Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উত্তাল আমেরিকা: একটি নির্মম মৃত্যু কেন জ্বালিয়ে দিচ্ছে পুরো দেশ

সম্প্রতি জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুতে বর্ণবাদ বৈষম্যের আন্দোলনে উত্তাল আমেরিকার খবর নিশ্চয়ই শুনেছেন, তবে আন্দোলনের এপিঠ-ওপিঠ দেখার আগে নিজ দেশের বর্ণবাদের প্রেক্ষাপটটা একটু চিত্রায়ণ করার চেষ্টা করা যাক, তাহলে চলমান আন্দোলন কেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে তা অনুধাবন করতে সহজ হবে।

বাংলাদেশে বড় পরিসরে বর্ণবাদের বৈষম্য নিয়ে কোনো জরিপ করা হয় না, কারণ আমাদের কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ হিসেবে আলাদা করা হয় না। কিন্তু তাই বলে বর্ণবিদ্বেষী রূপ প্রদর্শনে পিছিয়ে নেই আমাদের সমাজও। ছোট্ট একটি শিশু ভূমিষ্ট হবার পর থেকে জীবনে ধাপে ধাপে বর্ণবাদের শিকার হতে থাকে। কখনো আত্মীয়-স্বজনের কটু মন্তব্যে, কখনো খেলার মাঠে বা স্কুলে, কখনো চাকরিক্ষেত্রে এবং অবশ্যই জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিয়ের আয়োজনেও।

শ্বেতাঙ্গদের অধীন থেকে মুক্ত হলেও গায়ের সাদা রঙের প্রতি টানটা আমাদের এখনো আছে, আমরাই এর চর্চা করে আসছি। বর্ণবিদ্বেষী এই আঘাতের ক্ষতটা যদিও পশ্চিমের দেশগুলোতে শারীরিক, তবে আমাদের এখানে তা মানসিক হলেও প্রাণ কেড়ে নেয়ার মতো যথেষ্ট। খবরের কাগজে বা সংবাদে প্রায়ই এই কারণে আত্মহত্যার খবর আমাদের চোখে পড়ে। ফর্সা রঙকে প্রাধান্য দেয়া আর বর্ণবাদে বৈষম্য বা কটুক্তির শিকার হওয়া দুটি আলাদা বিষয় হলেও দেশে যুগ যুগ ধরে দুটির চর্চাই হয়ে আসছে।

গত মে মাসের ২৫ তারিখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে ক্রিশ্চিয়ান কুপারের ধারণ করা সেই ভিডিওতে শ্বেতাঙ্গ এক মহিলাকে উত্তেজিত আচরণ করতে দেখা যায়, কারণ তার কুকুরটিকে কেবলমাত্র বেধে রাখতে বলা হয়েছিল। পাখি পর্যবেক্ষক ক্রিশ্চিয়ান কুপার পার্কের নিয়মানুযায়ী নম্রতার সাথে কুকুরটিকে বেঁধে রাখার কথা বললে অ্যামি কুপার নামের সেই মহিলা ক্রিশ্চিয়ানকে তার জীবনের জন্য হুমকি এবং আফ্রিকান-আমেরিকান হিসেবে আখ্যা দিয়ে পুলিশ ডাকার কথা বলেন।

ভিডিওতে অ্যামি কুপারকে ৯১১ এ কল করতে দেখা যায়; Image Source: Christian Cooper 

ঠিক একই দিনে সন্ধ্যা বেলায় মিনেসোটা রাজ্যের মিনিয়াপলিসে পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিনের হাঁটুর নিচে চাপা পড়ে থাকা জর্জ ফ্লয়েডের নিথর দেহের পালস খোঁজার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন একজন মেডিকেল টেকনিশিয়ান। কিছু সময় পরে নিকটস্থ এক হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ফ্লয়েডের মৃত্যু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে দেশজুড়ে। সৌভাগ্যবশত, সেদিন ক্রিশ্চিয়ান কুপারের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেয়নি পুলিশ, কিন্তু ফ্লয়েডের নাম উঠেছে বর্ণবাদের রোষানলে পড়া শিকারদের তালিকায়। আবারও প্রজ্বলিত হয়েছে শত শত বর্ষ ধরে জমে থাকা বৈষম্যের বারুদ, যা রূপ নিয়েছে আরও একটি প্রতিবাদের দাবানলে।

