Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্যাবো দেলগাদোর বিদ্রোহ: মোজাম্বিকের মাটিতে আইএসের সঙ্গে রুশ মার্সেনারিদের লড়াই

একবিংশ শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে, এবং একই সঙ্গে পরিবর্তন এসেছে যুদ্ধের ধরন ও গতিপ্রকৃতিতে। এতদিন পর্যন্ত যে ধরনের যুদ্ধ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল, সেটি হচ্ছে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ, অর্থাৎ এক বা একাধিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের সঙ্গে অপর এক বা একাধিক সার্বভৌম রাষ্ট্রের যুদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে যুদ্ধের যে ধরনটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত, সেটি হচ্ছে ‘অন্তঃরাষ্ট্রীয়’ যুদ্ধ বা ‘গৃহযুদ্ধ’। এবং এই গৃহযুদ্ধগুলো ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর রূপ ধারণ করছে।

প্রতিটি গৃহযুদ্ধেই কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ পক্ষগুলোর পাশাপাশি বিদেশি সশস্ত্রবাহিনী, আন্তর্জাতিক সামরিক জোট, বিদেশিদের দ্বারা সৃষ্ট মিলিশিয়া কিংবা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিলিট্যান্ট গ্রুপ জড়িত হয়ে পড়ছে। একইসঙ্গে জড়িত হয়ে পড়ছে বিভিন্ন বিদেশি মার্সেনারি গ্রুপ, আনুষ্ঠানিক ভাষায় ‘বেসরকারি সামরিক কোম্পানি’ (private military company, ‘PMC’)।

মার্সেনারি বলতে সহজ ভাষায় ভাড়াটে যোদ্ধাদের বোঝায়, যারা অর্থের বিনিময়ে কোনো রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির জন্য লড়াই করে। প্রাচীনকাল থেকেই এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে, বিশেষত ইরাক যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে, মার্কিন মার্সেনারি গ্রুপ ‘ব্ল্যাকওয়াটার’ (বর্তমান নাম ‘অ্যাকাডেমি’) বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিল। বলা যেতে পারে, ব্ল্যাকওয়াটার বা অ্যাকাডেমিরই রুশ সংস্করণ হচ্ছে সম্প্রতি খ্যাতি বা কুখ্যাতি অর্জনকারী ‘ওয়াগনার গ্রুপ’ (রুশ: Группа Вагнера, ‘গ্রুপ্পা ভাগনেরা’) বা ‘বেসরকারি সামরিক কোম্পানি ওয়াগনার’ (রুশ: Частная Военная Компания Вагнера, ‘চাস্তনায়া ভয়েন্নায়া কোম্পানিয়া ভাগনেরা’)।

রুশ আইন অনুযায়ী, রাশিয়ায় এ ধরনের মার্সেনারি গ্রুপ সৃষ্টি ও পরিচালনা করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। এজন্য রুশ মার্সেনারি গ্রুপগুলো সাধারণত রাশিয়ার বাইরের কোনো স্থানে নিবন্ধন করে থাকে। ২০১৪ সাল থেকে ওয়াগনার গ্রুপ সক্রিয় এবং এটির প্রতিষ্ঠাতা দিমিত্রি উৎকিন ছিলেন রুশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রাক্তন কর্মকর্তা। অবশ্য ধারণা করা হয় যে, রুশ ধনকুবের ও ‘কনকর্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড কনসাল্টিং’ কোম্পানির মালিক ইয়েভগেনি প্রিগোঝিন হচ্ছেন ওয়াগনার গ্রুপের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণকারী। রুশ সরকারের ভাষ্যমতে, ওয়াগনার গ্রুপের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্রব নেই। কিন্তু ধারণা করা হয়, ওয়াগনার গ্রুপ তাদের কার্যক্রম রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সমন্বয় করে থাকে। ওয়াগনার গ্রুপকে বহির্বিশ্বে রুশ প্রভাব বিস্তারের একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে।

