Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি এবং ককেশাসের ভূরাজনীতি || পর্ব–১

সম্প্রতি ১৪–১৫ জুন তুর্কি রাষ্ট্রপতি রেজেপ এরদোয়ান আজারবাইজান সফর করেছেন এবং আজারবাইজানের শুশায় দেশটির রাষ্ট্রপতি ইলহাম আলিয়েভের সঙ্গে ‘শুশা মৈত্রী ঘোষণা’য় (Shusha Declaration on Allied Relations) স্বাক্ষর করেছেন। সফর শেষে এরদোয়ান তুর্কি টিভি চ্যানেল ‘এনটিভি’কে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন এবং সেই সাক্ষাৎকারে একটি প্রশ্নের উত্তরে তিনি উল্লেখ করেছেন যে, তুরস্ক আজারবাইজানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে। এরদোয়ানের এই বক্তব্য ককেশাস অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে একটি নতুন সমীকরণের সৃষ্টি করেছে এবং সেখানে বিদ্যমান সামরিক–ভূরাজনৈতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছে।

উল্লেখ্য, অন্তত ষোড়শ শতাব্দী থেকে ককেশাস অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই অঞ্চলকে বেষ্টনকারী তিনটি সাম্রাজ্য–রাষ্ট্র রাশিয়া, ইরান এবং ওসমানীয় রাষ্ট্র পরস্পরের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত ছিল। বর্তমানে এতদঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের জন্য রাশিয়া, তুরস্ক ও ইরানের মধ্যে যে সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা বিদ্যমান, সেটি বস্তুত রাষ্ট্র তিনটির ককেশাস সংক্রান্ত ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বেরই প্রতিফলন। অবশ্য ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে এতদঞ্চলের বাইরের বিভিন্ন রাষ্ট্র (যেমন: ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি) অঞ্চলটিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়ে, এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে পড়েছে। ককেশাস অঞ্চলের স্বাধীন (আজারবাইজান, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া), কার্যত স্বাধীন (দক্ষিণ ওসেতিয়া, আবখাজিয়া ও আর্তসাখ) ও স্বায়ত্তশাসিত/আধা–স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রগুলো (রাশিয়ার দাগেস্তান, চেচনিয়া, ইঙ্গুশেতিয়া, কাবার্দিনো–বালকারিয়া, কারাচাই–চের্কেশিয়া, উত্তর ওসেতিয়া–আলানিয়া ও আদিগেয়া, আজারবাইজানের নাখচিভান এবং জর্জিয়ার আদজারা) ভূকৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং এজন্য তারা এই প্রতিযোগিতার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছে।

দক্ষিণ ককেশাসে অবস্থিত একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হচ্ছে আজারবাইজান। মধ্য এশিয়া থেকে আগত ওঘুজ তুর্কিদের সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণের সংমিশ্রণের ফলে গঠিত আজারবাইজানি জাতি ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে রুশ–শাসিত আজারবাইজান ও ইরানি–শাসিত আজারবাইজানের মধ্যে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রুশ–শাসিত আজারবাইজানে জাতীয় সচেতনতার সৃষ্টি হয় এবং রুশ সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯১৮ সালে আজারবাইজান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ১৯২০ সালে আজারবাইজানে বলশেভিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯২২ সালে রাষ্ট্রটি সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হয়, কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রটি আবারও স্বাধীনতা অর্জন করে। কিন্তু ইরানি–শাসিত আজারবাইজানের ভূখণ্ড এখনো ইরানের অন্তর্ভুক্ত এবং অঞ্চলটির জনসাধারণ অন্তত আংশিকভাবে ইরানি জাতির সঙ্গে অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছে।

ককেশাস অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক মানচিত্র; Source: Gifex

