ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার পথে ট্রলার ডুবে মৃত্যুর সংবাদ প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। কিন্তু ভূমধ্যসাগর চোখে দেখার অনেক আগে, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে সাহারা পাড়ি দিয়ে লিবিয়া বা আলজেরিয়াতে পৌঁছার পথেই যে প্রতি বছর আরও প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষের করুণ মৃত্যু ঘটে, সেটা আমাদের অজানাই রয়ে যায়। মরুভূমির এই যাত্রা সমুদ্রপথে যাত্রার চেয়েও অনেক বেশি কঠিন। এখানকার মৃত্যুও অনেক বেশি করুণ।
‘বিবিসি আফ্রিকা আই’ এর একটি বিশেষ প্রতিবেদন অবলম্বনে আমাদের এই লেখাটিতে সেরকমই একটি যাত্রার কাহিনী ফুটে উঠেছে। এই কাহিনীটি আবর্তিত হয়েছে আজাটেং নামে ঘানার এক শখের গোয়েন্দার অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে, যিনি মানবপাচারকারী একটি চক্রের উপর গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে নিজেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছিলেন। তার কাহিনী নিয়ে আমাদের চার পর্বের এই সিরিজের আজ পড়ুন ১ম পর্ব। সবগুলো পর্ব পড়তে পারবেন এখান থেকে: ১ম পর্ব, ২য় পর্ব, ৩য় পর্ব, ৪র্থ পর্ব।
গভীর রাতের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্য দিয়ে আজাটেং যখন সাহারার বালির উপর দিয়ে ক্রল করে পালাতে শুরু করেন, তখনও তিনি জানতেন না তার ভাগ্যে কী আছে। তিনি পালাচ্ছিলেন আলজেরিয়া সীমান্তের কাছাকাছি মালির উত্তরে অবস্থিত আল-খালিল এলাকার তুয়ারেগ বিদ্রোহীদের একটি চেকপয়েন্ট থেকে, যেখানে তাকে এবং তার মতো আরো ৭৫ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে তিনটি ট্রাকে করে আটকে রেখেছিল মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা।
পেছনে আল-খালিলের চেকপয়েন্টে সশস্ত্র বিদ্রোহীরা নাচে গানে মত্ত। মাঝেমাঝেই তারা সম্পূর্ণ বিনা কারণে আকাশের দিকে রাইফেল তাক করে গুলি ছুঁড়ছে। আজাটেং প্রথমে কিছুক্ষণ ক্রল করে এগোনোর চেষ্টা করেন। কয়েকশো মিটার দূরে আসার পর উঠে দাঁড়ান তিনি। গায়ের ধুলাবালি ঝেড়ে যাত্রা শুরু করেন অজানার উদ্দেশ্যে। অসীম মরুর বুকে তার নিজেকে ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো অসহায় মনে হতে থাকে।
চারপাশে যতদূর চোখ যায়, নিকষ অন্ধকার। মাইলের পর মাইল জুড়ে বিশাল সাহারা মরুভূমি। এই মরুর উপর দিয়ে উত্তর দিকে ক্রমাগত চলতে থাকলে হয়তো একসময় পৌঁছানো যাবে আলজেরিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন কোনো একটি গ্রামে, যদি তখনও তার শরীরে শক্তি অবশিষ্ট থাকে। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও তাকে পালাতে হবে এখান থেকে। কারণ তার ভয়, তার পরিচয় হয়তো ফাঁস হয়ে গেছে।
মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগেই আল-খালিলে অবস্থিত পাচারকারীরা মজা করার উদ্দেশ্যে তার চশমাটা ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাদের আচার-আচরণ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, চশমাটা ফেরত দেওয়ার কোনো ইচ্ছা তাদের ছিল না। আজাটেংয়ের বয়স ২৫ বছর, কিন্তু স্মাগলারদের তুলনায় তিনি উচ্চতায় অনেক খাটো। মাত্র পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এদের সাথে