২০১৬ সালের ২৪ জুন তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান রুশ বিমান ভূপাতিতকরণ ও রুশ বৈমানিকের মৃত্যুর জন্য ক্ষমা চেয়ে রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনকে চিঠি দেন এবং ২৭ জুন রুশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই সংবাদ ঘোষণা করে। এর মধ্য দিয়ে চলমান 'সু–২৪এম' সঙ্কটের অবসান ঘটে এবং রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। ২৯ জুন পুতিন ও এরদোয়ানের মধ্যে একটি ফোনালাপ অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পুতিন রুশ পর্যটকদের তুরস্ক ভ্রমণের ওপর থেকে সমস্ত বাধানিষেধ সরিয়ে নেন এবং রুশ–তুর্কি বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের নির্দেশ দেন। এরপর থেকে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সিরিয়াসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে যোগাযোগ বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়।
'সু–২৪এম সঙ্কট' নিরসনের মূল্য: আলেপ্পো থেকে তুর্কি পশ্চাৎপসরণ
সিরীয় যুদ্ধ শুরুর পর থেকে তুরস্ক সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃহত্তর পশ্চিমা বিশ্বের পদাঙ্ক অনুসরণ করে আসছিল এবং সিরীয় সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। অবশ্য একইসঙ্গে সিরিয়াকে ঘিরে তুরস্কের নিজস্ব ভূরাজনৈতিক পরিকল্পনাও ছিল। কিন্তু সিরীয় যুদ্ধ প্রলম্বিত হতে শুরু করলে সিরিয়ায় পশ্চিমা বিশ্বের কৌশলগত লক্ষ্যের সঙ্গে তুরস্কের কৌশলগত লক্ষ্যের পার্থক্য দেখা দিতে শুরু করে এবং সময়ের সাথে সাথে এই পার্থক্যের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। সিরীয় কুর্দি মিলিট্যান্টরা সিরিয়ায় তুরস্কের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সিরীয় কুর্দিদের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে। পশ্চিমা–সিরীয় কুর্দি সম্পর্ককে তুরস্ক নিজস্ব নিরাপত্তা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে শুরু করে।
এমতাবস্থায় রাশিয়া সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে এবং এর ফলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে শুরু করে। সিরিয়ায় রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট সরাসরি সিরীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে অস্বীকৃতি জানায়। কিন্তু তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তুরস্ককে উৎসাহ প্রদান করতে থাকে। বস্তুত রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করার পর প্রাথমিকভাবে তুর্কি সরকার রাশিয়ার প্রতি যে অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করছিল, সেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর প্রদত্ত নিরাপত্তা সংক্রান্ত নিশ্চয়তার ভিত্তিতেই করছিল। বস্তুত তুরস্ক রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর প্রাথমিকভাবে ন্যাটো এবং ন্যাটোভুক্ত ও ন্যাটোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট কিছু রাষ্ট্র (যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, লিথুয়ানিয়া, লাতভিয়া, ইউক্রেন, জর্জিয়া প্রভৃতি) তুরস্কের অবস্থানকে সমর্থন করে।
কিন্তু তুরস্কের প্রতি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন ছিল দুর্বল প্রকৃতির। এই ঘটনার দুই সপ্তাহের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের ইনজিরলিক বিমানঘাঁটি থেকে তুরস্ককে সম্ভাব্য রুশ আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য মোতায়েনকৃত মার্কিন যুদ্ধবিমানবহর প্রত্যাহার করে নেয়। তদুপরি, ন্যাটো সদস্য গ্রিস ও চেক প্রজাতন্ত্র তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার নিন্দা জানায়, এবং এর বাইরে সার্বিয়া, আর্মেনিয়া, ইরাক ও কাজাখস্তান তুরস্কের এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করে। শুধু তা-ই নয়, ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্র গ্রিস, বুলগেরিয়া ও ইতালিতে তুর্কি দূতাবাসের সামনে তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার প্রতিবাদে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। সর্বোপরি, বুলগেরিয়ার সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিত্বকারী দল 'মুভমেন্ট ফর রাইটস অ্যান্ড ফ্রিডমস/দ্ভিঝেনিয়ে জা প্রাভা ই সভোবোদি'র (বুলগেরীয়: Движение за права и свободи) সভাপতি লুৎভি মেস্তান তুরস্ক কর্তৃক রুশ বিমান ভূপাতিত করার সিদ্ধান্তকে সমর্থন করায় তাকে উক্ত দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
