Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এস–৪০০ ত্রিউম্ফ: রাশিয়ার সর্বাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের আখ্যান

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যেসব সামরিক সরঞ্জাম বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে ‘এস–৪০০’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। রুশ–নির্মিত এই সিস্টেমটির কার্যকারিতা ও প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা নিয়ে যেমন ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনা হয়েছে, তেমনি এর রাজনৈতিক ও কৌশলগত প্রভাব নিয়েও হয়েছে বিস্তর বাকবিতণ্ডা। এস–৪০০ এমন একটি সামরিক সরঞ্জাম, যেটি মোতায়েনের কারণে সিরীয় রণক্ষেত্রে একটি নতুন সমীকরণের সৃষ্টি হয়েছে, যেটি ক্রয়ের কারণে তুরস্কের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে এবং যেটি ক্রয়ের সম্ভাবনার কারণে ভারতীয় জলসীমায় মার্কিন রণতরী অনুপ্রবেশ করেছে।

সুইডেনভিত্তিক সামরিক বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ‘স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ এবং ব্রিটেনভিত্তিক সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দ্য ইকোনমিস্ট’–এর ভাষ্যমতে, ‘এস–৪০০ ত্রিউম্ফ’ (রুশ: C-400 Триумф) বর্তমান বিশ্বের শ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলোর মধ্যে অন্যতম। রুশ ভাষায় ‘ত্রিউম্ফ’ (ইংরেজিতে ‘Triumph’) শব্দটির অর্থ ‘বিজয়’। সিস্টেমটির পুরনো নাম ছিল ‘এস–৩০০পিএমইউ–৩’। অবশ্য মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘ন্যাটো’র পরিভাষায়, এর নাম ‘এসএ–২১ গ্রাউলার’ (SA–21 Growler)।

এস–৪০০ নির্মাণের ইতিহাস

এস–৪০০কে অত্যাধুনিক হিসেবে বর্ণনা করা হয়, কিন্তু এটি মূলত ১৯৭০–এর দশকে নির্মিত ‘এস–৩০০’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের ব্যাপকভাবে পরিমার্জিত ও উন্নততর সংস্করণ। সিস্টেমটি নির্মাণের জন্য গবেষণা শুরু হয়েছিল প্রায় চার দশক আগে ১৯৮০–এর দশকে। সিস্টেমটির নকশা প্রণয়ন করেছিল রুশ সামরিক গবেষণা সংস্থা ‘এনপিও আলমাজ’, এবং এটি নির্মাণ করে রুশ আকাশ প্রতিরক্ষা কর্পোরেশন ‘এমকেবি ফাকেল’। প্রকল্পটির মুখ্য প্রকৌশলী ছিলেন ডক্টর আলেক্সান্দর লেমানস্কি। ১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে রুশ বিমানবাহিনী প্রথমবারের মতো সিস্টেমটির কথা জনসমক্ষে ঘোষণা করে। ১৯৯৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার অস্ত্রাখান প্রদেশের ‘কাপুস্তিন ইয়ার’ রকেট নিক্ষেপ ও গবেষণা কেন্দ্রে সিস্টেমটি সফলভাবে পরীক্ষিত হয়।

এস–৪০০ সিস্টেমের মিসাইল লঞ্চার; Source: Wikimedia Commons

সিস্টেমটি ২০০১ সালে রুশ সশস্ত্রবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল, কিন্তু ২০০৩ সাল নাগাদ এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সিস্টেমটি মোতায়েন করার জন্য উপযুক্ত নয়। ধারণা করা হয়, ‘এস–৩০০পি’ সিস্টেমের পুরনো ইন্টারসেপ্টর ব্যবহার করে এস–৪০০ এর পরীক্ষা করা হচ্ছিল, এজন্য এটি ঠিকমতো কাজ করছিল না। পরবর্তীতে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পটির সমাপ্তি ঘোষণা করা হয় এবং এপ্রিলে অনুষ্ঠিত একটি পরীক্ষায় সিস্টেমটি একটি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। ২০০৭ সালের ২৮ এপ্রিল সিস্টেমটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ সশস্ত্রবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এস–৪০০: গঠনকাঠামো ও সামর্থ্য

