Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যখন তুরস্ক রুশ বোমারু বিমান ভূপাতিত করেছিল || পর্ব–৭

[৬ষ্ঠ পর্ব পড়ুন]

২০১৬ সালের জুলাইয়ে তুরস্কে সংঘটিত ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর তুর্কি সরকার জানায় যে, যে দুজন বৈমানিক ২০১৫ সালের নভেম্বরে রুশ বোমারু বিমানটি ভূপাতিত করেছিল, তারা অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সঙ্গে জড়িত ছিল এবং এজন্য তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার কয়েক দিনের মধ্যেই তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান ‘আল–জাজিরা’কে প্রদত্ত একটি সাক্ষাৎকারে এই সংবাদ নিশ্চিত করেন এবং জানান যে, উক্ত বৈমানিক দুইজন ফেতুল্লাহ গুলেনের সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কিনা, সেটি তারা তদন্ত করে দেখছেন। এই পরিস্থিতিতে রুশ বোমারু বিমানটি প্রকৃতপক্ষে কারা এবং কোন উদ্দেশ্যে ভূপাতিত করেছিল, সেটি নিয়ে নানা তত্ত্বের আবির্ভাব হতে থাকে।

সু–২৪এম সঙ্কটের সঙ্গে গুলেন ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সম্পর্ক

‘কার্নেগি ইউরোপে’র নন–রেসিডেন্ট অ্যাসোসিয়েট ব্রুনো ম্যাকেসের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, তুর্কিরা রুশ বিমান ভূপাতিত করার পর বেশকিছু তুর্কি সাংবাদিক আলোচনা করেছিলেন যে, যে এফ–১৬ যুদ্ধবিমানটি রুশ বিমান ভূপাতিত করেছে, সেটি তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর চেইন অফ কমান্ডের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল না। বরং সেটি ছিল একটি অনিয়ন্ত্রিত (rouge) ইউনিট, যেটির বৈমানিকরা নিজেদের সিদ্ধান্তেই রুশ বিমানটি ভূপাতিত করেছিলেন। সেসময় তুর্কি সরকার উক্ত সাংবাদিকদের ব্যাপারটি নিয়ে উচ্চবাচ্য না করার জন্য নির্দেশ দেয়, কিন্তু ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই রাতে অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার সময় তুর্কি বিমানবাহিনীর অন্তত ৬টি এফ–১৬ যুদ্ধবিমান অভ্যুত্থানকারীদের পক্ষে যোগ দেয় এবং আঙ্কারার ওপর বোমাবর্ষণে অংশ নেয়। যে দুইজন বৈমানিক রুশ বিমানটি ভূপাতিত করেছিলেন, তারাও আঙ্কারার ওপর বোমাবর্ষণে অংশগ্রহণ করেছিলেন। উক্ত বৈমানিকদের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ উপর্যুক্ত তুর্কি সাংবাদিকদের বক্তব্যের ভিত্তিকে জোরদার করেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, যদি সত্যিই তুর্কি বিমানবাহিনীর একটি অনিয়ন্ত্রিত ইউনিট রুশ বিমান ভূপাতিত করে থাকে, সেক্ষেত্রে তুর্কি সরকার তখনই কেন রুশদের কাছে ক্ষমা চেয়ে এবং উক্ত বৈমানিকদের গ্রেপ্তার করে সৃষ্ট সঙ্কটটি মিটিয়ে ফেলল না? এর সুনিশ্চিত কোনো জবাব পাওয়া সম্ভব নয়। তবে এর একটি উত্তর হতে পারে যে, তুর্কি সরকার আসলেই সেসময় সিরীয় তুর্কমেন মিলিট্যান্টদের ওপর বোমাবর্ষণের কারণে রুশদের ওপর ক্ষিপ্ত ছিল এবং রুশ বিমানটি ভূপাতিত হওয়ায় খুশি হয়েছিল। তদুপরি, বিমানটি ভূপাতিত হওয়ার পর তুর্কি জনসাধারণের মধ্যে তুর্কি সরকারের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং রুশদের কাছে ক্ষমা চেয়ে এই জনসমর্থন হারানোর মতো ইচ্ছা তুর্কি সরকারের ছিল না। সম্ভবত এজন্যই রুশ বিমানটিকে ধ্বংসকারী তুর্কি ইউনিটটি অনিয়ন্ত্রিত (rogue) ছিল কিনা বা তারা প্রকৃতপক্ষে কাদের নির্দেশে কাজ করছে, তুর্কি সরকার এই বিষয় খতিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি।