আজারবাইজানিরা ওঘুজ তুর্কিদের বংশধর এবং ১৯১০–এর দশকের শেষদিকে ‘আজারবাইজানি’ নাম ধারণ করার আগে তারা ‘ককেশিয়ান তাতার’/’ককেশিয়ান মুসলিম’ নামে পরিচিত ছিল। আজারবাইজানিরা জাতিগত, ভাষাগত ও সংস্কৃতিগতভাবে বর্তমান তুরস্কের আনাতোলিয়ায় বসবাসকারী তুর্কিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। অবশ্য দীর্ঘদিন ইরানি ও রুশ/সোভিয়েত শাসনাধীনে থাকার ফলে আজারবাইজানি সংস্কৃতিতে ব্যাপক ইরানি ও রুশ প্রভাব বিদ্যমান এবং প্রধানত শিয়া ইসলামের অনুসারী (কিন্তু বহুলাংশে ধর্মনিরপেক্ষ) আজারবাইজানিরা ধর্মগতভাবে সুন্নি ইসলামের অনুসারী আনাতোলীয় তুর্কিদের সঙ্গে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে ১৯৯০–এর দশক থেকে তুরস্ক ও আজারবাইজান পরস্পরকে ‘এক জাতি, দুই রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করতে শুরু করেছে।

বস্তুত রাষ্ট্র দুটির মধ্যকার সম্পর্কের সূচনা ১৯১৮ সাল থেকে। ১৯১৮ সালে আজারবাইজান স্বাধীনতা ঘোষণার পর সদ্য স্বাধীন দেশটির নেতারা ওসমানীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেন এবং ওসমানীয় রাষ্ট্রের তদানীন্তন ‘বৃহত্তর তুর্কি জাতীয়তাবাদী’ নেতারা ককেশাস ও মধ্য এশিয়ার বৃহত্তর তুর্কি–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে সাম্রাজ্য বিস্তারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে আজারবাইজানকে একটি ওসমানীয় আশ্রিত রাষ্ট্রে পরিণত করতে সচেষ্ট হন। ওসমানীয় রাষ্ট্র ছিল আজারবাইজানকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম রাষ্ট্র। ১৯১৮ সালে ওসমানীয় ও আজারবাইজানি সৈন্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘ককেশিয়ান ইসলামি সৈন্যবাহিনী’ বলশেভিক ও আর্মেনীয় জাতীয়তাবাদীদের পরাজিত করে বিপুল হাইড্রোকার্বন–সমৃদ্ধ বাকু দখল করে নেয়, কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ওসমানীয় রাষ্ট্রের পরাজয়ের ফলে তাদের আজারবাইজানে আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা স্থগিত হয়।

১৯৯১ সালে আজারবাইজান তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং তুরস্ক বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র হিসেবে আজারবাইজানকে স্বীকৃতি প্রদান করে। তখন থেকেই রাষ্ট্র দুটির মধ্যে ব্যাপক মাত্রায় সামরিক সহযোগিতা আরম্ভ হয়। আজারবাইজানের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৮৮–৯৪ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধে তুরস্ক আজারবাইজানকে সক্রিয় সমর্থন প্রদান করে, কিন্তু এই যুদ্ধে আজারবাইজান পরাজিত হয় এবং আজারবাইজানের অন্তর্ভুক্ত আর্মেনীয়–অধ্যুষিত নাগর্নো–কারাবাখ অঞ্চলের সিংহভাগ ও এর আশেপাশের ৭টি আজারবাইজানি জেলা নিয়ে গঠিত হয় আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিবিহীন কিন্তু কার্যত স্বাধীন আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত ‘আর্তসাখ’ রাষ্ট্র। রাশিয়া নাগর্নো–কারাবাখ দ্বন্দ্বে বাহ্যিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করে, কিন্তু কার্যত তাদের বিদ্যমান পরিস্থিতি বজায় রাখার চেষ্টা আর্মেনিয়ার অনুকূলে কাজ করেছে। তদুপরি, আর্মেনিয়া রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সামরিক–কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন করে, আর্মেনীয় ভূখণ্ডে রুশ সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের অনুমতি প্রদান করে এবং রুশ–নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ‘যৌথ নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা’ ও অর্থনৈতিক জোট ‘ইউরেশীয় অর্থনৈতিক ইউনিয়নে’র সদস্য হয়।