সাধারণভাবে এস–৪০০ কে ‘ক্ষেপণাস্ত্র’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়, কিন্তু এস–৪০০ কোনো একক ক্ষেপণাস্ত্র নয়। এটি হচ্ছে নানা উপাদান সংবলিত একটি পুরোদস্তুর এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। এতে রয়েছে একটি মাল্টি–ফাংশন রাডার, স্বয়ংক্রিয় চিহ্নিতকরণ ও লক্ষ্য নির্ধারণ ব্যবস্থা, বিমান–বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, লঞ্চার এবং কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার। এটি একসঙ্গে তিন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে এবং এর মধ্য দিয়ে একটি স্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারে।

এস–৪০০ সিস্টেমটি ৪০০ কি.মি.র মধ্যে ৩০ কি.মি. উচ্চতা পর্যন্ত বিমান, চালকবিহীন আকাশযান (ড্রোন) এবং ব্যালিস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রসহ আকাশে উড্ডীয়মান সব ধরনের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। সিস্টেমটি একসঙ্গে ৩৬টি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। উল্লেখ্য, সাধারণত একটি এস–৪০০ ব্যাটালিয়নে ৮টি লঞ্চার, ৩২টি ক্ষেপণাস্ত্র এবং ১টি গতিশীল কমান্ড পোস্ট থাকে।

এস–৪০০ সিস্টেমে চার ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয় – ৯এম৯৬ই, ৯এম৯৬ই২, ৪৮এন৬ডিএম এবং ৪০এন৬ই। ‘৯এম৯৬ই’ এবং ‘৯এম৯৬ই২’ ক্ষেপনাস্ত্রদ্বয়ের পাল্লা যথাক্রমে ৪০ কি.মি. এবং ১২০ কি.মি.। বিশ্লেষকদের ভাষ্যমতে, এগুলো মার্কিন–নির্মিত ‘এফ–১৫’, ‘এফ–১৬’, ‘এফ–২২’ ও ‘এফ–৩৫’ জঙ্গিবিমানের মতো দ্রুতগতিসম্পন্ন লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ‘৪৮এন৬ডিএম’ ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ২৫০ কি.মি. এবং এটি এই পাল্লার মধ্যে আকাশে উড্ডীয়মান যেকোনো লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে সক্ষম। ‘৪০এন৬ই’ ক্ষেপণাস্ত্রটির পাল্লা ৪০০ কি.মি. এবং এটি ‘এয়ারবোর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল’ বিমান, ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার বিমান ও অন্যান্য অতি মূল্যবান লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।

এস–৪০০ সিস্টেমে ব্যবহৃত ‘৪৮এন৬ই৩’ ক্ষেপণাস্ত্র; Source: Wikimedia Commons

এস–৪০০ সিস্টেমে ‘৫৫কে৬ই’ কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম ব্যবহৃত হয় এবং ‘উরাল–৫৩২৩০১’ গতিশীল কমান্ড পোস্ট ভেহিকল একে বহন করে। কমান্ড পোস্টে এলসিডি কনসোল থাকে এবং এস–৪০০ ব্যাটারিগুলোর আকাশসীমার ওপর নজরদারি সংক্রান্ত উপাত্তকে প্রক্রিয়াজাত করে। এটি দূরপাল্লার নজরদারি রাডারকে নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে, আকাশ থেকে আগত হুমকিগুলোকে চিহ্নিত করে, হুমকির মাত্রা নির্ধারণ করে এবং ব্যাটারিগুলোর মধ্যে সমন্বয়সাধন করে। সিস্টেমটি ‘এসএ–১২’, ‘এসএ–২৩’ ও ‘এস–৩০০’ এর মতো অন্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলোর সঙ্গে উপাত্ত বিনিময় করতেও সক্ষম।

এস–৪০০ সিস্টেমে ‘৯২এন৬ই’ আগুন নিয়ন্ত্রণ ও লক্ষ্যবস্তু নির্ধারণকারী রাডার ব্যবহৃত হয়। একটি ‘এমজেডকেটি–৭৯৩০ ৮×৮’ যান রাডার বহন করে। রাডারটি আশেপাশের ৬০০ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত বিমান, হেলিকপ্টার, ক্রুজ, ব্যালিস্টিক ও গাইডেড ক্ষেপনাস্ত্র এবং ড্রোন শনাক্ত ও তাদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারে। রাডারটি একই সঙ্গে ৩০০টি পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুকে পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম।

