গণিতের ভাষায় বলতে গেলে সাত একটি মৌলিক সংখ্যা। কিন্তু আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় জগতে এই সংখ্যার তাৎপর্য অনেক। ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা সাত সংখ্যাকে মনে করেন 'ঈশ্বর সংখ্যা', কারণ ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী ঈশ্বর এই পৃথিবী সৃষ্টি করেন ছয় দিনে এবং সপ্তম দিনে তিনি বিশ্রামে যান। সংখ্যাতত্ত্ব অনুযায়ী সাত খুবই শক্তিশালী সংখ্যা। তাই জেমস বন্ডের জিরো জিরো সেভেন কোড হোক বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর জার্সির সংখ্যা, সাতকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয় কোনোভাবেই।
রামধনুর সপ্তরঙের ছটা, সপ্তসুরের মূর্ছনা, চোখধাঁধানো পৃথিবীর সপ্তমাশ্চর্য- সাত সংখ্যাটি আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। পশ্চিমা সংস্কৃতিতে সাতের কদর ঈর্ষণীয়। মনে করা হয়, সাত খুবই সৌভাগ্যসূচক সংখ্যা। প্রাচ্যদেশ জাপান ও চীনেও সাতের কদর অনেক। হিন্দু ধর্মে সপ্ত ঋষি বা বিবাহের সময় অগ্নিসাক্ষী রেখে সাত পাকে ঘোরা ইত্যাদি ব্যাপারে এই সংখ্যার গুরুত্ব বোঝায়।
এ তো গেলো সাত নম্বরের সাতকাহন। কিন্তু যদি এই সংখ্যাকে কেউ যদি নিজের জীবনের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলে, শয়নে-স্বপনে-জাগরণে সাতই যদি তার ধ্যান-জ্ঞান হয়ে ওঠে, তাহলে কেমন হয়? শুধু সাত নয়, লাল আর সাদা এই দুটি রঙে মন প্রাণ রাঙিয়ে নিয়েছেন এই মানুষটি। তার এই বিশেষ সংখ্যার প্রতি অমোঘ টান ইন্ডিয়া বুক অব রেকর্ডসে জায়গা করে নিয়েছে। তিনি ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বেঙ্গালুরু শহরের বাসিন্দা। নাম সেভেনরাজ।
নাম এবং জীবনের এক অদ্ভূত সমাপতন। সেভেনরাজের জন্ম ও বেড়ে ওঠা এই শহরেই। বাবা-মায়ের সপ্তম সন্তান হওয়ায় আদর করে তার নাম রাখা হয় সেভেনরাজ। তবে বোধহয় তারা বুঝে উঠতে পারেননি যে তাদের সন্তান এভাবে নাম সার্থক করে তুলবে। পেশায় রিয়েল এস্টেট এজেন্ট সেভেনরাজ আজ শুধু বেঙ্গালুরু না, সারা ভারতে পরিচিতি লাভ করেছেন 'রেড অ্যান্ড হোয়াইট ম্যান' হিসেবে।
প্রথমে সাত সংখ্যার উপরে তার মোহ থাকলেও পরবর্তী সময়ে সাদা ও লাল রঙের দুনিয়ায় এমনভাবেই নিজেকে আবদ্ধ করে ফেলেছেন যে এর বাইরে অন্য কোনো রং বা সংখ্যা তিনি প্রাধান্য দেওয়া সমীচীন মনে করেন না। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে রাতে শুতে যাওয়া পর্যন্ত সবকিছুতেই তার পছন্দ লাল কিংবা সাদা অথবা লাল-সাদা রঙের। তার ব্যবহৃত প্রতিটি জিনিস; সেটা ফোনের কভার গার্ড হোক বা বসার আরাম কেদারা, সবই হতে হবে শুভ্র অথবা রক্তিম। এমনকি তার বাসনপত্রেও থাকতে হয় লাল-সাদার ছোঁয়া। রুপালি পর্দাকেও হার মানাবে এই অদ্ভুত শৌখিন মানুষের বাস্তব জীবনের কাহিনী।
সাদা রঙের প্রতি টান ছিল ছোট থেকেই। কারণ দক্ষিণ ভারতীয় পরিবারে সাদা রঙের প্রচলন এমনিতেই একটু বেশি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সাদা রঙের পোশাক পরতে পছন্দ করেন। আর নামের সাথে জুড়ে থাকা সাত সংখ্যাকে সেভেনরাজ তো কবেই রবি ঠাকুরের ভাষায় "তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা"!
