Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বহির্বিশ্বে রুশ সামরিক ঘাঁটি: ইসিক–কুল হ্রদ থেকে দনেস্তর নদী

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বহির্বিশ্বে মস্কোর সামরিক উপস্থিতি ব্যাপক হারে হ্রাস পায়। কিন্তু প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটিতে মস্কোর সামরিক উপস্থিতি বজায় থাকে কিংবা সাময়িক বিরতির পর নতুন করে রুশ সামরিক উপস্থিতি স্থাপিত হয়। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, দক্ষিণ ওসেতিয়া এবং প্রিদনেস্ত্রোভিয়ে। অবশ্য শেষোক্ত রাষ্ট্র দুইটি কার্যত স্বাধীন হলেও এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাপকভাবে স্বীকৃতি লাভ করেনি এবং যথাক্রমে জর্জিয়া ও মলদোভা উক্ত ভূখণ্ড দুটির মালিকানা দাবি করে থাকে।

কিরগিজস্তান: রুশ সমন্বিত সামরিক ঘাঁটি

মধ্য এশীয় মুসলিম ও বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত স্থলবেষ্টিত পার্বত্য রাষ্ট্র কিরগিজস্তান প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র ছিল এবং কিরগিজস্তানের ভূখণ্ডে বিস্তৃত সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কিরগিজস্তানি ভূখণ্ডে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সামরিক ইউনিটগুলো সাধারণভাবে নবগঠিত কিরগিজস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এর ফলে সদ্য স্বাধীন কিরগিজস্তানে কোনো রুশ সামরিক ঘাঁটি ছিল না। অবশ্য ১৯৯২ সাল থেকে কিরগিজস্তান রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’র সদস্য এবং ১৯৯৩ সালে রাশিয়া ও কিরগিজস্তানের মধ্যে সম্পাদিত একটি চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া তাত্ত্বিকভাবে কিরগিজস্তানি ভূখণ্ডে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অধিকার লাভ করে। উল্লেখ্য, এসময় কিরগিজস্তানি সরকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত, ক্ষুদ্র ও দুর্বল কিরগিজস্তানকে চীনা সম্প্রসারণবাদ থেকে নিরাপদ রাখার উদ্দেশ্যে চীনা–কিরগিজস্তানি সীমান্তে রুশ সীমান্তরক্ষী মোতায়েন করার জন্য রাশিয়াকে প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু এই প্রস্তাবনা ফলপ্রসূ হয়নি।

২০০১ সালে কিরগিজস্তানের রাজধানী বিশকেকের কাছে অবস্থিত মানাস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে একটি মার্কিন বিমানঘাঁটি স্থাপিত হয় এবং মার্কিন প্রভাব বলয়ে কিরগিজস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে রাশিয়া ২০০৩ সালে কিরগিজস্তানের কান্ত শহরের কাছে একটি সোভিয়েত–নির্মিত বিমানঘাঁটি পুনরায় ব্যবহার করতে আরম্ভ করে এবং কিরগিজস্তান উক্ত ঘাঁটিটিকে ১৫ বছরের জন্য রাশিয়ার কাছে ইজারা প্রদান করে। আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ বিমানবাহিনীর ‘৯৯৯তম বিমানঘাঁটি’ নামে পরিচিত এই বিমানঘাঁটি সিএসটিওর ‘কালেক্টিভ র‍্যাপিড রিঅ্যাকশন ফোর্সে’র (রুশ: Коллективные силы оперативного реагирования, ‘কোল্লেক্তিভনিয়ে সিলি অপেরাতিভনোগো রেয়াগিরোভানিয়া’) একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত। এই ঘাঁটিটি ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিদেশি ভূখণ্ডে স্থাপিত প্রথম রুশ বিমানঘাঁটি। এই ঘাঁটিটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মধ্য এশিয়ার আকাশসীমা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং মিলিট্যান্টদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করা।

কান্ত বিমানঘাঁটি থেকে উড্ডয়নের পর রুশ বিমানবাহিনীর ‘সুখোই সু–২৭’ যুদ্ধবিমান; Source: Vyacheslav Oseledko/AP Photo via TASS

