Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

যে গ্রামে অধিবাসী মাত্র একজন

শিরোনাম দেখে চমকে উঠতে পারেন আপনি। আধুনিক যুগে এসে একটা গ্রামে একজন মাত্র মানুষ কীভাবে বসবাস করতে পারে? হাজার বছর আগেই মানুষ নিজেদের স্বার্থে সমাজ গঠন করে গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনযাপনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে যা এখনও চলমান, এবং ভবিষ্যতেও যে মানুষ এই পথ থেকে সরে আসবে, সেই সম্ভাবনা নেই। স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য মানুষের যেসব দরকার তা একজন ব্যক্তির পক্ষে উৎপাদন করা সম্ভব না, তাই সমাজে পারস্পরিক সহযোগিতা ছাড়া চলা সম্ভব নয় মানুষের। কিন্তু আধুনিক যুগে এসেও আমেরিকায় এমন একটি গ্রামের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছেন মাত্র একজন মানুষ। বিভিন্ন কারণে একসময় মানুষের আগমন ঘটেছিল সেখানে, কিন্তু পরবর্তীতে সবাই চলে গিয়েছে, থেকে গিয়েছে এক দম্পতি। বর্তমানে সেই দম্পতির একজন বেঁচে আছেন এবং তিনিই সেখানকার একমাত্র অধিবাসী।

আমেরিকার নেব্রাস্কা প্রদেশের একটি ছোট গিয়ে গ্রামের নাম মনোয়ি। মাত্র আধা কিলোমিটার আয়তনের এই গ্রাম খুব বড় নয়। নেব্রাস্কা প্রদেশের একেবারে উত্তর দিকে এর অবস্থান, প্রতিবেশী দক্ষিণ ডাকোটা থেকে এই গ্রামের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। সবুজ মাঠ ও সোনালি গম ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে তৈরি করা পাকা রাস্তা দিয়ে যেতে হয় এই গ্রামে।

মিসৌরি ও নায়োব্রারা– দুটি বড় নদী বয়ে চলেছে এই গ্রামের পাশ দিয়ে। খুব বেশি স্থাপনা নেই এই গ্রামে; একটি পরিত্যক্ত চার্চ যার ভেতরে বর্তমানে অনেকগুলো ট্রাক্টরের টায়ার রয়েছে, একটি লাইব্রেরি যেখানে প্রায় পাঁচ হাজার বই রয়েছে, একটি সাদা ঘর যেখানে গ্রামের একমাত্র অধিবাসী চুরাশিবছর বয়সী এলসি এইলার একটি পানশালা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং একটি পরিত্যক্ত গুদামঘর যেখানে একসময় শস্য সংরক্ষণ করা হতো। গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া অধিবাসীদের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে কিছু পরিত্যক্ত ঘরও রয়েছে, যেগুলোর মেঝে ফেটে বিভিন্ন অজানা গাছের ডাল। এটাই মার্কিন সরকার কর্তৃক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একমাত্র মিউনিসিপ্যালিটি, যেখানে মাত্র একজন মানুষ বসবাস করছেন।

গসগশহআজব
নেব্রাস্কার মোনোয়াই গ্রামে অধিবাসী আক্ষরিক অর্থেই মাত্র একজন; image source: eater.com

১৯০২ সালে যখন এই অঞ্চলে রেললাইন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়, তখন ‘দ্য পাইওনিয়ার টাউনসাইট কোম্পানি’ একটি গ্রাম প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী খুব দ্রুত অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং অল্পসংখ্যক অধিবাসী নিয়ে এই গ্রামের যাত্রা শুরু হয়। গ্রামের নামকরণের পেছনেও রয়েছে মজার ইতিহাস। নেব্রাস্কার এই অঞ্চলে একধরনের ফুল জন্মায়, যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় মনোয়ি (Monowi)। দ্য পাইওনিয়ার টাউনসাইট কোম্পানি এই ফুলের নামেই গ্রামের নামকরণ করে এবং পরবর্তীতে গ্রামটি এ নামেই সবার কাছে পরিচিতি লাভ করে। রেললাইনের পর স্থানীয় অধিবাসীদের সুবিধার জন্য পোস্টঅফিসও তৈরি করা হয়। অল্প সংখ্যক মানুষ নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও ধীরে ধীরে গ্রামে মানুষের সংখ্যা বাড়তে শুরু করে।