২০১৬ সালের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পর তুরস্কের কায়সেরিতে একদল সন্দেহভাজন গুলেনপন্থীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে; Source: Reuters/Middle East Eye

উল্লেখ্য, তুর্কি সরকারের বহু সমর্থক এই তত্ত্বে বিশ্বাস করে থাকেন। তাদের মতে, উক্ত অনিয়ন্ত্রিত বৈমানিকরা মূলত তুর্কি সরকারের নির্দেশ বাস্তবায়ন করছিলেন না, বরং ফেতুল্লাহ গুলেনের সংগঠনের গোপন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছিলেন। এক্ষেত্রে আবারও প্রশ্ন ওঠে, গুলেন বা তার সমর্থকরা কেন রুশ বিমান ভূপাতিত করতে চাইবেন? এক্ষেত্রে তাদের কী স্বার্থ ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর বুঝতে হলে গুলেনের রাজনৈতিক আদর্শ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

গুলেনের সংগঠন মূলত ইসলামপন্থী, কিন্তু গুলেনের মতে, ইসলামি ও পশ্চিমা মূল্যবোধ পরস্পরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাজনৈতিকভাবে গুলেন উগ্র তুর্কি জাতীয়তাবাদী, এবং পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সম্পর্ক জোরদার করার জোরালো সমর্থক। তিনি তুরস্ককে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষপাতী এবং ইসরায়েলের প্রতি ‘বাস্তববাদী’ নীতির সমর্থক। একই সঙ্গে গুলেন রাশিয়া ও ইরানের কঠোর সমালোচক।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, তুর্কি পররাষ্ট্রনীতিতে কার্যত কম্পাসের চারটি কাঁটার মতো চারটি দিক রয়েছে, এবং তুর্কি সরকার ও সশস্ত্রবাহিনীতে প্রতিটি দিকেরই কিছু অনুসারী রয়েছে। পশ্চিমাভিমুখী পক্ষ প্রধানত তুরস্কের পশ্চিমে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। দক্ষিণাভিমুখী পক্ষ প্রধানত তুরস্কের দক্ষিণে অবস্থিত বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম–অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের পক্ষপাতী। পূর্বাভিমুখী পক্ষ প্রধানত তুরস্কের পূর্বে অবস্থিত ককেশাস ও মধ্য এশিয়ার বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে ইচ্ছুক। আর উত্তরাভিমুখী পক্ষ তুরস্কের উত্তরে অবস্থিত রাশিয়ার সঙ্গে একটি কৌশলগত মৈত্রী স্থাপন করতে উৎসাহী। এদিকে থেকে বিবেচনা করলে, গুলেন ও গুলেনপন্থীরা সুদৃঢ়ভাবে পশ্চিমাভিমুখী।

তদানীন্তন ইরানি রাষ্ট্রপতি হাসান রুহানি, তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ তাইয়্যিপ এরদোয়ান ও রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন। এরদোয়ান ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন; Source: Tehran Times

কিন্তু এরদোয়ানের পররাষ্ট্রনীতি ক্রমশ পশ্চিম থেকে দূরবর্তী এবং অন্য তিন দিকের নিকটবর্তী হচ্ছিল। তিনি রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করছিলেন, ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় তুর্কি প্রভাব বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন এবং তুর্কি প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে প্রথম বারের মতো বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করছিলেন। কিন্তু তার শাসনামলে তুরস্ক অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে পশ্চিমা বিশ্বের কাছ থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছিল এবং তুরস্কের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের সম্ভাবনা প্রায় শূন্যে নেমে এসেছিল। গুলেনপন্থীদের কাছে তুর্কি পররাষ্ট্রনীতির এই ধাঁচ পছন্দনীয় ছিল না এবং বিশেষত রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক তাদের খুবই অপছন্দনীয় ছিল।