কান্ত বিমানঘাঁটি বাদে কিরগিজস্তানি ভূখণ্ডে আরো কয়েকটি রুশ সামরিক স্থাপনা রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রুশ নৌবাহিনীর ‘৩৩৮তম যোগাযোগ কেন্দ্র’, ‘৯৫৪তম সাবমেরিন–বিধ্বংসী অস্ত্র পরীক্ষণ কেন্দ্র’, এবং ‘স্বয়ংক্রিয় সিজমিক স্টেশন এন১৭’। কিরগিজস্তানের কারা–বালতা শহরের নিকটে অবস্থিত ‘৩৩৮তম যোগাযোগ কেন্দ্র’টির সাহায্যে রুশ নৌবাহিনী ভারতীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরদ্বয়ে অবস্থানরত রুশ যুদ্ধজাহাজ ও সাবমেরিনগুলোর সঙ্গে বেতার যোগাযোগ রক্ষা করে এবং এতদঞ্চলে ইলেক্ট্রনিক রিকনিস্যান্স ও ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার পরিচালনা করে। কিরগিজস্তানের কারাকোল শহরের কাছে ইসিক–কুল হ্রদের তীরে অবস্থিত ‘৯৫৪তম সাবমেরিন–বিধ্বংসী অস্ত্র পরীক্ষণ কেন্দ্রে’ রুশরা তাদের নির্মিত টর্পেডোগুলোর পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে। আর কিরগিজস্তানের মাইলু–সু শহরের কাছে অবস্থিত সিজমিক স্টেশনের সাহায্যে রুশরা অন্যান্য রাষ্ট্রের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা–নিরীক্ষা ও ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করে এবং এর পাশাপাশি ভূমিকম্পও পরিমাপ করে থাকে।

২০১২ সালে কিরগিজস্তানি সরকার রাশিয়ার নিকট প্রদত্ত কান্ত বিমানঘাঁটির ইজারার মেয়াদ ৪৯ বছরে উন্নীত করে। এসময় রাশিয়া কিরগিজস্তানে অবস্থিত রুশ সামরিক স্থাপনাগুলোর সমন্বয়ে রাষ্ট্রটিতে একটি ‘সমন্বিত সামরিক ঘাঁটি’ স্থাপন করে এবং এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রটিতে রুশ সামরিক উপস্থিতিকে সুসংহত করে। অন্যদিকে, ২০১৪ সাল পর্যন্ত কিরগিজস্তান একটি ব্যতিক্রমধর্মী অবস্থানে ছিল, কারণ রাষ্ট্রটির ভূখণ্ডে রাষ্ট্রটির সরকারের অনুমোদনক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয় বৃহৎ শক্তির সামরিক ঘাঁটি ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্র কিরগিজস্তানে অবস্থিত তাদের বিমানঘাঁটিটি বন্ধ করে দেয় এবং এর ফলে বর্তমানে কিরগিজস্তানি ভূখণ্ডে কেবল রুশ সামরিক ঘাঁটি বিদ্যমান রয়েছে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে তদানীন্তন কিরগিজস্তানি সরকার ভবিষ্যতে কিরগিজস্তানে রুশ সামরিক ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়ার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে এবং রুশ সরকার জানায় যে, কিরগিজস্তান চাইলে তারা রাষ্ট্রটিতে অবস্থিত তাদের সামরিক ঘাঁটিগুলো বন্ধ করে দেবে। এর ফলে সেসময় ধারণা করা হচ্ছিল যে, কিরগিজস্তানে রুশ ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়া হবে। কিন্তু পরবর্তীতে কিরগিজস্তানি সরকার তাদের অবস্থানের পরিবর্তন করে এবং রাষ্ট্রটির ভূখণ্ডে অবস্থিত রুশ ঘাঁটি বন্ধ করে দেয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্রটিতে নতুন একটি রুশ ঘাঁটি নির্মাণের প্রস্তাব করে। অবশ্য এখন পর্যন্ত মস্কো বা বিশকেক এই লক্ষ্যে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

