তিনি একজন বিশ্বমানের প্রযুক্তিবিদ। হয়তো ভাবছেন, এতে আবার আলাদা কী আছে! আছে, কারণ তিনি আর পাঁচজনের মতো দৃষ্টিময় জগতের বাসিন্দা নন। হ্যাঁ, দৃষ্টিহীন হয়েও শ্রীকান্ত বল্লা একজন অত্যন্ত মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার এবং একজন সফল শিল্পপতি।
‘সফলতা’র সঠিক সংজ্ঞা কী? উত্তর খুব একটা সহজ না, কারণ সফলতার সংজ্ঞা সকলের কাছে একরকম হয় না। তবে তা অর্জনের জন্য দরকার সুদীর্ঘ ও কঠিন লড়াইয়ের। মাতৃগর্ভের সেই প্রথম দিন থেকে আমরণ আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার একমাত্র রাস্তা সংগ্রাম। সেই অর্থে আমারা প্রত্যেকেই একেকজন সংগ্রামী ও যোদ্ধা। তবুও আমাদের মাঝে এমন কারোর দেখা মেলে যারা নিজেদের সর্বোচ্চ প্রতিবন্ধকতাকে জয় তো করেছেনই, সাথে অসংখ্য মানুষকে এই দীর্ঘ সংগ্রামে সফলতার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। শ্রীকান্ত বল্লা তাদেরই একজন।
অন্ধ্র প্রদেশের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক অতি দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম শ্রীকান্তের, যে পরিবারের মাসিক উপার্জন ২,০০০ টাকারও কম। যে পরিবারে কায়িক পরিশ্রমই জীবিকার্জনের একমাত্র রাস্তা, সেখানেই তিনি ভূমিষ্ঠ হন কোনো দৃষ্টিশক্তি ছাড়াই। যে সন্তান বাবা-মায়ের মুখের হাসি কেড়ে নিয়ে ঘন কালো ছায়া ঝুলিয়ে দিয়েছিল, সেই সন্তান যে একদিন অসংখ্য মানুষের লড়াই করার অবলম্বন হয়ে দাঁড়াবে, সেটা বুঝতে অনেকগুলো বছর লেগে যায়।
দরিদ্র পরিবার, তাই বাবা-মায়ের মন না চাইলেও কৃষিকাজে সাহায্য করতেই হত ছোট্ট শ্রীকান্তকে। টলোমলো ছোট্ট পা দুটি আটকে যেত ধান জমির কাদায়, কচি হাতে আপ্রাণ চেষ্টা করত সেই শিশুটি তার বাবা-মাকে সাহায্য করতে, কিন্ত ভাগ্য-বিধাতা যে চিরদিনের মতো এক নিকষ কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছে শ্রীকান্তকে। বাবা বুঝলেন, পারবে না ছোট্ট শ্রীকান্ত। তাই ঠিক করলেন পড়াশোনা শেখাবেন ছেলেকে।
স্থানীয় স্কুলে শ্রীকান্তের জন্য ছিল শুধুই বঞ্চনা। তার ছিল না কোনো বন্ধু। সবাই যখন খেলাধুলা করত, শ্রীকান্ত এক কোণে বসে শুধু সেই কোলাহল শুনে নিজের মন ভরিয়ে নিত। ক্লাসরুমের একেবারে শেষ বেঞ্চে এক টুকরো জায়গা নির্দিষ্ট ছিল তার জন্য, কারণ সহপাঠী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে তিনি ছিলেন একেবারেই ‘অনুপযুক্ত’ এবং ‘বাতিল’। অবশেষে ৭ বছর বয়সে তাকে ভর্তি করে দেওয়া হয় দৃষ্টিহীনদের জন্য নির্ধারিত এক স্কুলে, যা তার বাড়ি থেকে ২৫০ মাইল দূরে হায়দ্রাবাদ শহরে।
খানিকটা মুক্ত শ্বাস নিয়ে বাঁচলেন শ্রীকান্ত। কিন্ত কিছুতেই মন টিকল না তার, সর্বদাই মন পড়ে থাকল বাড়ির দিকে; ঠিক করলেন পালিয়ে যাবেন। এ কথা জানতে পেরে তার কাকা একটা কথাই জিজ্ঞেস করেন, “বাড়ীতে কি তুমি এর থেকে ভাল কিছু আশা কর?”। বলা বাহুল্য, এই প্রশ্নই শ্রীকান্তের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।এরপর যে শিশুটিকে ‘বোঝা’ বলা হয়েছিল, সে-ই শিখল ব্রেইল পদ্ধতিতে পড়াশোনা, কম্পিউটার চালনা এবং সাথে খেলাধুলাও। একের পর এক পুরষ্কার জিততে থাকল বিভিন্ন বিতর্ক প্রতিযোগিতায়, দাবা খেলায়, এমনকি ক্রিকেট (দৃষ্টিহীনদের জন্য) খেলাতেও; শুধুমাত্র জাতীয় না, এমনকি আন্তর্জাতিক স্তরেও।
ততদিনে শ্রীকান্ত বুঝে গিয়েছেন, তিনি পারবেন, পারতে তাকে হবেই। অন্ধ্র বোর্ডের দশম শ্রেণীর পরীক্ষায় সবাইকে চমকে দিয়ে ৯০ শতাংশ নাম্বার পেয়ে উত্তীর্ণ হন। তিনি প্রমাণ করলেন তিনি আর কারো ‘বোঝা’ নন। নিজের ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, “আমার ছোটবেলা কেটেছে চরম একাকিত্বে, আমি প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছি, কিন্ত কখনোই পেছনে ফিরে তাকাইনি।"
