[২য় পর্ব পড়ুন]
তুর্কি বিমানবাহিনী কর্তৃক তুর্কি–সিরীয় সীমান্তে রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিতকরণ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সৃষ্ট সঙ্কট নিরসনের জন্য তদানীন্তন রুশ উপ–পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক্সেই মেশকভ তিনটি শর্ত প্রদান করেছিলেন। শর্ত তিনটি ছিল: তুরস্ককে রুশ বিমান ভূপাতিত করা ও রুশ বৈমানিকের মৃত্যুর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে, ভবিষ্যতে যেন এই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় তার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে এবং নিহত বৈমানিকের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রুশদের তিনটি শর্তই প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সৃষ্ট সঙ্কট প্রলম্বিত রূপ ধারণ করে এবং রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এই সঙ্কটের প্রভাব পড়ে। কার্যত ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের ২৭ জুন পর্যন্ত প্রায় সাত মাস উক্ত রুশ–তুর্কি সঙ্কট বিরাজমান ছিল।
রুশ–তুর্কি 'অর্থনৈতিক যুদ্ধ'
রুশ সরকার তুরস্কের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার পরিবর্তে তাদের বিরুদ্ধে 'অর্থনৈতিক যুদ্ধে' (economic warfare) লিপ্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এসময় রাশিয়া ছিল তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার এবং রাষ্ট্র দুটির মধ্যে বহুমুখী অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল (যেটি এখনো বিদ্যমান)। এজন্য রাশিয়ার পক্ষে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় তুরস্কের আর্থিক ক্ষতি সাধন করা সম্ভব ছিল। স্বাভাবিকভাবেই রুশ সরকারের কাছে তুরস্ককে 'শাস্তি প্রদানে'র মাধ্যম হিসেবে যুদ্ধের তুলনায় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে বেশি কার্যকরী হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছিল। রুশ সরকার কর্তৃক পরিচালিত এই 'অর্থনৈতিক যুদ্ধ' বিভিন্ন রূপ ধারণ করে।
২০১৫ সালের ২৮ নভেম্বর রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন একটি অধ্যাদেশ জারি করেন এবং তুরস্কের সঙ্গে বাণিজ্য ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কার্যক্রমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ৩০ নভেম্বর রুশ সরকার তুরস্কের বিরুদ্ধে গৃহীত অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলোর তালিকা প্রকাশ করে। তুরস্কবিরোধী অর্থনৈতিক যুদ্ধের অংশ হিসেবে রুশ সরকার 'বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংক্রান্ত যৌথ আন্তঃসরকারি রুশ–তুর্কি কমিশনে'র কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করে এবং প্রস্তাবিত তিন বছর মেয়াদী রুশ–তুর্কি বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, কারিগরি ও সাংস্কৃতিক সহযোগিতা প্রকল্প সংক্রান্ত আলোচন স্থগিত রাখে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ রুশ পর্যটকদের তুরস্কে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন এবং রুশ পর্যটন সংস্থাগুলো তুরস্ক ভ্রমণের প্যাকেজ বিক্রি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখে। তদুপরি, ২০১৫ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সকল চার্টার ফ্লাইট নিষিদ্ধ করা হয়।
এর পাশাপাশি রুশ সরকার ২০১১ সালে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে প্রবর্তিত ভিসামুক্ত যাতায়াত ব্যবস্থা বাতিল করে এবং পুনরায় ভিসার প্রচলন করে। শুধু তা-ই নয়, রুশ সরকার রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে স্থলপথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে তুর্কি পরিবহন কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমের ওপর বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা আরোপ করে এবং ২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কোনো রুশ প্রতিষ্ঠানে কোনো তুর্কি নাগরিককে নিয়োগ প্রদান করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সর্বোপরি, তুরস্ক থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানির ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় এবং রুশ অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে তুর্কি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