এস–৪০০ সিস্টেমে ‘এসপি৮৫টিই২’ লঞ্চার ব্যবহৃত হয় এবং ‘বিএজেড–৬৪০২২ ৬×৬ ট্র‍্যাক্টর ট্রাক বা ‘এমএজেড–৭৯১০০’ শ্রেণির ট্রান্সপোর্টার–ইরেক্টর–লঞ্চার (টিইএল) যানে এই লঞ্চারগুলোকে বহন করে। টিইএল যানটি ৪টি লঞ্চ টিউব বহন করতে সক্ষম।

এস–৪০০ সিস্টেমের ব্যবহার

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, রুশ সশস্ত্রবাহিনী রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয়, পূর্বাঞ্চলীয়, দক্ষিণাঞ্চলীয় ও কেন্দ্রীয় সামরিক জেলাসমূহ এবং উত্তরাঞ্চলীয় নৌবহর যৌথ কৌশলগত কমান্ডের অধীনে অন্তত ৫৭ ব্যাটালিয়ন এস–৪০০ সিস্টেম মোতায়েন করেছে। এর পাশাপাশি রুশরা সিরিয়ায় তাদের সামরিক ঘাঁটিগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সেগুলোতে কয়েক ব্যাটালিয়ন এস–৪০০ সিস্টেম মোতায়েন করেছে।

এস–৪০০ এবং এস–৩০০ সিস্টেমে ব্যবহৃত ‘২২টি৬’ লোডার–লঞ্চার; Source: Army Technology

রাশিয়া এস–৪০০ সিস্টেমের একটি রপ্তানিযোগ্য সংস্করণ তৈরি করেছে, যেটি তারা বিশ্বের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রের কাছে রপ্তানি করেছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক, চীন ও তুরস্ক এখন পর্যন্ত যথাক্রমে ৬ ও ৪ ব্যাটালিয়ন এস–৪০০ সিস্টেম ক্রয় ও মোতায়েন করেছে। বেলারুশ ও আলজেরিয়া সিস্টেমটি ক্রয়ের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, এবং ভারত, সৌদি আরব, ইরান, ইরাক, মিসর, মরক্কো, ভিয়েতনাম ও কাতারসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র সিস্টেমটি ক্রয়ের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে বিভিন্ন সময়ে প্রচারমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

বিভিন্ন রাষ্ট্র যে এস–৪০০ সিস্টেম ক্রয় করতে আগ্রহ প্রকাশ করছে, এর মূল কারণ হচ্ছে সিস্টেমটি বর্তমানে বিদ্যমান পশ্চিমা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলোর চেয়ে কম কার্যকরী নয়, কিন্তু দামের দিক থেকে অপেক্ষাকৃত সস্তা। উদাহরণস্বরূপ, এক ব্যাটারি এস–৪০০ এর মূল্য প্রায় ৫০ কোটি (বা ৫০০ মিলিয়ন) মার্কিন ডলার, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ‘এমআইএম–১০৪ প্যাট্রিয়টে’র এক ব্যাটারির মূল্য অন্তত ১০০ কোটি (বা ১ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। স্বভাবতই বিভিন্ন রাষ্ট্র এস–৪০০ সিস্টেমটি ক্রয়ের জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

তদুপরি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা অন্যান্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সাধারণত অন্য কোনো রাষ্ট্রের কাছে তাদের অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করলেও এগুলোর নির্মাণপ্রযুক্তি ঐ রাষ্ট্রগুলোকে সরবরাহ করে না। অন্যদিকে, রাশিয়া সাধারণত তাদের সামরিক সরঞ্জামের ক্রেতা রাষ্ট্রগুলোকে অন্তত অংশত সামরিক প্রযুক্তি সরবরাহ করে থাকে। এজন্যও কিছু কিছু রাষ্ট্র (বিশেষত যারা নিজস্ব সামরিক শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী) রুশ–নির্মিত এস–৪০০ ক্রয় করতে ইচ্ছুক।

