পয়েন্ট রবার্টস: যুক্তরাষ্ট্রের যে জায়গায় পাড়ি দিতে হয় কানাডার সীমান্ত!

মনে করুন, ‘ক’ ও ‘খ’ আলাদা দুটি রাষ্ট্র। এখন, কোনো একটি ভূখণ্ডকে যদি ‘ক’ রাষ্ট্রের অংশ বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং সেই ভূখণ্ডের চারপাশে যদি ‘খ’ রাষ্ট্রের ভূখন্ডের অংশ থাকে, সেক্ষেত্রে ‘ক’ রাষ্ট্রের সেই ভূখণ্ডকে ‘এক্সক্লেভ’ বলা হবে।

এটা তো গেল এক্সক্লেভের কথা। ‘পিনি এক্সক্লেভ’ এর চেয়েও একটু অন্যরকম ব্যাপার। ‘ক’ রাষ্ট্রের যে ভূখণ্ড ‘খ’ দ্বারা পরিবেষ্টিত বিধায় তাকে এক্সক্লেভ বলা হচ্ছে, সেটা যদি ‘ক’ রাষ্ট্রের সাথে কোনোভাবে সংযুক্ত থাকে, এবং তারপরও সেখানে পৌঁছতে হলে ‘খ’ রাষ্ট্রকে অতিক্রম করতে হয়, সেক্ষেত্রে সেই ভূখণ্ডটিকে পিনি এক্সক্লেভ বলা হয়।

একটু কঠিন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা? তাহলে এটাকে সহজ করে বোঝানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ‘পয়েন্ট রবার্টস’ এর চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হতে পারে না। ১,৩১৪ জন মানুষের এই বাসস্থানটিতে (২০১০ সালের আদমশুমারী অনুসারে) পৌঁছতে হলে আপনাকে কানাডার মধ্য দিয়ে ৪০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হবে। ওয়াশিংটনের সাথে সমুদ্র ও আকাশসীমার আওতায় থাকা এই ভূখণ্ডের ডাকঘরও ওয়াশিংটন। কিন্তু, তারপরও সরাসরি ওয়াশিংটন থেকে পয়েন্ট রবার্টসে যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই।

দুই দেশের পতাকাই উড়ছে; Photo Source: The point guy

শুরুটা যেভাবে …

সবসময় যে পয়েন্ট রবার্টস এমন অবস্থায় ছিল তা নয়। ১৯ শতকে ওরেগন চুক্তি হওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য নিজেদের সীমানা সংক্রান্ত দীর্ঘকালীন ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে ‘প্যাসিফিক নর্থওয়েস্ট আমেরিকান-কানাডিয়ান বর্ডার ডিসপিউট’ এর মাধ্যমে। ৪৯ তম একটি প্যারালাল লাইন টেনে দেওয়া হয় দুই দেশের মধ্য দিয়ে। কিন্তু, এত বড় বড় স্থানের ভীড়ে পয়েন্টস রবার্টসের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সবাই।

বিবাদের শুরুটা অবশ্য পয়েন্ট রবার্টস নয়, ১৮১২ সালে ভ্যানকুভারকে ঘিরেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার মধ্যকার সীমানা সংক্রান্ত সমস্যা দূর করতে কাল্পনিক লাইন টেনে দেওয়া হয় দুটো দেশের মধ্যে। ভ্যানকুভার দ্বীপটিই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে দ্বীপের ‘লাইন অব ল্যাটিচিউড’ বিভক্ত করা হবে, নাকি পুরো দ্বীপটিই কানাডাকে দিয়ে দেওয়া হবে সেটা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। অনেক ঝামেলার পর একটা সময় ভ্যানকুভার দ্বীপ কানাডাকে এবং সান জুয়ান দ্বীপ যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতসব আলোচনার মধ্যে সবার চোখের আড়ালে চলে যায় ছোট্ট একটি স্থান, পয়েন্ট রবার্টস। নতুন এই সমস্যার শুরু সেখান থেকেই।

