ইউক্রেনের ঘটনাবলি সংক্রান্ত ভ্লাদিমির পুতিনের ভাষণ || পর্ব–৪

২০২২ সালের জানুয়ারি–ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনীয় সীমান্তে রুশ সৈন্য সমাবেশ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্কের সীমান্তে ইউক্রেনীয় সৈন্য সমাবেশকে কেন্দ্র করে একদিকে রাশিয়া, দনেৎস্ক ও লুগানস্ক এবং অন্যদিকে ইউক্রেন ও ন্যাটোর মধ্যে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন দনেৎস্ক ও লুগানস্কের বিরুদ্ধে একটি আক্রমণাভিযান শুরু করে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় উভয় পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান উত্তেজনার মাত্রা তীব্রতর হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া দনেৎস্ক ও লুগানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান এবং রাষ্ট্রদ্বয়ের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক সহযোগিতা চুক্তি’ সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেয়। রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন রুশ জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত একটি ভাষণে এই ঘোষণা প্রদান করেন এবং ইউক্রেনে চলমান ঘটনাবলি সম্পর্কে সবিস্তারে নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করেন।

উক্ত ভাষণে ইউক্রেনীয় সঙ্কট, রুশ–ইউক্রেনীয় সম্পর্ক এবং ইউক্রেনীয় সঙ্কটে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা সম্পর্কে পুতিনের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্ফুটিত হয়েছে। ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ এবং রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে চলমান নতুন স্নায়ুযুদ্ধকে পূর্ণাঙ্গরূপে অনুধাবন করার জন্য পুতিনের এই ভাষণটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। এই নিবন্ধে উক্ত ভাষণের অনুবাদ করা হয়েছে এবং ভাষণটির বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও মতামত প্রদান করা হয়েছে। নিচের ইটালিক অক্ষরে প্রদত্ত অংশগুলো পুতিনের প্রদত্ত ভাষণের অংশ এবং তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে আবদ্ধ বিবরণগুলো উক্ত ভাষণ সম্পর্কিত ব্যাখ্যা/মতামত।

ভাষণ

[৩য় পর্বের পর]

(ইউক্রেনে) রুশ ভাষা ও সংস্কৃতিকে নির্মূল করা এবং আত্মীকরণকে ছড়িয়ে দেয়ার নীতি অনুসৃত হচ্ছে। ভের্খোভনা রাদা নিয়মিতভাবে একগুচ্ছ বৈষম্যমূলক আইন প্রণয়ন করছে এবং তথাকথিত আদিবাসী জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত আইন ইতোমধ্যে কার্যকর করা হয়েছে। যেসব মানুষ নিজেদেরকে রুশ হিসেবে আখ্যা দেয় এবং তাদের পরিচিতি, ভাষা ও সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে চায়, তাদেরকে এই মর্মে ইঙ্গিত দেয়া হচ্ছে যে, ইউক্রেন তাদেরকে চায় না।

শিক্ষা সংক্রান্ত এবং রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ইউক্রেনীয় ভাষা সংক্রান্ত আইনগুলো অনুসারে, স্কুলে বা জনসমক্ষে, এমনকি সাধারণ দোকানগুলোতেও রুশ ভাষার কোনো স্থান নেই। কর্মকর্তাদের তথাকথিত যাচাই–বাছাই সংক্রান্ত আইন এবং তাদের ছাঁটাইয়ের মধ্য দিয়ে অবাঞ্ছিত সরকারি কর্মকর্তাদের মোকাবিলা করার পথ তৈরি করা হয়েছে।

২০১৯ সালের এপ্রিলে তদানীন্তন ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি পেত্রো পোরোশেঙ্কো কর্তৃক বিতর্কিত ও বৈষম্যমূলক ‘রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ইউক্রেনীয় ভাষার কার্যক্রমকে সমর্থন’ বিষয়ক আইনে স্বাক্ষর করার দৃশ্য; Source: The Presidential Administration of Ukraine via Wikimedia Commons