তুরস্কের জন্য এই নিষেধাজ্ঞার ফলাফল ছিল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই নেতিবাচক। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রুশ পর্যটকরা কার্যত তুর্কি পর্যটনশিল্পের চালিকাশক্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে, কারণ তুরস্কে আগত বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে রুশ পর্যটকরা। প্রতি বছর ৩০ লক্ষ থেকে ৫০ লক্ষ রুশ পর্যটক তুরস্ক ভ্রমণ করে থাকে এবং এর মাধ্যমে প্রাপ্ত আয় তুর্কি অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া, তুর্কি কোম্পানিগুলো রাশিয়ায় ব্যাপক হারে ব্যবসা–বাণিজ্য করে থাকে এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত মুনাফা তুর্কি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। তদুপরি, রাশিয়া তুরস্কের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য (প্রধানত ফলমূল ও শাকসবজি) আমদানি করে এবং এই রপ্তানি বাণিজ্যও তুরস্কের জন্য লাভজনক।
রুশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে এর প্রতিটিই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তুরস্কে রুশ পর্যটকদের যাতায়াত প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয় এবং রুশ পর্যটকরা তুরস্কের পরিবর্তে গ্রিস, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া, ইতালি, ইসরায়েল, কিরগিজস্তান, তিউনিসিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে শুরু করে। তদুপরি, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ পর্যটন শিল্পও এর ফলে চাঙ্গা হয়ে ওঠে, কারণ তুরস্কের পরিবর্তে রুশরা ক্রিমিয়া, সোচি ও অন্যান্য রুশ অঞ্চলে ছুটি কাটাতে আরম্ভ করে। অন্যদিকে, তুরস্কও অন্যান্য রাষ্ট্রের পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু তাদের প্রচেষ্টা বিশেষ সাফল্যমণ্ডিত হয়নি। উল্লেখ্য, বর্তমানে রুশ–তুর্কি সঙ্কটের অবসান ঘটেছে, কিন্তু ক্রিমিয়া ও সোচির মতো রুশ অঞ্চলগুলোতে ২০১৫–১৬ সালে পর্যটনশিল্পের যে বিস্তৃতি ঘটেছিল, সেটি এখনো অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
রুশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে তুর্কি কোম্পানিগুলো ব্যাপক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং রাশিয়ায় কার্যক্রম পরিচালনা করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। শুধু তা-ই নয়, রাশিয়ায় কর্মরত জার্মান কোম্পানিগুলোর অনেকেই তুর্কি কর্মীদের নিয়োগ করত, এবং রুশ–তুর্কি দ্বন্দ্বের ফলে তাদের পক্ষেও তুর্কি কর্মী নিয়োগ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। রাশিয়া কর্তৃক তুরস্ক থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের ফলে তুরস্কের কৃষিবাণিজ্য খাত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তুর্কিরা দুটি উপায়ে এই ক্ষতিপূরণ করার চেষ্টা চালায়। তারা ইরানের মধ্য দিয়ে ঘুরপথে রাশিয়ায় নিজেদের কৃষিপণ্য রপ্তানির প্রচেষ্টা চালায় এবং আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোতে তুর্কি কৃষিপণ্যের জন্য নতুন বাজার সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু রুশরা তুর্কিদের কৌশল ধরে ফেলে এবং এটি বন্ধ করার জন্য ইরানের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। ২০১৬ সালের ২৩ জানুয়ারি ইরানি সরকার ইরানের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় তুর্কি পণ্য রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। অন্যদিকে, আফ্রিকায় তুর্কি কৃষিপণ্যের জন্য নতুন বাজার তৈরির প্রচেষ্টাও বিশেষ সাফল্যমণ্ডিত হয়নি।