তাজিকিস্তান: ২০১তম রুশ সামরিক ঘাঁটি

মধ্য এশীয় মুসলিম ও বৃহত্তর ইরানি–অধ্যুষিত স্থলবেষ্টিত পার্বত্য রাষ্ট্র তাজিকিস্তান প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের একটি ইউনিয়ন প্রজাতন্ত্র ছিল এবং তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডে বিস্তৃত সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাজিকিস্তানের ভূখণ্ডে মোতায়েনকৃত সোভিয়েত সামরিক ইউনিটগুলো সাধারণভাবে রুশ সশস্ত্রবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয় এবং এর ফলে শুরু থেকেই তাজিকিস্তানি ভূখণ্ডে রুশ সামরিক উপস্থিতি ছিল। ১৯৯২ সালে তাজিকিস্তানে গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং এই যুদ্ধ চলাকালে তাজিকিস্তানে মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যরা নবগঠিত তাজিকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে মিলে তদানীন্তন তাজিকিস্তানি সরকারের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। তদুপরি, সেসময় রুশ সীমান্তরক্ষীদের বৃহৎ একটি দল তাজিক–আফগান সীমান্ত প্রহরার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল। অবশ্য ২০০৫ সালে তাজিকিস্তান থেকে রুশ সীমান্তরক্ষীদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়, কিন্তু রুশ সৈন্যরা এখন পর্যন্ত তাজিকিস্তানি ভূখণ্ডে অবস্থান করছে।

তাজিকিস্তানে অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিতে সরবরাহকৃত নতুন ট্যাঙ্ক; Source: Sergey Guneyev/Sputnik

বর্তমানে তাজিকিস্তানের দুশানবে ও বখতার শহরদ্বয়ে এবং তাদের আশেপাশে বেশ কয়েকটি সামরিক স্থাপনায় তাজিকিস্তানে মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যরা অবস্থান করে। বর্তমানে রাষ্ট্রটির ভূখণ্ডে অন্তত ৭,০০০ রুশ সৈন্য মোতায়েন আছে বলে ধারণা করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে, তাজিকিস্তানে অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিটির নাম ‘২০১তম গাৎচিনা অর্ডার অফ ঝুকভ দ্বৈত রেড ব্যানার সামরিক ঘাঁটি’ (রুশ: 201-я Гатчинская ордена Жукова дважды Краснознамённая военная база, ‘দিয়েস্তি পেরভায়া গাৎচিনস্কায়া অর্দেনা ঝুকোভা দ্ভাঝদি ক্রাস্নোজনামিয়োন্নায়া ভয়েন্নায়া বাজা’)। সংক্ষেপে এটি ‘২০১তম রুশ সামরিক ঘাঁটি’ নামে পরিচিত।

তদুপরি, তাজিকিস্তানের নোরাক শহরের কাছে সাংলক পর্বতমালায় রুশ ‘স্পেস ফোর্সেসে’র একটি মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র অবস্থিত। ‘ওকনো’ (রুশ: Окно) নামে পরিচিত এই মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটি রুশ স্পেস ফোর্সেসের ‘৮২১তম মেইন সেন্টার ফর রিকনিস্যান্স অফ সিচুয়েশন ইন স্পেস’–এর অংশ। উল্লেখ্য, রুশ ভাষায় ‘ওকনো’ শব্দটির অর্থ ‘জানালা’। এই মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃত্রিম উপগ্রহ ও মহাকাশের অন্যান্য বস্তু চিহ্নিত ও পর্যবেক্ষণ করা। এই কেন্দ্রটি তাজিকিস্তানে অবস্থিত ২০১তম রুশ সামরিক ঘাঁটির অংশ নয়, বরং একটি স্বতন্ত্র রুশ সামরিক স্থাপনা। ১৯৯৯ সালে স্থাপনাটির পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হয় এবং ২০০৪ সাল নাগাদ এটির পূর্ণ সামরিক ব্যবহার আরম্ভ হয়। ২০০৪ সালে তাজিকিস্তান উক্ত স্থাপনাটির মালিকানা রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করে।

