জুলিয়া স্ক্রিপালের জ্ঞান ফিরে আসে। ৬৬ বছর বয়স্ক সের্গেই স্ক্রিপালের জ্ঞান ফিরে আসতে সময় লাগে প্রায় এক মাস। এরপর নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসার মাধ্যমে তাকে সুস্থ করে তোলা হয়। সেই ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত সের্গেই স্ক্রিপালকে ইংল্যান্ডের সরকার চরম গোপনীয়তার মধ্যে রেখেছে।
image source: jornaleconomico.sapo.pt/en
অ্যালেক্সেই নাভালনি কিংবা সের্গেই স্ক্রিপালের মধ্যে সাধারণ মিল হচ্ছে তারা দুজনই ক্রেমলিনের বিরাগভাজন ব্যক্তিত্ব। একজন ক্রেমলিনের সমালোচনায় সবসময় মুখর থেকেছেন, সারাদেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন। আরেকজন স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত রাশিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য ইংল্যান্ডের হাতে পাচার করেছেন। এদের বিরুদ্ধে তাই রুশ গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা গুপ্তহত্যার প্রচেষ্টা চালানো কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। বরং এরকম বিষাক্ত রুশ নোভিচক নার্ভ এজেন্টের কবলে পড়েও যে তারা হাসপাতাল থেকে বেঁচে ফিরতে পেরেছেন, এটা তাদের সৌভাগ্য বটে।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দুটি দেশই মারণাস্ত্রের উন্নয়ন ঘটানোর পাল্লা দেয়া শুরু করে। আমেরিকার ও ইউরোপের মার্কিন মিত্র দেশগুলোর কাছে আগে থেকেই 'ভিএক্স' (VX), সারিন প্রভৃতি নার্ভ এজেন্ট ছিল। ১৯৮৩ সালের দিকে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি মস্কোর কাছেই একটি অত্যাধুনিক ল্যাবে চতুর্থ প্রজন্মের নার্ভ এজেন্ট তৈরি করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ফোলিয়ান্ত (Foliant) ছদ্মনামের আড়ালে চলতে থাকে ভয়াবহ নার্ভ এজেন্ট তৈরির কাজ। রুশ কমিউনিস্ট পার্টির এই পরিকল্পনার মূল কারণ ছিল নার্ভ এজেন্টের দিক থেকে আমেরিকার নাগাল ধরতে পারা, যাদের আগে থেকেই তিনটি নার্ভ এজেন্ট ছিল।
কিন্তু আমেরিকা যেভাবে খোলাখুলিভাবে নার্ভ এজেন্টের কথা প্রকাশ করেছে, সোভিয়েত রাশিয়া সেদিক থেকে বিষয়গুলো একদম গোপন রেখেছিল। মার্কিন কংগ্রেসে নার্ভ এজেন্ট নিয়ে প্রকাশ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, মার্কিন মিডিয়ায় নার্ভ এজেন্ট নিয়ে বিস্তর লেখাপত্র প্রকাশিত হয়েছে অপরদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন একেবারে গোপনে নার্ভ এজেন্ট তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এর কারণও ছিল অবশ্য। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন শিল্পপণ্যের কাঁচামাল হিসেবে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়, সেগুলো দিয়ে নার্ভ এজেন্ট তৈরির চেষ্টা চালিয়েছিল এবং পরবর্তীতে তারা সফলও হয়। শিল্পপণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা কেমিক্যাল দিয়ে নার্ভ এজেন্ট দিয়ে তৈরির প্রধান সুবিধা হচ্ছে এতে করে তৎকালীন ন্যাটোর প্রযুক্তিকে ফাঁকি দেয়া। গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশকে ন্যাটো যে প্রযুক্তি ব্যবহার করতো, নোভিচক এজেন্ট সেগুলোকে সফলতার সাথে ফাঁকি দিয়েছে। না আমেরিকা, না ইউরোপ; ২০১৮ সালের আগে কেউই মারণাস্ত্রের প্রয়োগ হিসেবে নোভিচক নার্ভ এজেন্টের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারেনি!
