সিসিলিয়ান অপরাধ জগতের চূড়ায় থাকা গডফাদারদের নিয়ে আগ্রহী ব্যক্তির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। নইলে আমেরিকান-ইতালিয়ান মাফিয়া সাম্রাজ্য নিয়ে লেখা একজন মারিও পুজোর লেখা 'দ্য গডফাদার' একইসাথে রূপালি পর্দায় কিংবা বইয়ের সাদা পাতায় তুমুল জনপ্রিয়তা পায় কীভাবে? সিসিলির বিখ্যাত মাফিয়োসো কিংবা তাদের সংস্কৃতি এখন শুধুই অপরাধবিজ্ঞানী কিংবা ঐতিহাসিকদের আলোচনায় সীমাবদ্ধ নেই। সাহিত্যিক, লেখক কিংবা চলচ্চিত্রের মানুষদের হাত ধরে এখন মানুষ গডফাদারদের রোমহর্ষক কাহিনী জানছে, তাদের আলাদা সমাজ সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে।
মাফিয়ারা কীভাবে ইতালির সিসিলি থেকে ছড়িয়ে পড়লো সবখানে, সাধারণ মানুষদের বাস্তববাদী অনুসন্ধিৎসু চোখকে ফাঁকি দিয়ে নিপীড়নবাদী রাষ্ট্রের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেল, সমাজের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের গোড়ায় হাত দিয়ে সমস্ত কলকাঠি নাড়তে লাগল– এসব নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। মাফিয়ারা এখন ঠিক একেবারে রহস্যময় কিছু নয়, ওপেন সিক্রেট।
মাফিয়াদের নিয়ে ইতালিয়ান কর্তৃপক্ষের শুরু থেকেই অবহেলা করার দিকটি ছিল চোখে পড়ার মতো। অর্থনীতি এবং রাজনীতি সবসময় একে অপরকে প্রভাবিত করে চলে সমাজে। এই দুটি বিষয় যাদের হাতে থাকে, তারাই জনগণের রক্ষাকর্তা হয়ে বসে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়। উনিশ শতকে সিসিলির লেবু ব্যবসা, যেটি ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে লাভজনক ছিল, তা দখলে নিয়ে যখন মাফিয়ারা সমাজের অর্থনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলল, তখনও ইতালিয়ান প্রশাসন একধরনের ঘোরের মধ্যে ছিল, মাফিয়াদেরকে কার্যকরী প্রতিরোধ করার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। ইতালিকে তার ফল ভোগ করতে হয়েছে ভালোভাবেই।
'মাফিয়া' বলতে সিসিলিয়ান জনগণের আত্মবিশ্বাস বোঝানো হতো, যেটি পুরোপুরি বিমূর্ত একটি বিষয়। বাস্তবেও যে মাফিয়া একটি পুরোপুরি সংগঠিত অপরাধী সংগঠন হতে পারে, তা বিশ্বাস করতে পারেনি ইতালিয়ানরা কিংবা বিশ্বাস করার চেষ্টাও করেনি। মাফিয়াদের প্রতিষ্ঠা পাওয়ার পেছনে রাষ্ট্রের দায়ও এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মাফিয়াদেরকে প্রাথমিকভাবে দমন করার চেষ্টা হিসেবে রাষ্ট্র যে পাল্টা সন্ত্রাস চালিয়েছিল, তা বাস্তবেও ফলপ্রসূ ছিল না, নৈতিকভাবেও সমর্থনযোগ্য ছিল না। শুধু দমনমূলক কঠোর আইন প্রবর্তন করেই যে অপরাধ কমিয়ে আনা যায় না, মাফিয়াদের দমনে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা সেটিই আরেকবার প্রমাণ করে।
সিসিলিয়ান মাফিয়াদের বুঝতে হলে তাদের আবশ্যিকভাবে মেনে চলা ওমের্তা বা 'কোড অব অনার' সম্পর্কে জানার বিকল্প নেই। মাফিয়াদের টিকে থাকতে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাত থেকে সংগঠনকে বাঁচাতে এই প্রথা ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। উনিশ শতকের শেষের দিকে জন্ম নেয়া মাফিয়াদের অপরাধ সংগঠন দেড়শো বছরেরও বেশি সময় ধরে টিকে থাকার জন্য এই প্রথার কাছে বিশেষভাবে ঋণী।