‘ওকনো’ মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের একটি অংশের চিত্র; Source: DefenceTalk

উল্লেখ্য, তাজিকিস্তান রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘সিএসটিও’র সদস্য এবং তাজিকিস্তানে রুশ সামরিক উপস্থিতির মূল উদ্দেশ্য বহিঃশত্রুর সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে তাজিকিস্তানকে রক্ষা করা। তদুপরি, তাজিকিস্তানের ওপর রুশ প্রভাব বজায় রাখা, মধ্য এশিয়ায় রুশ সামরিক ও ভূকৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করা, আফগানিস্তানে বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা এবং চীন ও দক্ষিণ এশিয়ার ওপর নজরদারি করাও তাজিকিস্তানে রুশ সামরিক উপস্থিতির উদ্দেশ্য। সর্বোপরি, তাজিকিস্তানে অবস্থিত রুশ মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র মহাকাশে আধিপত্য বিস্তারের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় রাশিয়ার অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

দক্ষিণ ওসেতিয়া: ৪র্থ রক্ষী সামরিক ঘাঁটি

পশ্চিম এশীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টান ও বৃহত্তর ইরানি–অধ্যুষিত স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র দক্ষিণ ওসেতিয়া প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত জর্জিয়ার অধীনস্থ একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ ছিল এবং দক্ষিণ ওসেতিয়ার ভূখণ্ডে সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। ১৯৯১ সালে দক্ষিণ ওসেতিয়া জর্জিয়ার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং ১৯৯১–১৯৯২ সালের জর্জীয়–দক্ষিণ ওসেতীয় যুদ্ধে জর্জিয়া পরাজিত হওয়ার পর দক্ষিণ ওসেতিয়া, জর্জিয়া, রাশিয়া ও উত্তর ওসেতিয়ার (রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত একটি প্রজাতন্ত্র) সমন্বয়ে গঠিত ‘জর্জীয়–ওসেতীয় সংঘাত নিরসন সংক্রান্ত যৌথ নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ দক্ষিণ ওসেতিয়ায় একটি যৌথ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে। এই বাহিনীতে রুশ, জর্জীয় ও ওসেতীয় সৈন্য ছিল। ২০০৮ সালের রুশ–জর্জীয় যুদ্ধের পর এই শান্তিরক্ষী বাহিনীটি বিলুপ্ত হয় এবং রাশিয়া দক্ষিণ ওসেতিয়ায় একটি স্থায়ী ও একত্রিত সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।

২০১০ সালে রাশিয়া ও দক্ষিণ ওসেতিয়ার মধ্যে এই বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়া দক্ষিণ ওসেতিয়ায় ৪৯ বছরের জন্য ঘাঁটি স্থাপনের অনুমোদন লাভ করে। তদুপরি, এই মেয়াদ শেষ হওয়ার পর উভয় পক্ষের সম্মতিক্রমে চুক্তিটির মেয়াদ ১৫ বছর করে বৃদ্ধি করা যেতে পারে। দক্ষিণ ওসেতিয়া জুড়ে বহু সংখ্যক সামরিক ও সামরিক–সংশ্লিষ্ট স্থাপনার সমন্বয়ে এই ঘাঁটিটি গঠিত এবং এটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘৪র্থ রক্ষী ভাপনিয়ার–বার্লিন রেড ব্যানার, অর্ডার অফ সুভোরোভ ও কুতুজভ সামরিক ঘাঁটি’ (রুশ: 4-я гвардейская Вапнярско-Берлинская Краснознамённая, орденов Суворова и Кутузова военная база, ‘চিতিয়োর্তায়া গভার্দেইস্কায়া ভাপনিয়ারস্কো–বের্লিনস্কায়া ক্রাস্নোজনামিয়োন্নায়া, অর্দেনভ সুভোরোভা ই কুতুজোভা ভয়েন্নায়া বাজা’)। সংক্ষেপে এটি ‘৪র্থ রক্ষী সামরিক ঘাঁটি’ হিসেবে পরিচিত।