ওয়াগনার গ্রুপের সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, স্থানীয় মিলিশিয়াদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে ও তাদের জন্য উপদেষ্টার ভূমিকা পালন করে, বিভিন্ন স্থাপনার রক্ষী হিসেবে কাজ করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সরাসরি রুশ রাষ্ট্রের জনবল হিসেবে কাজ করে। তারা বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার কিংবা রাজনৈতিক সংগঠনকে সামরিক সহায়তা প্রদান করে এবং বিনিময়ে রুশ রাষ্ট্রের জন্য বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধা আদায় করে নেয়। এই সুযোগ–সুবিধার মধ্যে রয়েছে উক্ত অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের ক্ষেত্রে রুশ কোম্পানিগুলোকে সুযোগ করে দেওয়া।

ওয়াগনার গ্রুপ ক্রমশ রুশ পররাষ্ট্রনীতির একটি হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে; Source: Libya Tribune

ইউক্রেন, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলা এবং অন্তত ১৫টি আফ্রিকান রাষ্ট্রে ওয়াগনার গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে রয়েছে লিবিয়া, সুদান, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গিনি, গিনি–বিসাউ, জিম্বাবুয়ে, মাদাগাস্কার এবং মোজাম্বিক। এই যুদ্ধক্ষেত্রগুলোতে ওয়াগনার গ্রুপ সাফল্য ও ব্যর্থতা উভয়েরই সম্মুখীন হয়েছে। ২০১৮ সালে সিরিয়ায় সংঘটিত খাসামের খণ্ডযুদ্ধে তারা মার্কিনিদের হাতে পর্যুদস্ত হয়েছিল। অনুরূপভাবে, ২০২০ সালে লিবিয়ায় তারা তুর্কি আক্রমণের ফলে ত্রিপোলি থেকে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সামগ্রিকভাবে সিরিয়া ও লিবিয়া উভয় ক্ষেত্রেই তারা এখন পর্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে রুশ সরকারের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করে চলেছে। কিন্তু একটি যুদ্ধক্ষেত্রে তারা এমনভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে যে, তাদের কার্যকারিতা ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এই যুদ্ধক্ষেত্রটি হচ্ছে দক্ষিণ–পূর্ব আফ্রিকার রাষ্ট্র মোজাম্বিক।

২০১৭ সাল থেকে মোজাম্বিকের ক্যাবো দেলগাদো প্রদেশে বিদ্রোহ চলছে, যেটি বর্তমানে তীব্র আকার ধারণা করেছে। মোজাম্বিক প্রধানত একটি খ্রিস্টান–অধ্যুষিত রাষ্ট্র, কিন্তু রাষ্ট্রটির প্রায় ১৮% নাগরিক মুসলিম। ৮২,৬২৫ বর্গ কি.মি. আয়তন এবং প্রায় ২৩ লক্ষ ২০ হাজার জনসংখ্যা বিশিষ্ট ক্যাবো দেলগাদো প্রদেশটিতে মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রদেশটির মোট জনসংখ্যার ৫২.৫% মুসলিম। প্রদেশটি মোজাম্বিকের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত, এবং সেখানে বিপুল পরিমাণ রুবি ও প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ রয়েছে। উল্লেখ্য, মোজাম্বিকের হাইড্রোকার্বন খাতে প্রায় ৬,০০০ কোটি (বা ৬০ বিলিয়ন) বিদেশি বিনিয়োগ করা হয়েছে বা করার পরিকল্পনা রয়েছে। এই প্রকল্পের মূল অংশীদার মার্কিন কোম্পানি ‘এক্সনমোবিল’ এবং ফরাসি কোম্পানি ‘টোটাল’।

২০১৭ সালে প্রদেশটিতে স্থানীয় মিলিট্যান্ট গ্রুপ ‘আনসার আল–সুন্নাহ’ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গ্রুপটি বিভিন্ন শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত এবং পরবর্তীতে গ্রুপটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ইরাক ও সিরিয়া কেন্দ্রিক ‘ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড দ্য লেভান্ট’–এর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এরপর অঞ্চলটিকে ইসলামিক স্টেটের মধ্য আফ্রিকা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিদ্রোহটি প্রথম থেকে ধর্মীয় চরিত্র ধারণ করেছে, কিন্তু বিশ্লেষকদের মতে, এই বিদ্রোহের ক্ষেত্রে ধর্ম মুখ্য ভূমিকা পালন করছে না। বরং স্থানীয় সমস্যাগুলো (যেমন: দারিদ্র ও বেকারত্ব) সমাধানের ক্ষেত্রে মোজাম্বিকের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতা এবং মোজাম্বিকের উত্তরাঞ্চলের জনসাধারণ অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সম্পদ রপ্তানি থেকে প্রাপ্ত আয়ের ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এরকম একটি ধারণা বিস্তার এই বিদ্রোহ বিস্তৃত হওয়ার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।

