(পর্ব ৪-এর পর থেকে)
৮.
উত্তর কোরিয়ার কোনো ঘটনার সত্যতা যাচাই করা আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্যও কঠিন। কিন্তু অটোর গ্রেপ্তারের পরের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে ধারণা করা কঠিন কিছু নয়। গোয়েন্দা তথ্য, সরকারি কর্মকর্তাদের তথ্য, উত্তর কোরিয়ার জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের ডিফেক্টরদের দেওয়া তথ্য, এবং ১৯৯৬ সাল থেকে উত্তর কোরিয়ায় আরো ১৫ জন আমেরিকানের গ্রেপ্তারের ঘটনা বিশ্লেষণ করলে সেখানে অটোর সম্ভাব্য প্রতিদিনের জীবন সম্পর্কে একটা অনুমান করা যায়।
বিদ্যুৎ চালিত বেড়া দিয়ে ঘেরা উত্তর কোরিয়ার কুখ্যাত প্রিজন ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ১,২০,০০০ মানুষকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। এদের কাউকে কাউকে নিষিদ্ধ দক্ষিণ কোরিয়ার ড্রামা দেখার মতো গৌণ অপরাধের জন্যও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সেখানে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন করা হচ্ছে। প্রিজন ক্যাম্পকে পরিণত করা হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে জঘন্য জায়গাগুলোর একটিতে। ভাগ্যবানরা অনাহারে থাকার সময়টা পার করতে পারে। তখন তাদের নিয়মিত নির্যাতনের শিকার করতে হয়, এবং কয়লা উত্তোলনের মতো বিপজ্জনক কাজগুলো করতে বাধ্য করা হয়। দুর্ভাগারা নির্যাতনেই মারা যায়।
সিউলে থাকা উত্তর কোরিয়ার এক ডিফেক্টর মহিলা, যিনি দেশ থেকে পালানোর চেষ্টার অপরাধে তিন বছর এক প্রিজন ক্যাম্পে ছিলেন, আমাকে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
উত্তর কোরিয়ার কারাগারগুলো আসলে একেকটা নরক। ওদের চোখে আমরা ছিলাম কুকুরের চেয়েও অধম। তারা আমাদের প্রায়ই শারীরিক নির্যাতন করত। আমরা এতই ক্ষুধার্ত থাকতাম যে, সেলে থাকা ইঁদুর ধরেও খেয়ে ফেলতাম।
ওই মহিলা প্রতিদিন তার সাথের বন্দীদের মারা যেতে দেখতেন।
তবে আমেরিকানদের এমন কিছুর মুখোমুখি হওয়া লাগত না। অটোকে গ্রেপ্তারের পর সম্ভবত কোনো গেস্টহাউজে নিয়ে যাওয়া হয়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করে সেখানেই তাকে রাখা হয়েছিল। অন্তত পূর্ববর্তী পাঁচজন আমেরিকানকে গ্রেপ্তার করে দোতলা সবুজ রঙের ভবনে রাখা হয়েছিল, যা ছিল পিয়ংইয়ং শহরের কেন্দ্রস্থলে এক রেস্টুরেন্টের পেছনে। রেস্টুরেন্ট পরিচালনা করত উত্তর কোরিয়ার সিক্রেট পুলিশ স্টেট সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট। অন্যদের রাখা হয়েছিল বিভিন্ন গেস্টহাউজে। অন্তত তিনজনকে রাখা হয় এক হোটেলে। সবচেয়ে বেশি যে গেস্টহাউজ ব্যবহার করা হয়, সেটা স্থানীয় মানদণ্ডে খুবই বিলাসবহুল ছিল। তবে অটোকে হয়তো দুই রুমের সাধারণ কোনো হোটেলের স্যুইটেই রাখা হয়েছিল। তবে হোটেল রুম যতই সুন্দর হোক, সেটা একটা কারাপ্রকোষ্ঠই। কারণ রুম থেকে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না।
জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি দেওয়ার আগে দুই মাস অটোকে সম্ভবত নিরলসভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল। আমেরিকান মিশনারি কেনেথ বেই বলেন, তাকে একদিনে প্রায় ১৫ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদের লক্ষ্য সত্য উন্মোচন করা নয়, বরং তাদের মতো করে মিথ্যা স্বীকারোক্তি দেওয়ার জন্য বাধ্য করা। অতীতে উত্তর কোরিয়া সামান্য সত্য থেকে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায় করেছে বিভিন্নবার। অটোর ক্ষেত্রে সম্ভবত তার কেনা স্যুভেনির প্রোপাগান্ডা পোস্টার থেকেই এই ষড়যন্ত্র করা হয়েছে, সফরে থাকা অটোর রুমমেট ড্যানি গ্রেটন এমনটাই মনে করেন।
এর আগের কোনো আমেরিকান বন্দী স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ করেননি। কিন্তু অটো যদি নিজেকে বার বার নির্দোষ দাবি করতে থাকেন, তাহলে সম্ভবত তাকে ওহাইয়োর জেফরি ফোউলির মতো অভিজ্ঞতায় পড়তে হয়েছিল। অটোর দুই বছর আগে বন্দী হওয়া এই ব্যক্তি বলেন, “আপনি যদি তাদের সহযোগিতা শুরু না করেন, আপনার অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হবে না।” সাংবাদিক লরা লিং তার পাঁচ মাসের বন্দীজীবন নিয়ে লিখেছেন, “আমি প্রসিকিউটরকে বলে দেই তিনি যা শুনতে চান, এবং যতক্ষণ না তিনি সন্তুষ্ট হন, আমি বলতেই থাকি।”
১৯৬৮ সালে ইউএসস পুয়েবলো জব্দ করার পর থেকে আমেরিকান বন্দীদের ওপর উত্তর কোরিয়ার নির্যাতনের কোনো স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। লিং ও তার সাথের সাংবাদিক ইউনা লি ২০০৯ সালে চীন সীমান্ত দিয়ে ভিডিও সংবাদ প্রচার করার সময় অবৈধভাবে উত্তর কোরিয়া সীমান্তে প্রবেশ করে ফেলেন। তখন উত্তর কোরিয়ার সেনারা তাদের আটক করে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া যখন তাদের আমেরিকান নাগরিকত্ব সম্পর্কে জানতে পারে, তাদেরকে সবুজ ছাদের গেস্টহাউজে পাঠানো হয়। আমেরিকান মিডিয়া বারংবার সংবাদ প্রচার করে- মিশনারি রবার্ট পার্ককে শারীরিক নির্যাতন করা হয়, যার মাঝে নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো পত্রিকাও ছিল। কিন্তু পার্ক নিজে এই সংবাদ নিয়ে বলেন, তাকে নগ্ন করে মহিলা গার্ডদের বেত্রাঘাত করা আর লিঙ্গে আঘাত করার ব্যাপারটা পুরোটাই এক সাংবাদিকের কল্পিত গল্প।
বরং উত্তর কোরিয়া আমেরিকানদের গ্রেপ্তার করলে তাদের ভালোভাবেই যত্ন করত। এমনকি প্রয়োজন পড়লে অটোর মতো ফেন্ডশিপ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দিত। ৮৫ বছর বয়সী বন্দী মেরিল নিউম্যানকে এক চিকিৎসক আর নার্স দিনে চারবার এসে দেখে যেতেন। উত্তর কোরিয়ার এক উচ্চপদস্থ ডিফেক্টর, যিনি বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থায় কাজ করছেন, তিনি বলেন,
উত্তর কোরিয়া বিদেশি বন্দীদের সাথে ভালো ব্যবহারই করে। কারণ তারা জানে তাদেরকে একসময় ফিরিয়ে দিতে হবে।
কিন্তু এর মানে এই না যে উত্তর কোরিয়া আমেরিকানদের মানসিকভাবে নির্যাতন করত না। বেই, লিং ও অন্য বন্দীদের ক্রমাগত বলা হয়েছিল তাদের সরকার তাদেরকে “ভুলে গেছে” এবং তাদেরকে মুক্তি দেওয়ার এক ঘণ্টা আগে জানানো ছাড়া খুব কমই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। বেই সিউলে এক এনজিও অফিস চালান, যেখান থেকে উত্তর কোরিয়ার ডিফেক্টরদের সাহায্য করা হয়। তিনি আমাকে বলেন,