যুক্তরাষ্ট্রের এই স্থানে যেতে হলে পার করতে হয় কানাডা; Photo Source:Sailish.com

সীমানা টানার পর থেকেই পয়েন্টস রবার্ট কার সেটা নিয়ে কথা চলেছে। কানাডা এবং যুক্তরাজ্য এই ভূখণ্ডকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে নিতে চেয়েছে। কিন্তু, কোনো কিছুতেই কোনো লাভ হয়নি। এখনও অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়ে গিয়েছে পয়েন্ট রবার্টস।

‘পয়েন্ট রবার্টস’ যেভাবে ‘পয়েন্ট রবার্টস’ হলো

পয়েন্ট রবার্টস নামে যে স্থানটিকে আমরা আজ চিনি সেটি প্রথম দেখেছিলেন ফ্রাঞ্চিস্কো ডি এলিজা। সেটা ১৭৯১ সালের কথা। এরপর ১৭৯২ সালে জর্জ ভ্যানকুভার (ব্রিটিশ অভিযান) এবং গ্যালিয়ানো (স্প্যানিশ অভিযান) একইসাথে পয়েন্ট রবার্টসে আসেন, এটি যে কোনো দ্বীপ নয় সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হন এবং এ স্থান সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য নিয়ে একত্রে কাজ করেন। ভ্যানকুভারের কাছ থেকেই নিজের নাম পায় পয়েন্ট রবার্টস। নিজের বন্ধু হেনরি রবার্টসের নামানুসারে স্থানটির নাম পয়েন্ট রবার্টস রাখেন তিনি। ভ্যানকুভারের আগে এই অভিযানটি পরিচালনা করছিলেন রবার্টস। বন্ধু ও সঙ্গীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তিনি এভাবেই।

কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের সীমানা; Photo Source: splinternews.com

১৮৪৬ সালে এই বিভাজন হয়। এরপর কিন্তু এমন না যে, ১২.৬৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের পয়েন্ট রবার্টস নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা ছিলো না। বসতিও এখানে সবসময় ছিল। মানুষ তো বটেই, সাথে পাখি, তিমি আর নানারকম সামুদ্রিক প্রাণীর রাজত্ব পয়েন্ট রবার্টস। ১৯০৮ সালে আইসল্যান্ড থেকে আসা অভিবাসীদেরও স্থান দেয় এখানে যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে পয়েন্ট রবার্টসকে বনে ঘেরা একটি গ্রাম্য অঞ্চল বলা যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, কানাডার ভ্যানকুভারে প্রতিদিন জনসংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় তাদের অবসর কাটানোর প্রিয় স্থান হয়ে পড়েছে পয়েন্ট রবার্টস।

অবশ্য, কানাডা আর পয়েন্ট রবার্টসের সীমারেখা খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না। সীমারেখা দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই যে এটি দুটি দেশের সীমান্ত। বরং, অনেকটা দুটি বাড়ির মধ্যে যে সীমানা না দিলেই নয়, এটিও ঠিক তেমন। সাধারণ ড্রেনের প্রক্রিয়ায় যে সিমেন্টের পাকা প্রলেপ দেওয়া হয়, এটাও তেমন। শুধু কয়েক ইঞ্চি বড় শুধু।