তুর্কি সরকারের সমর্থকদের ভাষ্য অনুসারে, এই পরিস্থিতিতে গুলেনপন্থীরা রুশ–তুর্কি সম্পর্কে একটি সঙ্কট সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেয় এবং সিরিয়ায় রুশ সামরিক হস্তক্ষেপের পর রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সৃষ্ট সূক্ষ্ম উত্তেজনার সুযোগ গ্রহণ করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, তুর্কি বিমানবাহিনীর গুলেনপন্থী সদস্যরা একটি রুশ বিমান ধ্বংস করার পরিকল্পনা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল: এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে একটি যুদ্ধ বা যুদ্ধাবস্থার সৃষ্টি করা। পরিস্থিতি এরকম মোড় নিলে তুরস্ক পশ্চিমা বিশ্বের নিকটবর্তী হতে বাধ্য হতো। কিন্তু সেক্ষেত্রে আবারও প্রশ্ন ওঠে, তুরস্ককে পশ্চিমামুখী করার জন্য গুলেনপন্থীরা কেন এত ঝুঁকি নিতে যাবে? এক্ষেত্রে তাদের স্বার্থ কোথায়?

এই পর্যায়ে এসে তুর্কি সরকারের সমর্থকদের বক্তব্য হচ্ছে, গুলেন ও গুলেনপন্থীরা কার্যত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে কাজ করছেন এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’র সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, মার্কিন রাষ্ট্রপতি ওবামার কাছে এরদোয়ানের ব্যক্তিগত অনুরোধ সত্ত্বেও মার্কিন সরকার গুলেনকে তুর্কি সরকারের কাছে হস্তান্তর করেনি, গুলেনের ‘হিজমেৎ’ সংগঠনকে তারা ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করেনি এবং তুর্কি সরকার কর্তৃক তুর্কি সশস্ত্রবাহিনীর গুলেনপন্থী সদস্যদের গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তীব্র আপত্তি জানিয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, তুর্কি সরকার যেসব সামরিক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে, তাদের অনেকের সঙ্গেই মার্কিন সশস্ত্রবাহিনীর ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। এই বিষয়গুলোকে তুর্কি সরকারের সমর্থকরা ‘গুলেন মার্কিনিদের হয়ে কাজ করছেন’ এই জাতীয় তত্ত্বের প্রমাণ হিসেবে বিবেচনা করে।

তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ও তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোয়ান। এরদোয়ান ও ওবামার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও ওবামা গুলেনকে তুর্কি সরকারের কাছে হস্তান্তরের জন্য এরদোয়ানের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন; Source: Getty Images/Politico

অর্থাৎ, তুর্কি সরকারের সমর্থকদের যুক্তি আপাতদৃষ্টিতে খুবই সরল। তাদের মতে, গুলেন ও তার সংগঠন কার্যত সিআইএর হয়ে কাজ করছে। রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সংযোগ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পছন্দনীয় ছিল না, এবং এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সঙ্কট সৃষ্টির জন্য গুলেনপন্থীরা রুশ বিমানটি ভূপাতিত করেছিল। বিমানটি ভূপাতিত হওয়ার পর রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে প্রচ্ছন্ন স্নায়ুযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়, এবং সেসময় যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ককে মৌখিক সমর্থন প্রদান করে, কিন্তু কার্যকরভাবে সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকে। এরপর তুর্কি সরকার যখন অপ্রত্যাশিতভাবে রাশিয়ার সঙ্গে গোপন কূটনীতিতে লিপ্ত হয় এবং শেষে রুশ সরকারের কাছে বিমানটি ভূপাতিত করার জন্য ক্ষমা চায়, তখন যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিতে গুলেনপন্থীরা তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তুর্কি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা চালায়। এক্ষেত্রে তুর্কি সরকারের সমর্থকরা উল্লেখ করে যে, পুতিনের কাছে এরদোয়ানের চিঠি প্রেরণের মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা সংঘটিত হয়।