Image Source: Time

ফ্লয়েডের প্রতি নির্মমতার ঘটনার সূত্রপাত ২০ ডলারের একটি জাল নোটের অভিযোগ থেকে। অভিযোগের পর ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছায় এবং তাকে হাতকড়া পরানোর পর একপর্যায়ে অফিসার ডেরেক শভিন ফ্লয়েডকে রাস্তায় উল্টো করে শুইয়ে হাঁটু দিয়ে তার ঘাড় চেপে ধরেন। অভিযুক্ত ব্যক্তি অপরাধী হোক বা না হোক, পুলিশ অপরাধীর প্রতি এই ধরনের আচরণের কোনো এখতিয়ার রাখে না, তবুও পুলিশের এসকল আইনবহির্ভূত আচরণ যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে প্রায় ১৬ বার ফ্লয়েড বলতে থাকেন “I can’t breathe” অর্থাৎ আমি শ্বাস নিতে পারছি না। ঠিক যেন ২০১৪ সালে এরিক গার্নারের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ১৭ জুলাই নিউ ইয়র্কে একইভাবে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ এরিক গার্নারকে শ্বাসরোধ করে হত্যার সময় ১১ বার তিনি কাকুতি-মিনতি করে জানান শ্বাস নিতে পারছেন না তিনি। তার অপরাধ ছিল রাস্তায় ট্যাক্স স্ট্যাম্পবিহীন সিগারেট বিক্রি। 

এরিক গার্নারকে মারার দৃশ্য পথচারীরা ক্যামেরা ধারণ করেন; image source : wikimedia commons  

কিন্তু ১৯৯৩ সালে নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে পুলিশের এই ধরনের কৌশল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি বিল পাশ হয়। অর্থাৎ ফ্লয়েড বা গার্নার উভয়ের উপরেই যে পদ্ধতিতে বল প্রয়োগ করা হয়েছে (Chokehold) তা সম্পূর্ণভাবে নিউ ইয়র্ক পুলিশের জন্য নিষিদ্ধ। অপরাধী বাধা প্রদান বা আক্রমণাত্মক আচরণ করলেই কেবল গলায় চাপ প্রয়োগ ছাড়া এই পদ্ধতির প্রয়োগ করতে পারবে পুলিশ। ফ্লয়েড বা গার্নারের বেলায় কিন্তু কোনো সক্রিয়ভাবে বাধা প্রদান বা আক্রমণাত্মক ঘটনা দেখা যায়নি।

যা-ই হোক, ফিরে আসি ঘটনায়। একপর্যায়ে ফ্লয়েডে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেও শভিন তার অবস্থানে অটল থাকেন। ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড একইভাবে হাঁটু দিয়ে ঘাড় চাপা দিয়ে রাখার পর মেডিকেল টিম পৌঁছালে তিনি উঠে পড়েন। ফ্লয়েডের নিথর দেহটি নেয়া হয় হাসপাতালে এবং তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। (ফ্লয়েডের জীবনের শেষ ৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ডের পুরো ঘটনাটি রোর বাংলায় পড়তে এখানে ক্লিক করুন)

জর্জ ফ্লয়েড হত্যার দৃশ্য; Image Source: NYTimes

ঘটনা জানতে পারার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন মিনিয়াপলিসের জনগণ। বরখাস্ত করা হয় জড়িত চার পুলিশ অফিসারকেই। প্রাথমিকভাবে ডেরেক শভিনের বিরুদ্ধে থার্ড ডিগ্রি মার্ডার ও ম্যানস্লটারের অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয়, পরবর্তীতে ৩ জুন জড়িত থাকা বাকি তিন অফিসারের বিরুদ্ধেও অপরাধে সহযোগিতার অভিযোগ আনা হয় এবং শভিনের বিরুদ্ধে সেকেন্ড ডিগ্রিতে আভিযোগ আনা হয়।

জড়িতদের জীবনের পেছনে ফিরে তাকালে দেখা যাবে শভিন ও অন্য আরেক অফিসার টু থাও এর বিরুদ্ধে আগে থেকে আরো বেশকিছু অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। থাও এর বিরুদ্ধে ৬টি অভিযোগ, ২০১৭ সালে একজনকে মাটিতে ফেলে পেটানোর দায়ে আদালতে অভিযুক্ত হন। শভিনের বিরুদ্ধে ১৭টি অভিযোগ, তিনবার পুলিশী গোলাগুলির অভিযোগ যার মধ্যে একটি ছিল গুরুতর। কিন্তু কোনোবারই তাদের অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়নি, নেয়া হয়নি তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও। কিন্তু এই ধরনের ঘটনা পুলিশ ডিপার্টমেন্টে একদমই নতুন নয়। সে আলোচনায় আমরা পরে আসছি।

