Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইরানে নৃগোষ্ঠীগত জাতীয়তাবাদ (পর্ব–২): ইরানের পরিণতি কি সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো হতে যাচ্ছে?

ইরান একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র, এবং স্বভাবতই অন্যান্য বহুজাতিক রাষ্ট্রের মতো ইরানের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে দেশের অভ্যন্তরে বসবাসকারী জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের বিস্তার। পারসিকরা ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি, এবং দেশটির জনসংখ্যায় তাদের হার প্রায় ৫৩%। দেশটির দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহত্তম জাতি হচ্ছে যথাক্রমে আজারবাইজানি ও কুর্দিরা। স্বভাবতই আজারবাইজানিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিস্তার এবং দীর্ঘদিনব্যাপী বিরাজমান কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদ ইরানি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য বিরাট হুমকি। কিন্তু শুধু এই দুইটি জাতির বিচ্ছিন্নতাবাদই ইরানের অখণ্ডতার জন্য একমাত্র হুমকি নয়।

ইরান একটি বিশাল দেশ, এবং দেশটির নানা প্রান্তে বিভিন্ন জাতি বসবাস করে। তাদের বড় একটি অংশের নিজস্ব জাতিগত (এবং ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয়) পরিচিতি রয়েছে, এবং এদের মধ্যেও কমবেশি জাতীয়তাবাদ/বিচ্ছিন্নতাবাদের বিস্তার ঘটেছে। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদও ইরানের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও স্থিতিশীলতার জন্য কম মারাত্মক হুমকি নয়। বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে ইরানের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা নেহায়েত কম নয়, এবং তাদের অনেকেই ইরানের এই ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে বা করে যাচ্ছে।

বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদ

বালুচরা একটি ইন্দো–ইরানীয় জাতি, যারা বালুচি ভাষায় কথা বলে এবং যারা মূলত সুন্নি ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ঐতিহাসিক বালুচিস্তানের ভূমি বর্তমানে ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বিভক্ত। বালুচ জাতীয়তাবাদীদের দৃষ্টিকোণ থেকে, পাকিস্তানের বালুচিস্তান প্রদেশ হচ্ছে ‘পূর্ব বালুচিস্তান’, আর ইরানের সিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশ হচ্ছে ‘পশ্চিম বালুচিস্তান’। প্রচলিত তথ্য অনুযায়ী, ইরানে প্রায় ২০ লক্ষ জাতিগত বালুচ বসবাস করে। কিন্তু বালুচ জাতীয়তাবাদীদের মতে, এই সংখ্যাটি ৪০ লক্ষের ওপরে। বালুচরা পারসিকদের মতোই একটি ইন্দো–ইরানীয় জাতি, কিন্তু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য বিদ্যমান। পারসিকরা মূলত শিয়া ইসলামের অনুসারী, কিন্তু বালুচরা প্রধানত সুন্নি ইসলামের অনুসারী, যদিও বালুচদের মধ্যে কিছু শিয়া ইসলামের অনুসারীও রয়েছে।

ইরানি বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আল কায়েদার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ধারণা করা হয়; Source: The Iran Primer

ঐতিহাসিক বালুচিস্তানের ভূমির অংশবিশেষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেন ও ইরান বালুচিস্তানকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়, এবং বালুচিস্তানের পশ্চিমাংশ ইরানের ও পূর্বাংশ ব্রিটিশ–শাসিত ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে ইরানি বালুচিস্তানের বালুচরা ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, কিন্তু ইরানি সরকার ব্রিটিশ সহযোগিতায় এই বিদ্রোহ দমন করে। বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইরান জুড়ে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, এবং এই সুযোগে পশ্চিম বালুচিস্তান কার্যত স্বাধীন হয়ে পড়ে। পশ্চিম বালুচিস্তানের শাসকেরা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘শাহ–ই–বালুচিস্তান’ উপাধি গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯২৮ সালে ইরানি সৈন্যরা পশ্চিম বালুচিস্তান আক্রমণ ও দখল করে, এবং বালুচিস্তানের শাসক মীর দোস্ত মোহাম্মদ খানকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। পাহলভি বংশের শাসনামলে ইরানে পারসিক জাতীয়তাবাদ ও শিয়া ইসলামের ওপর জোর দেয়া হয়, ফলে স্বভাবতই সেখানে সুন্নি বালুচদের স্থান ছিল সামান্য।