গ্রামের সর্বোচ্চ জনসংখ্যা ছিল ১২৩, যেটি ১৯৩০ সালের আদমশুমারিতে নথিবদ্ধ করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে এরপর থেকে জনসংখ্যা কমতে থাকে। এখানে যারা বসতি স্থাপন করেছিলেন, তাদের স্বপ্ন ছিল কৃষির মাধ্যমে তারা স্বনির্ভরতা অর্জন করবেন। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য তারা প্রচুর পরিশ্রমও করেন, কিন্তু আবহাওয়া ও মাটির অবস্থা ভালো না হওয়ায় তাদেরকে হতাশ হতে হয়। বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করার পরও উপযুক্ত ফলন না পাওয়ায় শেষ পর্যন্ত অনেক অধিবাসী জীবিকার আশায় অন্যান্য অঞ্চলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়েন।

১৯৫৫ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী গ্রামবাসীর সংখ্যা ছিল ৯৯ জন এবং ১৯৮০ সালে সেটি নেমে আসে মাত্র ১৮ জনে। গ্রামের পাশ দিয়ে যে রেলপথ ছিল সেটির মাধ্যমে খুব অল্প পরিমাণ মানুষ ভ্রমণ করার জন্য রেলকোম্পানিকে লোকসানের মুখ দেখতে হয়। তারা উপায়ান্তর না দেখে রেল বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় এবং ফলশ্রুতিতে পোস্ট অফিসও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে সেই দম্পতি বাদে বাকি যারা ছিলেন, তারাও গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়া সিদ্ধান্ত নেন।

১৯৭৫ সালে গ্রামে একটি পানশালা স্থাপন করে এলসি এইলার ও রুডি দম্পতি। ২০০৪ সালের এলসির স্বামী রুডি মারা গেলে তিনি এই গ্রামেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা সেই মদের দোকানই এখন পর্যন্ত এলসির জীবিকার্জনের একমাত্র উৎস। তবে পানশালায় পানীয়ের পাশাপাশি বার্গার কিংবা হটডগের মতো হালকা খাবারেরও ব্যবস্থা আছে। রুডির একটি বড় স্বপ্ন ছিল গ্রামে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা। সেজন্য তিনি অনেক বইও সংগ্রহ করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার আগেই তাকে পরপারে পাড়ি জমাতে হয়। স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে এলসিই লাইব্রেরি স্থাপন করেন। মনোয়ি গ্রামে যারা বেড়াতে যান, তারা চাইলেই সেই লাইব্রেরিতে কোনো ফি ছাড়াই বই পড়তে পারেন কিংবা ধারেও নিয়ে আসতে পারেন। এই লাইব্রেরির সম্পূর্ণ দেখভাল করেন এলসি।

ুয়হচবপনলনলম
এলসি এইলার, মনোয়ির একমাত্র অধিবাসী; image source: norfolksdailynews.com