বাড়াবাড়ি করে লাভ নেই। তাই তিনি আস্তে করে পিছিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু তার ভয় তখনো কাটেনি। স্মাগলাররা যদি তার চশমাটা একটু ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখে, তাহলেই এর অতিরিক্ত পুরু ফ্রেম, ফ্রেমের একপাশে মিনি ইউএসবি পোর্ট এবং অন্যপাশে চার্জিং পোর্ট তাদের চোখে পড়ে যাবে। তাদের বুঝতে বাকি থাকবে না, ইউরোপে অভিবাসন প্রত্যাসীর ছদ্মবেশে তিনি আসলে একজন স্পাই। যাত্রা শুরুর পর থেকে যত অঘটনের সাক্ষী তিনি হয়েছেন, তাতে তার বুঝতে দেরি হয়নি, ধরা পড়ে গেলে তার পরিণতি কী হতে পারে।
ঘটনাটি ছিল ২০১৭ সালের মে মাসের। সে সময় আফ্রিকা থেকে উন্নত জীবনের আশায় ইউরোপে পাড়ি জমানোর হার ছিল অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। আজাটেং তার যাত্রা শুরু করেছিলেন ঘানা থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঘানা ছাড়াও গিনি, গাম্বিয়া, সিয়েরা লিয়ন, সেনেগালসহ পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলো থেকে লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু ইউরোপে পৌঁছেছে। যাত্রাপথে মারাও গেছে হাজার হাজার।
আফ্রিকা থেকে ইউরোপে যাওয়ার পথ অত্যন্ত দীর্ঘ। মালি এবং নাইজারের মধ্য দিয়ে প্রাচীন ট্রান্স-সাহারান রুটের কয়েক হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে অভিবাসীদেরকে প্রথমে পৌঁছাতে হয় লিবিয়া অথবা আলজেরিয়াতে। এই পথগুলোর অধিকাংশ স্থানই নিয়ন্ত্রণ করে তুয়ারেগ বিদ্রোহীরা, যারা কখনো স্মাগলার এবং ট্রাফিকারদের সাথে চুক্তি অনুযায়ী টাকার ভাগ নেয়। কখনো নিজেরই ট্রাক থামিয়ে যাত্রীদের সহায় সম্বল লুটপাট করে নেয়।
আলজেরিয়া বা লিবিয়া থেকে শুরু হয় যাত্রার দ্বিতীয় ধাপ। কাঠের বা প্লাস্টিকের তৈরি একবার ব্যবহারযোগ্য নৌকাতে কয়েকশো মানুষ গাদাগাদি করে যাত্রা করে ইতালির ল্যাম্পাদুসা দ্বীপের উদ্দেশ্যে। অধিকাংশ সময়ই মাঝপথেই নৌকাগুলো ডুবতে শুরু করে। ভাগ্য ভালো হলে ইউপোরীয় ইউনিয়নের উদ্ধারকারী জাহাজ তাদেরকে উদ্ধার করে। আর ভাগ্য খারাপ হলে সেখানেই সলিল সমাধি ঘটে সবার।
আজাটেং যে বছর যাত্রা করেন, তার পূর্ববর্তী বছরই ভূমধ্যসাগরে মৃত্যুবরণ করেছিল প্রায় ৫,০০০ অভিবাসী। কিন্তু জাতিসংঘের হিসেবে এর প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটেছে সমুদ্র চোখে দেখারও অনেক আগে, সাহারা মরুভূমির বুকে। ভূমধ্যসাগরের মৃত্যুগুলো সংবাদে স্থান পেলেও মরুভূমির মৃত্যুগুলো প্রায়ই অজানা রয়ে যায় বিশ্ববাসীর কাছে।
আজাটেংয়ের যাত্রার কয়েক সপ্তাহ পরে ঘানা এবং নাইজেরিয়ার ৪৪ জন নারী-পুরুষ ও শিশুর একটি দলের গাড়ির জ্বালানি যখন ফুরিয়ে গিয়েছিল, তখন তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে তাদের সবাই মৃত্যুবরণ করেছিল। তারও কয়েক সপ্তাহ পর মারা গিয়েছিল তিনটি ট্রাকে করে সাহারা পাড়ি দেয়ার চেষ্টা করা আরও ৫০ জন অভিবাসী।
আজাটেং যখন আল-খালিলের তুয়ারেগ বিদ্রোহীদের চেকপয়েন্ট থেকে হামাগুড়ি দিয়ে রাতের অন্ধকারে পালানোর চেষ্টা করছিলেন, তিনিও তখন জানতেন না তার ভাগ্যে কী আছে। তিনি কি পারবেন ইউরোপে পৌঁছতে? অথবা অন্তত তার মাতৃভূমি ঘানায় ফিরে যেতে? নাকি হাজার হাজার আফ্রিকান হতভাগার মতো তারও মৃত্যু ঘটবে বিশাল মরুভূমির বুকে?
