Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পানমুনজাম: দুই কোরিয়ার মাঝখানে শান্তিপূর্ণ গ্রাম

আজকের দিনে কোরিয়া বলতে আমরা পৃথক দুটি দেশকে বুঝি, যার একটি হচ্ছে উত্তর কোরিয়া, আরেকটি দক্ষিণ কোরিয়া। তবে বর্তমানের উদারনৈতিক বিশ্বে আপনি যদি কাউকে ‘কোরিয়ান’ পরিচয় দিতে দেখেন, তাহলে ধরেই নিতে পারেন সেই মানুষটি জাতিতে দক্ষিণ কোরিয়ান। সারা বিশ্বে বর্তমানে কে-ড্রামা তথা কোরিয়ান ড্রামা কিংবা কে-পপ বা কোরিয়ান পপ গানের যে জয়জয়কার, সেটির কৃতিত্ব কিন্তু পুরোটাই দক্ষিণ কোরিয়ার। পৃথিবীর অন্য সব দেশের সাথে উত্তর কোরিয়ার তুলনায় দক্ষিণ কোরিয়া রাষ্ট্রীয় মিথস্ক্রিয়া অনেক বেশি। আরও একটি বিশেষ দিক থেকে দক্ষিণ কোরিয়া তার প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ উত্তর কোরিয়া থেকে বিশাল ব্যবধানে এগিয়ে আছে। স্যামসাং, এলজি কিংবা হুন্দাইয়ের মতো পৃথিবীখ্যাত ইলেকট্রনিক পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষিণ কোরিয়ার উদ্যোক্তারা নিয়ন্ত্রণ করছে।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, আজ যেখানে দুই কোরিয়া দুটো আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠেছে, আট দশক আগেও কিন্তু এই চিত্র ছিল একেবারে ভিন্ন। গত শতকের শুরুর দিকে জাপানের মাথায় সাম্রাজ্যবাদের ভূত চেপে বসে, এশিয়ার তুলনামূলক দুর্বল রাষ্ট্রগুলো একের পর এক দখল করে নিতে শুরু করে শক্তিশালী ‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি। এরই ফলাফল হিসেবে বেশ কিছু যুদ্ধের পর কোরিয়ার পতন হয়, দেশটিকে জাপান সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দেয়া হয়। তখনও কোরিয়া ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর ভাগ হয়নি, অখন্ড কোরিয়া জাপানি সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে শাসিত হচ্ছিল জাপানি শাসকদের মাধ্যমে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির পক্ষে জাপান অংশগ্রহণ করে, এবং শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। এরপর যুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তির সামনে যে বড় প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়, সেটি হচ্ছে- জাপানি সাম্রাজ্যের অন্তর্গত কোরিয়া উপদ্বীপের ভবিষ্যত কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্মত হয় যে কোরিয়াকে ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর ভাগ করা হবে এবং দুই ভাগের জনগণকে নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের সুযোগ দেয়া হবে।

গেজোলম
দুই কোরিয়ার মাঝে তীব্র বৈরিতা চলমান; image source: businesskorea.co.kr

দুই কোরিয়া একসময় নিজ নিজ মতাদর্শে উজ্জীবিত হয়ে লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। উত্তর কোরিয়া চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো কমিউনিস্ট দেশগুলোর সহযোগিতা লাভ করে, অপরদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষে জাতিসংঘের নিজস্ব বাহিনী, যেটাতে আমেরিকান সৈন্যদের আধিপত্য ছিল, সেটি লড়াই শুরু করে। তিন বছরের যুদ্ধে প্রায় বিশ লাখ মানুষের মৃত্যু ও বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ চললেও দিনশেষে যুদ্ধে কোনো ফলাফল আসেনি। ১৯৫৩ সালে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে দুই কোরিয়ার মধ্যকার ভয়ংকর সামরিক সংঘাতের ইতি টানা হয়। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, কোরীয় উপদ্বীপের সেই যুদ্ধ পুরোপুরি অবসানের জন্য এখনও পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক শান্তিচুক্তি হয়নি, কৌশলগত দিক থেকে দুই কোরিয়া এখনও যুদ্ধাবস্থায়ই আছে। ১৯৫৩ সালে কোরিয়ার প্রতিনিধিদল যে জায়গায় যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয়েছিল (দ্য কোরিয়ান আর্মিস্টিস এগ্রিমেন্ট), সেই জায়গা হচ্ছে ‘পানমুনজাম’ নামের একটি গ্রাম। বর্তমানে সেই গ্রাম দুই কোরিয়ার সীমান্তে একমাত্র শান্তিপূর্ণ জায়গা হিসেবে স্বীকৃত।

জগেহললন
দক্ষিণ কোরিয়ার সুখ্যাতি পুরো বিশ্বজুড়ে, অপরদিকে উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টি পুরো উল্টো; image source: gone2korea.com

গত কয়েক দশক ধরেই দুই কোরিয়ার মধ্যে চলমান অস্থিরতা নিরসনের জন্য দুই দেশের প্রতিনিধিদের যে স্থানে ডাকা হয়, সেটি এই পানমুনজাম। আসলে এই গ্রামকে এমনভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যাতে যেকোনো শান্তি আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে আসা প্রতিনিধিরা কোনো অস্বস্তি বোধ না করেন। এখানে উত্তর কোরিয়া কিংবা দক্ষিণ কোরিয়া- কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তারক্ষীরা কোনো বৈরিতাপূর্ণ আচরণ করতে পারবে না, এমন নিয়ম রাখা হয়েছে। যদি কখনও আপনি এই গ্রামে বেড়াতে যান, তাহলে এখানকার সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে কখনোই আপনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারবেন না যে দুই কোরিয়ার কূটনৈতিক সম্পর্ক বেশ খারাপ। কোরিয়া উপদ্বীপের আশেপাশের দেশগুলো থেকে প্রতিবছর শত শত পর্যটক এই গ্রাম ভ্রমণ করতে আসেন। এখানে বেড়াতে আসা মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ আসে দক্ষিণ কোরিয়া থেকেই, কারণ দেশটির রাজধানী সিউল থেকে এই সীমান্তবর্তী অঞ্চলের দূরত্ব মাত্র পঞ্চাশ কিলোমিটার।