তুর্কি সরকারের সমর্থকদের পাশাপাশি বেশ কিছু তুর্কি, রুশ ও অন্যান্য বিশ্লেষক এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন। ব্রুনো ম্যাকেসের বক্তব্য অনুযায়ী, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টার কারণে তুরস্কে সংঘটিত অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত হয়েছিল। তুরস্কের ‘মার্মারা ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক এমরে এরশেনের ভাষ্যমতে, রুশ বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনাটির আগে রুশ–তুর্কি সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল এবং এজন্য আকস্মিকভাবে এই বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা সন্দেহের উদ্রেক করে। তুরস্কের ক্ষমতাসীন দল ‘একেপি’র উপ–সভাপতি ইয়াসিন আক্তায় সরাসরি মন্তব্য করেছেন, গুলেনপন্থী বৈমানিকরা রুশ–তুর্কি সম্পর্ক ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে রুশ বিমানটি ভূপাতিত করেছিল।

তুর্কি সরকারপন্থী অনলাইন পত্রিকা ‘স্টার’–এর প্রাক্তন কলামিস্ট জেম কুচুক ২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর রুশ বিমান ভূপাতিত হওয়ার পরপরই একটি অনুষ্ঠানে দাবি করেন যে, এটি গুলেনপন্থী বৈমানিকদের কাজ এবং তাদের উদ্দেশ্য রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সঙ্কট সৃষ্টি করা। ২০১৬ সালের অভ্যুত্থানের পর কুচুক আবার মন্তব্য করেন যে, গুলেনপন্থীরাই রুশ বিমানটি ভূপাতিত করেছিল এবং এটি ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে।

রুশ–তুর্কি সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ও ‘স্টার’ পত্রিকার কলামিস্ট সেভিল নুরিয়েভার ভাষ্য অনুযায়ী, গুলেনপন্থী বৈমানিকরা যুক্তরাষ্ট্রের নির্দেশে রুশ বিমানটি ভূপাতিত করেছিল এবং এটি ছিল রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে নির্মীয়মান কৌশলগত অংশীদারিত্ব ধ্বংস করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ‘ষড়যন্ত্র’৷ নুরিয়েভার মতে, রাশিয়া ও তুরস্ক কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের সৃষ্ট একটি ‘ফাঁদে’ পড়েছিল। তিনি আরো উল্লেখ করেন, ২০১০ সালে ‘গাজা ফ্রিডম ফ্লোটিলা’র ওপর ইসরায়েলি আক্রমণের ফলে ১০ জন তুর্কি নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র তুর্কি–ইসরায়েলি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য বিশেষভাবে প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু ‘সু–২৪এম’ সঙ্কট নিরসনের জন্য তারা কোনো প্রচেষ্টা চালায়নি, কারণ রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হোক, সেটি যুক্তরাষ্ট্রের কাম্য ছিল না।

রুশ রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা আলেক্সান্দর পুতিন এবং তদানীন্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলদিরিম; Source: Mete Sohtaoglu/Twitter

রুশ রাজনৈতিক বিশ্লেষক, তাত্ত্বিক ও রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিনের উপদেষ্টা আলেক্সান্দর দুগিনের ভাষ্যমতে, গুলেনপন্থী বৈমানিকরা ইচ্ছাকৃতভাবে রুশ–তুর্কি সম্পর্কে সঙ্কট সৃষ্টির জন্য রুশ বিমানটি ভূপাতিত করেছিল। দুগিনের মতে, রুশ বিমানটির ধ্বংসসাধন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের একটি মাধ্যম। তিনি আরো যোগ করেছেন যে, ‘সু–২৪এম’ সঙ্কট নিরসনের পর রুশ–তুর্কি সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতেই যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্র–নিয়ন্ত্রিত ‘হিজমেৎ’ বা গুলেনপন্থীরা তুরস্কে অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেছে।