এস–৪০০ সিস্টেমের কার্যকারিতা: একটি যৌক্তিক বিশ্লেষণ

এখন পর্যন্ত এস–৪০০ সিস্টেমটি কার্যত যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়নি। এজন্য স্বভাবতই সিস্টেমটির কার্যকারিতা নিয়ে কিছু প্রশ্ন বিদ্যমান। বলাই বাহুল্য, আন্তর্জাতিক অস্ত্র বাণিজ্যের বাজারে যেসব রাষ্ট্র (বিশেষত পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো) রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী, তারা তাদের প্রচারমাধ্যমে এস–৪০০ সিস্টেমের কার্যকারিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে নানা ধরনের প্রচারণা চালিয়েছে। এক্ষেত্রে তাদের উত্থাপিত প্রশ্ন বা সংশয়ের মূল উদ্দেশ্য বাণিজ্যিক। কারণ, যদি ক্রেতা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে এস–৪০০ সিস্টেমের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় সৃষ্টি করা সম্ভব হয়, সেক্ষেত্রে এই রাষ্ট্রগুলোর কাছে পশ্চিমা–নির্মিত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করার বিকল্প থাকবে না।

এস–৪০০ সিস্টেমে ব্যবহৃত ‘বিএজেড–৬৯০৯২–০২১’ টোয়িং ভেহিকল, যেটিতে ‘৫আই৫৭এ’ পাওয়ার জেনারেটর ও ‘৬৩টি৬এ’ পাওয়ার কনভার্টার বহন করা হয়; Source: Missile Threat

আগেই বলা হয়েছে, এস–৪০০ এখন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়নি। সুতরাং এটি বাস্তবে কতটুকু কার্যকরী, সেটি নিশ্চিতভাবে বলা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু যেকোনো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের কার্যকারিতা কিছু বাস্তবতার ওপরে নির্ভরশীল, এবং এগুলোকে বিবেচনায় নিলে এস–৪০০ সিস্টেমটির কার্যকারিতার ব্যাপারে আংশিক ধারণা পাওয়া সক্ষম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষণকারী কোম্পানি ‘স্ট্র‍্যাটফোর’ এই ব্যাপারে একটি সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা প্রদান করেছে।

স্ট্র‍্যাটফোরের মতে, এস–৪০০ বা অন্য যেকোনো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের একটি বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের তাত্ত্বিক কার্যকারিতা এবং বাস্তবিক কার্যকারিতা যে একই হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোনো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের কার্যকারিতা বহুলাংশে নির্ভর করে সিস্টেমটি কারা পরিচালনা করছে এবং কীভাবে করছে, তার ওপরে। এস–৪০০ সিস্টেমের মূল বিশেষত্বগুলো হচ্ছে এর বিস্তৃত পাল্লা, বিভিন্ন ধরনের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার ক্ষমতা এবং অত্যাধুনিক সেন্সর, যেটিতে আংশিক অ্যান্টি–স্টেলথ সক্ষমতা রয়েছে বলে দাবি করা হয়।

যদি দক্ষ ও সুপ্রশিক্ষিত ক্রুরা সিস্টেমটি পরিচালনা করে, সেক্ষেত্রে এস–৪০০ শত্রুপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করতে সক্ষম। সিস্টেমটি তার বিস্তৃত পাল্লার কারণে শত্রুপক্ষের অতি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক বিমান (যেমন: এরিয়াল রিফুয়েলিং ট্যাঙ্কার ও এয়ারবোর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল বিমান) ধ্বংস করতে সক্ষম। সিস্টেমটি একইসঙ্গে বহুসংখ্যক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এবং এর ফলে এটি একই সঙ্গে বহু সংখ্যক ও বহু ধরনের আক্রমণ মোকাবিলায় পারদর্শী। সিস্টেমটির সীমিত অ্যান্টি–স্টেলথ ক্ষমতার কারণে এটি বর্তমান বিশ্বের শীর্ষ জঙ্গিবিমানগুলোকে ভূপাতিত করতে পারে।

কিন্তু এস–৪০০ সিস্টেমের বাস্তবিক কার্যকারিতা সিস্টেমটির পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, সিস্টেমটি কোন ধরনের শত্রুর মোকাবিলা করবে, সেটির ওপর ভিত্তি করে এটির কার্যকারিতা ভিন্ন হবে।
একটি এস–৪০০ সিস্টেম শত্রুপক্ষের একটি সীমিত মাত্রার বিমান হামলা প্রতিহত করার ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যকারিতা দেখাতে সক্ষম। কিন্তু শত্রুপক্ষ যদি বিস্তৃত পরিসরে বিমান হামলা চালায়, সেক্ষেত্রে একটি পূর্ণ এস–৪০০ ব্যাটালিয়নের পক্ষেও টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, কারণ একটি এস–৪০০ ব্যাটালিয়নে ৩২টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র থাকে না।