১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর বালুচদের প্রতি ইরানি সরকারের নীতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। উল্টো ১৯৮১ সালে ইরানি সরকার বালুচ রাজনৈতিক ও অন্যান্য কর্মীদের ওপর নানান রকম দমন–পীড়ন শুরু করে। শিয়া–নিয়ন্ত্রিত ইরানি সরকার সুন্নি বালুচদের প্রতি সহানুভূতিশীল নয়। কার্যত জীবনযাত্রার মান, সাক্ষরতার হার, গড় আয়ু, পানি সরবরাহ, শিশু মৃত্যুর হার– এরকম প্রতিটি দিক ইরানের ৩১টি প্রদেশের মধ্যে সিস্তান ও বালুচিস্তান প্রদেশটির অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। প্রদেশটি তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস, স্বর্ণ, তামা, ইউরেনিয়াম প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রদেশটিতে দারিদ্র সর্বব্যাপী। এই পরিস্থিতির ফলে পশ্চিম বালুচিস্তানে নানা ধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের উৎপত্তি ঘটেছে, যাদের মধ্যে বালুচ নৃগোষ্ঠীগত জাতীয়তাবাদী থেকে আরম্ভ করে সালাফিপন্থী– নানান আদর্শিক ধারা বিদ্যমান।

২০০৩–২০০৪ থেকে সিস্তান ও বালুচিস্তানে ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা লড়াই করছে, যদিও এই লড়াইয়ের মাত্রা খুব তীব্র নয়। প্রাথমিকভাবে ‘জান্দাল্লাহ’ গ্রুপটি এই লড়াইয়ের ধ্বজাধারী ছিল, কিন্তু সেটির বিলুপ্তির পর ‘আনসার আল–ফুরকান’ ও ‘জাইশ আল–আদল’ গ্রুপ দুইটি এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। এই গ্রুপগুলোর সঙ্গে ‘আল কায়েদা’র যোগাযোগ রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এখন পর্যন্ত বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে শত শত ইরানি সৈন্য নিহত হয়েছে, এবং এদের মধ্যে ইরানি সামরিক বাহিনীর কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাও রয়েছেন। ইরানি সরকারের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও আরো কিছু রাষ্ট্র এই গ্রুপগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে।

২০১৯ সালে একজন সুন্নি বালুচ ধর্মীয় নেতাকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ইরানি বালুচরা রাস্তা অবরোধ করছে; Source: Radio Farda

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইরানের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলীয় প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানেও বালুচ জাতীয়তাবাদীরা সক্রিয়, এবং তারাও পাকিস্তান থেকে বালুচিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। এজন্য বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনের ক্ষেত্রে ইরান ও পাকিস্তান পরস্পরকে সহযোগিতা করে থাকে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বালুচ ইস্যু নিয়ে রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে বেশ কয়েকবার দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে।

আরব জাতীয়তাবাদ

ইরানে বর্তমানে প্রায় ১৬ লক্ষ আরব বসবাস করে, এবং তাদের সিংহভাগ তেলসমৃদ্ধ খুজেস্তান প্রদেশে বসবাস করে। খুজেস্তান প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে আরবদের সংখ্যাই সর্বাধিক, কিন্তু আরবরা সেখানে এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। খুজেস্তানি আরব গোত্রগুলো ৭ম শতাব্দীতে আরবদের ইরান বিজয়ের সময় ইরানে বসতি স্থাপন করেছিল, এবং তারা এখন পর্যন্ত তাদের জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। ইরানি আরবদের মধ্যে সিংহভাগই শিয়া ইসলামের অনুসারী, কিন্তু তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক সুন্নিও রয়েছে। ইরানি আরবরা সাধারণভাবে ইরানি রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত, কিন্তু অভিযোগ রয়েছে যে, ইরানি সরকার ইরানি আরবদের প্রতি পদ্ধতিগতভাবে বৈষম্য করে থাকে।

পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিক পর্যন্ত খুজেস্তানে ইরানি রাষ্ট্রকাঠামোর অভ্যন্তরে একটি স্বায়ত্তশাসিত আরব রাষ্ট্র ছিল, যেটির নাম ছিল ‘আরবিস্তান আমিরাত’। কিন্তু ১৯২০–এর দশকে পাহলভি বংশ ইরানের শাসনক্ষমতা লাভ করে এবং ইরানের প্রান্তিক স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলগুলোর স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে কঠোর এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা প্রণয়ন করে। এর ফলে ১৯২২ সালে আরবিস্তানে বিদ্রোহ দেখা দেয়, কিন্তু ১৯২৪ সালের মধ্যে ইরানি সৈন্যরা এই বিদ্রোহ দমন করে, এবং ১৯২৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আরবিস্তানের বিলুপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে খুজেস্তানে কতিপয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরব বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সৃষ্টি হয়। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর খুজেস্তানে পুনরায় একটি বিদ্রোহ দেখা দেয় এবং ইরানের তদানীন্তন প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্র ইরাক এই বিদ্রোহে সমর্থন প্রদান করে, কিন্তু বিদ্রোহটি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

ইরানি আরবরা ইরানি সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করছে; Source: Fikra Forum

১৯৮০ সালে ইরানি আরব বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ ‘আরবিস্তান মুক্তি গণতান্ত্রিক বিপ্লবী দল’ ব্রিটেনের লন্ডনে অবস্থিত ইরানি দূতাবাসের কর্মীদের জিম্মি করে, কিন্তু ব্রিটিশ ‘স্পেশাল এয়ার সার্ভিসে’র হস্তক্ষেপে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। ১৯৮০–১৯৮৮ সালে ইরান–ইরাক যুদ্ধ চলাকালে ইরাকি সৈন্যরা খুজেস্তানের অংশবিশেষ দখল করে নেয়, এবং ইরাকি সরকার খুজেস্তানের অধিবাসীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাব ছড়ানোর চেষ্টা করে, কিন্তু এই প্রচেষ্টাটি বিশেষ সাফল্য অর্জন করেনি। অবশ্য ১৯৯০–এর দশকে ইরানি আরবদের মধ্যে নতুন কয়েকটি বিচ্ছিন্নতাবাদী দলের সৃষ্টি হয়, এবং সৌদি আরব এদেরকে সহায়তা প্রদান করছে বলে জানা যায়। ইরানি সরকার এই দলগুলোকে সমর্থন প্রদানের দায়ে অন্যান্য রাষ্ট্রকেও (যেমন: ইসরায়েল) দায়ী করেছে।

ইরানি সরকারের দাবি অনুযায়ী, ইরানি আরবদের প্রতি কোনোধরনের বৈষম্য করা হয় না, এবং ইরানি আরবদের সঙ্গে তাদের কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে ইরানি আরব বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ইরানের অভ্যন্তরে বেশ কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করেছে, এবং এর ফলে অন্তত কয়েক শত মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। তদুপরি, খুজেস্তানি আরবরা বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ মিছিলের আয়োজন করেছে। উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ইরানের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে এই রাষ্ট্রগুলো ইরানি আরবদের পক্ষে বক্তব্য রাখছে এবং ইরানি আরব বিচ্ছিন্নতাবাদকে উস্কে দিচ্ছে। এর ফলে ইরানি আরব জাতীয়তাবাদ ইরানি রাষ্ট্রের ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তুর্কমেন জাতীয়তাবাদ

তুর্কমেনরা বৃহত্তর তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত একটি জাতি, এবং তারা তুর্কমেনিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান ও অন্যান্য রাষ্ট্র বসবাস করে। ইরানে প্রায় ১০ থেকে ১৬ লক্ষ জাতিগত তুর্কমেন বসবাস করে, এবং উত্তর–পূর্ব ইরানের যে অঞ্চলটিতে তুর্কমেনরা প্রধানত বসবাস করে, সেটি ‘তুর্কমেন সাহরা’ বা ‘তুর্কমেন স্তেপ’ নামে পরিচিত। ইরানের গোলেস্তান প্রদেশের অধিবাসীদের মধ্যে তুর্কমেনরা সংখ্যায় সর্বাধিক, এবং উত্তর খোরাসান ও রাজাভি খোরাসান প্রদেশদ্বয়েও তাদের উপস্থিতি রয়েছে। ইরানি তুর্কমেনদের সিংহভাগ সুন্নি ইসলাম ধর্মের অনুসারী। অর্থাৎ, জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ইরানি তুর্কমেনরা পারসিকদের চেয়ে পৃথক। ইরানি তুর্কমেনরা একসময় প্রধানত যাযাবর ছিল, কিন্তু বর্তমানে তাদের মধ্যে ব্যাপক হারে শহুরে জীবনধারা গ্রহণ ও পারসিকীকরণ (Persianization) প্রক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