মাফিয়ারা রাষ্ট্রের প্রবর্তন করা আইনে বিশ্বাস রাখতে চায় না। সেলুলয়েডের ফিতায় 'দ্য গডফাদার' সিনেমায় যখন আমেরিগো বনাসেরা তার মেয়ের নির্যাতনের বিচার চেয়ে রাষ্ট্রের কাছ থেকে প্রত্যাখাত হয়, তখন ন্যায়বিচারের আশায় মাফিয়া ডন ভিটো কর্লিয়নির কাছে এসেছিল। কিছুটা আহত হয়ে ডন কর্লিয়নি তাকে বলেছিলেন, "তুমি প্রথমেই কেন আমার কাছে আসোনি?" মাফিয়াদের রাষ্ট্রের প্রবর্তিত আইনের প্রতি বিতৃষ্ণা সেই দৃশ্যে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারা যায়। সিনেমার পর্দা ছাড়াও বাস্তবের দুনিয়ায়ও মাফিয়ারা রাষ্ট্রের আইন-কানুনকে থোড়াই কেয়ার করে।
মাফিয়া পরিবারগুলোর অধীনে নির্দিষ্ট অঞ্চল থাকে, যেখানে মাফিয়া গডফাদারদের কথাই চূড়ান্ত হিসেবে বিবেচিত হয়। একটি পরিবার আরেকটি মাফিয়া পরিবারের অঞ্চলে গিয়ে মোড়লগিরি দেখায় না কিংবা যে ব্যবসায় একটি মাফিয়া পরিবারের আধিপত্য রয়েছে সেখানে অন্য একটি পরিবার গিয়ে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করে না পারতপক্ষে। যদি দেখানোর কোনো চেষ্টা হয়, তাহলে সেখানকার মাটিতে ভয়াল সংঘর্ষ হয় দুই পরিবারের মাঝে। এসব সংঘর্ষে কিন্তু মাফিয়া পরিবারগুলোর প্রধান কর্তাব্যক্তিরা কখনোই মাঠে নামে না। তাদের অনুগত যেসব সশস্ত্র ব্যক্তি আছে, তারাই সংঘর্ষে জড়ায়, আহত হয়, মারা যায়।
দুটো মাফিয়া পরিবারের সংঘর্ষের ফলে কিংবা অন্য কোনো অপরাধের কারণে যখন পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করে, তখনই 'ওমের্তা' প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের সময় যত কঠোর পন্থাই অবলম্বন করুক না কেন, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তি কোনোভাবেই পুলিশকে কোনো তথ্য দেয় না। এমনকি যদি কোনো মাফিয়াকে নির্দোষ থাকার পরও গ্রেফতার করা হয় এবং জিজ্ঞাসাবাদের সময় প্রকৃত অপরাধীর সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়, তখনও সে মুখ খোলে না। কারণ একজন মাফিয়া কখনই চায় না আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী সবসময় আড়ালে থাকতে চাওয়া মাফিয়া সংগঠন সম্পর্কে কিছু জেনে সেই মোতাবেক পদক্ষেপ নিক।
আমেরিকান মাফিয়া ভিনসেন্ট গিগান্টের একটি বিখ্যাত কেস আছে। ডন ভিটো জেনোভিসের আদেশে ভিনসেন্ট গিগান্ট প্রতিপক্ষ ফ্র্যাংক কস্টেল্লোর উপরে হামলার পরিকল্পনা করে। শেষ মুহুর্তে গিয়ে ডনের আদেশ পালনে গিগান্ট ব্যর্থ হয়। পুলিশ গ্রেফতার করে তাকে কোর্টে হাজির করে। হামলার শিকার কস্টেল্লো নিশ্চিতভাবেই জানতেন ডনের আদেশে গিগান্ট তার উপর হামলা চালিয়েছে। কিন্তু কোর্টের সামনে তিনি সবকিছু বেমালুম চেপে যান। হামলাকারীকে চিনতে পারেননি বলে কোর্টের নিজের মতামত ব্যক্ত করেন। পর্যাপ্ত প্রমাণাদির অভাবে গিগান্ট দীর্ঘ কারাবরণের হাত থেকে বেঁচে যায়। কোর্টরুম থেকে বের হবার সময় গিগান্টে খুব আন্তরিকভাবে কস্টেল্লোকে ধন্যবাদ জানান।
কোর্টে বিচারকের সামনে কস্টেল্লো তার হামলাকারীর কথা সুনিশ্চিতভাবে জেনেও যেভাবে চেপে গিয়েছিলেন, তা পুরোটাই ওমের্তা নামের সেই প্রথার জন্য। প্রতিপক্ষকে আদালতের সামনে ফাঁসানোর সবকিছুই কস্টেল্লোর হাতে ছিল, কিন্তু ভুলেও কোর্টকে সাহায্য করেননি। ওমের্তার নিয়মানুযায়ী কোর্টের সামনে বা রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থার সামনে কোনো মাফিয়া মুখ খুলতে পারবে না, এমনকি প্রতিপক্ষকে ফাঁসানোর সুযোগ থাকলেও!