আর্মেনিয়ার গুমরিতে অবস্থিত রুশ সামরিক ঘাঁটির সামনে রুশ ভাষার একটি ফলক; Source: Wikimedia Commons

অন্যদিকে, আজারবাইজান রাশিয়ার সঙ্গে চলনসই সম্পর্ক বজায় রাখে এবং রাশিয়ার সঙ্গে বিস্তৃত সামরিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখে, কিন্তু আর্মেনিয়ার সঙ্গে রাশিয়ার মৈত্রীর প্রত্যুত্তর হিসেবে তারা তুরস্কের সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলতে শুরু করে। তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে বিস্তৃত রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সম্পর্ক স্থাপিত হতে থাকে। অবশ্য ২০০০–এর দশকের শেষদিকে তুরস্ক ও আর্মেনিয়া পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা চালায়, কিন্তু এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। ২০১০ সালে তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে একটি ‘কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয় এবং এর মধ্য দিয়ে উভয় রাষ্ট্র তৃতীয় কোনো পক্ষের দ্বারা আক্রান্ত হলে একে অপরকে সহায়তা করবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়।

বস্তুত ১৯৯১ সাল থেকেই তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আজারবাইজানি সৈন্যরা তুরস্কের বিভিন্ন সামরিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে, তুর্কি সামরিক প্রশিক্ষকরা আজারবাইজানের ভূখণ্ডে দেশটির সৈন্যদের প্রশিক্ষণ প্রদান করে, আজারবাইজান তুরস্কের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্র ক্রয় করে এবং রাষ্ট্র দুটি নিয়মিত বিভিন্ন ধরনের সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে। তদুপরি, হাইড্রোকার্বন–সমৃদ্ধ আজারবাইজান তুরস্কের জীবাশ্ম জ্বালানির অন্যতম প্রধান উৎস এবং তুরস্কের ওপর দিয়ে নির্মিত কতিপয় পাইপলাইনের মাধ্যমে আজারবাইজান ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর কাছে জীবাশ্ম জ্বালানি রপ্তানি করে, যেগুলোর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ওপর তুরস্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর জ্বালানি সংক্রান্ত নির্ভরতার মাত্রা হ্রাস পেয়েছে। অর্থাৎ, তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে বিস্তৃত সামরিক–কৌশলগত সম্পর্ক বিদ্যমান।

এজন্য ১৯৯০–এর দশক থেকেই প্রচারমাধ্যমে (বিশেষত প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোর প্রচারমাধ্যমে) এই মর্মে জল্পনাকল্পনা চলে আসছে যে, আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হবে। অবশ্য অন্তত ২০১০–এর দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত আজারবাইজানে তুরস্কের কোনো কার্যকর সামরিক উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু ২০১৬ সালে তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে একটি সামরিক প্রোটোকল স্বাক্ষরিত হয়। এই প্রোটোকল অনুযায়ী আজারবাইজানি সরকার আজারবাইজানের গিজিল শের্গ সামরিক শহরের কিছু ভবন ও অবকাঠামো এবং হাজি জেয়নালআব্দিন তাগিয়েভ অঞ্চলে অবস্থিত বিমানঘাঁটির একটি টার্মিনাল ভবন তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করে। আজারবাইজানি সরকারের ভাষ্যমতে, এগুলো কোনো সামরিক ঘাঁটি নয়। কিন্তু এটি স্পষ্ট যে, আজারবাইজান এই সামরিক স্থাপনাগুলোকে কোনো ‘বেসামরিক’ উদ্দেশ্যে তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করেনি। বিশ্লেষকদের মতে, এগুলোতে তুরস্কের কোনো বৃহৎ মাত্রার সামরিক উপস্থিতি নেই, কিন্তু সীমিত মাত্রার তুর্কি সামরিক উপস্থিতি বিদ্যমান।