ইরানের মানচিত্রে তুর্কমেন সাহরা/তুর্কমেন স্তেপ অঞ্চল (লাল চিহ্নিত); Source: Wikimedia Commons

তুর্কমেনরা ছিল মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ যাযাবর জাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম, এবং দীর্ঘদিন পর্যন্ত তারা ইরানি শাসকদের কর্তৃত্ব স্বীকার থেকে বিরত ছিল। ১৮৮০–এর দশকে রুশরা বর্তমান তুর্কমেনিস্তান দখল করে নেয়, এবং এর ফলে তুর্কমেন জাতি ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯২৪ সালে ইরানি সরকারের কঠোর কেন্দ্রীয়করণ (centralization) নীতির বিরুদ্ধে ইরানি তুর্কমেনরা বিদ্রোহ করে, কিন্তু ১৯২৬ সালের মধ্যে ইরানি সৈন্যরা এই বিদ্রোহ দমন করতে সক্ষম হয়। ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানি তুর্কমেনরা আঞ্চলিক ও জাতিগত স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করে, কিন্তু ইরানের নতুন সরকার এই দাবি উপেক্ষা করে এবং তুর্কমেন রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর নিষ্পেষণ চালায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের ফলে তুর্কমেনিস্তান একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়, এবং এর ফলে ইরানি তুর্কমেনদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার ব্যাপক বিস্তার ঘটে।

কিন্তু তুর্কমেনিস্তানের শাসকশ্রেণি জাতীয়তাবাদ বা সম্প্রসারণবাদের তুলনায় নিজস্ব খামখেয়ালি কার্যক্রম পরিচালনায় বেশি ব্যস্ত ছিল, এবং তাদের গৃহীত ‘চিরস্থায়ী নিরপেক্ষতা’র নীতি অনুযায়ী তারা কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে শত্রুতায় লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকে। এর ফলে বৈদেশিক সমর্থনের অভাবে ইরানি তুর্কমেন জাতীয়তাবাদ ক্রমশ স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইরানি সরকার তুর্কমেনদের পারসিক ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ এবং পারসিক সমাজব্যবস্থায় অঙ্গীভূতকরণে উৎসাহিত করতে থাকে। এর ফলে বর্তমানে ইরানি তুর্কমেনদের মধ্যে কোনো উল্লেখযোগ্য জাতীয়তাবাদী/বিচ্ছিন্নতাবাদী/স্বায়ত্তশাসনবাদী আন্দোলন নেই।

কিন্তু সম্প্রতি তুরস্ক ‘বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী’ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করতে শুরু করেছে, এবং ইতোমধ্যেই বিশ্লেষকরা ধারণা করতে শুরু করেছেন যে, তুরস্ক ইরানে বসবাসকারী বৃহত্তর তুর্কি জাতিভুক্ত জনগোষ্ঠীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী/বিচ্ছিন্নতাবাদী মনোভাবের বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাবে। ইরানি তুর্কমেনদের অতীতে ইরানি সরকারের বিরুদ্ধ বিদ্রোহ/বিক্ষোভ করার নজির রয়েছে, এবং ভবিষ্যতে সুদৃঢ় বৈদেশিক সমর্থন পেলে এই ঘটনার যে পুনরাবৃত্তি ঘটবে না, এরকম কোনো নিশ্চয়তা নেই। এর ফলে তুর্কমেন জাতীয়তাবাদ ইরানের অখণ্ডতার জন্য একটি সুপ্ত হুমকি।