‘রাশান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেস’-এর অন্তর্ভুক্ত ‘ইনস্টিটিউট অফ ওরিয়েন্টাল স্টাডিজে’র সিনিয়র ফেলো রুসলান কুরবানভের বক্তব্য অনুযায়ী, যে তুর্কি বৈমানিকরা রুশ বিমানটিকে ভূপাতিত করেছিলেন, তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ইনজিরলিক বিমানঘাঁটির একজন গুলেনপন্থী কর্নেল। কুরবানভের মতে, ২০১৬ সালের অভ্যুত্থানের পর তুর্কি সরকার ও জনসাধারণ বুঝতে পেরেছে যে, ইনজিরলিক ঘাঁটি তাদের জন্য একটি ‘ট্রোজান ঘোড়া’ (Trojan Horse)। উল্লেখ্য, অভ্যুত্থানের সময় আঙ্কারার ওপর বোমাবর্ষণে অংশগ্রহণকারী এফ–১৬ যুদ্ধবিমানগুলো ইনজিরলিক বিমানঘাঁটি থেকে জ্বালানি সংগ্রহ করেছিল, আর এই ঘাঁটিটি তুর্কি বিমানবাহিনীর পাশাপাশি মার্কিন বিমানবাহিনীও ব্যবহার করে। এজন্য অভ্যুত্থানের পর তুর্কি সরকার বাইরে থেকে ঘাঁটিটির বিদ্যুৎ সংযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার অভিযোগে ঘাঁটিটির তুর্কি অধিনায়ক জেনারেল বেকির এরজান ভানকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এই বিশ্লেষকদের বক্তব্যকে যদি সত্যি হিসেবে ধরে নেয়া হয়, সেক্ষেত্রে প্রতীয়মান হয় যে, গুলেনপন্থীরা একটি রুশ বিমান ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল। তারা সিরীয় আকাশসীমার ওপর নজর রাখছিল এবং একটি রুশ বিমান তুর্কি–সিরীয় সীমান্তের কাছাকাছি আসার পরপরই তারা সেটির ওপর আক্রমণ চালায়। এক্ষেত্রে তাদের রুশ বিমানটিকে সতর্ক করার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না, কারণ তারা তুর্কি আকাশসীমার লঙ্ঘন ঠেকানোর চেষ্টা করছিল না, বরং একটি রুশ বিমান ধ্বংস করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু এই তত্ত্ব যদি সত্য হয়ে থাকে এবং ঘটনা প্রকৃতপক্ষেই এরকমভাবে ঘটে থাকে, সেক্ষেত্রে তুর্কি সরকার কেন দাবি করল যে, তারা অন্তত ১০ বার রুশ বিমানকে সতর্ক করেছিল?

রুশ অ্যাকাডেমিশিয়ান রুসলান কুরবানভ তুরস্কে অবস্থিত মার্কিন বিমানবাহিনীর ইনজিরলিক বিমানঘাঁটিকে ‘ট্রোজান ঘোড়া’ হিসেবে অভিহিত করেছেন এবং এখান থেকেই গুলেনপন্থীরা রুশ বিমান ভূপাতিত করার পরিকল্পনা করেছিল বলে অভিযোগ করেছেন; Source: TRT World and Agencies

এক্ষেত্রে যে ব্যাপারটি হয়ে থাকতে পারে, সেটি হচ্ছে, গুলেনপন্থী বৈমানিকরা কোনো সতর্কবার্তা ছাড়াই রুশ বিমানটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং সেটিকে ধ্বংস করে দেয়। এরপর তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানায় যে, রুশ বিমানটি তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল এবং তারা বারবার সতর্কবার্তা প্রদান করার পরেও সেটি কর্ণপাত না করায় তারা সেটিকে তুর্কি সরকারের ইতিপূর্বে জারি করা নিয়ম অনুযায়ী ভূপাতিত করতে বাধ্য হয়েছে। তুর্কি সরকার তাদের এই ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করে এবং সেটির ভিত্তিতে রাশিয়ার সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে পড়ে। সহজ ভাষায়, গুলেনপন্থী বৈমানিকরা তুর্কি সরকারকে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ করে তাদেরকে ‘ফাঁদে’ ফেলে।

কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, রুশ রাষ্ট্রপতি পুতিন প্রথম থেকেই দাবি করে আসছিলেন যে, রুশ বিমান ভূপাতিত করার ঘটনাটি আকস্মিক ছিল না, বরং এটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত ‘অ্যাম্বুশ’। তুর্কি সরকার এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। কিন্তু তুর্কি সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য যদি সত্য হয়, অর্থাৎ উক্ত বৈমানিকরা যদি প্রকৃতপক্ষেই গুলেনপন্থী হয়ে থাকেন ও রুশ–তুর্কি সম্পর্ক ধ্বংসের উদ্দেশ্যেই রুশ বিমানটি ভূপাতিত করে থাকেন, সেক্ষেত্রে প্রতীয়মান হবে যে, পুতিনের বক্তব্যই সঠিক। রুশ বিমান ভূপাতিত করার ঘটনাটি ছিল একটি সুপরিকল্পিত ‘অ্যাম্বুশ’, কিন্তু পার্থক্য হচ্ছে, অ্যাম্বুশটির আয়োজন তুর্কি সরকার করেনি, করেছিল গুলেনপন্থীরা।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১৯ ডিসেম্বর তুরস্কের আঙ্কারায় একটি প্রদর্শনী চলাকালে মেভলুত মের্ত আলতিনতাশ নামক একজন তুর্কি পুলিশ কর্মকর্তা তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কারলভকে খুন করে। অবশ্য খুনের পরপরই সে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। পরবর্তীতে তুর্কি আদালত এই খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ৫ জন তুর্কি নাগরিককে যাবজ্জীবন মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। তুর্কি সরকার এই খুনের জন্য গুলেনপন্থীদের দায়ী করেছে এবং রুশ সরকার তাদের এই মতামতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছে। তুর্কি সরকারের সমর্থকদের ভাষ্য মোতাবেক, গুলেনপন্থীরা প্রথমে রুশ বিমান ভূপাতিত করে রুশ–তুর্কি সম্পর্ক ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে, সেই চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তুরস্কে অভ্যুত্থান ঘটানোর প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং সেই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হওয়ার পর রুশ রাষ্ট্রদূতকে খুন করে আবার রুশ–তুর্কি সম্পর্কে ফাটল ধরানোর চেষ্টা চালিয়েছে।

তুরস্কের দেমরে শহরের ‘আন্দ্রেই কারলভ সরণি’তে অবস্থিত স্মৃতিফলক। ২০১৬ সালে আঙ্কারায় নিহত রুশ রাষ্ট্রদূতের স্মরণে তুর্কি সরকার তার নামে দেমরে শহরের একটি সরণির নামকরণ করেছে এবং একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করেছে; Source: Moskovskaya Dukhovaya Akademiya/Wikimedia Commons

সামগ্রিকভাবে, এই তত্ত্বটি যথেষ্ট জোরালো বলে প্রতীয়মান হয় এবং তত্ত্বটির বক্তব্য প্রকৃত সত্যের অনুরূপ বা কাছাকাছি হলে সেটি মোটেই আশ্চর্যজনক হবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তত্ত্বটিতে যথেষ্ট ফাঁকফোকর রয়েছে এবং সেজন্য এই তত্ত্বকে বিনা প্রশ্নে গ্রহণ করা যায় না। যেমন: তুর্কি সরকার রুশ বিমান ভূপাতিত করার সঙ্গে জড়িত দুই বৈমানিককে গ্রেপ্তার করেছে, কিন্তু তাদের নাম–পরিচয় প্রকাশ করেনি, তারা প্রকৃতপক্ষেই গুলেনপন্থী ছিল কিনা সেটি নিশ্চিত করেনি এবং তাদেরকে অভ্যুত্থানে জড়িত থাকার দায়ে কী শাস্তি প্রদান করা হয়েছে, সেটিও প্রকাশ করেনি। এদিকে প্রাক্তন তুর্কি প্রধানমন্ত্রী (এবং বর্তমানে এরদোয়ানের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী) আহমেত দাভুতোলু ২০১৭ সালে দাবি করেছেন, ঐ দুই বৈমানিক গুলেনপন্থী ছিলেন না। এক্ষেত্রে অবশ্য দাভুতোলুর বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করারও কোনো উপায় নেই। তাছাড়া, রুশ রাষ্ট্রদূতের খুনি প্রকৃতপক্ষেই গুলেনপন্থী ছিল কিনা, সেটি জানার কোনো উপায় নেই, কারণ খুনের পরপরই সে পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে এবং খুনের কিছুক্ষণ আগেই সে তার ফোন থেকে সমস্ত ই–মেইল ডিলেট করে দিয়েছিল, যেগুলো আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

