উত্তর কোরিয়া নিয়ে পৃথিবীবাসীর আগ্রহের শেষ নেই। সারাবিশ্বের মানুষের সামনে এই দেশকে গণমাধ্যম এমনভাবে উপস্থাপন করে, যেসব শুনলে কিংবা দেখলে মনে হবে এই দেশটি জেলখানার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। একটি রাষ্ট্র ঠিক যতখানি খারাপ হতে পারে, যতখানি নিপীড়ক হতে পারে– উত্তর কোরিয়া যেন ঠিক ততটাই নিকৃষ্টতা নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছে। পশ্চিমা উদারনৈতিক বিশ্বের সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক একদম তলানিতে, আমেরিকার সাথে দেশটির প্রায়ই সরাসরি সংঘর্ষ লেগে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে কিম জং উনের উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় বড় বড় গণমাধ্যমগুলোর প্রথম পাতা দখল করেছিল। উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে আমরা প্রধানত ধারণা পেয়ে থাকি পশ্চিমা মিডিয়ার মাধ্যমে, এবং পশ্চিমা মিডিয়া তাদের শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোকে প্রায়শই বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে, যেটি আমাদের সাধারণ চোখে ধরা পড়ে না।
উত্তর কোরিয়ায় ক্ষমতালোভী স্বৈরশাসক কিম জং-উন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আছেন, সেখানে কোনো নাগরিক অধিকার নেই, সেদেশের জনগণের পেটে খাবার না থাকলেও নিত্যনতুন মিসাইল ও সামরিক মারণাস্ত্রের পেছনে ব্যয় করতে কমিউনিস্ট পার্টি কখনও পিছপা হয় না, সেদেশে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বললে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে থাকতে হয়– এসব বিষয় আমাদের প্রায় সবারই জানা, গণমাধ্যম আমাদের এসব জানানোর মাধ্যমে সবার মনে উত্তর কোরিয়ার একটি নেতিবাচক প্রতিচ্ছবি দাঁড়া করিয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে গণমাধ্যমের এসব দাবির সত্যতা নিয়ে আমরা খুব কমই ঘেঁটেছি। উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে প্রচলিত তেমনই কিছু মিথ, যেগুলো বাস্তবে পুরোপুরি সত্য নয়– সেসব নিয়ে আলোচনা হবে।
শুরুতেই একটি বড় অভিযোগ নিয়ে কথা বলা যাক। পশ্চিমা মিডিয়া প্রায়ই দাবি করে যে, উত্তর কোরিয়া তার জনগণের সবধরনের প্রয়োজনই রাষ্ট্রের মাধ্যমে পূরণ করার চেষ্টা করে, কিন্তু রাষ্ট্র যা সরবরাহ করে তাতে জনগণ কোনোভাবেই সন্তুষ্ট নয়। যেমন ধরা যাক, খাবারের ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে তার নাগরিককে খাবার সরবরাহ করে, কিন্তু যে পরিমাণ খাবার দেয়া হয় তাতে নাগরিকদের পুষ্টির চাহিদা পূরণ হয় না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নির্ধারিত নিয়মের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই, আবার রাষ্ট্রও নাগরিকের অবস্থা অনুযায়ী জিনিসপত্র সরবরাহ করে না। কিন্তু ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসের একটি ব্লগের মাধ্যমে জানা যায়, এই ধরনের ব্যবস্থা আগে থাকলেও বর্তমানে উত্তর কোরিয়া বাজার অর্থনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েছে। দুই যুগ আগে 'পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম'–এর মাধ্যমে জনগণকে সরকারি সেবা দেয়া হতো, কিন্তু বর্তমানে বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করার ফলে যে কেউই স্বাধীনভাবে উদ্যোগ নিতে পারে।
উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে আরেকটি মিথ্যা কথা পশ্চিমা মিডিয়া প্রায়ই বলে থাকে, যেটি হলো– "উত্তর কোরিয়া একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র। এই দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়েছে এবং পশ্চিমা বিশ্ব যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেয় তবে অতি শীঘ্রই এখানে মানবিক বিপর্যয় ঘটবে।" আসলে এই ধরনের দাবি পশ্চিমা গণমাধ্যম প্রায় দুই যুগ ধরেই করে আসছে। হ্যাঁ, তবে এটা সত্যি যে গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের দিকে সত্যিই উত্তর কোরিয়ার ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছিল, কিন্তু সে যাত্রায় রাষ্ট্রটি বেঁচে যায়। পরবর্তীতে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি খুব বড়জোর খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু কখনও ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হয়নি। সেখানে অর্থনীতির অগ্রগতি খুব দ্রুত না হলেও আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতি এখন বেশ শক্ত অবস্থানে আছে। তাই পশ্চিমা মিডিয়া উত্তর কোরিয়াকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে বারবার দাবি করলেও বাস্তবে এই দাবি প্রোপাগান্ডা ক্যাম্পেইনের অংশ ছাড়া কিছুই নয়।