আজাটেংয়ের জন্ম ঘানার উত্তরাঞ্চলের এক পুলিশ ব্যারাকে। তার বাবা ছিলেন একজন পুলিশ সদস্য। তার বাবার ইচ্ছা ছিল ছেলে বড় হয়ে তার মতো পুলিশে যোগ দিবে। কিন্তু পুলিশের দুর্নীতি খুব কাছ থেকে দেখায় আজাটেং ছিলেন পুলিশের প্রতি বীতশ্রদ্ধ। তার ইচ্ছে ছিল, তিনি বড় হয়ে স্পাই হবেন এবং দুর্নীতিবাজ ও বড় বড় অপরাধীদের মুখোশ খুলে দেবেন।
ছোটকাল থেকেই আজাটেং জেমস বন্ড এবং বিভিন্ন লো বাজেটের সিআইএ থ্রিলার ফিল্মের ভক্ত ছিলেন। বাবার দেওয়া পকেট খরচের টাকা তিনি ব্যয় করতেন পাড়ার দোকান থেকে কেনা স্পাই মুভির পাইরেটেড ডিভিডির পেছনে। তিনি সব সময় একটি পকেট রেডিও বহন করতেন এবং নিজেকে ঝানু গোয়েন্দা হিসেবে কল্পনা করতেন।
হাইস্কুলে থাকার সময় আজাটেং প্রথমবারের মতো তার গোয়েন্দাগিরির শখকে বাস্তবে রূপ দেয়ার সুযোগ পান। নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে তিনি একদল দুর্নীতিবাজ শিক্ষকের অপকর্ম রেকর্ড করে ফাঁস করে দেন, যারা স্কুল প্রাঙ্গণে মদ্যপান করত এবং পরীক্ষায় বেশি নম্বর দেয়ার বিনিময়ে ছাত্রদের কাছ থেকে টাকা নিত। তার ফাঁস করা এই কাহিনী যখন স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়, তখন প্রধান শিক্ষকসহ দুর্নীতির সাথে জড়িত শিক্ষকদের চাকরি চলে যায়।
স্কুলজীবন শেষ করে আজাটেং কিন্টাম্পো শহরে গিয়ে মায়ের সাথে ক্ষেতে কাজ করতে শুরু করেন। সারাদিন কাজ করে রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়েও তিনি ভাবতেন, একদিন তিনি নামকরা আন্ডারকভার সাংবাদিক হবেন। আরও বড় কোনো গল্প তিনি তুলে ধরবেন দেশবাসীর সামনে। আরও বড় অপরাধীদেরকে তুলে দিবেন আইনের হাতে।
এ সময়ই শুয়ে শুয়ে রেডিওতে তিনি শুনতে থাকেন, হাজার হাজার আফ্রিকান নারী-পুরুষ এবং শিশু ইউরোপ যাওয়ার পথে সাহারা মরুভূমিতে এবং ভূমধ্যসাগরে মারা পড়ছে। আজাটেং বুঝতে পারেন, এই গল্পের জন্যই তিনি এতদিন অপেক্ষা করছিলেন। এই গল্পই তাকে বলতে হবে। খুঁজে বের করতে হবে কারা এই অসহায় মানুষগুলোকে ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে!