এত কিছুর পরও একটুও কমেনি শ্রীকান্তের প্রতিকূলতা। বিজ্ঞান বিভাগে পরবর্তী পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন তিনি, তবে বাধ সাধলো দেশের সেই অচল শিক্ষাব্যবস্থা, যেখানে কেবল কলা বিভাগে তিনি পড়াশোনা করতে পারবেন। কিন্তু শ্রীকান্তের স্বপ্ন তো আরও অন্য কিছু। শুরু হলো এক অসম লড়াই। দীর্ঘ ছয় মাসের আইনী লড়াইয়ে অবশেষে জিতলেন তিনি, অনুমতি পেলেন বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করার। কিন্তু আদালতের রায়ে লেখা থাকল, “You may, but at your own risk”।
ততদিনে অন্য ছাত্রদের থেকে শ্রীকান্ত পিছিয়ে পড়েছেন। তার উপযুক্ত বিজ্ঞান বিষয়ক কোনো পাঠ্যপুস্তক নেই। কিন্তু তিনি হেরে যাবার পাত্র নন। সমস্ত পাঠ্যপুস্তক তিনি অডিও বুকে পরিণত করলেন আর ব্রেইল পদ্ধতিতে সমস্ত ডায়াগ্রাম (Diagram) তৈরি করে নিলেন। স্কুলের কয়েকজন শিক্ষক আপ্রাণ সাহায্য করলেন, নিজের সমস্তটুকু উজাড় করে দিলেন শ্রীকান্ত। ফলাফল, দ্বাদশ শ্রেণীর বোর্ড পরীক্ষায় ৯৮ শতাংশ নাম্বার। শোনা যায়, স্বপ্নের রঙ নাকি সাদা-কালো, কিন্ত শ্রীকান্তের কাছে স্বপ্ন শুধুই রঙিন, কারণ তিনি স্বপ্নের জন্য পরিশ্রম করতে জানেন, “প্রতিবন্ধকতা কখনোই আমার স্বপ্ন দেখার পথে অন্তরায় হতে পারে না।”
শ্রীকান্তের লড়াই এরপর আরও কঠিন হলো। প্রযুক্তিবিদ্যা তার একমাত্র পছন্দের বিষয়। সেই অনুযায়ী আবেদন করতে থাকলেন আইআইটি, বিআইটিএস-এর মতো দেশের প্রথমসারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষার অনুমতিপত্রের বদলে বাড়িতে এলো একটি চিঠি যার বয়ান, “তুমি দৃষ্টিহীন, তোমার কোনো প্রবেশাধিকার নেই সর্বভারতীয় কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসার।” অপমানের চূড়ান্ত হলো সেদিন যখন নিয়ামক সংস্থার কেউ একজন তাকে প্রশ্ন করলেন, “যদি একটি লাল বল ছুঁড়ে দিয়ে তোমাকে তার দিকনির্দেশ করতে বলা হয় তাহলে কি তুমি পারবে? পারবে না, কারণ তুমি দৃষ্টিহীন। শুধু নিউটনের সূত্র মুখস্ত করলেই ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায় না।” চূড়ান্ত অপমানিত ও অবসন্ন মন নিয়ে কোনো উত্তরই দিতে পারেননি, আর উত্তর দেবার ছিলই বা কী! তিনি শুধু ভেবেছিলেন, “যদি আইআইটি আমাকে না চায় তাহলে আমিও আইআইটি-কে চাই না। আর লড়াই করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”
কিন্ত লড়াই করাই যার জীবনের একমাত্র মন্ত্র, তিনি কি থেমে থাকতে পারেন? ইন্টারনেটের সাহায্যে আবেদন করলেন আমেরিকার বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। যে সুযোগ নিজের দেশ তাকে দিতে পারল না, সেই সুযোগ তাঁকে দিল এমআইটি, যা বিশ্বের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম। এমআইটি কোনো আলাদা দাক্ষিণ্য দেখায়নি, রীতিমতো স্কলারশিপ নিয়ে সেখানে পদার্পণ করেন শ্রীকান্ত। এমআইটি ছাড়াও স্ট্যানফোর্ড, বার্কলে এবং কার্নেগী মেলন-এর মতো বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রণ পান, সবটুকুই ছিল নিজের যোগ্যতায়। শ্রীকান্ত বিশ্বাস করতেন, “আমার জন্য সব দুয়ার বন্ধ হয়ে গেলেও কোথাও না কোথাও একটি হলেও জানালা খোলা থাকবে।” আর সেই ‘জানালা’ দিয়েই সম্পূর্ণ বিশ্বের দুয়ার উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছে তার কাছে।
কৃতিত্বের সাথে ব্যাচেলর ডিগ্রী অর্জনের পর একটি প্রশ্ন শ্রীকান্তের কাছে এসে উপস্থিত হলো, “এরপর কী?” এর উত্তর তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে এলো সেখানে, যেখান থেকে তিনি অস্তিত্বের লড়াই শুরু করেছিলেন। আমেরিকার মতো একটি দেশের নাগরিকত্ব এবং ক্যারিয়ার তৈরির সুবর্ণ সুযোগ ছেড়ে দিয়ে তিনি ফিরে এলেন দেশে, কারণ কয়েকটি প্রশ্ন তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে, “কেন এই বিশেষভাবে সক্ষম ছেলেমেয়েদের সমাজের একেবারে পেছনের সারিতে ঠেলে দেওয়া হবে? কেন তাদের অর্থনীতির মূল স্রোত থেকে বঞ্চিত করা হবে? কেন তারা তাদের প্রাপ্য সম্মান পাবে না?”