উত্তর কোরিয়া একটি বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র– এটি সম্ভবত দেশটির বিরুদ্ধে ওঠা সবচেয়ে সাধারণ অভিযোগ। পশ্চিমা বিশ্বের সাথে দেশটির কোনো সম্পর্ক না থাকার কারণে সেই দেশগুলোর গণমাধ্যম উত্তর কোরিয়াকে 'আধুনিক দুনিয়ায় থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখ একটি রাষ্ট্র' হিসেবে প্রচার করতে ভালোবাসে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব তো পুরো পৃথিবী নয়। প্রতিবছর হাজার হাজার উত্তর কোরীয় শিক্ষার্থী বিদেশে প্রশিক্ষণ ও শিক্ষা নিতে যায়। চীন, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ায় অসংখ্য উত্তর কোরীয় নাগরিক বিভিন্ন অর্থনৈতিক কাজে জড়িত আছেন। আরও জেনে অবাক লাগবে, 'দ্য লায়ন কিং' নামের যে বিখ্যাত অ্যানিমেটেড ফিল্ম রয়েছে, সেটাতে পিয়ং ইয়ংয়ের অভিজাত কার্টুন ইন্ডাস্ট্রি কাজ করেছিল। উত্তর কোরিয়ার একটি নির্মাতা কোম্পানি কম্বোডিয়ায় একটি অত্যাধুনিক জাদুঘর তৈরি করেছে, যেখানে সিমুলেশনের মাধ্যমে প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শনগুলো ফুটিয়ে তোলা যাবে। অবশ্যই উত্তর কোরিয়া তাদের অর্থনীতির জন্য বাইরের বিশ্ব থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন, কিন্তু তাই বলে পশ্চিমা গণমাধ্যম ঠিক যে পরিমাণ বিচ্ছিন্ন বলে দাবি করে, ততটা নয়।
পৃথিবীর অনেক দেশেরই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, চীন হচ্ছে একমাত্র দেশ যেটি পশ্চিমা বিশ্বের সাথে উত্তর কোরিয়ার অচলাবস্থা দূর করতে পারে। কারণ পরাশক্তি দেশগুলোর মধ্যে চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার যা একটু ভালো সম্পর্ক রয়েছে। তবে পশ্চিমাদের এই দাবিও আসলে বাস্তবতাবিবর্জিত। উত্তর কোরিয়া সাথে চীনের অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে সখ্য থাকলেও বাস্তবে যেকোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে উত্তর কোরিয়ার উপর চীনের কোনো প্রভাব নেই। বরং অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক দাবি করেন, কিম জং-উনের সাথে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সুপ্রিম লিডার শি জিনপিংয়ের সম্পর্ক খুব বেশি ভালো না। এজন্য ক্ষমতা গ্রহণের বেশ কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও দুই নেতার খুব কমই সরাসরি সাক্ষাৎ হয়েছে। চীন কৌশলগত কারণে উত্তর কোরিয়াকে হারাতে চায় না, তাই অনেক সময় উত্তর কোরিয়ার অনেক আচরণে চীন ক্ষুদ্ধ হলেও বাস্তবে কঠোর ব্যবস্থা নেয় না।
উত্তর কোরিয়া সম্পর্কে আরেকটি গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে, দেশটি একটি যুদ্ধবাজ স্বৈরাচারী শাসক দ্বারা শাসিত হচ্ছে এবং কোনোভাবে রাষ্ট্রটি পারমাণবিক অস্ত্র হাতে পেলে বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাবে। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের উত্তর কোরিয়া বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক হ্যাজেল স্মিথের মতে, উপরের দাবির বাস্তবতা আসলে ভিন্ন। উত্তর কোরিয়ায় কিম জং-উন নেতা হিসেবে থাকলেও 'পলিটিক্যাল এলিট'রা মূলত দেশ নিয়ন্ত্রণ করেন। এই 'পলিটিক্যাল এলিট'রা হচ্ছেন উত্তর কোরিয়ার বিভিন্ন প্রভাবশালী পরিবারের কর্তাব্যক্তি। তবে তারা মনে-প্রাণে পারমাণবিক অস্ত্র চান, কেন না তাদের ভয় হচ্ছে আমেরিকার আগ্রাসন ঠেকাতে হলে অবশ্যই পারমাণবিক অস্ত্র হাতে রাখতে হবে। ইরাকে সাদ্দাম হোসেন, লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফি কিংবা মিশরের হোসনি মোবারকের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা সতর্ক হয়েছেন। উত্তর কোরিয়ার 'পলিটিক্যাল এলিট'দের ধারণা, পারমাণবিক অস্ত্র হাতে না থাকলে আমেরিকা যেভাবেই হোক উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির পতন ঘটিয়ে ছাড়বে। অর্থাৎ মূল কথা হলো তারা নিজেদের সুরক্ষার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র চান, অন্য কোনো কারণে নয়।
উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে পশ্চিমা গণমাধ্যম যেসব তথ্য দেয়, তা কিছুটা সত্য, তবে অধিকাংশই অতিরঞ্জিত। তবে যা রটে তা কিছু তো বটেই! পশ্চিমা প্রোপাগান্ডায় আমরা সত্যের কাছ থেকে নিজেদের অজান্তেই সরে আসি। যেসব মিথের অসত্যতা নিয়ে আলোচনা করা হলো, সেগুলোর মাধ্যমে উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে বৈধতা দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। অবশ্যই উত্তর কোরিয়া বিশ্ব থেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন, জনগণের উপর কঠোর নজরদারি চালানো একটি রাষ্ট্র। কিন্তু পশ্চিমা গণমাধ্যম যেভাবে একতরফাভাবে নেতিবাচকতা ছড়ায়, সেটিও কাম্য নয়।
This Bengali article debunks some myth regarding North Korea.
Reference:
১) 4 Myths About North Korea - The Diplomat
২) Five Myths about North Korea - Yale Macmillan Center
৩) It's Not a Hermit Kingdom, and 4 Other Myths About North Korea - The Atlantic
৪) Don't believe all the myths about North Korea - The Japan Times