Image Source: Apu Gomes/Getty Images

ফ্লয়েডের মৃত্যু বেদনাদায়ক কিন্তু অস্বাভাবিক নয়, ভয়ঙ্কর কিন্তু আশ্চর্যজনক নয়। আমেরিকার ইতিহাসে পর্যায়ক্রমে ঘটে আসা বর্ণ বৈষম্যের আর আধিপত্যের ঘটনারই একটি অংশকে চিত্রিত করেছে ফ্লয়েডের মৃত্যু। কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানদের প্রতি পুলিশের এই নির্মমতার গল্পও ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তি। তাই আন্দোলনের সূত্রপাতও কেবলমাত্র ফ্লয়েডের বিচারের দাবিতে নয়, বলা যায় এক অপ্রতিসাম্যতার বিরুদ্ধে লড়াই। আর গল্পটা যতটা না আন্দোলনকারীদের সহিংসতার, তার থেকেও বেশি পুলিশের নির্মমতা এবং শ্বেতাঙ্গদের আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে।

যদিও এই অস্থিরতার সূত্রপাত পুলিশী নির্যাতনকে সামনে রেখে, কিন্তু আড়ালে থেকে যাওয়া বৈষম্যের আরও একটি চিত্র লক্ষ্য করার মতো যা নিয়ে কেউ আন্দোলন করেনি। মহামারীতে রূপ নেয়া করোনাভাইরাস কিন্তু বর্ণভেদ মেনে সংক্রমিত হয় না, তবুও বর্ণবাদের আঁচড় পড়েছে এখানেও। সম্প্রতি লুইজিয়ানা, মিশিগান, শিকাগোসহ বিভিন্ন এলাকার এবং প্রোপাবলিকার প্রকাশিত তথ্য থেকে দেখা যায় করোনায় কৃষ্ণাঙ্গদের ঝুঁকি যথেষ্ট বেশি শ্বেতাঙ্গদের তুলনায়।

একটা বিষয় লক্ষ্য রাখা দরকার, যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকানদের জনসংখ্যা যেখানে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কম, সেখানে আক্রান্ত ও মৃতদের তালিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা বেশি থাকাটা নিতান্তই কাকতালীয় নয়। টেস্ট এবং পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবার বেলাতেও বৈষম্যের শিকারের চিত্র ফুটে উঠেছে এই মহামারীতে। এখন একটি প্রশ্ন, সম্পদশালী বা মধ্যবিত্ত এই শ্বেতাঙ্গরা যখন করোনার ধাক্কা সামলে উঠবে, তখন কি আদৌ তারা এই বৈষম্য নিপীড়িত সম্প্রদায়ের কথা ভাববে, নাকি একই বৈষম্য থেকেই যাবে যাতে পরবর্তীতে এই কষাঘাত কেবল কৃষ্ণাঙ্গদেরই বয়ে বেড়াতে হয়?

১৯১৮ এর ইনফ্লুয়েঞ্জা কিংবা এইচ১এন১ সংক্রমণের সময়ও বৈষম্যের ঠিক একইরকম চিত্র আমরা দেখেছি। এছাড়াও বর্তমান মহামারীতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের কর্মসংস্থান হারানোর হার বেশি, যার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থেকে তাদের জীবিকার সন্ধান করতে হচ্ছে যা সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। ২০১৬ সালের এক জরিপে দেখা যায় শ্বেতাঙ্গরা দশগুণ বেশি আয় করে কৃষ্ণাঙ্গদের তুলনায়।

আবারও ফিরে আসা যাক আগের ঘটনায়। ফ্লয়েডের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পরপরই মাঠে নেমে আসে সব বর্ণের মানুষ। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন শুরু করলেও ক্রমেই তা রূপ নেয় ভয়ঙ্কর অস্থিরতায়। পুলিশের টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট থেকে শুরু হয়ে আন্দোলনকারীদের পুলিশ ফাঁড়ি, হোয়াইট হাউজ আক্রমণ, দোকানপাট লুট, গাড়ি ভাংচুর পর্যন্ত গড়ায়। গ্রেফতার করা হয়েছে হাজার হাজার আন্দোলনকারীকে।

অনেকের মতে, উনবিংশ শতাব্দীর ষাটের দশকে মার্টিন কিং লুথারের আততায়ীর হাতে খুন হবার পর গড়ে ওঠা আন্দোলনের পর ঘটা এটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলন। কিন্তু মিডিয়াতে প্রদর্শিত চলমান অস্থিরতা আর সহিংসতা পুরো আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে না।

Image Source: Elijah Nouvelage/Getty Images

একইভাবে ঘটে যাওয়া দাঙ্গা আর অস্থিরতা আন্দোলনের চলমান পরিস্থিতিকেও তুলে ধরে না। তাই বর্তমান আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, অন্যান্য আন্দোলনের থেকে এই আন্দলোনের গুরুত্ব এবং চলমান পরিস্থিতির আলোচনায় আসার আগে চলুন একটু ইতিহাসের পাতা থেকে নির্মমতার আর বৈষম্যের চিত্রগুলো একে একে দেখে আসা যাক, যা আজকের এই ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের জ্বালানীর ভূমিকা পালন করছে। তবে অতীত ইতিহাসের থেকে সম্প্রতি পুলিশী নির্যাতনের ইতিহাস এখানে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  

আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের আগমনের গল্পটা ইতিহাসে কলঙ্কের কালিতে লেখা আছে, যা আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড নামে পরিচিত। আমেরিকার মাটিতে ক্রিস্টোফার কলাম্বাসের পা দেয়ার পর থেকেই রচিত হতে থাকে বর্বরতার নতুন অধ্যায়। ভারতীয় উপমহাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে পথ ভুলে বাহামাস দ্বীপে পা ফেলার পর স্বর্ণের অনুসন্ধান শুরু করেন কলাম্বাস। তাতে ব্যর্থ হলেও আমেরিকার জমির উর্বতার কদর বুঝতে ভুল হয়নি ইউরোপীয়দের। একে একে তারপর শুরু হয় কৃষিজ পণ্যের চাষাবাদ। আখ, কফি, তামাক, কোকোয়া, তুলাসহ ধান, গম চাষ চলতে থাকে। কিন্তু এতসব চাষাবাদের জন্য চাই জনবল। একদিকে নেটিভ আমেরিকান নিধন, অন্যদিকে ইউরোপীয়দের বয়ে আনা সংক্রামক রোগের সাথে পাল্লা দিয়ে পেরে উঠছিল না আদিবাসীরা।

এদিকে ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে দক্ষিণ আমেরিকায় ঘাঁটি গাড়া পর্তুগীজরা শুরু করে আফ্রিকান দাস ব্যবসা, একে একে এতে যোগ দেয় স্প্যানিশ, ডাচ ও ফ্রেঞ্চরাও। সদ্য আবিষ্কৃত ইউরোপীয় উপনিবেশ আমেরিকায় তাই জনবলের যোগান দিতে স্প্যানিশরা আফ্রিকান দাস চালান শুরু করে। আনুমানিক ১৫০২ এর দিকে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয় আফ্রিকান দাসদের। ষোড়শ শতাব্দী থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত আনুমানিক ১ কোটি ২০ লক্ষ আফ্রিকান এই দাস ব্যবসার মাধ্যমে আনা হয়, যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সমুদ্রপথেই প্রাণ হারায়।

“The Slave Trade” by Auguste François Biard, 1840

এ তো গেল স্বল্প কথায় আফ্রিকানদের আগমনের ইতিহাস। তাদের প্রতি নির্যাতন আর বর্বরতার ইতিহাস আরো ভয়ানক, তবে সে অন্য গল্প। পূর্বপুরুষদের এই আঘাতের দাগ আফ্রিকান-আমেরিকানরা আজও ভোলেনি তা খুব স্পষ্ট, তবে আজকের এই শক্তিশালী আমেরিকার অর্থনৈতিক যাঁতাকল যে তারাই নির্মাণ করে দিয়েছেন এ কথা নিশ্চয় নতুন করে বলা লাগবে না।

১৮৬৫ সালে গৃহযুদ্ধে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করা হলেও তা পুরোপুরিভাবে বন্ধ হতে ৮০ এর দশক পর্যন্ত লেগে যায়। উত্তরে ইউনিয়নের জয়ের ফলে প্রায় ৪০ লক্ষের কাছাকাছি দাসের মুক্তি তো মিলল তবে তারা নিঃস্ব। থাকার জায়গা, খাবার, কাপড় যোগাতে কাজের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকা ছাড়া আর কী-ই বা করার আছে! এদিকে দক্ষিণের রাজ্যগুলো ব্ল্যাক কোড জারি করে তাদের চলাচল একরকম সীমাবদ্ধ করে কৃষিকাজে বাধ্য করে। ব্ল্যাক কোড আর রেডলাইনিং আইনের বেড়াজালে বসবাসের ভূমি একরকমের ক্রয় ক্ষমতার নাগালের বাইরে চলে যাওয়াই অপেক্ষাকৃত অনেক দরিদ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলোতে বসবাস ছাড়া উপায় ছিল না তাদের।

অন্যদিকে গৃহযুদ্ধের পর দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে আবির্ভাব ঘটে শ্বেতাঙ্গদের সন্ত্রাসী গুপ্তসংঘ কু ক্লাক্স ক্ল্যানের। সদ্য দাস প্রথা থেকে মুক্তি পাওয়া আফ্রিকান-আমেরিকানদের দমিয়ে রাখাই তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল। রাতের আঁধারে সশস্ত্র অবস্থায় টহল দিয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের নির্যাতন, প্রকাশ্যে জনসম্মুখে কৃষ্ণাঙ্গদের দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদন্ড দেওয়া ছাড়াও নৃশংসতার চূড়ান্ত পর্যায় প্রদর্শন করে তারা। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গদের সমর্থনকারী শ্বেতাঙ্গদেরও ছাড় দেয়নি ক্ল্যানের সদস্যরা। গৃহযুদ্ধের পর থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের লিঞ্চিং শুরু হয়। সম্পূর্ণ বিচার বহির্ভূত এ প্রক্রিয়ায় জনগণের রায়ে দোষী সাব্যস্ত করে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হতো। উনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আনুমানিক ৪,০০০ আফ্রিকান-আমেরিকানকের এভাবে হত্যা করা হয়েছে। 

