Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অটো ওয়ার্মবিয়ার: উত্তর কোরিয়ায় গ্রেপ্তার এক দুর্ভাগা আমেরিকান । পর্ব ১

২০১৬-১৮ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রে আলোচিত এক নাম ছিলেন অটো ওয়ার্মবিয়ার। রোমাঞ্চের স্বাদ নিতে ২০১৬ সালকে স্বাগত জানাতে গিয়েছিলেন উত্তর কোরিয়া সফরে। কিন্তু সেটাই যে তার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াবে, তা কি কখনো ভাবতে পেরেছিলেন? উত্তর কোরিয়ার প্রোপাগান্ডা পোস্টার চুরির দায়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর অনেক জল ঘোলা হয়। যুক্তরাষ্ট্র-উত্তর কোরিয়া যুদ্ধ লেগে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তাকে নিয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন উভয়ই নিজেদের স্বার্থে রাজনীতি করেছেন। কিন্তু এতে প্রাণ হারিয়েছেন অটো। তার মৃত্যু নিয়ে ছিল বেশ জল্পনা-কল্পনা। অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডগ বক ক্লার্ক ২০১৮ সালে পুরো ঘটনার এক চিত্র তুলে ধরেন। রোর বাংলার পাঠকদের জন্য তার সেই প্রতিবেদন বাংলায় তুলে ধরা হলো।   

অটো ওয়ার্মবিয়ার; Image Source: Assoiciated Press

১.

২০১৭ সালের জুন মাস; এক স্যাঁতস্যাঁতে সকালে যুক্তরাষ্ট্রের সিনসিনাটি শহরতলীতে ফ্রেড ও সিন্ডি ওয়ার্মবিয়ার তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। দেড় বছর আগে তাদের ছেলে অটো যখন উত্তর কোরিয়া সফরে গিয়েছিলেন, এরপর থেকে তার সাথে আর কথা হয়নি তাদের। সর্বশেষ তাকে একঝলক দেখতে পান পিয়ংইয়ং থেকে টেলিভিশনে প্রচার করা এক সংবাদ সম্মেলনে। ওই সম্মেলনে দেখা যায়- ২১ বছর বয়সী, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র, অটো ওয়ার্মবিয়ার তার দোষ স্বীকার করে বিবৃতি দিচ্ছেন। তার কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয় যে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গোপন সংঘ ওহাইয়ো চার্চ ও আমেরিকান সরকারের নির্দেশে উত্তর কোরিয়ার এক প্রোপাগান্ডা পোস্টার চুরি করেন।

তিনি তখন ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,

আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলাম। কিন্তু আমি একজন মানুষ… আমি আপনাদের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছি। আপনারা আমাকে ক্ষমা করে দিন। আমাকে বাড়িতে আমার পরিবারের কাছে ফিরে যেতে দিন।

কিন্তু তার আকুতি সত্ত্বেও তাকে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

দোষ স্বীকার করে বক্তব্য দিচ্ছেন অটো ওয়ার্মবিয়ার; Image Source: ITAR-TASS News Agency / Alamy Stock Photo

ফ্রেড আর সিন্ডি দুশ্চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাতে কাটাতে একপর্যায়ে তাদের বন্ধুদের কাছে বলেন, অটোকে হয়তো উত্তর কোরিয়া খুন করে ফেলেছে। অটোর ২২তম জন্মদিনে সিন্ডি উত্তর কোরিয়া অভিমুখে চীনা ঘরানার ফানুশ উড়িয়ে স্বপ্ন দেখছিলেন ছেলে তার বার্তা দেখতে পাবে। তিনি বলেন, “আমি তোমাকে ভালোবাসি অটো।” তারপর “শুভ জন্মদিন” গানটি গান।

কিন্তু জুনের সেই সকালে ওয়ার্মবিয়ার দম্পতি গোপন তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারেন- অটোকে মুক্ত করে নিয়ে আসা হতে পারে। অটো অচেতন অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা জানতে পেরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আমেরিকান কর্মকর্তাদের একটি দলকে উত্তর কোরিয়ায় যাওয়ার নির্দেশ দেন। তখন ওই মিশন সম্পর্কে সরকারের একেবারে উচ্চপর্যায় থেকে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। কিন্তু ওই তরুণকে আসলেই মুক্তি দেওয়া হবে কিনা, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছিল না। কর্মকর্তারা তাই উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলেন। সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন প্রেসিডেন্টকে টেলিফোন করে জানান- অটো দেশে ফেরার বিমানে আছেন। প্রেসিডেন্ট ফোন রাখার আগে বলেন, “অটোর খেয়াল রেখো।” এরপর ওহাইও সিনেটর রব পোর্টম্যান ওয়ার্মবিয়ার দম্পতিকে ফোনে জানান, অটোকে নিয়ে আসা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সটি জাপানের আকাশসীমায় আছে, সে রাতের বেলায় দেশে পৌঁছাবে। তিনি অটোকে দেশে ফেরানোর ব্যাপারে তদারকি কাজে সাহায্য করছিলেন।