ঐতিহাসিকভাবে মোজাম্বিকের সশস্ত্রবাহিনী দুর্বল, স্বল্প প্রশিক্ষিত, ও স্বল্প পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। এজন্য তাদের পক্ষে এই বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে মিলিট্যান্টরা স্থানীয় জনসাধারণ ও স্থাপনাগুলোর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করত, কিন্তু মোজাম্বিকান সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে সংঘাত এড়িয়ে যেত। ক্রমশ মিলিট্যান্টদের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকলে এবং একপর্যায়ে তারা সশস্ত্রবাহিনীর ওপরেও আক্রমণ চালাতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত অন্তত কয়েক হাজার সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি এ যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে, এবং প্রায় ৭ লক্ষ মানুষ এ যুদ্ধের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে।

মোজাম্বিকান রাষ্ট্রপতি ফিলিপি নিউসি ও রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন; Source: regnum.ru

ক্রমশ পরিস্থিতি মোজাম্বিকান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে এবং মিলিট্যান্টদের দমন করার ক্ষেত্রে মোজাম্বিকান সৈন্যরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে মোজাম্বিক বাইরে থেকে সাহায্য লাভের প্রচেষ্টা চালায়। মোজাম্বিকান সৈন্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও যুদ্ধ পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য তারা বিদেশি মার্সেনারি নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রাথমিক পর্যায়ে তারা এ কাজের জন্য অভিজ্ঞ মার্কিন ও আফ্রিকান মার্সেনারি গ্রুপগুলোকে বাছাই করার চিন্তাভাবনা করছিল। মার্কিন মার্সেনারি গ্রুপ ‘অ্যাকাডেমি’ মোজাম্বিককে ২টি হেলিকপ্টার ও হেলিকপ্টার ক্রু সরবরাহ করে এবং তারা ক্যাবো দেলগাদোয় চলমান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত মোজাম্বিকান সরকার ওয়াগনার গ্রুপকে কাজের জন্য বাছাই করে।

মোজাম্বিকের সঙ্গে রাশিয়ার ঐতিহাসিক সম্পর্ক বিদ্যমান। ১৯৬০–এর দশক ও ১৯৭০–এর দশকের প্রথমদিকে মোজাম্বিকান গেরিলারা তাদের পর্তুগিজ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত ছিল এবং এই যুদ্ধে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন মোজাম্বিকান গেরিলাদেরকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সহায়তা করে। মোজাম্বিক স্বাধীন হওয়ার পর এটি একটি প্রোটো–কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত হয় এবং স্নায়ুযুদ্ধের জটিল চক্রে জড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পরপরই মোজাম্বিকান সরকার ও পশ্চিমা–সমর্থিত বিদ্রোহীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, এবং এই যুদ্ধেও মোজাম্বিকান সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে সহায়তা লাভ করে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রুশ–মোজাম্বিকান সম্পর্ক বহুলাংশে সীমিত হয়ে পড়ে।

কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া আফ্রিকায় প্রভাব বিস্তারের জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠেছে এবং এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে তারা মোজাম্বিকের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক জোরদার করে। রাশিয়ার নিকট মোজাম্বিকের যে বড় অঙ্কের ঋণ ছিল, তার ৯৫% মস্কো মওকুফ করে দেয় এবং রাষ্ট্র দুইটির মধ্যে সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা বিষয়ক একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ২০১৯ সালের আগস্টে মোজাম্বিকান রাষ্ট্রপতি ফিলিপি নিউসু রাশিয়া সফর করেন এবং রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় রুশ ওয়াগনার গ্রুপ ক্যাবো দেলগাদোর বিদ্রোহ দমনে মোজাম্বিকান সরকারকে সহায়তা করবে– উভয় পক্ষের মধ্যে অনুরূপ একটি বোঝাপড়া হয়। বিনিময়ে মোজাম্বিক রাশিয়ার সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন বিষয়ক একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এছাড়া, জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, রাশিয়া মোজাম্বিকে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি লাভ করেছে।