তদুপরি, তুরস্কে ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ (conspiracy theory) ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় এবং তুর্কি প্রচারমাধ্যম বিভিন্ন বিষয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারের জন্য প্রসিদ্ধ/কুখ্যাত। সর্বোপরি, তুরস্ক ও রাশিয়া দুই রাষ্ট্রেই মার্কিনবিরোধী মনোভাব অত্যন্ত তীব্র, এবং এজন্য যেকোনো সঙ্কটের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করা রাষ্ট্র দুটিতে নিত্যনৈমিত্তিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে প্রকৃতপক্ষেই রুশ ‘সু–২৪এম’ বিমানটি ভূপাতিত করার পশ্চাতে গুলেনপন্থীরা ও যুক্তরাষ্ট্র দায়ী ছিল কিনা, পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়া সেটি নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। এবং রুশ ও তুর্কি সরকারের কার্যকলাপে এটিই প্রতীয়মান হয় যে, তারা এই ব্যাপারে আর ঘাঁটাঘাঁটি করতে আগ্রহী নয় এবং দুই দেশের মধ্যেকার সম্পর্কের এই অপ্রীতিকর ঘটনাটি যতদূর সম্ভব আলোচনার বাইরে রাখতেই রাষ্ট্র দুটির সরকার আগ্রহী। সুতরাং এখনই এই ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যুক্তিসঙ্গত নয়।

সু–২৪এম সঙ্কট–পরবর্তী রুশ–তুর্কি সম্পর্কের ধারা

‘সু–২৪এম’ সঙ্কট নিরসনের পর রুশ–তুর্কি সম্পর্ক ক্রমশ উষ্ণ হয়ে ওঠে এবং পূর্ব ইউরোপ থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে নানাবিধ স্বার্থের সংঘাত সত্ত্বেও রুশ–তুর্কি সম্পর্কের মাত্রা ক্রমাগত বিস্তৃত হচ্ছে। তুরস্ক রাশিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছে, তুরস্কের আমদানিকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উৎস রাশিয়া, তুরস্কের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রুশরা নির্মাণ করে দিচ্ছে, তুরস্ক রুশ কৃষিপণ্যের প্রধান আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে এবং তুরস্কে আগমনকারী রুশ পর্যটকদের সংখ্যা প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। তদুপরি, তুরস্ক রুশ–নির্মিত ‘এস–৪০০ ত্রিউম্ফ’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয় করে যুক্তরাষ্ট্রের বিরাগভাজন হয়েছে এবং এরপরেও তারা সম্প্রতি রাশিয়ার কাছ থেকে আরো কয়েক ইউনিট ‘এস–৪০০’ ক্রয়ের আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

সিরিয়ার ইদলিবে একটি যৌথ মহড়ার সময় রুশ সামরিক পুলিশ ও তুর্কি সৈন্যরা; Source: Anadolu Agency/TRT World

শুধু তা-ই নয়, যে সিরিয়াকে কেন্দ্র করে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে ‘সু–২৪এম’ সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছিল, সেই সিরিয়াতেও রাশিয়া ও তুরস্ক এক ধরনের ‘অস্বস্তিকর সহযোগিতামূলক সম্পর্কে’ লিপ্ত হয়েছে। এই সম্পর্কটি বহুলাংশেই বিনিময়ভিত্তিক এবং তুর্কি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সোনের চাগাপ্তায় বিষয়টির ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। তার মতে, বস্তুত ২০১৬ সালের মাঝামাঝি নাগাদ তুরস্ক রুশ–সমর্থিত সিরীয় সরকারকে সামরিক শক্তিবলে উৎখাত করার পরিকল্পনা থেকে সরে আসে এবং সিরীয় কুর্দি মিলিট্যান্টদের সামর্থ্য খর্ব করার ব্যাপারে মনোনিবেশ করে। বিনিময়ে রাশিয়া সিরীয় কুর্দিদের সঙ্গে তাদের সংযোগের মাত্রা হ্রাস করে, যদিও তারা এই সংযোগ পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করেনি।