একটি যৌথ সামরিক মহড়া চলাকালে তুর্কি ও আজারবাইজানি হেলিকপ্টার; Source: Daily Sabah/Eurasia Daily Monitor

পরবর্তীতে ২০২০ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধের প্রাক্কালে আজারবাইজানে তুরস্কের বিস্তৃত সামরিক উপস্থিতি গড়ে ওঠে। যুদ্ধ শুরুর আগে ২০২০ সালের জুলাই–আগস্টে আজারবাইজানের ভূখণ্ডে তুর্কি ও আজারবাইজানি সশস্ত্রবাহিনী একটি বৃহৎ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করে এবং এই মহড়ার পর মহড়াটিতে অংশ নিতে আসা তুর্কি সৈন্য ও সামরিক সরঞ্জামের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আজারবাইজানেই রয়ে যায়। এসময় আজারবাইজানি রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গাবেল হুসায়ন আলী মতপ্রকাশ করেন যে, তুরস্ক আজারবাইজানের অন্তর্গত (কিন্তু মূল আজারবাইজানি ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন) নাখচিভান স্বায়ত্তশাসিত প্রজাতন্ত্র ও আবশেরন উপদ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে পারে।

রুশ গোয়েন্দা সংস্থার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের নাগর্নো–কারাবাখ যুদ্ধের সময় আজারবাইজানের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ৬০০ জন তুর্কি সৈন্য অবস্থান করছিল। এদের মধ্যে ছিল ২০০ সৈন্যের একটি ট্যাকটিক্যাল ব্যাটালিয়ন, নাখচিভানে মোতায়েনকৃত ৫০ জন সামরিক প্রশিক্ষক, বাকুতে মোতায়েনকৃত ৯০ জন সামরিক উপদেষ্টা, গাবালা বিমানঘাঁটিতে মোতায়েনকৃত ১২০ জন ফ্লাইট পার্সোনেল, দোল্লার বিমানঘাঁটিতে মোতায়েনকৃত ২০ জন ড্রোন অপারেটর, ইয়েভলাখ বিমানঘাঁটিতে মোতায়েনকৃত ৫০ জন সামরিক প্রশিক্ষক, পেরেকেশকালে আজারবাইজানি সেনাবাহিনীর ৪র্থ আর্মি কোরে মোতায়েনকৃত ৫০ জন সামরিক প্রশিক্ষক এবং বাকু নৌঘাঁটি ও আজারবাইজান উচ্চতর সামরিক অ্যাকাডেমিতে মোতায়েনকৃত ২০ জন সামরিক প্রশিক্ষক। তদুপরি, আর্মেনীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, তুর্কি স্পেশাল ফোর্সের প্রায় ১,২০০ সদস্য যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিল। যুদ্ধের পর উক্ত সৈন্যরা তুরস্কে ফিরে গেছে, না আজারবাইজানেই অবস্থান করছে, সেটি নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।

এই যুদ্ধে তুরস্ক কর্তৃক সরবরাহকৃত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ অ্যাটাক ড্রোন যুদ্ধক্ষেত্রে আজারবাইজানিদের সাফল্যে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অবশ্য এর পাশাপাশি ইসরায়েলি–নির্মিত ‘হারোপ’ আত্মঘাতী ড্রোন এবং রুশ–নির্মিত মাল্টিপল লঞ্চ রকেট সিস্টেমগুলোও আজারবাইজানের সামরিক সাফল্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। অবশেষে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যে একটি যুদ্ধবির‍তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং আজারবাইজান ১৯৮৮–৯৪ সালের যুদ্ধে হারানো ৭টি জেলা ও নাগর্নো–কারাবাখের একাংশ ফিরে পায়।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত বিজয়সূচক প্যারেডে তুর্কি–নির্মিত ‘বায়রাক্তার টিবি–২’ অ্যাটাক ড্রোন; Source: Wikimedia Commons