আফ্রিকার দক্ষিণাংশে অভিযান পরিচালনার কোনো পূর্ব-অভিজ্ঞতা ওয়াগনার গ্রুপের ছিল না। অন্যদিকে, মার্কিন ও আফ্রিকান মার্সেনারি গ্রুপগুলোর এক্ষেত্রে বিস্তৃত অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু ওয়াগনার গ্রুপের অনভিজ্ঞতা সত্ত্বেও মোজাম্বিকান সরকার তাদেরকেই বেছে নেয়। এর মূল কারণ ছিল অবশ্য আর্থিক। মার্কিন বা আফ্রিকান মার্সেনারি গ্রুপগুলোকে এই কাজ দিলে মোজাম্বিকান সরকারকে প্রত্যেক মার্সেনারি বাবদ ১৫,০০০ থেকে ২৫,০০০ মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হতো। কিন্তু ওয়াগনার গ্রুপের ক্ষেত্রে মোজাম্বিকান সরকারের মাথাপিছু ব্যয় ছিল ১,৮০০ থেকে ৪,৭০০ মার্কিন ডলার। স্বভাবতই মোজাম্বিকান সরকার ওয়াগনার গ্রুপকে দিয়ে সস্তায় কাজ করিয়ে নিতে ইচ্ছুক ছিল।

মানচিত্রে মোজাম্বিকের ক্যাবো দেলগাদো প্রদেশ; Source: Africa News

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ১৬০ থেকে ২০০ জন ওয়াগনার গ্রুপ সদস্য রুশ বিমানবাহিনীর ‘আন্তোনভ আন–১২৪’ পরিবহন বিমানে করে মোজাম্বিকের উত্তরাঞ্চলীয় বন্দরনগরী নাকালায় পৌঁছায়। তাদের সঙ্গে ছিল ২টি ‘মিল মি–১৭’ পরিবহন হেলিকপ্টার, ১টি ‘মিল মি–২৪’ অ্যাটাক হেলিকপ্টার, ট্রাক ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম। ধারণা করা হয়, মোজাম্বিকে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদের ও তাদের সরঞ্জামাদি পৌঁছে দেওয়ার কাজে রুশ নৌবাহিনীর জাহাজও অংশগ্রহণ করে। মোজাম্বিকে পৌঁছানোর পরপরই ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা ক্যাবো দেলগাদোর মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে।

কিন্তু ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদের বেশকিছু দুর্বলতা ছিল। আফ্রিকার এ অঞ্চলে অভিযান চালানোর অভিজ্ঞতা তাদের ছিল না। দক্ষিণ আফ্রিকান নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবাদ বিশেষজ্ঞ জেসমিন অপারম্যানের মতে, ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা সাধারণভাবে মোজাম্বিকের এবং বিশেষত ক্যাবো দেলগাদো অঞ্চলের স্থানীয় সামরিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচিত ছিল না। স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল না এবং স্থানীয় ভাষাও তাদের আয়ত্ত ছিল না। তদুপরি, ঘন জঙ্গলাকীর্ণ ও বৃষ্টিবহুল কোনো অঞ্চলে অভিযান পরিচালনার জন্যও তারা প্রস্তুত ছিল না। এ অবস্থায় তারা এমন একটি মিলিট্যান্ট গ্রুপের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে, যাদের শক্তি ছিল ক্রমবর্ধমান।

সর্বোপরি, ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা মোজাম্বিকান সশস্ত্রবাহিনীর সঙ্গে তাদের কার্যক্রমকে সঠিকভাবে সমন্বিত করতে পারেনি। স্থানীয় ভাষা না জানা ছিল এর একটা বড় কারণ, কিন্তু এর পাশাপাশি অন্যান্য কারণও এজন্য দায়ী ছিল। তারা মোজাম্বিকান সৈন্যদেরকে বিশ্বাস করত না এবং তাদেরকে শৃঙ্খলাহীনতার দায়ে অভিযুক্ত করে। অন্যদিকে, মোজাম্বিকান সৈন্যরা ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদের ‘আধিপত্যবাদী’ আচরণের কারণে তাদের ওপরে ক্ষিপ্ত ছিল। ফলে বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে মোজাম্বিকান সৈন্যরা ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত অভিযানে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়।