কিন্তু সিন্ডি জানতেন- তার ছেলের বিপদ তখনো কাটেনি। উদ্ধারকার্যের সময় পোর্টম্যান তাকে জানিয়েছিলেন, উত্তর কোরিয়ার ভাষ্যমতে অটো কয়েক মাস ধরে অচেতন অবস্থায় আছেন। কেউই জানে না তার আঘাতের মাত্রা আসলে কতটা তীব্র। সিন্ডি পোর্টম্যানকে প্রশ্ন করেন, “আপনি কি আমাকে বলবেন অটোর মস্তিষ্ক সচল আছে কিনা?

পোর্টম্যান উত্তর দেন- অটোর মস্তিষ্কে সম্ভবত মারাত্মক জখম সৃষ্টি হয়েছে।

সিন্ডি গণমাধ্যমকে বলেন, তিনি মনে করছেন অটো ঘুমিয়ে আছেন অথবা ওষুধের মাধ্যমে তাকে কোমায় রাখা হয়েছে। ওয়ার্মবিয়াররা তাদের সন্তানের ব্যাপারে ইতিবাচক ছিলেন। তারা আশা করছিলেন, আমেরিকান স্বাস্থ্যসেবা আর তাদের ভালোবাসায় তাদের ছেলে আবার আগের মতো প্রাণবন্ত হয়ে উঠবেন।

পোর্টম্যান ও তার অধীনস্থ কর্মীরা তখন অটোকে বাড়ি ফেরানোর প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তাকে বহন করে আনা বিমানের গতিপথ সিনসিনাটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সরিয়ে স্থানীয় এক বিমানবন্দরে নিয়ে আসা হয়। কারণ এখানে জনসমাবেশ তুলনামূলক কম থাকবে। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর অটোকে বরণ করে নেওয়ার জন্য জনতা জড়ো হতে থাকে। টেলিভিশন কর্মীরা বিমানবন্দরের সীমানা প্রাচীরের কাছে ক্যামেরা বসানো শুরু করেন। অবশেষে অটোকে বহন করে আনা বিমানটি হ্যাঙ্গারগুলোর সামনে এসে দাঁড়ায়, যার কাছেই অপেক্ষা করছিলেন ওয়ার্মবিয়ার পরিবার।

অটোকে উদ্ধার করে আনা বিমান থেকে নামিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে  ©John Minchillo

ফ্রেড ওয়ার্মবিয়ার পরবর্তীতে ওই সময়ের প্রসঙ্গে বলেন, তিনি যখন বিমানের সিঁড়ি দিয়ে উঠছিলেন, মাঝপথে থাকা অবস্থায় ইঞ্জিনের শব্দকে ছাড়িয়ে একটা “অমানবিক” কর্কশ শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন না এটা কীসের শব্দ হতে পারে। কিন্তু তিনি যখন বিশৃঙ্খলভাবে রাখা মেডিকেল সরঞ্জামযুক্ত কেবিনে প্রবেশ করলেন, শব্দের উৎস খুঁজে পেলেন। তার ছেলে অটো একটা স্ট্রেচারে শক্ত করে বাঁধা থাকা অবস্থায় হিংস্রভাবে ঝাঁকাচ্ছেন আর আর্তনাদ করছেন।

সিন্ডি মানসিকভাবে তৈরি ছিলেন তার ছেলেকে দুরবস্থার মধ্যে দেখার জন্য। কিন্তু এতটা খারাপ অবস্থায় দেখবেন, এটা আশা করেননি। অটোর অভিভাবকদের ভাষ্যমতে, তার হাত-পা পুরোপুরি বিকৃত অবস্থায় ছিল। নাকে নল লাগানো ছিল খাবার দেওয়ার জন্য। ফ্রেড বলেন, “দেখে মনে হচ্ছিল কেউ এক জোড়া প্লাইয়ার্স নিয়ে এসে তার নিচের দাঁতগুলো অদল-বদল করে দিয়েছে।” অটোর বোন এ অবস্থা দেখে চিৎকার করে বিমান থেকে নেমে যান। সিন্ডিও তার পিছু পিছু চলে যান।