অর্থাৎ, রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর তুর্কি সরকার বহির্বিশ্ব, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্ব, থেকে যে ধরনের সমর্থন লাভের আশা করেছিল, সে ধরনের সমর্থন পায়নি। স্বাভাবিকভাবেই তুর্কি সরকার ও জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এরকম বোধ করতে থাকে যে, পশ্চিমা বিশ্ব প্রথমে তাদেরকে সিরিয়া ও পরে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে উৎসাহিত করেছে এবং এরপর তাদেরকে রুশদের মোকাবিলায় একাকী দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বের ফলে বিপুল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি আর রুশদের সঙ্গে সিরীয়/তুর্কি কুর্দিদের সম্পর্কোন্নয়ন ছাড়া তুরস্ক আর কিছু লাভ করতে পারেনি। ফলে শেষপর্যন্ত তুর্কি সরকার রুশদের সঙ্গে সরাসরি দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকার নীতি থেকে সরে আসে।
পরবর্তী ঘটনাবলির পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান হয় যে, পুতিনের কাছে এরদোয়ানের চিঠি প্রেরণ, ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রস্তাব রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য রাশিয়াকে তুর্কি সরকারের প্রদত্ত একমাত্র মূল্য ছিল না। উক্ত চিঠি প্রেরণের দুই সপ্তাহের মধ্যেই তুরস্ক সিরিয়ার আলেপ্পো থেকে তুর্কি গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের প্রত্যাহার করে নেয়। উল্লেখ্য, ২০১২ সাল থেকে সিরীয় সরকার ও সিরীয় মিলিট্যান্টরা সিরিয়ার তদানীন্তন বৃহত্তম শহর আলেপ্পো দখলের জন্য প্রলম্বিত এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, সৌদি আরব ও কাতারের পাশাপাশি তুরস্কও আলেপ্পো দখলের লড়াইয়ে সিরীয় মিলিট্যান্টদের সর্বতোভাবে সহায়তা করছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল, মিলিট্যান্টরা আলেপ্পো দখল করতে পারলে সেটিকে রাজধানী ঘোষণা করে একটি বিকল্প সরকার গঠন করতে পারবে এবং সিরীয় সরকারের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারবে।
বিশ্লেষকদের মতে, পুতিনের কাছে চিঠি প্রেরণের পর আলেপ্পো থেকে নিজেদের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সরিয়ে নিয়ে আঙ্কারা মস্কোকে ইঙ্গিত দেয় যে, তারা তাদের আগের পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে এবং সিরিয়ায় রুশ সামরিক অভিযানে তারা আর প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে না। এর ফলে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর নাগাদ সিরীয় সরকার রুশ, ইরানি ও হিজবুল্লাহ সহায়তায় আলেপ্পোর সম্পূর্ণ অংশ পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়। এটিই ছিল রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য তুর্কিদের প্রদত্ত প্রকৃত মূল্য। সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিনিময়ে তারা রুশপন্থী সিরীয় সরকারকে সামরিক শক্তির মাধ্যমে উৎখাত করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে এবং নিজেদের কার্যক্রম প্রধানত সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ রাখে। কিন্তু রুশ–তুর্কি সম্পর্কে আরো অগ্রগতি হওয়ার আগেই তুরস্কের অভ্যন্তরে বৃহৎ মাত্রার একটি 'রাজনৈতিক ভূমিকম্প' (political earthquake) ঘটে।
তুর্কি সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা: কে দায়ী?