ক্লু ক্লাক্স ক্ল্যানের সদস্যরা; Image Source: Brittanica

১৮৬৫ সালে কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠিত Freedman’s Bureau আফ্রিকান-আমেরিকানদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। খাবার, থাকার ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে ভূমিকা রাখে আমেরিকান মিশনারী অ্যাসোসিয়েশনও। শিক্ষার সুযোগ করে দেয়ার লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানও স্থাপিত হয়। একটু একটু করে অবস্থার উন্নতি হতে থাকলে দক্ষিণে রাজনৈতিক অঙ্গণে প্রবেশ শুরু করে কৃষ্ণঙ্গরা। তবে এ সুযোগ বেশি দিন স্থায়ী ছিল না। গৃহযুদ্ধে হেরে যাওয়া কনফেডারেসি স্টেট পুনরায় ফেরত আসে এবং কৃষ্ণাঙ্গদের আবারও দমন শুরু করে।

উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দুই দশকে বর্ণবাদের বৈষম্য বেশ ভালোভাবেই ভিত্তি গাড়তে শুরু করে। এর মধ্যে অন্যতম ছিল জিম ক্রো আইন পাস, যার মাধ্যমে “সমতা কিন্তু আলাদা” নীতির নামে কৃষ্ণাঙ্গদের পৃথক করে সব ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হতো। শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বিয়ে নিষিদ্ধ, পাবলিক প্লেস, যানবাহন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সহ সবকিছু পৃথক করে দেয়া হতে থাকে। যেমন চলতো বৈষম্য, তেমনই চলতো নির্যাতন এবং আইন-বহির্ভূত হত্যাকান্ডও। ১৯৬৪ সালের সিভিল রাইট আইনের আগপর্যন্ত এই আইন বহাল ছিল। জিম ক্রো আইন পাশের মাধ্যমে অবশ্য কু ক্লাক্স ক্ল্যানের প্রাথমিক অবসান ঘটে। পরবর্তীতে আবারও সিভিল রাইটস মুভমেন্ট দমনের জন্য তৃতীয় ক্ল্যানের আবির্ভাব হয়; চলে খুন, বোমাবাজিসহ বিশৃঙ্খলা। এদিকে চলমান আন্দোলনেও কু ক্লাক্স ক্লানের সদস্যদের আবারও আবির্ভাবের গুঞ্জন উঠেছে। গত ৮ই জুন আন্দোলনকারীদের মাঝে চলন্ত গাড়ি তুলে দেয় হ্যারি রজার নামের এক শ্বেতাঙ্গ। তাকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সে নিজেকে কু ক্লাক্সের সদস্য বলে দাবি করেছে।

বিংশ শতাব্দীটা ছিল আফ্রিকান-আমেরিকানদের জন্য বেশ কঠিন একটা সময়। সিভিল রাইট আইনের মাধ্যমে বর্ণভেদ পৃথকীকরণের অবসান ঘটলেও বৈষম্যের অবসান ঘটেনি। অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তাই বিংশ শতাব্দীর অনেকটা সময়জুড়ে বিভিন্ন আন্দোলনে মাঠে নামতে হয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদের। এর মধ্যে ১৯১৯ ছিল আন্দোলনে উত্তপ্ত এক বছর। লেক মিশিগানে রিলিফ নেওয়ার সময় এক শ্বেতাঙ্গ ১৭ বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ ইউজিন উইলিয়ামসকে পাথর মেরে নৌকা থেকে পানিতে ফেলে দেয়, ডুবে মারা যায় ইউজিন।

এদিকে ঘটনায় জড়িত শ্বেতাঙ্গকে গ্রেফতার বা অভিযুক্তও করা হলো না। ক্ষোভে ফেটে পড়ল শিকাগোর আফ্রিকান-আমেরিকানরা, আন্দোলনে আরেক কৃষ্ণাঙ্গকে গুলি করে মারা হলো। এদিকে শ্বেতাঙ্গদের আরেকটি দল সশস্ত্র অবস্থায় রাস্তায় বেরিয়ে এলোপাতাড়ি কৃষ্ণাঙ্গদের মারা শুরু করে, বাড়ি ভাংচুর ও গুলি চালায়। শুধু শিকাগো নয়, উত্তরের বেশ কয়েকটি রাজ্যেই অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ে। কেবল ইউজিনের মৃত্যু নয়, গত দশকের এমনই আরো অসংখ্য অবিচার তাদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। বছরজুড়ে আরো বেশ কয়টি আন্দোলন হয়, শয়ে শয়ে মারা পড়ে কৃষ্ণাঙ্গরা। ইতিহাসে এ সময়টা রেড সামার নামে পরিচিত।