নোভিচক নার্ভ এজেন্টের প্রধান কাজ হচ্ছে ব্যক্তির শরীরের পেশির কার্যক্ষমতাকে নষ্ট করে দেয়া। পাউডার, তরল কিংবা বায়বীয় আকারে এটি টার্গেট ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করানো হয়। কখনও শ্বাস-প্রশ্বাস, কখনও বা ত্বকের মাধ্যমে এটি ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করে। এটি স্নায়ুতন্ত্রে গিয়ে আঘাত হানে, ফলে স্নায়ুতন্ত্র থেকে পেশিতে আর সিগন্যাল পৌঁছাতে পারে না। এভাবে একসময় দেহের বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করা ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। হৃদপিণ্ড কাজ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে একসময় ব্যক্তি মারা যায়। নার্ভ এজেন্ট খুব দ্রুত ক্রিয়া করে শরীরে। ঠিকমতো প্রয়োগ করা হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই যেকোনো ব্যক্তি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে।
নোভিচক বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ ও কার্যকর নার্ভ এজেন্ট হিসেবে স্বীকৃত। ফোলিয়ান্ত প্রোগ্রামের সফলতা হিসেবে প্রথম যে নার্ভ এজেন্ট প্রস্তুত করা হয়, তার নাম দেয়া হয় 'নোভিচক', রুশ ভাষায় যার অর্থ আগন্তুক। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর অনেক সোভিয়েত বিজ্ঞানী ইউরোপ ও আমেরিকায় চলে আসেন। বিজ্ঞানী ভিল মিরজায়ানোভ ও লেভ ফিয়োদোরোভ তেমনই দুজন বিজ্ঞানী, যারা নার্ভ এজেন্ট তৈরির 'ফোলিয়ান্ত' প্রোগ্রামে কাজ করেন এবং পরবর্তীতে ইউরোপে চলে আসেন। তাদের লেখা চিঠি থেকে জানা যায়, যেকোনো ব্যক্তিকে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে আমেরিকার ভিএক্স নার্ভ এজেন্টের তুলনায় রুশ এজেন্ট নোভিচক দশ গুণ বেশি শক্তিশালী!
রুশ গোয়েন্দা সংস্থার নোভিচক এজেন্ট প্রয়োগে গুপ্তহত্যা চালানোর প্রতিটি অভিযোগকেই রাশিয়ান সরকার দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছে। সর্বশেষ যেবার ইংল্যান্ডে সের্গেই স্ক্রিপাল ও তার কন্যাকে নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগের ঘটনা ঘটলো, তারপর থেকে ইউরোপের সাথে রাশিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক একেবারে তলানিতে নেমেছিল। ন্যাটো বার বার রাশিয়াকে নার্ভ এজেন্ট তৈরির কার্যক্রম অব্যহত রাখা সম্পর্কে সতর্ক করেছে, সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই রাশিয়া এসব অভিযোগকে ভিত্তিহীন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আন্তর্জাতিক কেমিক্যাল ওয়েপন কনভেনশনে রাশিয়া যোগ দেয়ার পরও এই ধরনের নার্ভ এজেন্টের প্রয়োগ পশ্চিমাদের রীতিমতো ক্ষুদ্ধ করেছে, কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে প্ররোচিত করেছে।
নার্ভ এজেন্ট তৈরিতে রাশিয়া সবাইকে ফাঁকি দিতে পেরেছে, কারণ নোভিচক তৈরিতে যেসব উপাদান ব্যবহার করা হয়, সেগুলো এখনও নিষিদ্ধ করা হয়নি। আগেই বলা হয়েছে, নোভিচক তৈরিতে এমন সব উপাদান ব্যবহার করা হয়, যেগুলো বিভিন্ন শিল্পপণ্যের কাঁচামাল তৈরিতেও ব্যবহার করা হয়। এই সুবিধাই রাশিয়া কাজে লাগিয়েছে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ছাড়া নোভিচক এজেন্টকে শনাক্ত করাও সম্ভব নয়।
গণহারে নার্ভ এজেন্টের ব্যবহার মানবিক বিপর্যয় ঘটায়। জাপানের পাতাল রেলে এরকম নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করে অসংখ্য মানুষকে অসুস্থ করে ফেলা হয়েছিল, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল। নার্ভ এজেন্টের ব্যবহার বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডকে নতুন মাত্রা দান করে, যেটি শান্তিকামী মানুষের ভয়কে বাড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। আন্তর্জাতিক কেমিক্যাল ওয়েপন কনভেনশনে ১৯৩টি দেশ স্বাক্ষর করেছে, যাদের মধ্যে রাশিয়াও রয়েছে। তারপরও নিজের শত্রুদের বিরুদ্ধে রুশ গোয়েন্দা সংস্থার নোভিচক নার্ভ এজেন্ট ব্যবহার করা মতো ঘটনা শুধু হতাশাই বাড়ায়। নার্ভ এজেন্টের মতো কুখ্যাত মারণাস্ত্রের ব্যবহার কখনোই শান্তি বয়ে আনতে পারে না।
This Bengali article discusses the illegal use of Novichok nerve agent by Russian intelligence agencies.
Reference:
১) What Is Novichok, the Russian Nerve Agent Tied to Navalny Poisoning?
২) Novichok nerve agent used against Russian dissident has dark history