২০১৬ সালের ১৫–১৬ জুলাই তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর একাংশ একটি সামরিক অভ্যুত্থান পরিচালনা করে এবং 'একেপি'–নিয়ন্ত্রিত তুর্কি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা চালায়। অভ্যুত্থানকারীরা তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর জেনারেল স্টাফের প্রধান জেনারেল হুলুসি আকারকে বন্দি করে, আঙ্কারায় তুর্কি আইনসভা ভবনের ওপর বোমাবর্ষণ করে এবং তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ানকে খুন করার প্রচেষ্টা চালায়। কিন্তু তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর সিংহভাগ অংশ এই অভ্যুত্থানে যোগদান করেনি এবং তুর্কি জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সক্রিয়ভাবে অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করে। ফলে অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হয় এবং তুর্কি সরকার নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর তুর্কি সরকার তুর্কি সশস্ত্রবাহিনী ও তুরস্কের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান চালাতে শুরু করে এবং হাজার হাজার ব্যক্তিকে অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।
তুর্কি সরকার এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার জন্য তুর্কি ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনের নেতৃত্বাধীন সংগঠন 'সার্ভিস/হিজমেৎ'কে (তুর্কি: Hizmet) দায়ী করে এবং এই সময় থেকেই তুর্কি সরকার হিজমেৎকে 'ফেতুল্লাহিস্ট টেররিস্ট অর্গানাইজেশন/ফেতুল্লাহচি তেরর ওর্গুতু' (তুর্কি: Fethullahçı Terör Örgütü, 'FETÖ') নামে অভিহিত করতে শুরু করে। উল্লেখ্য, গুলেন তুরস্কের একজন অত্যন্ত প্রভাবশালী ধর্মীয় নেতা এবং ১৯৭০–এর দশক থেকে তার সংগঠনটি তুর্কি রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে গোপনে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। ২০০২ সালে 'একেপি' তুরস্কের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর একেপি ও হিজমেৎ তুর্কি সরকার ও সশস্ত্রবাহিনীর ধর্মনিরপেক্ষ অভিজাত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে একটি জোট গঠন করে এবং ২০১০–এর দশকের প্রথম দিক নাগাদ তুর্কি ধর্মনিরপেক্ষ অভিজাতরা পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হন। এরপর একেপি ও হিজমেৎ–এর মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং একেপি–নিয়ন্ত্রিত তুর্কি সরকার তুর্কি রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হিজমেৎবিরোধী শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করতে শুরু করে। উল্লেখ্য, একেপি ও হিজমেৎ উভয়েই সাধারণভাবে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী, কিন্তু তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম আদর্শিক ও নীতিগত পার্থক্য রয়েছে।
১৯৯৯ সাল থেকে গুলেন যুক্তরাষ্ট্রের পেন্সিলভেনিয়া প্রদেশে স্বেচ্ছা–নির্বাসনে রয়েছেন। গুলেন ২০১৬ সালে তুরস্কে সংঘটিত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা করেছেন। কিন্তু তুর্কি সরকারের ভাষ্যমতে, গুলেনের নির্দেশেই তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর অভ্যন্তরে মিশে থাকা হিজমেৎ সদস্যরা/গুলেনপন্থীরা এই অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে তুরস্ক গুলেনের নাগরিকত্ব বাতিল করে, তার সংগঠনকে একটি 'সন্ত্রাসবাদী সংগঠন' হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তুরস্ক জুড়ে সন্দেহভাজন গুলেনপন্থীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক দমন–পীড়ন শুরু করে। উল্লেখ্য, তুরস্কের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান এবং উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলোও গুলেনের সংগঠনকে 'সন্ত্রাসবাদী সংগঠন' হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা রুশ–তুর্কি সম্পর্কে একটি নতুন ধারার সূচনা করে। অভ্যুত্থানের পর ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নেতাদের আগেই রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন এরদোয়ানকে ফোন করেন এবং অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা জানিয়ে তুর্কি সরকারের প্রতি রাশিয়ার সমর্থন ব্যক্ত করেন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের নেতারা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা জানানোর ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা দেরি করেন। এর ফলে তুর্কি সরকারের সদস্যদের মধ্যে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয় যে, পশ্চিমা বিশ্ব এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টাকে সমর্থন করছিল এবং শেষ পর্যন্ত অভ্যুত্থান সফল হয় কিনা, সেটি দেখতে অপেক্ষা করছিল।