এ পরিস্থিতিতে ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। মি–১৭ হেলিকপ্টারে চড়ে তারা মোজাম্বিকের গভীরে প্রবেশ করে এবং মি–২৪ অ্যাটাক হেলিকপ্টারের কাভার নিয়ে মোজাম্বিক–তাঞ্জানিয়া সীমান্ত বরাবর অভিযান চালাতে শুরু করে। অন্যদিকে, মিলিট্যান্টরা তাদের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত হয়। পূর্ব আফ্রিকা, বিশেষত সোমালিয়া থেকে বহুসংখ্যক ‘স্বেচ্ছাসেবক’ এসে স্থানীয় মিলিট্যান্টদের সঙ্গে যোগ দেয় এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের অক্টোবরে ওয়াগনার গ্রুপ ও মোজাম্বিকান সৈন্যরা মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযান চালায়। এর ফলে মিলিট্যান্টরা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয় এবং জঙ্গলে আশ্রয় নেয়।

মোজাম্বিকের ক্যাবো দেলগাদো প্রদেশকে আইএস তাদের ‘মধ্য আফ্রিকা প্রদেশে’র অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে; Source: Wikimedia Commons

কিন্তু একই সময়ে মোজাম্বিকান সৈন্যদের সঙ্গে ওয়াগনার গ্রুপের সমন্বয়হীনতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে, এবং মিলিট্যান্টরা ওয়াগনার গ্রুপের উপর পাল্টা আক্রমণ চালাতে থাকে। ৬ অক্টোবর ক্যাবো দেলগাদোর মোসিম্বোয়া দা প্রাইয়া বন্দরনগরীতে একজন ওয়াগনার গ্রুপ সদস্য মিলিট্যান্টদের হাতে নিহত হয় বলে জানা যায়। ১০ অক্টোবর মোসোমিয়া জেলায় মিলিট্যান্টদের দ্বারা পরিচালিত একটি চোরাগোপ্তা আক্রমণে দুই জন ওয়াগনার গ্রুপ সদস্য নিহত হয়। ২৭ অক্টোবর মুইদাম্বে জেলায় ওয়াগনার গ্রুপ ও মোজাম্বিকান সৈন্যদের একটি কনভয়ের উপর মিলিট্যান্টরা আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ৫ জন ওয়াগনার গ্রুপ সদস্য ও অন্তত ২০ জন মোজাম্বিকান সৈন্য নিহত হয়। এদের মধ্যে ৪ জন ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করার পর মিলিট্যান্টরা তাদের মাথা কেটে ফেলে।

‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপে’র আফ্রিকা বিষয়ক সিনিয়র পরামর্শদাতা পিয়ার্স পিগোর মতে, এই আক্রমণ ছিল ওয়াগনার গ্রুপের জন্য একটি বিরাট ‘মনস্তাত্ত্বিক আঘাত’। তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল আনুপাতিকভাবে অনেক বেশি, এবং এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, স্থানীয় মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে যুদ্ধ করার মতো সামর্থ্য ওয়াগনার গ্রুপের নেই। এ পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের নভেম্বরে তারা পশ্চাদপসরণ করে এবং প্রায় ২৫০ মাইল দক্ষিণে নাকালা শহরে তাদের মূল ঘাঁটিতে ফিরে যায়।

বিভিন্ন সূত্রের মতে, এ সময় মার্কিন মার্সেনারি গ্রুপ ‘অ্যাকাডেমি’ ওয়াগনার গ্রুপকে মোজাম্বিকের লড়াইয়ে সহায়তা করার প্রস্তাব দেয়। তারা মোজাম্বিকে নিযুক্ত ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যদেরকে অতিরিক্ত জনবল এবং আকাশভিত্তিক নজরদারি ব্যবস্থা সরবরাহ করার প্রস্তাব দেয়। ওয়াগনার গ্রুপের এ রকম কোনো নজরদারি ব্যবস্থা ছিল না এবং নতুন করে অভিযান শুরু করার জন্য তাদের অতিরিক্ত জনবলের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ওয়াগনার গ্রুপ এই প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করে।