[২০১৪ সালের ইউরোমাইদান বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পর নতুন ইউক্রেনীয় সরকার একটি উগ্র জাতীয়তাবাদী ও তীব্র রুশবিরোধী অভ্যন্তরীণ নীতি অনুসরণ করতে শুরু করে। ইউক্রেনে রুশঘেঁষা ও রুশবিরোধী নির্বিশেষে জনসাধারণের সিংহভাগ রুশ ভাষায় কথা বলে এবং ইউক্রেনীয় জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের (বিশেষত পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের জনসাধারণের সিংহভাগ) ওপর রুশ সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। ইউরোমাইদান–পরবর্তী ইউক্রেনীয় সরকার ইউক্রেনের প্রধান ভাষা হিসেবে রুশ ভাষাকে ইউক্রেনীয় ভাষার দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং ইউক্রেনে বসবাসরত জাতিগত রুশদের ও রুশঘেঁষা জাতিগত ইউক্রেনীয়দের জোরপূর্বক ‘ইউক্রেনীয়করণে’র (Ukrainization) নীতি গ্রহণ করে।

২০১৪ সালের অক্টোবরে ইউক্রেনীয় সরকার একটি আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনীয় সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান শুরু করে। এর উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের সঙ্গে সম্পৃক্ত (এবং সম্ভাব্য রুশপন্থী) সকল সরকারি কর্মকর্তাকে প্রশাসন থেকে অপসারণ করা এবং ইউক্রেনীয় রাজনীতিতে তদানীন্তন ইউক্রেনীয় সরকারের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ ইউক্রেনীয় সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীকে পদচ্যুত করা হয়।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনীয় সরকার শিক্ষা সংক্রান্ত একটি আইন অনুমোদন করে। উক্ত আইন অনুসারে, ইউক্রেনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় মাধ্যমিক স্তর থেকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে পুরোপুরিভাবে ইউক্রেনীয় ভাষা ব্যবহার করতে হবে এবং জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর শিক্ষার্থীরা কেবল একটি ‘বিশেষ পাঠ’ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেদের ভাষা শিখতে পারবে। এই আইন প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেনের সর্বস্তর থেকে রুশ ভাষাকে অপসারণ করা এবং পরবর্তী ইউক্রেনীয় প্রজন্ম যেন রুশভাষী হয়ে না ওঠে, সেটি নিশ্চিত করা। রাশিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া ও মলদোভা ইউক্রেনীয় সরকারের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানায়, কারণ এই আইনের ফলে ইউক্রেনে বসবাসরত রুশ, হাঙ্গেরীয় ও রুমানীয় সংখ্যালঘুদের ভাষাগত অধিকার গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

২০১৯ সালের এপ্রিলে ইউক্রেনীয় সরকার রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ইউক্রেনীয় ভাষার কার্যক্রমকে সমর্থনের বিষয়ে একটি আইন অনুমোদন করে। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনীয় ভাষা ইউক্রেনের একমাত্র রাষ্ট্রভাষায় পরিণত হয় এবং জনসমক্ষে সর্বস্তরে ইউক্রেনীয় ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। ইতিপূর্বে ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি প্রদেশে রুশ ভাষা আঞ্চলিক সরকারি ভাষা ছিল। কিন্তু ইউক্রেনীয় সরকার সেটিকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দেয় এবং রুশ ভাষার সরকারি মর্যাদা বিলুপ্ত করে। এই আইনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইউক্রেন থেকে রুশ ভাষার অপসারণের মাধ্যমে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার সাংস্কৃতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং ইউক্রেনকে রুশ বিশ্ব থেকে চিরতরে পৃথক করে ফেলা।

২০২১ সালে ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবা মন্তব্য করেন যে, জাতিগত রুশরা ইউক্রেনের ‘আদিবাসী’ নয়; Source: Dmytro Kuleba/Facebook via The Kyiv Independent