উল্লেখ্য, উক্ত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এই মর্মে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার আগেই রুশরা তুরস্কে অনুষ্ঠিতব্য অভ্যুত্থানের কথা জানতে পেরেছিল। রুশ সশস্ত্রবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সিরিয়ার লাতাকিয়ায় অবস্থিত তাদের ঘাঁটি থেকে তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর যোগাযোগের ওপর নজরদারি করছিল এবং এসময় তারা অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যেকার যোগাযোগ ইন্টারসেপ্ট করে। এই পরিস্থিতিতে রুশরা তুর্কি গোয়েন্দা সংস্থা 'এমআইটি'কে সম্ভাব্য অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সম্পর্কে জানিয়ে দেয়। এমআইটি প্রধান হাকান ফিদান অভ্যুত্থানকারীদের পরিকল্পনা সম্পর্কে জেনে গেছেন, এটা জানতে পারার পর অভ্যুত্থানকারীরা নির্ধারিত সময়ের পাঁচ ঘণ্টা আগেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা শুরু করতে বাধ্য হয়, যেটি তাদের পরিকল্পনাকে সম্পূর্ণ ওলটপালট করে দেয় এবং শেষপর্যন্ত অভ্যুত্থানটি ব্যর্থ হয়।
এক্ষেত্রে দুটি বিষয় বিবেচনাযোগ্য। প্রথমত, এই সংবাদটি সত্যি কিনা, সেটি যাচাই করার কোনো উপায় নেই। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর রুশ রাষ্ট্রপতির মুখপাত্র দিমিত্রি পেস্কভ জানান যে, অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হওয়ার আগে রুশরা এই বিষয়ে কিছু জানত না। কিন্তু রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পুতিনের উপদেষ্টা আলেক্সান্দর দুগিনের ভাষ্যমতে, রুশরা অভ্যুত্থানের আগে সম্ভাব্য অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সম্পর্কে তুর্কি সরকারকে অবগত করেছিল।
দ্বিতীয়ত, এই সংবাদটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, পুতিনের কাছে চিঠি প্রেরণের মাধ্যমে 'সু–২৪এম' সঙ্কট নিরসনের সিদ্ধান্ত ছিল এরদোয়ান ও একেপির জন্য একটি অত্যন্ত ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত। কারণ অভ্যুত্থানের সময় যদি রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে দ্বন্দ্ব বজায় থাকত, সেক্ষেত্রে রুশরা তুর্কিদেরকে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সম্পর্কে সতর্ক করে দিত, এরকম সম্ভাবনা ছিল খুবই কম। সেক্ষেত্রে উক্ত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সফল হওয়ার এবং এরদোয়ানের নিহত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
সংবাদটি সত্যি বা মিথ্যা যা-ই হোক, অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর এরদোয়ান প্রথম যে দেশটি সফর করেছিলেন সেটি হচ্ছে রাশিয়া। ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট তিনি রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গে পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর তুর্কি সরকারের প্রতি রাশিয়ার সমর্থনের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানান। বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে উভয়ে ঘোষণা করেন যে, রাশিয়া ও তুরস্ক 'সু–২৪এম' সঙ্কটকে পিছনে ফেলে নিজেদের সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আগ্রহী।
এদিকে ২০১৬ সালের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্কের গুরুতর অবনতি ঘটে। পশ্চিমা রাষ্ট্রনায়করা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার নিন্দা জানাতে দেরি করেন এবং এটিকে তুর্কি সরকার উক্ত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার প্রতি পশ্চিমাদের 'মৌন সমর্থন' হিসেবে চিহ্নিত করে। তদুপরি, অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার পর এরদোয়ান তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামার কাছে ফোন করেন এবং গুলেনকে এই অভ্যুত্থানের জন্য দায়ী করে তাকে তুর্কি সরকারের কাছে হস্তান্তর করার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু মার্কিন সরকার তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। তদুপরি, তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর বেশকিছু গুলেনপন্থী সদস্য পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোতে (যেমন: যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, গ্রিস প্রভৃতি) রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ করে এবং একে কেন্দ্র করেও তাদের সঙ্গে তুর্কি সরকারের বিরোধ দেখা দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে এরদোয়ান মন্তব্য করেন, উক্ত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পশ্চাতে গুলেনের পাশাপাশি একটি 'উচ্চতর শক্তি' ভূমিকা রয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, তার ইঙ্গিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। পরবর্তীতে এরদোয়ান সরাসরি অভিযোগ করেন যে, মার্কিন সরকার 'সন্ত্রাসবাদী' গুলেনকে রক্ষা করছে এবং মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর 'সেন্ট্রাল কমান্ডে'র অধিনায়ক জেনারেল জোসেফ ভোটেল অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে ছিলেন। তদানীন্তন তুর্কি শ্রম ও সামাজিক নিরাপত্তামন্ত্রী (বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) সুলেয়মান সোয়লু এই অভ্যুত্থানের জন্য সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন। তুর্কি সরকারপন্থী পত্রিকা 'ইয়েনি শাফাকে'র ভাষ্যমতে, আফগানিস্তানে মোতায়েনকৃত ন্যাটো সৈন্যদলের প্রাক্তন অধিনায়ক মার্কিন জেনারেল জন ক্যাম্পবেল ছিলেন এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার মূল পরিকল্পনাকারী। পরবর্তীতে ইস্তাম্বুলের একটি আদালত এই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে মার্কিন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও 'ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স কাউন্সিলে'র প্রাক্তন উপ–সভাপতি গ্রাহাম ফুলারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
মার্কিন সরকার এই অভিযোগগুলোর প্রতিটিই অস্বীকার করেছে। কিন্তু তার ফলে তুর্কি সরকার ও জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসেনি। তুর্কিরা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকেই দায়ী করতে থাকে। এমতাবস্থায় কিছু নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি হয়। ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর তুর্কিরা যে রুশ বিমানটি ভূপাতিত করেছিল, সেটি কি আসলেই তুর্কি সরকারের নির্দেশে ঘটেছিল, নাকি অন্য কেউ ঘটনাটি ঘটিয়ে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে একটি সঙ্কট সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল?
সু–২৪এম সঙ্কট, গুলেন ও যুক্তরাষ্ট্র: রহস্য উন্মোচন, না ষড়যন্ত্র তত্ত্ব?
২০১৬ সালের ১৫–১৬ জুলাই তুরস্কে সংঘটিত ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের পর তুর্কি সরকার তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর সন্দেহভাজন গুলেনপন্থী সদস্যদের পাইকারিভাবে গ্রেপ্তার করতে শুরু করে। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পরের দিন আঙ্কারার তদানীন্তন মেয়র মেলিহ গোকচেক 'সিএনএন তুর্ক'কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে জানান যে, যে এফ–১৬ যুদ্ধবিমানটি রুশ বোমারু বিমানকে ভূপাতিত করেছিল, সেটির দুই বৈমানিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিল। তিনি মন্তব্য করেন যে, এই দুই বৈমানিক গুলেনপন্থী এবং তারা রুশ বিমান ভূপাতিত করে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করতে চেয়েছিল। এর কয়েকদিন পরেই তুর্কি বিচারমন্ত্রী বেকির বোজদা তুর্কি টিভি চ্যানেল 'হাবেরতুর্ক'কে জানান যে, উক্ত দুই বৈমানিককে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং গুলেনের 'হিজমেৎ' সংগঠনের সঙ্গে তাদের কোনো সংযোগ আছে কিনা, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, দুজন বৈমানিক নিজে থেকে কীভাবে একটি বিদেশি বিমান ভূপাতিত করার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? তাদের এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার নেই এবং এই জাতীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য তাদের প্রথমে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাহলে তারা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশ ছাড়া কীভাবে রুশ বিমান ভূপাতিত করলেন? আর যদি বা তারা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নির্দেশ ছাড়াই রুশ বিমান ভূপাতিত করে থাকেন, সেক্ষেত্রে বিমানটি ভূপাতিত করার পরপরই কেন তাদেরকে সামরিক আইন অনুযায়ী বিচারের সম্মুখীন করা হলো না?
এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোলু তুর্কি আইনসভাকে প্রদত্ত একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছেন, কার্যত রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান বা তিনি ঐদিন রুশ বিমানটি ভূপাতিত করার নির্দেশ দেননি। তার ভাষ্যমতে, রুশ বিমানটি মাত্র ১৭ সেকেন্ড তুর্কি আকাশসীমায় অবস্থান করেছিল (উল্লেখ্য, রুশদের মতে বিমানটি তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করেনি) এবং এই স্বল্প সময়ের মধ্যে বৈমানিকদের পক্ষে তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং রাষ্ট্রপতি/প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। সুতরাং বৈমানিকরা নিজেরাই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
কিন্তু দাভুতোলু তার প্রতিবেদনে এটাও উল্লেখ করেছেন যে, বৈমানিকরা যে পুরোপুরি নিজেদের সিদ্ধান্তে রুশ বিমানটি ভূপাতিত করেছিলেন, এমনটাও না। ২০১২ সালে একটি তুর্কি বিমান সিরীয় আকাশসীমা লঙ্ঘন করার পর সিরীয় সেনাবাহিনী উক্ত বিমানটি ভূপাতিত করে এবং এরপর থেকে তুর্কি সরকার তাদের আকাশসীমা সংক্রান্ত নিয়ম পরিবর্তন করে। এসময় তুর্কি সরকার থেকে তুর্কি বিমানবাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, সিরিয়া থেকে কোনো আকাশযান তুর্কি আকাশসীমায় প্রবেশ করলেই সেটি ধ্বংস করতে হবে। এই নির্দেশনা মোতাবেক পরবর্তী দুই বছরে তুর্কি বিমানবাহিনী একটি সিরীয় হেলিকপ্টার ও একটি সিরীয় যুদ্ধবিমানকে ভূপাতিত করে। রুশরা যখন সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তখনো তুর্কি সরকার এই নিয়ম বজায় রাখে। সুতরাং রুশ বিমানটি যদি তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করে থাকে, সেক্ষেত্রে তুর্কি বৈমানিকরা বিমানটি ভূপাতিত করে কার্যত তুর্কি সরকারের ইতিপূর্বে জারি করা নির্দেশই পালন করেছে।
অর্থাৎ, দাভুতোলুর মতে, তুর্কি বৈমানিকরা রুশ বিমানটি ভূপাতিত করার আগে তুর্কি সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নেয়নি, কিন্তু তুর্কি সরকারেরই ইতিপূর্বে জারি করা নির্দেশ পালন করেছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন দেখা দেয়: তুর্কি বৈমানিক দুজন কি রুশ বিমানটি ভূপাতিত করার সময় সত্যিই কেবল তুর্কি সরকারের নির্দেশ পালন করছিল? নাকি তারা তুর্কি সরকারের নির্দেশ পালনের আড়ালে অন্য কারো গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিল?
This is the sixth part of a Bengali article about the shootdown of a Russian Su-24M bomber in Syria by Turkey in 2015.
Sources:
- Bruno Maçães. "Did Turkey’s Moves Toward Russia Provoke the Coup?" Carnegie Europe. August 10, 2016.
- Damien Sharkov. "Erdogan Ally Says Turkish Pilot Decided To Down Russian Jet." Newsweek. July 22, 2016.
- Yunus Paksoy. "FETÖ targeted Turkish-Russian ties by downing Russian jet, analysts say." Daily Sabah. July 29, 2016.
- "Erdogan: Link Between Pilots Who Shot Down Russian Su-24 and Gulen Movement." Sputnik International. July 20, 2016.
- "Davutoğlu: Genelkurmay, Rus uçağını düşüren pilotun FETÖ'cü olmadığını iletti." Sputnik Türkiye. January 12, 2017.
- "Davutoğlu'dan Rus uçağı açıklaması: 'Suriye'den yaklaşan her uçak vurulmalı' dedik." BBC News Türkçe. July 27, 2016.
- "'Rus uçağını Gülen düşürdü, Karlov'u Gülen vurdu' Bu hikayeleri ninenize anlatın." ABC Gazetesi. December 27, 2016.
- "Kurbanov: Rus uçağı İncirlik'ten düşürüldü." Takvim. December 5, 2016.
- "Rus Savaş Uçağının Fetö Tarafıdan Düşürüldüğü İddiası." Milliyet. July 10, 2017.
- "Rus uçağını düşüren pilotlar tutuklandı mı? Bozdağ: Teyit edilmedi." Cumhuriyet. July 19, 2016.
- "Rus uçağını düşürme emrini kimin verdiği ortaya çıktı." Sabah. December 5, 2016.
- "В АФИНАХ ОСУДИЛИ ТУРКОВ ЗА СУ-24." DNI.ru. November 26, 2015.
- "В Риме прошел митинг против действий турецких властей." Pravda.ru. November 28, 2015.
- "Партия в Болгарии исключила своего лидера за поддержку Турции по Су-24." RIA Novosti. December 24, 2015.
Source of the featured image: Airforce Technology