বস্তুত তুর্কি কৃষিপণ্য আমদানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের ফলে রুশ জনসাধারণও প্রাথমিক পর্যায়ে আংশিকভাবে ভোগান্তির সম্মুখীন হয়, কারণ তুরস্কের ওপর রুশ নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর বাজারে সাময়িকভাবে কিছু কিছু পণ্যের (বিশেষত ফলমূল ও শাকসবজি) সঙ্কট দেখা দেয়। কিন্তু শীঘ্রই দক্ষিণ গোলার্ধের অন্যান্য রাষ্ট্র তুর্কিদের এই বিপর্যয়ের সুযোগ গ্রহণ করে এবং রাশিয়ায় তুর্কি কৃষিপণ্যের বাজার নিজেরা অধিকার করে নেয়। এই রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে ছিল ইরান, আজারবাইজান, জর্জিয়া, আবখাজিয়া, চীন, উজবেকিস্তান, ইসরায়েল, মরক্কো ও আর্জেন্টিনা। উল্লেখ্য, উক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আজারবাইজান, জর্জিয়া ও ইসরায়েলের সঙ্গে তুরস্কের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান, কিন্তু তা সত্ত্বেও তুর্কিদের রুশ বাজার হারানোর সুযোগ নিতে তারা বিলম্ব করেনি।
তদুপরি, রুশরা তুরস্কের সঙ্গে তাদের বিভিন্ন যৌথ প্রকল্পের কাজ স্থগিত রাখে এবং এর ফলে 'তুর্কস্ট্রিম' গ্যাস পাইপলাইনের কাজ রুদ্ধ হয়ে যায়। তুরস্ক তাদের আমদানিকৃত জ্বালানির অর্ধেকের বেশি আমদানি করে রাশিয়া থেকে এবং তুর্কি অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য রুশ গ্যাসের সরবরাহ অব্যাহত থাকা তাদের জন্য আবশ্যক। রুশরা ইচ্ছা করলে তুরস্কের কাছে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রেখে তুর্কি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে ফেলতে পারত, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাদের নিজেদেরও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো। এজন্য রুশরা এই পদক্ষেপ গ্রহণ থেকে বিরত থাকে।
সামগ্রিকভাবে, তুরস্কের ওপর প্রায় সাত মাস স্থায়ী রুশ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে তুর্কি অর্থনীতির প্রত্যক্ষ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অন্তত ৯০০ কোটি (বা ৯ বিলিয়ন) থেকে ১,১০০ কোটি (বা ১১ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। তুর্কি অর্থনীতির আকারের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে এটি ছিল তাদের জন্য বড় মাত্রার ক্ষতি। রুশ–তুর্কি সঙ্কট যত প্রলম্বিত হচ্ছিল, তুর্কি অর্থনীতিতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এজন্য ২০১৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ তুর্কি রাজনীতিবিদদের জন্য এই বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছিল।
অবশ্য তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফলে রাশিয়াও প্রাথমিকভাবে কিছু আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। যেমন: তুরস্কে রুশ পর্যটনের মাত্রা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ার ফলে রুশ বৈদেশিক পর্যটন সংস্থাগুলো আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু রুশ পর্যটকরা তুরস্কের পরিবর্তে অন্যান্য রাষ্ট্রে ভ্রমণ করতে শুরু করে এবং এর ফলে তুরস্কে রুশ পর্যটন হ্রাস পাওয়ার ফলে রুশ কোম্পানিগুলোর যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল, তা পূরণ হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, রাশিয়া তুরস্কের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার পর তুরস্কও রাশিয়ার বিরুদ্ধে অনুরূপ পদক্ষেপ নেয়ার প্রচেষ্টা চালায়। তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তুর্কি নাগরিকদের রাশিয়ায় না যাওয়ার জন্য পরামর্শ প্রদান করে এবং তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী তাদের সদস্যদের রাশিয়ায় ছুটি কাটাতে যেতে নিষেধ করে। কিন্তু তুর্কি অর্থনীতির মতো রুশ অর্থনীতিতে পর্যটনশিল্পের অতটা গুরুত্ব নেই এবং এমনিতেও তুরস্ক থেকে রাশিয়ায় গমনকারী পর্যটকের সংখ্যা ছিল অনেক কম। সুতরাং তুর্কিদের পাল্টা পদক্ষেপ রুশ অর্থনীতির ওপর বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়নি।