২০২০ সালে ক্যাবো দেলগাদোর বিদ্রোহ চরম আকার ধারণ করে। এ সময় মিলিট্যান্টরা বেশকিছু অঞ্চল দখল করে নিতে সমর্থ হয়। একপর্যায়ে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোসিম্বোয়া দা প্রাইয়া শহরটিও দখল করে নিয়েছিল। শত শত মোজাম্বিকান সৈন্য এ বছর মিলিট্যান্টদের হাতে নিহত হয়। এমন পরিস্থিতিতে মোজাম্বিক ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সাহায্য প্রার্থনা করে। ফলশ্রুতিতে দক্ষিণ আফ্রিকার স্পেশাল ফোর্স মোজাম্বিকে প্রবেশ করে এবং মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে শুরু করে। এর পাশাপাশি দক্ষিণ আফ্রিকান মার্সেনারি গ্রুপ ‘ডাইক অ্যাডভাইজরি গ্রুপ’ ও ‘প্যারামাউন্ট গ্রুপ’ এবং জিম্বাবুয়ের মার্সেনারিদেরকেও মোজাম্বিকান সরকার মিলিট্যান্টদের দমনের জন্য নিয়োগ করে।

মানচিত্রে ক্যাবো দেলগাদোর বিদ্রোহ; Source: ACAPS

অন্যদিকে, এ সময় ওয়াগনার গ্রুপ নতুন করে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়। তারা তাদের রণকৌশল পরিবর্তন করে এবং স্থানীয় সামরিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুধাবনের প্রচেষ্টা চালায়। এর পাশাপাশি তারা মিলিট্যান্টদের ওপর নজরদারি করার জন্য চালকবিহীন আকাশযান (ড্রোন) ও অত্যাধুনিক সামরিক উপাত্ত বিশ্লেষক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে। একই সময়ে তারা মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে দক্ষিণ আফ্রিকান মার্সেনারিদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে শুরু করে। এখন পর্যন্ত ওয়াগনার গ্রুপ সদস্যরা ক্যাবো দেলগাদো প্রদেশের মোসিয়াম্বো দা প্রাইয়া শহর এবং পার্শ্ববর্তী নাকালা ও নামিয়ালো অঞ্চলে অবস্থান করছে।

২০২১ সালে ক্যাবো দেলগাদোয় যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। এখন পর্যন্ত পালমা শহর দখলের জন্য মোজাম্বিকান সশস্ত্রবাহিনী ও আইএস মিলিট্যান্টদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। মোজাম্বিকে আইএস ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মোজাম্বিকান সৈন্যদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য মার্কিন সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্স সদস্যদের মোজাম্বিকে মোতায়েন করেছে। এদিকে ক্যাবো দেলগাদোর যুদ্ধ একটি পূর্ণমাত্রার গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে, এ রকম একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে এবং স্থানীয় জনসাধারণের দুর্দশা চরমে পৌঁছেছে।

বর্তমানে মোজাম্বিকের পরিস্থিতি সিরিয়া, লিবিয়া বা ইয়েমেনের চেয়ে কম জটিল নয়। মোজাম্বিকের স্থানীয় মিলিট্যান্টরা আন্তর্জাতিক মিলিট্যান্ট গ্রুপ আইএসের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছে এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো থেকে আগত যোদ্ধারা এ পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে তুলেছে। তাদেরকে দমনের জন্য মোজাম্বিকান সরকার মার্কিন ও দক্ষিণ আফ্রিকান সৈন্য এবং রুশ, দক্ষিণ আফ্রিকান ও জিম্বাবুয়ের মার্সেনারিদের সহায়তা নিচ্ছে। অর্থাৎ, মোজাম্বিকের পরিস্থিতি বর্তমানে আক্ষরিক অর্থেই ‘হ-য-ব-র-ল’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এতে ওয়াগনার গ্রুপসহ অন্যান্য মার্সেনারি গ্রুপগুলোরই লাভ হবে। কারণ এই যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হবে, মোজাম্বিকে মার্সেনারিদের উপস্থিতি ততটাই বিস্তৃত ও লাভজনক হয়ে উঠবে।

Related Articles