২০২১ সালের জুলাইয়ে ইউক্রেনীয় সরকার আদিবাসী জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত একটি আইন অনুমোদন করে। উক্ত আইন অনুযায়ী, ক্রিমিয়ান তাতার, কারাইম ও ক্রিমচাকদেরকে ইউক্রেনের ‘আদিবাসী জনগোষ্ঠী’ (indigenous people) হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। কিন্তু ইউক্রেনে বসবাসরত রুশদেরকে (যারা ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি) ইউক্রেনের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। ইউক্রেনীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্রো কুলেবার ভাষ্য অনুসারে, রুশদের একটি নিজস্ব রাষ্ট্র (রাশিয়া) রয়েছে, সুতরাং রুশদেরকে ইউক্রেনের ‘আদিবাসী’ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না। বাস্তবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, ইউক্রেনীয় সরকারের এই যুক্তি ভিত্তিহীন, কারণ রুশরা শত শত বছর আগে থেকে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে বসবাস করে আসছে।

বস্তুত এই আইনটির মূল উদ্দেশ্য ইউক্রেনের জাতিগত সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা প্রদান করা নয়, বরং এর মূল উদ্দেশ্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেয়া এবং ইউক্রেনে বসবাসরত জাতিগত রুশদের পরোক্ষভাবে ‘ভিনদেশি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক নাগরিকে রূপান্তরিত করা। ক্রিমিয়ান তাতার, কারাইম ও ক্রিমচাকদের মূল জনগোষ্ঠী ক্রিমিয়া উপদ্বীপে বসবাস করে, এবং ২০১৪ সাল থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। যতদিন ক্রিমিয়া ইউক্রেনের অধীনে ছিল, ততদিন ইউক্রেনীয় সরকার ক্রিমিয়ান তাতার, কারাইম বা ক্রিমচাকদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উদাহরণস্বরূপ, ক্রিমিয়ান তাতাররা ক্রিমিয়া উপদ্বীপের তৃতীয় বৃহত্তম জাতি হওয়া সত্ত্বেও সেখানে ক্রিমিয়ান তাতার ভাষার আনুষ্ঠানিক কোনো মর্যাদা ছিল না।

কিন্তু ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার অধীনে চলে যাওয়ার পর ইউক্রেনীয় সরকার ক্রিমিয়ার জাতিগত সংখ্যালঘুদের প্রতি এবং বিশেষ করে ক্রিমিয়ান তাতারদের প্রতি বিশেষ সহানুভূতি প্রদর্শন করতে শুরু করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ক্রিমিয়ায় বসবাসরত ক্রিমিয়ান তাতারদের সমর্থন আদায় করে তাদেরকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা এবং ক্রিমিয়া ইস্যুতে তুরস্কের সুদৃঢ় সমর্থন আদায় করা (যেহেতু তুর্কি ও ক্রিমিয়ান তাতারদের মধ্যকার ঐতিহাসিক, জাতিগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঘনিষ্ঠতার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রিমিয়ান তাতারদের বিষয়ে তুরস্কের ‘বিশেষ অধিকার’ রয়েছে বলে তুর্কিরা বিবেচনা করে)। একইসঙ্গে এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ইউক্রেনীয় রুশদের প্রতি এই বার্তা পৌঁছানো হয়েছে যে, তারা ইউক্রেনের আদি বা প্রকৃত অধিবাসী নয়, বরং একটি বিজাতীয় জনগোষ্ঠী। সাধারণত কোনো রাষ্ট্র যখন কোনো জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নিষ্পেষণের প্রস্তুতি নেয়, তখন উক্ত জাতির বিরুদ্ধে এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, মিয়ানমারের (তদানীন্তন বার্মার) সামরিক সরকার রোহিঙ্গা জাতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে নিষ্পেষণ শুরুর আগে দেশটির আদিবাসী জনগোষ্ঠীর তালিকা থেকে রোহিঙ্গাদেরকে অপসারণ করেছিল।