রুশ–তুর্কি প্রচ্ছন্ন 'সামরিক স্নায়ুযুদ্ধ'
তুরস্ক রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করার পরপ্রই রাশিয়া সিরিয়ায় নিজেদের সামরিক অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। রুশ সামরিক কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় যে, এখন থেকে সিরিয়ায় রুশ যুদ্ধবিমান রুশ বোমারু বিমানগুলোকে 'এসকর্ট' করবে এবং রুশ বোমারু বিমানগুলোতে এয়ার–টু–এয়ার মিসাইল মোতায়েন করা হবে। হিমেইমিম বিমানঘাঁটিতে তারা অত্যাধুনিক 'এস–৪০০ ত্রিউম্ফ' এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করে এবং এর মধ্য দিয়ে কার্যত সিরীয় আকাশসীমায় একটি তুর্কিবিরোধী 'নো ফ্লাই জোন' প্রতিষ্ঠা করে। 'এস–৩০০এফ ফোর্ত' এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সংবলিত রুশ নৌবাহিনীর ক্রুজার 'মস্কভা'কে লাতাকিয়া বন্দরে মোতায়েন করা হয় এবং এর মধ্য দিয়ে সিরিয়ায় রুশ সশস্ত্রবাহিনীর নিরাপত্তার মাত্রা বৃদ্ধি করা হয়। রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন সিরিয়ায় মোতায়েনকৃত রুশ সৈন্যদের 'অত্যন্ত কঠোর'ভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করার এবং তাদের হুমকির সম্মুখীন করতে পারে এরকম সকল লক্ষ্যবস্ত ধ্বংস করে দেয়ার নির্দেশ দেন।
তদুপরি, রাশিয়া তুরস্কের সঙ্গে সব ধরনের সামরিক যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়, তুর্কি উদ্যোগে গঠিত 'ব্ল্যাক সি ন্যাভাল ফোর্স' সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ বন্ধ করে দেয়, তুরস্ক থেকে নিজেদের নৌবাহিনীর প্রতিনিধিদের প্রত্যাহার করে নেয় এবং রুশ নৌবাহিনীর কৃষ্ণসাগরীয় নৌবহর তুর্কি নৌবাহিনীর সঙ্গে তাদের কার্যক্রম সমন্বয় করা স্থগিত রাখে। এছাড়া রুশরা আর্মেনিয়ায় অবস্থিত এরেবুনি বিমানঘাঁটিতে ৭টি অতিরিক্ত 'মি–২৪পি' অ্যাটাক হেলিকপ্টার ও 'মি–৮এমটি' পরিবহন হেলিকপ্টার মোতায়েন করে, এবং অঞ্চলটি পূর্ব তুরস্কের সন্নিকটে। বস্তুত রুশদের গৃহীত এসব সামরিক পদক্ষেপ তুর্কি সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তোলে এবং তারা আশঙ্কা করতে থাকে যে, রাশিয়া হয়তো তুরস্কের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বসতে পারে। এজন্য রুশ বিমান ভূপাতিত করার পরপরই তারাও বেশ কিছু সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
তুর্কি–সিরীয় সীমান্তে ইতিপূর্বে ২টি করে তুর্কি যুদ্ধবিমান টহল দিত, কিন্তু রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর তুর্কি সরকার এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৬টিতে উন্নীত করে, কারণ তাদের আশঙ্কা ছিল যে, রুশরা প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য তুর্কি বিমান ভূপাতিত করার চেষ্টা করতে পারে। ২০১৫ সালের ২৬ নভেম্বর তারা তুর্কি–সিরীয় সীমান্তে ২০টি ট্যাঙ্ক ও ১৮টি যুদ্ধবিমান মোতায়েন করে। ২৭ নভেম্বর তারা সিরিয়ায় আইএসের ওপর বিমান হামলা পরিচালনা স্থগিত রাখে (উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে মার্কিন–নেতৃত্বাধীন যে জোটটি আইএসকে দমনের কারণ দেখিয়ে সিরিয়ায় আক্রমণ চালায়, তুরস্কও সেই জোটের সদস্য ছিল)। ২৯ নভেম্বর তুর্কিরা তুর্কি–সিরীয় সীমান্তের কাছে 'কোরাল' ইলেক্ট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম মোতায়েন করে।