পয়েন্ট রবার্টস নিয়ে কথা অবশ্য কম ওঠেনি। অনেকেই ভাবেন, পয়েন্ট রবার্টস স্বাক্ষীদের আস্তানা। যুক্তরাষ্ট্রকে সাহায্য করে যে মানুষগুলো অপরাধীদের বিরুদ্ধে স্বাক্ষ্য দেন, তাদেরকে রাষ্ট্র নতুন নাম ও ঠিকানা দেন। সেই ঠিকানার একটি পয়েন্ট রবার্টস। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পয়েন্ট রবার্টসে প্রবেশ করতে হলে যে কাউকে মোট দুটি আন্তর্জাতিক সীমানা পার হতে হবে। প্রথমটি হলো কানাডার, দ্বিতীয়টি যুক্তরাষ্ট্রের। আর কানাডা সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের ব্যাপারে অসম্ভব সতর্ক। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তারপর তারা কোনো মানুষকে নিজেদের সীমানায় প্রবেশ করার অনুমতি প্রদান করে। তাই পয়েন্ট রবার্টসে একজন অপরাধী সহজে প্রবেশ করতে পারবে না। ওয়াশিংটনের মধ্যে সবচেয়ে কম সন্ত্রাসী কার্যক্রম হয় এই পয়েন্ট রবার্টসে।

পয়েন্ট রবার্টসে সন্ত্রাসী কার্যক্রম অনেক কম; Photo Source:Marinas.com

কী আছে পয়েন্ট রবার্টসে?

এই কথার উত্তরে বলা উচিৎ যে, ঠিক কী নেই এই ছোট্ট ভূখণ্ডটিতে! একটি ক্লিনিক, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি ফায়ার স্টেশন, পুলিশ স্টেশন, মেরিনা, গ্রন্থাগার এবং ছোট ছোট অনেকগুলো বাড়িঘর- মোটকথায় বসবাসের যোগ্য সবকিছুই আছে স্থানটিতে।

প্রতিদিনই কানাডা থেকে প্রচুর মানুষ কেনাকাটার জন্য, গাড়ির গ্যাস ভরতে, এমনকি বার্গার খেতেও চলে আসেন পয়েন্ট রবার্টসে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার তুলনায় এখানে খাবারের দাম বেশ কম। তবে, নেতিবাচক দিকও যে নেই এখানে তা নয়। যেকোনো সাধারণ কাজেও বছরের পর বছর লেগে যায় পয়েন্ট রবার্টসে। সামান্য একটি সড়কবাতি ঠিক করতেও সময় লাগে প্রায় দুই বছর। সাধারণ অনেক চাহিদা পূরণের দ্রব্য এখানে নেই। পড়াশোনা করতেও সীমানা পেরিয়ে ঘন্টাখানেক ভ্রমণ করে বাইরে যেতে হবে আপনাকে। তবে তারপরও অবস্থানগত কারণে পয়েন্ট রবার্টস একেবারেই আলাদা এবং সবার কাছে জনপ্রিয়। একটু শান্তিতে সময় কাটানোর জন্য একদম ঠিকঠাক এই স্থানে আপনি যেমন কানাডার ছোঁয়া পাবেন, তেমনই পাবেন যুক্তরাষ্ট্রকেও।

পয়েন্ট রবার্টসের ডাকঘর; Photo Source: Wikimedia Commons

হয়তো এই চুক্তি, কিংবা  সীমানা- এসব কিছুই খুব একটা অর্থ বহন করে না। কিন্তু, বইয়ের পাতায় আর আইনের ধারায় দেখতে গেলে খুব সহজেই আপনার চোখে পড়বে যে, সামান্য একটি লাইন কীভাবে পুরো একটা স্থানের ভাগ্য বদলে দিয়েছে। রাজনৈতিক এই কথোপকথন হয়তো খুব সামান্য ও সহজ ছিল। কিন্তু, চার দেয়ালের মধ্যে নেওয়া এই সিদ্ধান্ত বদলে দিয়েছে বহু মানুষের জীবন। জটিল করে তুলেছে অনেক হিসাব-নিকাশ। এমন বাস্তবতার প্রত্যক্ষ এক উদাহরণ হলো পয়েন্ট রবার্টস।

বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

This article is written on the place 'Point Roberts' which is under the USA sovereignty and to reach there crossing Canada is the only way.

Featured Photo: The point guy

Related Articles