সিরিয়ায় রুশ–তুর্কি বিনিময়ভিত্তিক সহযোগিতার এরকম বেশ কয়েকটি উদাহরণ রয়েছে। যেমন: ২০১৬ সালের দ্বিতীয়ার্ধে তুরস্ক আইএসের কাছ থেকে জারাবলুস অঞ্চল দখলের উদ্দেশ্যে সিরিয়ায় সৈন্য প্রেরণ করতে চাচ্ছিল। তুর্কিদের উদ্দেশ্য ছিল জারাবলুস দখলের মাধ্যমে উত্তর সিরিয়ায় সিরীয় কুর্দি–অধিকৃত অঞ্চলগুলোর মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি। রুশরা আঙ্কারাকে এই অভিযান পরিচালনার অনুমতি প্রদান করে এবং তুর্কি সৈন্যরা জারাবলুস দখল করে। কিন্তু বিনিময়ে তুরস্ককে তুর্কি–সমর্থিত মিলিট্যান্টদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পূর্ব আলেপ্পোর ওপর পরিচালিত রুশ–সিরীয় আক্রমণ মেনে নিতে হয়। তুরস্ক পূর্ব আলেপ্পোর মিলিট্যান্টদের ওপর শহরটি ছেড়ে দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করে এবং গোপনে সিরীয় সরকার ও মিলিট্যান্টদের মধ্যে মধ্যস্থতা করে। অর্থাৎ, তুরস্ক জারাবলুস লাভ করে, আর বিনিময়ে রাশিয়া ও সিরীয় সরকার লাভ করে পূর্ব আলেপ্পো।

রাশিয়ার লিপেৎস্কে নিহত রুশ বৈমানিক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ওলেগ পেশকভের সমাধির ওপরে নির্মিত স্মারক; Source: Aleksandr Ryumin/TASS

আবার, ২০১৮ সালে রাশিয়া উত্তর–পশ্চিম সিরিয়ায় সিরীয় কুর্দি–নিয়ন্ত্রিত আফরিন অঞ্চলের ওপর বিমান হামলা চালানোর জন্য এবং এরপর অঞ্চলটি দখল করার জন্য তুরস্ককে অনুমতি প্রদান করে। বিনিময়ে তুরস্ক তুর্কি–সমর্থিত মিলিট্যান্টদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত পূর্ব ঘুতার ওপর রুশ ও সিরীয় আক্রমণে মৌন সম্মতি প্রদান করে। শেষ পর্যন্ত তুরস্ক লাভ করে আফরিন, আর রাশিয়া ও সিরীয় সরকার লাভ করে পূর্ব ঘুতা।

অনুরূপভাবে, ২০১৮ সালে এটি প্রতীয়মান হচ্ছিল যে, রাশিয়া, সিরিয়া ও ইরান উত্তর সিরিয়ায় ইদলিবের ওপর আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে। ইদলিব তুর্কি–সমর্থিত মিলিট্যান্টদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য অঞ্চল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাশিয়া ও তুরস্কের মধ্যে একটি সমঝোতা হয় এবং এই সমঝোতা অনুযায়ী তুরস্ক দক্ষিণ ইদলিবের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলো থেকে মিলিট্যান্টদের পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য করে। বিনিময়ে রাশিয়া তাদের আক্রমণ স্থগিত রাখে। অর্থাৎ, তুরস্ক উত্তর ইদলিবের সিংহভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সক্ষম হয়, কিন্তু রাশিয়া ও সিরীয় সরকার বিনা যুদ্ধে দক্ষিণ ইদলিবের অংশবিশেষ লাভ করে।

অবস্থাদৃষ্টে এটি প্রতীয়মান হয় যে, রাশিয়া ও তুরস্ক ‘সু–২৪এম’ সঙ্কটকে অতিক্রম করেছে এবং বিনিময়ভিত্তিক সহযোগিতা ও দ্বন্দ্বসমূহের ‘কম্পার্টমেন্টালাইজেশনে’র ভিত্তিতে একটি কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু ২০১৬ সালে পুতিনের কাছে এরদোয়ানের ‘ক্ষমা’ চাওয়ার পর রুশরা কি সত্যিই তুর্কিদের দ্বারা তাদের বিমান ভূপাতিত হওয়া ও বৈমানিকের মৃত্যুর বিষয়টি ভুলে গিয়েছিল? তুর্কি প্রচারমাধ্যমের ভাষ্যমতে, এর উত্তর হচ্ছে, ‘না’।

Related Articles