 শিকাগোতে আন্দোলনের সময় পুলিশের সাথে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এক কৃষ্ণাঙ্গ; Jun Fujita/Courtesy of the Chicago History Museum

১৯৫৫ এর ডিসেম্বরে আলাবামার মন্টগোমারিতে রোজা পার্ক নামের এক মহিলা এক শ্বেতাঙ্গের জন্য তার আসন ছাড়তে অস্বীকৃতি জানালে তাকে গ্রেফতার করা হলে মন্টোগোমারি বাস বয়কট আন্দোলন শুরু হয়। প্রাথমিকভাবে এটি সিভিল রাইটস আন্দোলন শুরুর ভূমিকা রাখে।

১৯৩৫ এর হারলেম রেনেসাঁ, ১৯৪৩ ডেট্রয়েট অস্থিরতা, ১৯৬৪ এ হারলেম দাঙ্গা, ১৯৬৭ এর লং হট সামার, সিভিল রাইটস আন্দোলন, ১৯৬৮ এ মার্টি কিং লুথারের গুপ্তহত্যার পর গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলো ইতিহাসে বৈষম্যের সাক্ষী বয়ে বেড়াবে চিরকাল। দীর্ঘ এই চারশত বছরের ইতিহাসে সবগুলো আন্দোলনের কোনোটারই পথ সহজ ছিল না, বেশিরভাগই ছিল নির্মমতায় পরিপূর্ণ।

এবার নজর দেয়া যাক সম্প্রতি ঘটে যাওয়া পুলিশি নির্যাতন আর কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি পুলিশের আধিপত্যের দিকে। এর বেশিরভাগই আইনের বিচার-বহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতন। ওয়াশিংটন পোস্টের একটি জরিপে দেখা যায়, ২০১৮ সালেই ২৩ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ পুলিশের হাতে প্রাণ হারায়, যেখানে মোট জনসংখ্যার কেবল ১২ শতাংশ আফ্রিকান-আমেরিকান। কিন্তু পুলিশ কখনোই এসব হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত হয় না, কিংবা হলেও পরবর্তীতে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। জর্জ ফ্লয়েড হত্যায় যতটা দ্রুত পুলিশের বিরুদ্ধ চার্জ গঠন করা হয়েছে, ইতিহাসে এমনটা সচারাচর ঘটেনি।

২০১২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারিতে ফ্লোরিডার স্যানফোর্ডে ট্রেভন মার্টিনকে বাসায় ফেরার পথে একা হেঁটে যেতে দেখায় সন্দেহভাজন হিসেবে প্রথমে ধ্বস্তাধস্তি ও পরে গুলি করে হত্যা করে জর্জ জিমারম্যান। মার্টিন তার বাবার সাথে ফ্লোরিডায় বাবার বাগদত্তার বাসায় গিয়েছিল। ২০১৩ সালে জিমারম্যানকে নির্দোষ হিসেবে খালাস দেয়া হলে শুরু হয় ব্ল্যাক লাইভ ম্যাটার আন্দোলন।

২০১৪-তে এরিক গার্নারকে ফ্লয়েডের মতো করেই হত্যা করা হলে জনগণের মধ্যে প্রচারণা পায় এই আন্দোলন। প্রাথমিকভাবে এরিকের হত্যাকারীর বিরুদ্ধেও চার্জ গঠনে অস্বীকৃতি জানানো হয়, তবে এর পাঁচ বছর পর চাকরি হারালেও কোনো অভিযোগ গঠন হয়নি

ট্রেভন মার্টিন; Image Source: AP Photo/Martin Family Photos

২০১৫ সালে উত্তর মিনিয়াপলিসে জামার ক্লার্ককে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ক্লার্ক গ্রেফতার কাজে বাধা দিচ্ছিল এবং পুলিশের পিস্তল ছিনিয়ে নিতে চাইছিল; পথচারী প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ক্লার্ককে মাটিতে ফেলে হাতকড়া পরানো অবস্থায় গুলি করা হয়। সম্প্রতি পুলিশের নির্মমতার শিকার হয়েছেন আহমাদ আরবেরি, ব্রেওনা টেইলর, ফিলান্ড ক্যাস্টাইল, মাইকেল ব্রাউন, সান্দ্রা ব্ল্যান্ডসহ আরো অনেকেই। এসবের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন হয়নি।

২০০৬ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ৪১ জন পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতার করা হয় মানবহত্যার অভিযোগে, যেখানে তথ্যানুযায়ী ২,৭০০টিরও বেশি আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে পুলিশের হাতে। কিন্তু আইনের সংস্করণ, পুলিশের বডি ক্যামেরা স্থাপন- এতগুলো আন্দোলন কোনোকিছুই পরিবর্তন আনতে পারেনি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তিতে।  