ছয়মাস পর আজাটেং তার যাত্রা শুরু করেন। প্রথমেই তিনি উপস্থিত হন ঘানার রাজধানী আক্রার পশ্চিম প্রান্তের আবেকা লাপাজ শহরে। সেখানে নয় লেনের জর্জ ডাব্লিউ বুশ হাইওয়ের পাশে সিএসআইটি লিমিটেড নামের একটি কম্পিউটার সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের দোতলা শোরুমে গিয়ে প্রবেশ করেন তিনি। তার লক্ষ্য, গোপনে রেকর্ড করতে সক্ষম, এরকম একটি স্পাই ক্যামেরা কিনবেন তিনি।
দোকানটিতে বিভিন্ন ধরনের স্পাইক্যাম ছিল। কিছু ছিল বোতামের ভেতর, কিছু কলমের ভেতর, আবার কিছু ছিল ঘড়ির ভেতর। কিন্তু আজাটেংয়ের পছন্দ হয় চশমার ভেতর স্থাপিত স্পাইক্যামটি। এর ছবির রেজোল্যুশন খুব বেশি না, রাতের বেলা এটি ভালো ছবি তুলতে পারে না, কিন্তু দামে এটি ছিল তুলনামূলকভাবে সস্তা। মাত্র ২০০ ঘানিয়ান সেডি, বা প্রায় ৩০ ইউরো।
পরবর্তী পাঁচ মাস ধরে আজাটেং টাকা-পয়সা জমাতে থাকেন। সেই সাথে তিনি দিনরাত তার চশমার ভেতরে থাকা গোপন ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা এবং অডিও-ভিডিও রেকর্ড করা অনুশীলন করতে থাকেন। ধরা পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলে কীভাবে চশমা থেকে মেমোরি কার্ডটি চট করে খুলে মুখের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে হবে, সেই কৌশলও তিনি রপ্ত করেন ছোটকালে দেখা একটা স্পাই মুভি অবলম্বনে।
এরপর একদিন সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে, তার খামারের দুটি ভেড়া, ছয়টি ছাগল এবং দশটি মুরগি বিক্রি করে সেই টাকা নিয়ে আজাটেং বেরিয়ে পড়েন ঘর ছেড়ে। যাওয়ার আগে তিনি তার গির্জার ফাদারকে জানিয়েছিলেন, তিনি মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে ইউরোপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যেন তার চশমার মধ্যে লুকানো ক্যামেরা দিয়ে তাদের অপকর্মগুলো রেকর্ড করে ফেলতে পারেন।
ফাদার তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আজাটেং কি ভেবে দেখেছে, এতে কত বড় ঝুঁকি আছে? উত্তরে আজাটেং জানিয়েছিলেন, তিনি সবকিছু ভেবেই এই ঝুঁকি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কারণ তার মতে, এটা বিশ্বের প্রতি তার দায়িত্ব। মানুষের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব।
কিন্তু আজাটেং কি তার দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন? তিনি কি পেরেছিলেন তার গোপন ক্যামেরা দিয়ে পাচারকারীদের ছবি এবং ভয়েস রেকর্ড করতে? কেমন ছিল তার সাহারা পাড়ি দেয়ার অভিজ্ঞতা? কী কী কঠিন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাকে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা জানব এই সিরিজের পরবর্তী পর্বে। আর সবগুলো পর্ব পড়তে পারেন এখান থেকে: ১ম পর্ব, ২য় পর্ব, ৩য় পর্ব, ৪র্থ পর্ব।
This article is in Bangla language. It's the story of a young Ghanian migrant, who tried to spy on the people smugglers with hs secret spectacles. The story is based on a BBC Africa Eye special report. All the references are hyperlinked inside the article.
Featured Image: BBC