ফ্রেড তার ছেলের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেন। তার চোখের মাঝে ছিল শূন্য দৃষ্টি। ফ্রেড তাকে বলেন, তিনি তাকে খুব মিস করেছেন। এখন তাকে ফিরে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছেন। কিন্তু অটোর চিৎকার চলতেই থাকে। তাকে কোনোভাবেই শান্ত করা যাচ্ছিল না।       

প্যারামেডিকরা যখন অটোকে হাতে-পায়ে ধরে বিমান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে আনে, সিন্ডি ততক্ষণে নিজেকে ধাতস্থ করে নেন। মনের জোর নিয়ে ওট্টোর সাথে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠে বসেন। ছেলেকে এমন যন্ত্রণার মাঝে দেখে তিনি প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলেন।

ওট্টো ওয়ার্মবিয়ারের বাবা-মা; Image Source: White House/JNS

সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে অটোর বিছানার পাশেই তার পরিবার থাকার ব্যবস্থা করে। এদিকে বিশ্বজুড়ে তার এই দুরবস্থার কারণ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। কিন্তু অটো কখনোই তার পক্ষের গল্প বলার মতো সুস্থ হতে পারেননি। এদিকে চিকিৎসকরা সমগ্র পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও তার এমন জখমের কোনো কারণ খুঁজে পাননি।

এদিকে কোনো স্পষ্ট তথ্য না থাকায় আমেরিকা ও উত্তর কোরিয়া উভয়েই নিজেদের মতো করে গল্প বানাতে শুরু করে। উত্তর কোরিয়া দাবি করে, অটোর অবস্থা খারাপ হওয়ার পেছনে বটুলিজম নামের রোগ হয়ে থাকতে পারে। সে কারাগারে শূকরের মাংস খাওয়ার কারণেই নাকি এমন হয়েছে। অথবা তাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়ায় পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। আমেরিকান ডাক্তাররা উত্তর কোরিয়ার এমন ব্যাখ্যার সাথে একমত ছিলেন না।

এক জ্যেষ্ঠ আমেরিকান কর্মকর্তা জানান, গোয়েন্দা তথ্য থেকে পাওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী- অটোকে বারংবার শারীরিক আঘাত করা হয়েছে। ফ্রেড ও সিন্ডি মিডিয়ার সামনে এসে দাবি করেন, তাদের ছেলেকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে, যাতে উত্তর কোরিয়ার অশুভ স্বৈরতন্ত্র বহির্বিশ্বে আলোচনায় আসতে পারে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও ওই ঘরানাতেই কথা বলতে থাকেন। এদিকে আমেরিকান সেনাবাহিনী তখন উত্তর কোরিয়ার সাথে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়তে যুদ্ধ ও অটোর প্রসঙ্গে লেখা হয়।

ট্রাম্প প্রশাসন আর উত্তর কোরিয়া যখন তাদের মতো করে অটোর গল্প শোনাচ্ছিল, আমি তখন ছয় মাস ধরে ওয়াশিংটন ডিসি থেকে সিউল ঘুরে প্রতিবেদন তৈরি করতে থাকি অটোর আসলে কী হয়েছিল তা বের করার জন্য। আমেরিকান এক কলেজ ছাত্র কেন পিয়ংইয়ংয়ে গিয়েছিলেন? বন্দিদশায় থাকার সময় তাকে কী পরিমাণ দুঃস্বপ্নের মধ্যে কাটাতে হয়েছিল? তার মস্তিষ্কে কীভাবে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল? তার মৃত্যু কীভাবে আমেরিকাকে উত্তর কোরিয়ার সাথে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল? আশ্চর্যজনকভাবে, এই মৃত্যুই কীভাবে পরিস্থিতি উল্টো করে ট্রাম্পের সাথে কিম জং উনের শান্তি সম্মেলনের দিকে নিয়ে গিয়েছিল? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমি যে গল্প জানতে পেরেছি, তা আরো অদ্ভুত ও দুঃখজনক ছিল, যা অন্য কেউ জানত না। আসলে অটোর আঘাত নিয়ে মানুষ যেরকম সাদা-কালো তত্ত্বে বিশ্বাস করে, বিষয়টা সেরকম ছিল না। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্রশাসনের প্রচারাভিযানের মুখপাত্র হওয়ার আগে তিনি ছিলেন আর দশজন সাধারণ ছাত্রদের মতোই একজন। তার নাম ছিল অটো ওয়ার্মবিয়ার।

Related Articles