একটি মহড়ার সময় ৪র্থ রক্ষী সামরিক ঘাঁটির সৈন্যরা; Source: Ministry of Defence of the Russian Federation via Wikimedia Commons

দক্ষিণ ওসেতিয়ার রাজধানী তস্খিনভালে উক্ত ঘাঁটির সদর দপ্তর অবস্থিত। উক্ত ঘাঁটির অধীনে দক্ষিণ ওসেতিয়ায় রুশ সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন শাখার অন্তত ৪,৫০০ সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে এবং ঘাঁটিটির অধীনে বেশ কয়েকটি সেনাঘাঁটি ও বিমানঘাঁটি রয়েছে। উক্ত ঘাঁটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দক্ষিণ ওসেতিয়ার ওপর আক্রমণ পরিচালনা থেকে জর্জিয়াকে নিবৃত্ত রাখা। তদুপরি, দক্ষিণ ওসেতিয়ার ওপর রুশ প্রভাব বজায় রাখা, দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে রুশ সামরিক ও ভূকৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করা এবং মার্কিন মিত্র জর্জিয়ার ওপর অব্যাহতভাবে চাপ প্রদান করাও এই ঘাঁটির ও দক্ষিণ ওসেতিয়ায় রুশ সামরিক উপস্থিতির উদ্দেশ্য।

উল্লেখ্য, জর্জিয়া দক্ষিণ ওসেতিয়াকে নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে এবং এটিকে ‘রুশ দখলকৃত ভূমি’ হিসেবে অভিহিত করে। জাতিসংঘের সিংহভাগ সদস্য রাষ্ট্র জর্জিয়ার এই অবস্থানকে সমর্থন করে, এবং এই প্রেক্ষাপটে অনেকে দক্ষিণ ওসেতিয়ায় অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিকে জর্জীয় ভূখণ্ডে অবস্থিত ‘অবৈধ’ রুশ সামরিক ঘাঁটি হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। কিন্তু রাশিয়া ও জাতিসংঘের আরো ৪টি সদস্য রাষ্ট্র দক্ষিণ ওসেতিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং রাশিয়া ও দক্ষিণ ওসেতিয়া দক্ষিণ ওসেতিয়ায় অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটিকে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে অবস্থিত রুশ ঘাঁটি হিসেবে বিবেচনা করে।

প্রিদনেস্ত্রোভিয়ে: রুশ সৈন্যদের অপারেশনাল গ্রুপ

পূর্ব ইউরোপীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টান ও পূর্ব স্লাভিক–অধ্যুষিত স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্র প্রিদনেস্ত্রোভিয়ে (ইংরেজিতে যেটি ‘ট্রান্সনিস্ট্রিয়া’ বা ‘Transnistria’ নামে সমধিক পরিচিত) প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত মোলদাভিয়ার (বর্তমান মলদোভা) অংশ ছিল এবং প্রিদনেস্ত্রোভিয়ের ভূখণ্ডে সোভিয়েত সামরিক উপস্থিতি ছিল। দনেস্তর নদী তীরবর্তী এই ভূখণ্ডটি ১৯৯০ সালে মলদোভার কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং মলদোভা ও প্রিদনেস্ত্রোভিয়ের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর প্রিদনেস্ত্রোভিয়েতে অবস্থিত সোভিয়েত সামরিক ইউনিটগুলো সাধারণভাবে রুশ সশস্ত্রবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয় এবং রুশ সৈন্যরা প্রিদনেস্ত্রোভিয়েতে মোতায়েন থেকে যায়। উক্ত সৈন্যদলের আনুষ্ঠানিক নাম ‘মলদোভা প্রজাতন্ত্রের প্রিদনেস্ত্রোভিয়ে অঞ্চলে রুশ সৈন্যদের অপারেশনাল গ্রুপ’ (রুশ: Оперативная группа российских войск в Приднестровском регионе Республики Молдова, ‘অপেরাতিভনায়া গ্রুপ্পা রোসিস্কিখ ভয়স্ক ভে প্রিদনেস্ত্রোভস্কোম রেগিওনে রেসপুবলিকি মলদোভা’)। সংক্ষেপে এটি ‘প্রিদনেস্ত্রোভিয়েতে রুশ সৈন্যদের অপারেশনাল গ্রুপ’ নামে পরিচিত।