বন্দীজীবনটা ছিল বিচ্ছিন্ন, একাকিত্বের, আর হতাশার। ট্রায়ালে আমাকে পুরো আমেরিকার জন্য দায় নিতে হয়েছিল। আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এবং আমার এই শাস্তি ভোগ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আগের কিছু বন্দীকে বাড়ি থেকে আসা চিঠিগুলো পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু উত্তর কোরিয়া অটোকে বহির্বিশ্বের সাথে কোনোপ্রকার যোগাযোগই করতে দেয়নি। জিজ্ঞসাবাদের বিরতিতে সম্ভবত তাকে প্রোপাগান্ডা সিনেমাগুলো দেখতে বাধ্য করা হয়েছিল। পূর্ববর্তী বন্দীরা এমন মানসিক আঘাতের কারণে অবসাদে ভুগত, এমনকি আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছে কেউ কেউ।
ওই সংবাদ সম্মেলনের ফুটেজে অটোকে দেখে শারীরিকভাবে সুস্থ মনে হচ্ছিল। কিন্তু তিনি তার স্বাধীন জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য কান্না করছিলেন। স্পষ্টতই তিনি তীব্র মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে ছিলেন। দুই সপ্তাহ পর মার্চের মাঝামাঝি সময়ে অটোকে ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ার সময় ভিডিওতে অটোকে দেখে শারীরিকভাবে তখনও সুস্থই মনে হচ্ছিল। কিন্তু তার অভিব্যক্তি ছিল ভাবলেশহীন। তাকে আদালত থেকে বের করে নেওয়ার জন্য দুই গার্ডকে ধরে ধরে নিয়ে যেতে হয়েছিল।
এখন পর্যন্ত অটোর পরবর্তী পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করা হয়- মস্তিষ্কের ক্ষত শুরু হয় 'এপ্রিলে'। কারণ তার প্রথম ব্রেন স্ক্যান ঐ সময়েরই। ধারণা করা হয়, এই দুঃখজনক ঘটনার সূত্রপাত হয়তো বিদেশিদের জন্য বিশেষ এক শ্রম শিবির থেকে, যেখানে অন্তত তিনজন আমেরিকানকে সশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। সেখানে তাদের সয়াবিনের চারা লাগাতে বাধ্য করা হয়, এবং ইট বানাতে হয়। আর থাকতে হয় খুবই বাজে পরিবেশে। তবে বেই এ প্রসঙ্গে বলেন, সাধারণ উত্তর কোরীয় বন্দীদের সাথে তুলনা করলে তিনি চার তারকা রিসোর্টে ছিলেন। অটোর ঘটনা আরো বিভিন্ন কারণে হতে পারে। পিয়ংইয়ং থেকে কয়েক মাইল দূরে কোনো বদ্ধ স্থানে কড়া সূর্যের রোদের নিচে ক্রমাগত কাজ করা, দুর্ঘটনার সম্মুখীন হওয়া, এমনকি শারীরিক নির্যতনের কারণেও হতে পারে। তবে অটোর ক্ষেত্রে প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়- তাকে শ্রম শিবিরে যেতে হয়নি।
ফ্লুয়েকিগার বলেন, ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের কর্মীরা তাকে বলেছিলেন, তারা অটোকে ট্রায়ালের পর পরই হাসপাতালে গ্রহণ করেন, এবং ওই সময়ে তিনি অচেতন ছিলেন। তাকে অক্সিজেন দিয়ে ভেন্টিলেটরে রাখতে হয়েছিল। না হলে তিনি আর বাঁচতেন না।
কূটনীতিক ইয়ুন বলেন,
চিকিৎসকরা নিশ্চিত ছিলেন অটোকে ট্রায়ালের একদিনের মাথাতেই হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আমি তাকে দেখার আগপর্যন্ত তিনি হাসপাতালের ওই রুমেই ছিলেন।
This is a Bengali article written about American young student Otto Warmbier who was arrested by North Korean regime in 2016 and died in 2017. The article is adapted from investigative journalist DOUG BOCK CLARK's "The Untold Story of Otto Warmbier, American Hostage".
Featured Image: Kyodo via Reuters