ওমের্তার মতো একটি প্রথার কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীরা মাফিয়াদের সম্পর্কে শুরুর দিকে কিছু জানতে পারেননি। ফলে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়াটাও আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। অসংখ্য মাফিয়া অপরাধীকে গ্রেফতারের পর ছেড়ে দিতে হয়েছে, কারণ কোর্টে তার প্রতিপক্ষ কোনো তথ্যই দেয়নি কিংবা বেমালুম চেপে গিয়েছে বলে।
মাফিয়ার অন্ধকার জগতে প্রবেশের আগে একজন মানুষকে সংগঠনের প্রতি আনুগত্য ও ওমের্তা বা নীরবতার প্রথা মেনে চলার শপথ নিতে হয়। কুমারী মেরির ছবিতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে দু'হাতে চেপে ধরে রাখতে বলা হয়, যতক্ষণ না সেটি একদম ভস্মে পরিণত হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একজন সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়, জন্ম নেয় মাফিয়া সংগঠনের একজন 'ম্যান অব অনার'।
সাধারণ মানুষ থেকে একজন 'ম্যান অব অনার' হওয়ার ক্ষেত্রে মানুষ খুন করাটা বেশ কাজে দেয়। অতীতে খুনের রেকর্ড থাকলে একজন মানুষের পক্ষে সহজেই ম্যান অব অনার হওয়া যায়। তবে মাফিয়ারা নারী ও শিশুদের স্পর্শ করে না বলে দাবী করে থাকে। কারণ নারী ও শিশু হত্যা সমর্থকদের মাঝে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে। তারপরও যদি ডনের নির্দেশ আসে, সেক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের হত্যা করতেও মাফিয়ারা পিছপা হয় না, এ কথা অতীতে প্রমাণিত হয়েছে অনেকবার।
মাফিয়াদের সংঘর্ষ নিয়ে সিনেমায় যেরকমটা আমাদের দেখানো হয়, তার চেয়ে বাস্তবের মাফিয়াদের সংঘর্ষ আরও অনেক বেশি ভয়ংকর। সিসিলির মাফিয়াদের নিয়ন্ত্রণে আনতে ইতালির সরকার অসংখ্যবার ব্যর্থ হয়েছে। এই মাফিয়াদের হাত অনেক গভীরে বিস্তৃত। রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে অনেক ব্যবসা তাদের নিয়ন্ত্রণে। তারা যখন অপরাধ করে, তখন কোনো চিহ্ন রেখে যায় না যাতে করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোন সংকেত পেতে পারে মাফিয়া সাম্রাজ্য সম্পর্কে।
কোড অব অনার কিংবা ওমের্তা ভঙ্গ করার মানেই হচ্ছে মৃত্যু-পরোয়ানা জারি হওয়া। জেলে থাকার সময় কিংবা পুলিশের কাছে জিজ্ঞাসাবাদের সময় যদি কখনও কোনো ম্যান অব অনার পেনটিটি অর্থাৎ পক্ষত্যাগ করে কোড ভঙ্গ করে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করে, তাহলে জেল থেকে বের হয়েই যে তার মৃত্যু হবে, এটা সুনিশ্চিত বলা যায়। অতীতে যারাই মাফিয়াদের কোড অব অনার ও ওমের্তা ভঙ্গ করেছে, তাদেরকেই দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে।
সিসিলিয়ান মাফিয়াদের টিকে থাকার পেছনে ওমের্তার অবদান অপরিসীম। প্রায় এক শতাব্দী ধরে ইতালির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও রাজনীতিবিদেরা মাফিয়াদের প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সমাজের গভীরে গেড়ে বসা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারেনি শুধু এই ওমের্তা ও কোড অব অনারের কারণে। কোড অব অনার নিশ্চিত করেছে কোনো মাফিয়া তার গডফাদারের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে না, ওমের্তা নিশ্চিত করেছে কখনও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ম্যান অব অনারকে গ্রেফতার করলেও মুখ না খোলার কারণে মাফিয়াদের টিকিরও খোঁজ পাবে না। মাফিয়াদের রক্ষাকবচ হিসেবে তাই ওমের্তার ভূমিকা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।
This is a Bengali article on 'the code of omerta', followed by the Mafias.
Reference:
(১) Omertà
(২) What Was The Code of Omertà?
(৩) OMERTÀ : THE CODE OF SILENCE
(৪) কাসা নোস্ত্রা; অনুবাদ: ইফতেখার আমিন