যুদ্ধে আজারবাইজানের সাফল্যে তুরস্কের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। স্বভাবতই যুদ্ধের পর তুরস্ক আজারবাইজানে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করবে, এরকমটাই ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে তুরস্ককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি এবং চুক্তির শর্তগুলোও তুরস্কের আশানুরূপ হয়নি। যুদ্ধবিরতি চুক্তির ফলে আজারবাইজান তার হারানো ভূখণ্ডের সিংহভাগ ফিরে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু নাগর্নো–কারাবাখের রাজধানী স্তেপানাকের্ত–সহ অঞ্চলটির বৃহদাংশ আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত আর্তসাখের অধীনে রয়ে গেছে। শুধু তা-ই নয়, নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশ এবং আর্মেনিয়া ও আর্তসাখের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী লাচিন করিডোরে ‘শান্তিরক্ষী’ হিসেবে রুশ সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে। অনুরূপভাবে, চুক্তি অনুযায়ী আজারবাইজানের মূল ভূখণ্ড ও নাখচিভানের মধ্যে প্রস্তাবিত জাঙ্গেজুর করিডোরও রুশ সৈন্যরা নিয়ন্ত্রণ করবে।

যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী, নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশ ও লাচিন করিডোরে ১,৯৬০ জন রুশ সৈন্য মোতায়েনের অনুমতি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউরেশিয়ান প্রেস ফাউন্ডেশনে’র প্রেসিডেন্ট কারাবাখলি উমুদ মির্জায়েভের ভাষ্যমতে, কার্যত রুশরা সুকৌশলে অঞ্চলটিতে এর চেয়ে বেশি সৈন্য মোতায়েন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, নাগর্নো–কারাবাখে স্থাপিত রুশ ‘আন্তঃবিভাগীয় মানবিক সহায়তা কেন্দ্র’টি পরিচালনা করে রুশ জরুরি পরিস্থিতি মন্ত্রণালয়, যেটি রুশ আইন অনুযায়ী কার্যত একটি সামরিক সংস্থা। এর মধ্য দিয়ে রুশরা নাগর্নো–কারাবাখে একটি বিস্তৃত সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলছে। ইতিপূর্বে অঞ্চলটিতে রুশ শান্তিরক্ষী মোতায়েনের প্রস্তাব আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান উভয়েই প্রত্যাখ্যান করেছিল। কিন্তু এই যুদ্ধের ফলে রাশিয়া এতদঞ্চলে নিজস্ব প্রভাব বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে। তুর্কি ‘হাবের৭’ ওয়েবসাইটের কলাম লেখক তাহা দালির ভাষ্যমতে, রুশরা একটাও গুলি না ছুড়ে কারাবাখ যুদ্ধে জিতে গেছে!

স্বাভাবিকভাবেই তুরস্ক যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেনি। যুদ্ধবিরতি চুক্তির সময় আজারবাইজানি রাষ্ট্রপতি আলিয়েভ প্রচারমাধ্যমের কাছে মন্তব্য করেছিলেন যে, নাগর্নো–কারাবাখে রুশ সৈন্যের পাশাপাশি তুর্কি সৈন্যও মোতায়েন করা হবে। কিন্তু পরবর্তীতে এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আজারবাইজানি জনসাধারণ যাতে নাগর্নো–কারাবাখে রুশ সৈন্য মোতায়েনের সিদ্ধান্তে ক্ষিপ্ত না হয়ে ওঠে, সেটি নিশ্চিত করার জন্যই কেবল আলিয়েভ এই মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অবশ্য রুশরা তুরস্কের সম্ভাব্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করার জন্য তুরস্কের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করে এবং সেই মোতাবেক আজারবাইজানের আগদাম অঞ্চলে যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি রুশ–তুর্কি ‘যৌথ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপিত হয়। সেখানে ৬০ জন রুশ ও ৬০ জন তুর্কি সৈন্য রয়েছে, যাদের দায়িত্ব সেখান থেকে ড্রোনের সাহায্যে নাগর্নো–কারাবাখের যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করা।