তিরাসপোলে বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত মহড়ায় রুশ অপারেশনাল গ্রুপের একদল সৈন্য; Source: Press Service of the President of the Pridnestrovian Moldavian Republic via Wikimedia Commons

১৯৯০–১৯৯২ সালের প্রিদনেস্ত্রোভিয়ের যুদ্ধে মলদোভা পরাজিত হয়, এবং প্রিদনেস্ত্রোভিয়ে, মলদোভা ও রাশিয়ার সমন্বয়ে গঠিত একটি ত্রিপক্ষীয় ‘যৌথ নিয়ন্ত্রণ কমিশন’ প্রিদনেস্ত্রোভিয়েতে একটি যৌথ শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে। এই বাহিনীতে রুশ, মলদোভান ও প্রিদনেস্ত্রোভীয় সৈন্য রয়েছে। উক্ত বাহিনীর অন্ত্ররভুক্ত রুশ সৈন্যরাও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রিদনেস্ত্রোভিয়েতে মোতায়েনকৃত রুশ অপারেশনাল গ্রুপের অধীনস্থ।

প্রিদনেস্ত্রোভিয়ের রাজধানী তিরাসপোলে উক্ত অপারেশনাল গ্রুপের সদর দপ্তর অবস্থিত। উক্ত অপারেশনাল গ্রুপের অধীনে প্রিদনেস্ত্রোভয়েতে রুশ সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন শাখার অন্তত ১,৫০০ সদস্যকে মোতায়েন করা হয়েছে এবং গ্রুপটির অধীনে বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে, এই সৈন্যদলটির মূল দায়িত্ব হচ্ছে প্রিদনেস্তোভিয়েতে অবস্থিত সোভিয়েত আমলের প্রায় ২২,০০০ টন সামরিক সরঞ্জামের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু কার্যত উক্ত রুশ সৈন্যদলটি সম্ভাব্য মলদোভান আক্রমণ থেকে প্রিদনেস্ত্রোভিয়ের জন্য সুরক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে আসছে। তদুপরি, প্রিদনেস্ত্রোভিয়ের ওপর রুশ প্রভাব বজায় রাখা, পূর্ব ইউরোপে রুশ সামরিক ও ভূকৌশলগত অবস্থানকে শক্তিশালী করা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নমুখী মলদোভার ওপর অব্যাহতভাবে চাপ প্রদান করাও প্রিদনেস্তোভিয়েতে রুশ সামরিক উপস্থিতির উদ্দেশ্য।

উল্লেখ্য, মলদোভা প্রিদনেস্ত্রোভিয়েকে নিজস্ব ভূখণ্ড হিসেবে বিবেচনা করে এবং এটিকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ভূমি’ হিসেবে অভিহিত করে। জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র মলদোভার এই অবস্থানকে সমর্থন করে, এবং রাশিয়াসহ জাতিসংঘের কোনো সদস্য রাষ্ট্রই প্রিদনেস্ত্রোভিয়েকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেনি। অর্থাৎ, রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে প্রিদনেস্ত্রোভিয়েকে মলদোভান ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকার করে। কিন্তু বর্তমান মলদোভান সরকারের মতে, প্রিদনেস্ত্রোভিয়েতে রুশ অপারেশনাল গ্রুপের উপস্থিতির ব্যাপারে রাশিয়া ও মলদোভার মধ্যে কোনো চুক্তি সম্পাদিত হয়নি, এবং এতদঞ্চলে রুশ সামরিক উপস্থিতির ‘প্রয়োজনীয়তা’ বা ‘বৈধতা’ কোনোটিই নেই। এই প্রেক্ষাপটে মলদোভা প্রিদনেস্ত্রোভিয়ে থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত মস্কো ও চিসিনাউ এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। ফলে প্রিদনেস্ত্রোভিয়েতে রুশ সামরিক উপস্থিতি বজায় রয়েছে।

Related Articles