চিত্রে এস–৪০০ সিস্টেমে ব্যবহৃত ‘৯৬এল৬’ রাডার দেখা যাচ্ছে; Source: Wikimedia Commons

এজন্য যদি কোনো এস–৪০০ ব্যাটালিয়নকে অন্য আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে মোতায়েন না করা হয়, সেক্ষেত্রে ব্যাটালিয়নটির পক্ষে একাকী বেশিক্ষণ ধরে শত্রুপক্ষের তীব্র বিমান আক্রমণ প্রতিহত করা সম্ভব নয়। পশ্চিম এশিয়ার ক্ষেত্রে এই বক্তব্য আরো বেশি প্রযোজ্য, কারণ পশ্চিম এশীয় রাষ্ট্রগুলো তাদের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলো ব্যাটালিয়ন হিসেবে নয়, ব্যাটারি হিসেবে মোতায়েন করে এবং একেকটি ব্যাটারিতে ১৬টির বেশি ক্ষেপণাস্ত্র থাকে না।

তদুপরি, যে অঞ্চলে এস–৪০০ সিস্টেম মোতায়েন করা হবে, সেই অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যও সিস্টেমটির কার্যকারিতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত পার্বত্য অঞ্চলে এস–৪০০ সিস্টেমের সেন্সরগুলোর কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে শত্রুপক্ষের বিমান অপেক্ষাকৃত নিচু দিয়ে উড়ে অসতর্ক এস–৪০০ সিস্টেমের ওপর আক্রমণ চালিয়ে সেটিকে ধ্বংস করে দিতে পারে।

বস্তুত এস–৪০০ সিস্টেমকে একাকী শত্রুপক্ষের মোকাবিলার জন্য তৈরি করা হয়নি, বরং ইন্টিগ্রেটেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের (আইএডিএস) অংশ হিসেবে কাজ করার জন্য তৈরি করা হয়েছে। একটি কার্যকরী আইএডিএসে বিভিন্ন ধরনের ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র থাকে, যেগুলো অত্যন্ত স্বল্প পাল্লার থেকে অত্যন্ত দূরপাল্লার হয়ে থাকে। এতে শত্রুপক্ষের বিভিন্ন ধরনের লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন ধরনের রাডার ও অন্যান্য সেন্সর থাকে। কোনো আইএডিএসের আকৃতি যত বড় হবে (অর্থাৎ যত বেশি অঞ্চলকে কাভার করবে), ঘনত্ব যত বেশি হবে (অর্থাৎ যত বেশি সংখ্যক সিস্টেম থাকবে) এবং প্রযুক্তিগতভাবে যত বেশি উন্নত হবে, সেই আইএডিএসের কোনো অঞ্চলের আকাশসীমা রক্ষার সামর্থ্য তত বৃদ্ধি পাবে।

একটি আধুনিক ও কার্যকরী আইএডিএসের ভিত্তি হচ্ছে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (যেমন: এস–৪০০ সিস্টেম), কিন্তু এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছাড়াও আইএডিএসের নানা অংশ থাকে। আইএডিএসে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর সুরক্ষা জন্য স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র থাকে এবং এগুলো অপেক্ষাকৃত নিচু থেকে আগত শত্রুপক্ষের ক্ষেপণাস্ত্র বা গোলা থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকে রক্ষা করে। এজন্য এস–৪০০ সিস্টেমকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হলে এটিকে একটি পূর্ণ আইএডিএসের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে নিতে হবে।

কিন্তু সব রাষ্ট্রের পক্ষে পূর্ণ আইএডিএস গড়ে তোলা সম্ভব নয়, এবং যে রাষ্ট্র পূর্ণ আইএডিএস গড়ে তুলতে পারবে না, তার পক্ষে এস–৪০০ সিস্টেমকে কার্যকরীভাবে ব্যবহার করাও সম্ভব হবে না। উদাহরণস্বরূপ, রাশিয়া ও চীন উভয়েরই খুবই ‘ঘন’ ও অত্যাধুনিক আইএডিএস রয়েছে এবং এর পাশাপাশি তাদের বহুসংখ্যক ইন্টারসেপ্টর বিমান রয়েছে। এজন্য তারা সবচেয়ে কার্যকরভাবে এস–৪০০ সিস্টেম ব্যবহার করতে পারবে। তুরস্কের আইএডিএস বেশি ‘ঘন’ নয়, কিন্তু তাদের এয়ার ডিফেন্সের মূল হাতিয়ার হচ্ছে তাদের জঙ্গিবিমান বহর, তাই তুরস্কও বেশ কার্যকরভাবে এস–৪০০ সিস্টেম ব্যবহার করতে পারবে।