এগুলো ছিল পুলিশের বর্ণবাদী আচরণের একটি অন্যতম নৃশংস দিক। আইনের চোখে সাদা-কালোর বৈষম্যের একটা ছোট্ট উদাহরণ দেয়া যাক। যদি একই অপরাধ কোনো কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গ করে, তবে অবশ্যই শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গের সাজা কমপক্ষে ২০ শতাংশ বেশি হয়। সার্বিক প্রেক্ষাপটে পুলিশের হাতে হেনস্তার শিকার কিন্তু সাদাদের তুলনায় কালোরাই বেশি হয়। ট্রাফিক স্টপে বা রাস্তায় গাড়ি চালানোর সময় কৃষ্ণাঙ্গদের দ্বিগুণেরও বেশি সার্চ করা হয় শ্বেতাঙ্গদের তুলনায়। আবার দেখা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ এবং শ্বেতাঙ্গদের মাদক চোরাচালানের সাথে সম্পৃক্ত অপরাধের হার প্রায় সমান। সেখানেও শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সম্ভাবনা অনেক বেশি। বিষয়টা এতটাই পক্ষপাতদুষ্ট যে, কৃষ্ণাঙ্গদের কথা ভাবলেই তাদের যেকোনো অপরাধের সাথে সম্পৃক্ততা টেনে আনা হয়।

এবারে বর্তমান প্রেক্ষাপটে একটু চোখ বুলানো যাক। গত কয়েক সপ্তাহে কীভাবে বদলে গেল আমেরিকার চিত্র। চলমান মহামারী, আসন্ন নির্বাচন আর সোশ্যাল মিডিয়া বর্তমানের আন্দোলনের চিত্র অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। এই আন্দোলন যেমন কৃষ্ণাঙ্গদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকার আসন্ন প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচন এবং পরবর্তী কয়েকটি বছরের জন্য। একদিকে আসন্ন নির্বাচন বাধ্য করছে রাজনৈতিক নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে, অন্যদিকে ট্রাম্প যেভাবে সম্পূর্ণ বিষয়টির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন তা-ও আন্দোলনের জ্বালানী হিসেবে ভূমিকা রাখছে। যেখানে এই মুহূর্তে ট্রাম্পের উচিত ছিল নমনীয় আচরণের, ঠিক তার উল্টোটা করেছেন তিনি।

পহেলা জুন ট্রাম্প চার্চের বাইরে বাইবেল হাতে ছবি তোলেন বিক্ষোভকারীদের হোয়াইট হাউজ থেকে সরানোর পর; Image Source: AP/Patrick Semansky

তার টুইটারে করা পোস্টগুলো রীতিমতো আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢালার সামিল। অন্যদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধের হুশিয়ারি, আন্দোলন দমনে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েন, পরিস্থিতি বিশেষে বেখাপ্পা সব উক্তিতে বিরক্ত রিপাবলিকান সদস্যরাও। তাদের মতে, আন্দোলনের প্রতি ট্রাম্পের এহেন প্রতিক্রিয়া এবং মহামারীর অর্থনৈতিক ও জনগণের স্বাস্থ্যগত অবনতির প্রভাব আসন্ন নির্বাচনে খুব খারাপভাবেই পড়বে। 

শুরুর দিকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চলতে থাকলেও যেভাবে বিশৃঙ্খলার দিকে মোড় নিতে থাকে আন্দোলন তা খুব একটা আশ্চর্যজনক ছিল না। কেননা দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এত বিশাল একটা আন্দোলনের পুরোটা সময়জুড়েই যে কেবল শান্তিপূর্ণ হবে এমনটা আশা করা যৌক্তিক হবে না, বিশেষ করে যখন বহিরাগতরা এসে লুট করা শুরু করে। এমনকি লুট-ভাংচুরের বিষয়গুলোও অবশ্যম্ভাবী ঘটনা ছিল। তবে একটা বিষয় খুব খেয়াল রাখতে হবে, শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনকারী আর লুট করতে আসা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য এক নয়। ২০ বছর ধরে আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করা ইউনিভার্সিটি অভ মেরিল্যান্ডের সোশিওলজিস্ট ডানা ফিসার জানান, এটা খুবই বিরল যে একজন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারী ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ভাংচুর বা লুট করে। আর এই আন্দোলন কিন্তু রেসিজমের বিরুদ্ধে, ক্যাপিটালিজম নয়।

লুটপাট ও অগ্নি সংযোগের পর দোকানের অবস্থা Image Source: Stephen Maturen/Getty Images