মনোয়ির প্রধান কে জানেন? একমাত্র অধিবাসী এলসি। গ্রামে আর কোনো মানুষ না থাকায় ‘গ্রামের প্রধান কে?’– এই প্রশ্নের উত্তরে খুব বেশি ভাববার কোনো প্রয়োজন নেই। আবার যেহেতু তিনি একমাত্র অধিবাসী, তাই গ্রামের প্রধান তথা মেয়র নির্বাচনের সময় তিনিই একমাত্র ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন। আরও মজার বিষয় হলো যেহেতু তিনিই একমাত্র ভোটার এবং প্রার্থী, তাই তিনি নিজেকেই প্রতিবার নির্বাচনের সময় ভোট দিয়ে থাকেন, নিজেকে নিজেই মেয়র নির্বাচিত করে থাকেন। শুনতে অদ্ভুত শোনাচ্ছে নিশ্চয়ই, তাই না? যেহেতু মনোয়ি গ্রামটি ‘মিউনিসিপ্যালিটি’ হিসেবে আমেরিকা সরকারের কাছে নথিবদ্ধ আছে, তাই নিয়মানুযায়ী এখানে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন হয়ে থাকে। তিনি যে পানশালা পরিচালনা করেন, সেখানে লিকার লাইসেন্স দরকার হয়। এক্ষেত্রেও তিনি নিজের কাছে আবেদন করেন এবং নিজেকে লিকার লাইসেন্স প্রদান করেন। তবে প্রতিবছর মেয়র হিসেবে যে বাজেট তাকে রাজ্য সরকার বরাদ্দ দেয়, সেটার জন্য তাকে মিউনিসিপ্যালিটির পূর্ণ পরিকল্পনা নেব্রাস্কার প্রাদেশিক রাজ্য সরকারের কাছে পাঠাতে হয়।

হডহচহচজআজব
image source: magazine.outdoornebraska.gov

২০০৪ সালে যখন রুডি মারা যান, তারপর থেকে এই গ্রামের একমাত্র অধিবাসী হিসেবে রয়ে গিয়েছেন তিনি। ‘আমেরিকান সরকারের কাছে দ্বারা স্বীকৃত একমাত্র মিউনিসিপ্যালিটি যেখানে মাত্র একজন মানুষ বসবাস করেন’ এ ধরনের খবর গণমাধ্যমে আসার পর তিনি আমেরিকায় ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। বিখ্যাত গণমাধ্যম বিবিসি থেকে শুরু করে খ্যাতনামা পিপলস ম্যাগাজিনে তাকে নিয়ে লেখা প্রকাশ করা হয়েছে, যেগুলো তাকে রীতিমতো সেলিব্রিটি বানিয়ে দিয়েছে। তার পানশালা ও খাবারের দোকানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থান থেকে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকেরা খাবার খেয়েছেন। তার কাছে চারটি মোটা ডায়েরি রয়েছে, যেগুলোতে তিনি ঘুরতে আসা পর্যটকদের স্বাক্ষর সংরক্ষণ করেছেন। পর্যটকদের অনেকে তাকে অনেক সময় বিভিন্ন উপহার দিয়েছে। সেগুলোও তিনি সযত্নে রেখে দিয়েছেন।

একজন লাইব্রেরিয়ান, একজন মেয়র, একজন খাবারের দোকান ও পানশালার মালিক হিসেবে সাতাশি বছর বয়স্কা এই নারীকে বেশ ব্যস্ত সময় পার করতে হয়। মনোয়ি গ্রামটি এমনই অদ্ভুত একজন অধিবাসীকে পেয়েছে, যিনি শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তার স্মৃতিবিজড়িত স্থান থেকে চলে যেতে চান না। স্বামীর আজীবনের স্বপ্ন পূরণ করেছেন লাইব্রেরি বানিয়ে, গ্রামে বেড়াতে যাওয়া অতিথিদেরও আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি রাখেন না এই নারী। গণমাধ্যমে তাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর যখন আলোচনা শুরু হয়, তখন তিনি সোজাসাপ্টা উত্তর দেন, “খ্যাতি নিয়ে কখনোই কোন ভাবনা ছিল না আমার।” মনোয়ি অদ্ভুত একটি গ্রাম, যেখানে একজন মানুষই সবকিছু সামলে চলেছেন। পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত গ্রামগুলোর মধ্যে এটিও একটি।

Related Articles