কোরিয়াকে যেভাবে ৩৮° অক্ষরেখা বরাবর দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে, ঠিক একইভাবে এই পানমুনজাম গ্রামকেও সমান দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। তবে যে রেখার মাধ্যমে বিভক্ত করা হয়েছে, সেখানে দুই কোরিয়ায় উত্তেজনাপূর্ণ সীমান্তের মতো আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত নিরাপত্তারক্ষী রাখার বিধান নেই। জাতিসংঘের পতাকার আদলে সেই রেখার দুই পাশে আকাশী-নীল রঙের বিল্ডিং স্থাপন করা হয়েছে এবং মূলত এখানেই শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। শুরুতে জাতিসংঘ বিধান রেখেছিল কোনো রাষ্ট্রই এখানে পঁয়ত্রিশজনের বেশি নিরাপত্তারক্ষী রাখতে পারবে না। কিন্তু পরবর্তীতে বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দুটি দেশই নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা বাড়িয়েছে। বিভেদকারী রেখার একপাশে দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে রয়েছে ফ্রিডম হাউজ, পিস হাউজ ও সাংকেন গার্ডেনের মতো স্থাপনা, অপরদিকে উত্তর কোরিয়ার দিকে রয়েছে কিম টু সাং মনুমেন্ট এবং পানমুন প্যাভিলিয়ন।

কবকনলহলমমল
পানমুনজাম গ্রামে কিছু বিশেষ রীতিনীতি রয়েছে; image source: koreaherald.com

পানমুনজামে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। সম্প্রতি একজন উত্তর কোরিয়ান সৈন্য তার দেশ থেকে পালিয়ে পানমুনজামে প্রবেশ করেছিলেন, উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ কোরিয়ায় পালিয়ে আসা। তার উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা প্রায় চল্লিশ রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে সেই ‘ডিফেক্টর’ সৈন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছেন। এরপর তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে সেখানেই চিকিৎসা শুরু করেন এবং সুস্থতা লাভ করেন।

১৯৮৪ সালে এক রুশ ছাত্র বিভেদকারী রেখা বরাবর দৌড়ানো শুরু করলে দুই কোরিয়ার মাঝে গোলাগুলি শুরু হয়, এবং তাতে চারজন মারা গিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে উত্তর কোরিয়ার সৈন্যরা দুজন আমেরিকান সৈন্যকে হত্যা করে, যেটি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধে রূপ পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। তিনদিন ব্যাপক আলোচনা চালানোর পর পেন্টাগনের হর্তাকর্তারা প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন- উত্তর কোরিয়াকে এবার উচিত শিক্ষা দেয়া হবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত এই তিক্ততা যুদ্ধে পর্যবসিত হয়নি। সুতরাং বলা যায়, সম্প্রতি পানমুনজাম কিংবা তার কাছাকাছি এলাকাগুলোতে দুই কোরিয়ার মাঝে গোলাগুলি বা সংঘাতের ঘটনা না ঘটলেও ইতিহাসে বেশ কয়েকবারই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে দুই দেশের সৈন্যরা।

দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমাগুলোর একটি হচ্ছে ‘জে.এস.এ’ (জয়েন্ট সিকিউরিটি এরিয়া)। এই সিনেমা তৈরি হয়েছে পানমুনজামের বিখ্যাত জয়েন্ট সিকিউরিটি এরিয়াকে কেন্দ্র করে। সিনেমার পরিচালক প্রথমে পানমুনজামে শুটিংয়ের অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হন। এরপর নিজেই প্রায় আট লাখ ডলার খরচ করে পানমুনজামের অনুকরণে ‘নকল পানমুনজাম গ্রাম’ তৈরি করেন। তার নির্মিত চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়া হয় দুই কোরিয়ার প্রধান দুই নেতা কিম জং ইল এবং কিম দায়ে জুংয়ের ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকারের ঠিক আগমুহুর্তে।

হতপগপেহ
গুগল ম্যাপের মাধ্যমে ভূমি হতে বেশ উপর থেকে পানমুনজাম গ্রামের ছবি; image source: nytimes.com

পানমুনজাম এমনই এক গ্রাম, যেখানে দুই কোরিয়ার আলোচনার দ্বার সবসময় উন্মুক্ত। দুই কোরিয়ার বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের ছাপ দেখা যায় এখানেও, কিন্তু সেটি সহনীয় মাত্রায়। গ্রামটি জাতিসংঘের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে থাকায় বেশ নিরাপদ দুই পক্ষের জন্যই। দ্য কোরিয়ান আর্মিস্টিস ট্রিটির মাধ্যমে পানমুনজাম ইতোমধ্যে ইতিহাসের পাতায় স্থান পেয়েছে। সামনে যদি দুই কোরিয়ার মধ্যে কোনো ঐতিহাসিক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এখানে, তাহলে আরও একবার ইতিহাসের পাতায় নাম উঠবে এই গ্রামের।

Related Articles