তবে লুটকারীদের মোটিভেশনের অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। একটা জাতি যখন শত শত বছর জুড়ে বৈষম্যের শিকার হতে থাকে তখন তারা আন্দোলনে লুট করাকে আর খারাপ হিসেবে দেখে না, বরং সুযোগের সদ্ব্যবহারের একটা পন্থা হিসেবে দেখে। এছাড়া মহামারীর প্রকোপে দীর্ঘদিন ঘরে থেকে কর্মসংস্থান হারানো মানষগুলোও এই সুযোগ কাজে লাগায়।

আবার কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কিন্তু গণমাধ্যমে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে না, তাই আন্দোলনকারীরা মিডিয়া ও জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যও অস্থিরতা সৃষ্টি করে, কারণ মিডিয়া কেবল আন্দোলনের অস্থির দিকটাই বেশি তুলে ধরবে যা জনগণের জন্য উত্তেজক খবর। তবে উদ্দেশ্য যা-ই হোক, লুট কখনোই গ্রহণযোগ্য না, বিপরীতে এটি আন্দোলনকে ভুল পথে নিয়ে যায়। কিন্তু আন্দোলনের অস্থিরতা যে কেবল আন্দোলনকারীদের উপরেই নির্ভর করে এমনটাও ঠিক না। পুলিশের সহায়তা ছাড়া আন্দোলনের গতি ঠিক রাখা যেখানে সম্ভব না, সেখানে পুলিশই শুরুতে টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে আন্দোলনকারীদের উষ্কে দিলে তারা আর শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।

Image Source: Samuel CORUM/ AFP

গত ৭ জুন ঘোষণা দেয়া হয় মিনিয়াপলিস পুলিশ ডিপার্টমেন্ট পুনর্গঠনের, একইসাথে চলমান আইন পুনঃসংশোধনের, যা আন্দোলনের একটা অন্যতম সফলতা বলা যায়। এদিকে আন্দোলনের টিয়ার গ্যাস নিষিদ্ধ করা হয়েছে আগামী ৩০ দিনের জন্য, নামিয়ে ফেলা শুরু হয়েছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদী কনফেডারেট নেতাদের স্তম্ভ-প্রতিমূর্তি।

বিভিন্ন জরিপে উঠে এসেছে আগে জনগণ আন্দোলনগুলোকে কীভাবে দেখতেন আর এখন কীভাবে দেখছেন। বর্তমানে ৫৭ শতাংশ আমেরিকান এবং ৪৯ শতাংশ শ্বেতাঙ্গ মনে করেন আফ্রিকান-আমেরিকানদের ওপর বর্ণবাদী পুলিশী নির্যাতন মাত্রাতিরিক্ত। যেখানে ২০১৪ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩৩ এবং ২৬ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আমেরিকান একে অনেক বড় একটি ঘটনা হিসেবে দেখছেন। একইসাথে সব বর্ণের আন্দোলনকারীদের অংশগ্রহণও এই আন্দোলনকে যথেষ্ট বেগবান করে যাচ্ছে। পূর্বে যেখানে শ্বেতাঙ্গদের এসব আন্দোলনে তেমন একটা অংশগ্রহণ থাকত না, এবার কিন্তু এর বিপরীতটাই ঘটেছে, কৃষ্ণাঙ্গদের সাথে সমান তালে গলা মেলাচ্ছে শ্বেতাঙ্গরাও। মহামারীতে মানুষের ঘরে বন্দী থাকার ফলে যেভাবে সময় কাটাচ্ছে সবাই, তাতে এই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণেও কোনো কমতি রাখেনি।

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ১৩% শতাংশের কর্মহীনতা আন্দোলনকারীদের সংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম একটা কারণ বলা যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থা, প্রতিষ্ঠানগুলোর সমর্থন পূর্বের আন্দোলনগুলোর থেকে যথেষ্ঠ শক্তিশালীও করেছে এই আন্দোলনকে। সার্বিকভাবে অনেক বিশেষজ্ঞই এই আন্দোলনকে ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন, পাশাপাশি আশা করছেন বড় একটি পরিবর্তনের।

তবে ইউনিভার্সিটি অভ নিউ ইয়র্কের ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার কোর্সের শিক্ষক লিওন রবার্টের মতে, এখনই কোনো মন্তব্য করা ঠিক হবে না এই আন্দোলন নিয়ে। সিভিল রাইটস আন্দোলন এক দশক স্থায়ী হয়েছিল, বর্তমান আন্দোলনের গতিপথ বুঝতে আরো অপেক্ষা করতে হবে। তবে তিনিও আশাবাদী, হয়তো চারশত বছরের বৈষম্যের ঘটবে এবার।

Featured Image: Jerry Holt/Star Tribune via Getty Images

This article explains the story and reasons behind black lives matter movement, why is this happening and what is going to happen. 

Further Reading:

Vox

BBC

Related Articles