দেশে ফিরেই তিনি সবার প্রথম একটি নন-প্রফিট অর্গানাইজেশন (হায়দ্রাবাদ শহরে) চালু করেন, যেখানে তিনি ব্রেইল পদ্ধতিতে শিক্ষাদানের সম্প্রসারণ ঘটান, সাথে ব্রেইল প্রেস ও লাইব্রেরি তৈরি করেন। বর্তমানে এই সংস্থা বছরে প্রায় ৩,০০০ দৃষ্টিহীন ছাত্র-ছাত্রীকে বিনামূল্যে শিক্ষাদান করে থাকে। ২০১২ সালে সামান্য কিছু মূলধন সম্বল করে তিনি Bollant Industries Pvt. Ltd নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন, যেখানে পরিবেশবান্ধব বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে শুরু করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল আঠা, প্রিন্টিংয়ের কালি ও প্রিন্টিং সংক্রান্ত নানা যন্ত্রাংশ তৈরি হতে থাকে। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের বাৎসরিক আয় প্রায় ১০০ কোটি টাকা, কর্মী সংখ্যা ৬০০ এর কাছাকাছি যার ৬০%-ই দৃষ্টিহীন এবং বিশেষভাবে সক্ষম। তার এই প্রচেষ্টায় অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পপতি রতন টাটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
ভাবতে অবাক লাগে, এই সেই শ্রীকান্ত বল্লা, যাকে জন্মের পরেই অক্ষম হিসেবে প্রতিবেশীরা মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে চেয়েছিল, কারণ সেই সন্তান নাকি শুধুই তার বাবা-মায়ের বোঝা। এমআইটি-এর এক জার্নালে তিনি জানিয়েছিলেন, “আমি আমার জীবন সেবামূলক কর্ম এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের কল্যাণে ব্যয় করতে চাই।”
শ্রীকান্তের সব স্বপ্নই সফল হয়েছে, শুধু একটি বাকি আছে। তার উপাস্য ব্যক্তি ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) এ পি জে আব্দুল কালাম, তাঁর মতোই শ্রীকান্ত চান একদিন সারাদেশের সেবা করার অধিকার অর্জন করতে।
শ্রীকান্ত এক অন্য দৃষ্টির কথা বলেছেন, যেখানে সবাই সমান, যেখানে কাউকে তার প্রতিবন্ধকতার জন্য পিছিয়ে পড়তে হবে না। তিনি নিজে যে মুক্তির স্বাদ পেয়েছেন, তা সবাইকে দিতে চান। একমাত্র শ্রীকান্ত বল্লার মতো মানুষই বলতে পারেন,
যদি সারা বিশ্ব আমার প্রতিবন্ধকতার দিকে তাকিয়ে বলে, "শ্রীকান্ত তুমি কিছুই করার উপযুক্ত নও", তাহলে আমি আমি তাদের দিকে তাকিয়ে বলতে পারি। "আমি পারি, আমি যা চাই তা-ই করতে পারি।"
This is a Bengali article describing the life, struggle, and achievements of Srikanth Bollant.
Reference:
১. The blind CEO who built a 50 crore company
২. Bollant Industries now gets Ratan Tata’s backing
৩. Beating All Odds, This Blind Man Became The Founder & CEO Of A Company Worth Crores
৪. Blind student Srikant Bolla, rejected by IIT, gets admission to MIT & is now an entrepreneur!
৬. Srikanth Bolla: Seeing no obstacles
Feature Image: The Hans India