মানচিত্রের নীল চিহ্নিত রাষ্ট্রগুলো এস–৪০০ সিস্টেম ব্যবহার করছে কিংবা ক্রয় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে; Source: Wikimedia Commons

কিন্তু গৃহযুদ্ধের কারণে সিরিয়ার আইএডিএস প্রায় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে, তাদের ক্রুদের প্রশিক্ষণের মান নিম্ন এবং তাদের স্বল্পপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রযুক্তিগতভাবে অনুন্নত। এজন্য সিরিয়ার পক্ষে এস–৪০০ (কিংবা এস–৩০০) সিস্টেম কার্যকরভাবে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। এজন্য সিরীয় সশস্ত্রবাহিনী যদি কখনো এস–৪০০ সিস্টেম ব্যবহার করতে শুরু করে এবং তুর্কি বা ইসরায়েলিরা এক বা একাধিক সিরীয় এস–৪০০ সিস্টেম ধ্বংস করতে সক্ষম হয় (তাত্ত্বিকভাবে), সেক্ষেত্রে আশ্চর্য হওয়ার তেমন কিছু থাকবে না।

অর্থাৎ, এস–৪০০ সিস্টেমের কার্যকারিতা বহুলাংশে সিস্টেমটি কারা, কোথায়, কীভাবে এবং কাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে– এই বিষয়গুলোর ওপর নির্ভরশীল।

এস–৪০০ সিস্টেমের রাজনীতি

এস–৪০০ সিস্টেমটিকে বর্তমানে রাশিয়ার সর্বাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। স্বভাবতই রাশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রগুলো প্রথম থেকেই সিস্টেমটিকে একটি সামরিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। কিন্তু একই সঙ্গে সিস্টেমটিকে তারা একটি রাজনৈতিক হুমকি হিসেবেও বিবেচনা করছে। কারণ, এস–৪০০ বিক্রির মধ্য দিয়ে রুশরা বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করতে সক্ষম হবে, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের বাজারে রুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে এবং যে রাষ্ট্রগুলো এই সিস্টেম ক্রয় করবে, তাদের সঙ্গে রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদী সামরিক ও কারিগরি সম্পর্ক গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দেবে।

এজন্য যারাই রুশ–নির্মিত এই সিস্টেমটি ক্রয় করেছে বা ক্রয় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রত্যেকের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ বা অন্যান্য প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি দিয়েছে। যেমন: তুরস্ক এস–৪০০ সিস্টেম ক্রয় করায় যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে এফ–৩৫ স্টেলথ জঙ্গিবিমান তৈরির প্রকল্প থেকে বহিষ্কার করেছে এবং তুরস্কের ওপর সীমিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। ভারত এস–৪০০ সিস্টেম ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করায় যুক্তরাষ্ট্র ভারতের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার হুমকি দিয়েছে এবং সতর্কবার্তা হিসেবে মার্কিন নৌবাহিনী ভারতীয় জলসীমায় অনুপ্রবেশ করেছে। উল্লেখ্য, তুরস্ক মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য এবং ভারত বর্তমানে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন জোট ‘কোয়াড’–এর অংশ। তবুও তারা এস–৪০০ সিস্টেম ক্রয় বা ক্রয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করার পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণে পিছপা হয়নি।

এই পরিস্থিতিতে এটি স্পষ্ট যে, সামরিক সরঞ্জাম হিসেবে এস–৪০০ সিস্টেমের কার্যকারিতা যেমনই হোক না কেন, সিস্টেমটি রাশিয়ার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক হাতিয়ারে’ পরিণত হয়েছে এবং রাশিয়া যাতে এই সিস্টেম ব্যবহার করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করতে না পারে, সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এর ফলে এস–৪০০ রাশিয়ার একটি আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম থেকে বর্তমান রুশ–মার্কিন স্নায়ুযুদ্ধের একটি অন্যতম প্রতীকে রূপান্তরিত হয়েছে, এবং বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এই প্রতীকটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল।

Related Articles