আর্তসাখের স্তেপানাকের্তে অনুষ্ঠিত আর্তসাখের রাষ্ট্রপতি আরায়িক হারুতিউনিয়ানের সঙ্গে আর্তসাখে মোতায়েনকৃত রুশ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কমান্ডার রুস্তম মুরাদভের বৈঠক; Source: CIVILNET via Twitter

কিন্তু তুর্কিরা যুদ্ধপরবর্তী আজারবাইজানে যে ধরনের প্রভাব আশা করছিল, তার তুলনায় এটি ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। এই ‘যৌথ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ স্থাপনও ছিল কার্যত রুশদের কূটনৈতিক বিজয়, কারণ এর মধ্য দিয়ে আজারবাইজানের নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড ও আজারবাইজানি সরকার–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড উভয় অংশেই রুশ সামরিক উপস্থিতি স্থাপিত হয়। অন্যদিকে, তুর্কি সামরিক উপস্থিতি নাগর্নো–কারাবাখের আর্মেনীয়–নিয়ন্ত্রিত অংশের বাইরে বাইরে কেবল আজারবাইজানি সরকার–নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ থাকে। এজন্য আজারবাইজানে প্রভাব বৃদ্ধির জন্য তুরস্ক ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

২০২০ সালের ডিসেম্বরে আজারবাইজানে বিজয় প্যারেড আয়োজিত হয় এবং তুর্কি সৈন্যরা এই প্যারেডে অংশ নেয়। এরদোয়ান একমাত্র বিদেশি রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে এই প্যারেড অনুষ্ঠানে যোগ দেন। পরবর্তী মাসগুলোতে তুরস্ক ও আজারবাইজানের মধ্যে বেশ কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং উভয় পক্ষের সামরিক–অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়। ২০২০ সালের প্রথম চার মাসের তুলনায় ২০২১ সালের প্রথম চার মাসে আজারবাইজান কর্তৃক তুর্কি সামরিক সরঞ্জাম আমদানির মাত্রা ৮৫০.৪% বৃদ্ধি পেয়েছে! একই সময়ে তুরস্ক ও আজারবাইজানের সশস্ত্রবাহিনী বেশ কয়েকটি যৌথ সামরিক মহড়ায় অংশগ্রহণ করেছে। শুধু তাই নয়, আজারবাইজানের পুনরুদ্ধারকৃত যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলোর পুনর্গঠনে তুর্কি কোম্পানিগুলো সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে।

এর মধ্যে নতুন করে আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনার খবর প্রচারিত হতে থাকে। ‘ফ্লাইটরাডার-২৪’ এর প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের ডিসেম্বরের শেষদিকে তুর্কি বিমানবাহিনী গাবালা, গাঞ্জা ও লাঙ্কারান বরাবর একটি ‘আকাশ সেতু’ (aerial bridge) স্থাপন করেছে এবং এক্ষেত্রে তারা আর্মেনিয়ার আকাশসীমাকে এড়িয়ে গেছে। এসময় প্রতিদিনই তুর্কি বিমানে করে বিপুল সংখ্যক সামরিক সরঞ্জাম আজারবাইজানের বিভিন্ন বিমানঘাঁটিতে নিয়ে আসা হচ্ছিল। ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি ‘হাক্কিন.আজ’ নামক একটি আজারবাইজানি ওয়েবসাইটে এই মর্মে খবর প্রচারিত হয় যে, আজারবাইজানের গাবালা, গাঞ্জা ও লাঙ্কারানে তিনটি তুর্কি বিমানঘাঁটি স্থাপিত হতে যাচ্ছে। অবশ্য পরবর্তীতে খবরটি অপসারণ করে ফেলা হয়। কিন্তু তার আগেই খবরটি প্রচারমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি করে। এই পরিস্থিতিতে আজারবাইজানি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই মর্মে বিবৃতি প্রদান করে যে, আজারবাইজানে কোনো বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হতে যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে তারা আজারবাইজানে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের পথে অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করে।