তুর্কি সরকারের ধারণা ছিল, মার্কিন–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো রুশ–তুর্কি সঙ্কটে তুরস্ককে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করবে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে তুর্কি রাজনীতিবিদরা যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিচ্ছিলেন, সেটি বহুলাংশে ন্যাটোর প্রদত্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিশ্চয়তার ভিত্তিতেই দিচ্ছিলেন। বস্তুত ২০১৫ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই তুরস্কের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য মার্কিন বিমানবাহিনী তুরস্কের ইনজিরলিক বিমানঘাঁটিতে অতিরিক্ত যুদ্ধবিমান মোতায়েন করেছিল এবং তুরস্ক রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর প্রাথমিকভাবে মার্কিন ও ন্যাটো কর্মকর্তারা তুর্কিদের অবস্থানকে সমর্থন করেন। কিন্তু ৬ ডিসেম্বর নাগাদ মার্কিনিরা ইনজিরলিক বিমানঘাঁটি থেকে তুরস্কের নিরাপত্তার জন্য মোতায়েনকৃত যুদ্ধবিমান প্রত্যাহার করে নেয়। এই ঘটনার ফলে তুর্কি সরকারের কাছে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সিরিয়াকে কেন্দ্র করে রুশ–তুর্কি যুদ্ধ আরম্ভ হলে তুরস্ক যে ন্যাটোর সমর্থন লাভ করবেই, সেটি নিশ্চিত নয়।
এদিকে রুশদের সামরিক প্রতিক্রিয়া কেবল সিরিয়ায় তাদের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি ও তুরস্কের সঙ্গে সামরিক যোগাযোগ হ্রাস করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তুর্কিরা রুশ বিমান ভূপাতিত করার পরবর্তী দিনই (২০১৫ সালের ২৫ নভেম্বর) রুশ বিমানবাহিনী সিরিয়ার মিলিট্যান্ট–নিয়ন্ত্রিত উত্তর–পশ্চিমাঞ্চলীয় আজাজ শহরে একটি তুর্কি 'সহায়তা কনভয়ে'র ওপর আক্রমণ চালায়। রুশ বিমান হামলার ফলে কনভয়টির অন্তত ২০টি ট্রাক ধ্বংস হয়ে যায়, এবং ৭ জন ট্রাকচালক নিহত ও অন্তত ১০ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। কনভয়টি তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় কিলিস প্রদেশ থেকে সিরিয়ায় প্রবেশ করেছিল এবং তুর্কিদের ভাষ্যমতে, সেটি সিরীয় মিলিট্যান্টদের জন্য 'মানবিক সহায়তা' নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কনভয়টি কী বহন করছিল, সেটি প্রশ্নসাপেক্ষ। উল্লেখ্য, আজাজ শহরকে সিরীয় মিলিট্যান্টদের জন্য 'লাইফলাইন' হিসেবে বিবেচনা করা হতো, কারণ এর মধ্য দিয়ে তুরস্ক থেকে সিরীয় মিলিট্যান্টদের জন্য অস্ত্রশস্ত্র ও রসদপত্র আসত।
তুর্কিদের রুশ বিমান ভূপাতিত করার পশ্চাতে তাৎক্ষণিক কারণ ছিল সিরীয় তুর্কমেন–অধ্যুষিত বায়িরবুজাক অঞ্চলে চলমান রুশ–সিরীয় সামরিক অভিযান। বিমানটি ভূপাতিত করার আগে এবং পরে তুর্কিরা বারবার এই অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা বন্ধ করার জন্য রাশিয়ার কাছে দাবি জানিয়েছিল। কিন্তু তুর্কিরা রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর এবং সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টরা রুশ বৈমানিককে খুন করার পর রুশরা তুর্কিদের দাবি সম্পূর্ণভাবে অগ্রাহ্য করে। ২৫ নভেম্বর থেকে রুশ বিমানবাহিনী অঞ্চলটির ওপর ব্যাপক বোমাবর্ষণ শুরু করে এবং ভূমধ্যসাগর থেকে রুশ যুদ্ধজাহাজ অঞ্চলটির ওপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। সিরীয় সেনাবাহিনীও অঞ্চলটির ওপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ শুরু করে। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর ২০১৬ সালের ১২ মার্চ নাগাদ বায়িরবুজাকসহ প্রায় সমগ্র লাতাকিয়া প্রদেশ সিরীয় সরকারের হস্তগত হয়। এর ফলে 'সুরিয়ে তুর্কমেন ওর্দুসু'সহ তুর্কি–সমর্থিত মিলিট্যান্ট গ্রুপগুলো এই অঞ্চল থেকে পশ্চাৎপসরণে বাধ্য হয়।
তদুপরি, রাশিয়া সিরিয়ায় তুরস্কের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠা 'ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি/পার্তিয়া ইয়েকিতিয়া দেমোক্রাৎ' (কুর্দি: Partiya Yekîtiya Demokrat, 'PYD') এবং 'পিওয়াইডি'র সশস্ত্র শাখা 'পিপলস ডিফেন্স ইউনিটস/ইয়েকিনেয়েন পারাস্তিনা গেল'–এর (কুর্দি: Yekîneyên Parastina Gel, 'YPG') সঙ্গে তাদের বিদ্যমান সম্পর্ককে জোরদার করে। পিওয়াইডির সঙ্গে তুরস্কভিত্তিক কুর্দি মিলিট্যান্ট গ্রুপ 'কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি/পার্তিয়া কারকেরেন কুর্দিস্তান'–এর (কুর্দি: Partîya Karkerên Kurdistanê, 'PKK') ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে এবং তুর্কি সরকার কর্তৃক 'সন্ত্রাসবাদী সংগঠন' হিসেবে চিহ্নিত এই দলটি ১৯৮০–এর দশক থেকে তুর্কি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। স্বভাবতই রাশিয়া ও সিরীয় কুর্দিদের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন তুরস্কের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয় দাঁড়ায়। উল্লেখ্য, ইতিপূর্বে সিরিয়া নিয়ে তুরস্ক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছিল, সেটিও মূলত উদ্ভূত হয়েছিল পিওয়াইডি/ওয়াইপিজির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার কারণে।
তুরস্ক রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর রুশরা আইএস ও তুর্কি–সমর্থিত মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পিওয়াইডি/ওয়াইপিজিকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিতে শুরু করে এবং রুশ বিমানবাহিনী সিরীয় কুর্দি মিলিট্যান্টদের সমর্থনে বিমান হামলা চালায়। তুরস্কের প্রতিবাদ সত্ত্বেও রুশরা সিরিয়ার আফরিন অঞ্চলে সক্রিয় প্রায় ৫,০০০ কুর্দি মিলিট্যান্টকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাভরভ খোলাখুলিভাবে আইএসবিরোধী যুদ্ধে সিরীয় কুর্দি মিলিট্যান্টদের ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং তাদেরকে সিরিয়া সংক্রান্ত শান্তি আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেন।
তদুপরি, ২০১৬ সালের ২৯ জানুয়ারি ও ২৪ ফেব্রুয়ারি তুর্কি সরকার অভিযোগ করে যে, রুশ বিমান আবারো তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। অবশ্য রাশিয়া উভয় ক্ষেত্রেই এই অভিযোগ অস্বীকার করে। তুর্কিদের অভিযোগ যদি সত্যি হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে যে, 'সু–২৪এম' ঘটনার পর রুশরা ইচ্ছাকৃতভাবেই তুর্কিদের উত্যক্ত করার জন্য তাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে শুরু করে, কিন্তু চলমান রুশ–তুর্কি যাতে আরো তীব্র রূপ ধারণ না করে, সেজন্য তুর্কিরা কোনো ধরনের আক্রমণাত্মক জবাব প্রদান করা থেকে বিরত থাকে। বস্তুত এসময় রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল, যেটিতে কোনো পক্ষই পিছু হটতে প্রস্তুত ছিল না, আবার কোনো পক্ষ সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হতেও আগ্রহী ছিল না।
This is the third part of a Bengali article about the shootdown of a Russian bomber in Syria by Turkey in 2015.
Sources:
- Deniz Ayhan. "Aktrolller Rus krizinde suçluyu buldu." Sözcü. December 15, 2015.
- Emre Erşen. "Evaluating the Fighter Jet Crisis in Turkish-Russian Relations." Insight Turkey, Vol. 19, No. 4, p. 85–104.
- Natasha Bertrand. "Russia is already exacting its revenge on Turkey for downing a Russian warplane." Business Insider. November 26, 2015.
- Olga Kuznetsova. "Друг оказался враг." Kommersant. December 25, 2015.
- Olivier d'Auzon. "Les Kurdes à la lisière de l'Euphrate ou la revanche de Poutine." Huffpost. January 13, 2016.
- Seyhmus Cakan and John Davison. "Russia bombards Syrian rebels near site of downed Russian jet." Business Insider. November 25, 2015.
- "Russian airstrikes target aid convoy in northwestern Syrian town of Azaz, 7 killed." Daily Sabah. November 25, 2015.
- "Russian support for PKK's Syrian arm PYD." Anadolu Agency. November 27, 2015.
- "Аксенов: Крым прервет паромное сообщение и деловые контакты с Турцией." RIA Novosti. November 25, 2015.
- "На авиабазу Хмеймим в Сирии перебросят зенитно-ракетную систему С-400." Lenta.ru. November 25, 2015.
- "РФ в ответ на атаку Су-24 турецкими ВВС приостанавливает участие в учениях BLACKSEAFOR." TASS. November 27, 2015.
Source of the featured image: Airforce Technology