অন্যান্য প্রচ্ছন্ন ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ

আজারবাইজানি, কুর্দি, বালুচ, আরব ও তুর্কমেনরা ছাড়াও ইরানে নানাবিধ ইন্দো–ইরানীয় ও বৃহত্তর তুর্কি জাতিভুক্ত মানুষ বসবাস করে, কিন্তু এই জাতিগুলো বহির্বিশ্বে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেনি। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ইন্দো–ইরানীয় মহাজাতিভুক্ত লুর, গিলাক, মাজান্দারানি, তালিশ ও তাৎ জাতি, এবং বৃহত্তর তুর্কি মহাজাতিভুক্ত খোরাসানি তুর্কি ও কাশকাই জাতি। ইরানে প্রায় ৫০ লক্ষ লুর, প্রায় ৪০ লক্ষ গিলাক, প্রায় ৪০ লক্ষ মাজান্দারানি, প্রায় ১০ লক্ষ খোরাসানি তুর্কি, প্রায় ৮ লক্ষ কাশকাই, প্রায় ৬ লক্ষ তালিশ এবং প্রায় ৩ লক্ষ তাৎ জাতিভুক্ত মানুষের বসবাস। এই জাতিগুলোর প্রতিটিই শিয়া ইসলামের অনুসারী। ইরানি সরকার গিলাকি ও মাজান্দারানিদের পারসিক জাতির অংশ হিসেবে বিবেচনা করে, কিন্তু সব নৃতত্ত্ববিদ এই শ্রেণিবিন্যাসের সঙ্গে একমত নন। অন্যদিকে, কাশকাই জাতি মূলত বিভিন্ন তুর্কি গোত্রের একটি সমষ্টি।

ইরানি রাষ্ট্র ভেঙে যে নতুন রাষ্ট্রগুলোর সৃষ্টি হতে পারে তার একটি মানচিত্র; Source: Wikimedia Commons

ইরানের ৩টি প্রদেশে (কোঘিলুয়েহ ও বোয়ের–আহমেদ, বাহার মাহাল ও বখতিয়ারি এবং লুরিস্তান) প্রদেশে জাতিগত লুররা সংখ্যাগরিষ্ঠ, এবং খুজেস্তান প্রদেশেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লুর বসবাস করে। এর ফলে লুর জাতীয়তাবাদের বিস্তারের তেহরানের জন্য একটি বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। গিলাক ও মাজান্দারানিরা যথাক্রমে ইরানের গিলান ও মাজান্দারান প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জাতি, এবং গিলাকদের ইতিপূর্বে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার (১৯২০–এর দশকে গঠিত গিলান সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র) ইতিহাস রয়েছে। ইরানে বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদের বিস্তারের ফলে তুর্কমেনদের মতো খোরাসানি তুর্কি ও কাশকাইদের মধ্যেও বিচ্ছিন্নতাবাদের সৃষ্টি হতে পারে। অন্যদিকে, তালিশরা ইতিপূর্বে ১৯২০ ও ১৯৯০–এর দশকে আজারবাইজানের অভ্যন্তরে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করেছিল, এবং ইরানেও তালিশ জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে পড়া অসম্ভব কিছু নয়।

সামগ্রিকভাবে, বহুজাতিক ইরানে নৃগোষ্ঠীগত জাতীয়তাবাদের বিস্তার ইরানের ভৌগোলিক অখণ্ডতাকে হুমকির সম্মুখীন করবে, এই সম্ভাবনা প্রবল। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও সৌদি আরব ইরানের বিভিন্ন জাতির মধ্যে জাতীয়তাবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনগুলোকে সমর্থন প্রদান করে আসছে। সম্প্রতি তুরস্কও সক্রিয়ভাবে এই দলে শামিল হয়েছে, এবং ভবিষ্যতে আজারবাইজান ও তুর্কমেনিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলোও এই প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সামাজিক অবক্ষয় এবং ক্রমবর্ধমান বৈদেশিক চাপ এমনিতেই ইরানি সরকারকে প্রবল চাপের মধ্যে রেখেছে। এমতাবস্থায় ইরানি সরকারের জাতীয়তা নীতি (nationality policy) যদি যথার্থ না হয় এবং যদি ইরানি সরলার দেশটির জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সংক্রান্ত সমস্যাগুলো যথাসময়ে সমাধান করতে সমর্থ না হয়, সেক্ষেত্রে সুদূর ভবিষ্যতে ইরানের পরিণতিও প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো হতে পারে।

Related Articles