আজারবাইজানের আগদামে রুশ–তুর্কি যৌথ যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের উদ্বোধন অনুষ্ঠান; Source: Wikimedia Commons

প্রথমত, আজারবাইজানি সংবিধান এবং ২০১০ সালে গৃহীত আজারবাইজানি সামরিক ডকট্রিন অনুযায়ী, আজারবাইজানের ভূখণ্ডে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন নিষিদ্ধ। অবশ্য এক্ষেত্রে কোনো ধরনের সামরিক উপস্থিতিকে ‘ঘাঁটি’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে বা করা হবে না, সেটি নির্ধারণ করে দেয়া হয়নি। এজন্য আজারবাইজানি সরকার তাত্ত্বিকভাবে কোনো বিদেশি রাষ্ট্রকে আজারবাইজানি ভূখণ্ডে সামরিক উপস্থিতি স্থাপনের সুযোগ প্রদান করতে পারে এবং সেটিকে ‘ঘাঁটি’ হিসেবে চিহ্নিত করা থেকে বিরত থাকতে পারে। উল্লেখ্য, আজারবাইজানি সরকার ২০১৬ সালে তুরস্কের কাছে হস্তান্তরকৃত আজারবাইজানি সামরিক স্থাপনাগুলোকে এবং ২০২০ সালে আগদামে স্থাপিত রুশ–তুর্কি যৌথ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রকে ‘ঘাঁটি’ হিসেবে বিবেচনা করে না।

দ্বিতীয়ত, আজারবাইজান ‘জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে’র সদস্য এবং আলিয়েভ সংস্থাটির বর্তমান সভাপতির পদে অধিষ্ঠিত। এই পরিস্থিতিতে আজারবাইজানি ভূখণ্ডে ন্যাটো সদস্য তুরস্ককে ঘাঁটি স্থাপন করতে দেয়াকে জোট নিরপেক্ষতা নীতির পরিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। অবশ্য জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন বর্তমানে প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে এবং আজারবাইজান যদি নিজেদের ভূখণ্ডে তুর্কিদের ঘাঁটি স্থাপন করতে অনুমতি দেয়, সেক্ষেত্রে সংস্থাটির কার্যত কিছুই করার থাকবে না।

সর্বোপরি, আজারবাইজানি কর্মকর্তা যে কারণটি এখানে উল্লেখ করেন নি, সেটি হচ্ছে – তুরস্ক আজারবাইজানে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করলে রাশিয়া বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে এবং রুশ–আজারবাইজানি সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দেবে। এটি হচ্ছে আজারবাইজানে তুর্কি ঘাঁটি স্থাপনের পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক।

উল্লেখ্য, আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে এরদোয়ান মন্তব্য করেছেন, প্রক্রিয়াটি নির্ভর করবে আলিয়েভের সঙ্গে রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের আলোচনার ওপরে। অর্থাৎ, আজারবাইজানে তুর্কি সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের ব্যাপারে তুরস্ক রাশিয়ার মতামত যাচাই করে নিতে চায়। বস্তুত বর্তমানে রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের বিস্তৃত অর্থনৈতিক–প্রযুক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে, যেটির উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘তুর্কস্ট্রিম’ প্রকল্প, আক্কুয়ু পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ‘এস–৪০০ ত্রিউম্ফ’ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, তুর্কি পর্যটনশিল্পে রুশ পর্যটকদের ভূমিকা এবং সিরিয়া ও লিবিয়ায় সামরিক–রাজনৈতিক কার্যক্রমের আংশিক সমন্বয়। সরাসরি রাশিয়াকে ক্ষিপ্ত করে তুরস্ক এই বিস্তৃত সম্পর্ককে ধ্বংস করতে ইচ্ছুক নয় এবং এজন্য আজারবাইজানে ঘাঁটি স্থাপনের বিপুল আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে সতর্কতা অবলম্বন করতে হচ্ছে।

Related Articles