ধীরে ধীরে লাল রঙের প্রতি ভালোলাগা তৈরি হয়। আঠারো বছর বয়স থেকে তিনি লাল রঙের পোশাক পরা আরম্ভ করেন। ব্যাস, তারপরে এই তিনের বাইরে আর কিছু ভাবতেই পারেন না সেভেনরাজ। বর্তমানে তাকে বেশিরভাগ সময় লাল কোট, সাদা শার্ট, লাল টাই এবং লাল রঙের জুতো পরেই দেখা যায়।
সেভেনরাজের এই লাল-সাদা দুনিয়ায় মানিয়ে নিয়েছেন তার স্ত্রী পুষ্পা এবং সন্তানরাও। তার ছেলে ও মেয়ে ছোটবেলা থেকেই লাল-সাদা রঙের পোশাক পরতে অভ্যস্ত। এমনকি তাদের এমন স্কুলেই ভর্তি করা হয়েছিল যেখানকার স্কুলের পোশাক ছিল লাল-সাদা রঙের। বাবার এই বিশেষ রঙের প্রতি আবেগকে তারা বেশ উপভোগ করে।
সেভেনরাজের সাত সংখ্যার ওপরে যে আবেগ, তা বোধহয় কল্পনাকেও হার মানায়। তার প্রথম মোবাইল নাম্বারের শেষ তিনটি সংখ্যা ছিল ০০৭। বর্তমানে যে ফোন নম্বরটি ব্যবহার করেন সেটারও শেষ সংখ্যা তিনটি ৭৭৭। তার প্রতিটি পোশাকে, অফিসের সিল মোহরে প্রিয় সংখ্যা সাতকে খোদাই করে নিয়েছেন সুন্দর প্রতীক হিসেবে। এমন সাতপ্রেমী মানুষের তার সাদা লাল রঙের স্করপিও গাড়ির নম্বর প্লেটের চারটি সংখ্যা কী হতে পারে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গাড়িতেও খোদাই করা রয়েছে সাত সংখ্যা।
তার ব্লেজারে বা জামাতে সবসময় সাতটি বোতাম থাকে। এমনকি এই সাত সংখ্যার প্রতি ভালোলাগাকে মান্যতা দিয়ে শিখে ফেলেছেন সাত সাতটি ভাষাও! ইংরেজি, হিন্দি, কানাড়া, তামিল, তেলেগু, মারাঠি এবং নিজের মাতৃভাষা মালায়ালাম।
সাত সংখ্যাকে জীবনে খুবই শুভ মানেন সেভেন রাজ। তাই জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সাত সংখ্যাকে জড়িয়ে নিয়েছেন ওতপ্রোতভাবে। নিন্দুকেরা অবশ্য একে সেভেনরাজের সহজে জনপ্রিয়তা অর্জনের চাল বলে কটাক্ষ করলেও এসবে পাত্তা দিতে তিনি নারাজ। তার অকপট বক্তব্য, "প্রথমে আমাকে নিয়ে অনেকে হাসাহাসি করত। আমার পোশাকের রং নিয়ে মজা করত। কিন্তু আমি ঠিক করে নিয়েছি আমৃত্যু এই লাল ও সাদা রঙের পোশাকই পরব।"
এমনিতেই ব্যবসার কাজে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন। অবসর সময় পরিবারের সাথে কাটাতে বেশি পছন্দ করেন। ছেলে ভরতরাজ একজন নৃত্যশিল্পী। ছেলের কাছে সমস্ত প্রেরণার উৎস তার বাবা। বেঙ্গালুরু শহরে তার জনপ্রিয়তা ফিল্মস্টারদেরও হার মানায়। ট্রাফিক সিগনালে কিংবা কোনো পার্টিতে মানুষজন তাকে ঘিরে ধরেন সেলফি তোলার জন্য। দেশের বহু বিখ্যাত সংবাদমাধ্যমে তার কথা প্রচারিত হয়েছে। প্রচুর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এসেছেন ইউটিউব চ্যানেলের অনুষ্ঠানেও।
তবে সেভেনরাজ বলেন, তার এই শখ জনপ্রিয়তা অর্জনের সস্তা চাল ছিল না কখনোই। তিনি আগে একজন সফল ব্যবসায়ী। পরিশ্রম করে অর্থোপার্জন করেন। সুতরাং তার এই শখ পূরণের প্রতিটি কানাকড়ি তার স্বহস্তে অর্জিত। তাই এই বিষয়ে কারো কিছু বলার নেই।
মদ্যপান একেবারেই পছন্দ করেন না। ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে আজীবন শুদ্ধ শাকাহারী। ক্রিসমাসে লাল রঙের জোব্বা পরে সান্তা সেজে বাচ্চাদের উপহারও বিলি করেন। অত্যন্ত হাসিখুশি মানুষটি তার ছোট্ট পরিবার আর তিনটি আজব শখ নিয়ে বেশ সুখেই আছেন। কারণ, নির্ঝঞ্ঝাট, সদালাপী সেভেনরাজ কারও ঝুটঝামেলায় না থাকলেও আজীবন যে সাতের গেরোয় থেকে যাবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
This Bengali article discusses the story of Sevenraj, the man who is fond of number 7 and colors red & white.
Reference:
1. Meet Sevenraj - A Man Obsessed With The Colours Red And White, And The Number 7 - India Times
2. Secret of Sevenraj's success is in red and white - DNA India
3. Meet Sevenraj -The Man Obsessed With The Number 7 And The Color Red - Daily Hunt