সামগ্রিকভাবে, এসব আইন প্রণয়নের মধ্য দিয়ে ইউক্রেনীয় সরকার ইউক্রেন থেকে রুশ প্রভাব সম্পূর্ণভাবে অপসারণ করতে চাচ্ছে। বস্তুত রুশবিরোধিতা ইউরোমাইদান–পরবর্তী ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রের ‘অস্তিত্বের যৌক্তিকতা’য় (raison d’être) পরিণত হয়েছে। ইউক্রেন সম্পর্কে বর্তমান ইউক্রেনীয় সরকারের চূড়ান্ত লক্ষ্য হচ্ছে: ইউক্রেন থেকে রুশ প্রভাব নির্মূল করার মধ্য দিয়ে ইউক্রেনকে রুশ বিশ্ব বা রুশ প্রভাব বলয় থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করা এবং এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেনের একটি স্বতন্ত্র ও দৃঢ় রাষ্ট্রসত্তা গড়ে তোলা। ইউক্রেনীয় সরকার ও জাতীয়তাবাদীরা উক্ত রুশ প্রভাবমুক্ত ইউক্রেনকে ইউরো–আটলান্টিক বিশ্বের অন্তর্ভুক্ত করতে ইচ্ছুক।

২০২১ সালে ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা পরিষদের সচিব ওলেক্সি দানিলভ মন্তব্য করেন যে, রুশ ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে ইউক্রেনের ‘দ্বিতীয় ভাষা’ হিসেবে গ্রহণ করা উচিত এবং ইংরেজি ভাষা অধ্যয়ন ইউক্রেনের ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ বৃদ্ধি করবে; Source: Oleg Petrasiuk/Kyiv Post

যেহেতু ইউক্রেনের জনসাধারণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ জাতিগত রুশ ও রুশঘেঁষা জাতিগত ইউক্রেনীয়দের সমন্বয়ে গঠিত, সেহেতু ইউক্রেনীয় সরকারের কাছে দুটি পথ খোলা রয়েছে: হয় উক্ত জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সত্তা বিলুপ্ত করে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে জাতিগত ইউক্রেনীয়তে রূপান্তরিত করা, নয়তো তাদেরকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। ইউক্রেনীয় সরকার একসঙ্গে উভয় পথই বেছে নিয়েছে। তারা দনবাসের রুশঘেঁষা জনসাধারণকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে এবং ইউক্রেনের বাকি অংশে জনসাধারণের রুশঘেঁষা অংশকে জোরপূর্বক আত্মীকরণের (forced assimilation) প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রুশ বিশ্ব থেকে ইউক্রেনের চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পশ্চিমা বিশ্বের জন্য লাভজনক, সুতরাং ইউক্রেনীয় সরকার কর্তৃক প্রণীত বৈষম্যমূলক আইনগুলো স্পষ্টভাবে পশ্চিমাদের ঘোষিত উদার গণতান্ত্রিক নীতির পরিপন্থী হলেও পশ্চিমা বিশ্ব নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থে ইউক্রেনীয় সরকারের এসব কার্যক্রমকে মৌন সমর্থন দিয়েছে]

বাক স্বাধীনতা, ভিন্নমত দমন এবং বিরোধী দলগুলোর পিছে লেগে থাকার উদ্দেশ্যে ইউক্রেনীয় সামরিক বাহিনী ও আইন–শৃঙ্খলা রক্ষী সংস্থাগুলোকে ক্ষমতায়নের জন্য নতুন নতুন আইন তৈরি করা হচ্ছে। অন্য রাষ্ট্র, বিদেশি ব্যক্তি ও বৈধ সংস্থার বিরুদ্ধে একতরফা বেআইনি নিষেধাজ্ঞা আরোপের নিন্দনীয় প্রথার সঙ্গে বিশ্ব পরিচিত। ইউক্রেন তাদের নিজেদের নাগরিক, কোম্পানি, টেলিভিশন চ্যানেল, অন্যান্য প্রচারমাধ্যম এবং এমনকি আইনসভা সদস্যদের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এক্ষেত্রে তাদের পশ্চিমা প্রভুদেরকেও ছাড়িয়ে গেছে।

কিয়েভ মস্কো প্যাট্রিয়ার্কেটভুক্ত ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চকে ধ্বংস করার প্রস্তুতি নেয়া অব্যাহত রেখেছে। এটি কোনো আবেগপ্রবণ রায় নয়; বাস্তব সিদ্ধান্ত ও নথিপত্রে এটির প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাবে। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ বিভেদের বিয়োগান্তক ঘটনাটিকে নিষ্ঠুরভাবে রাষ্ট্রীয় নীতির হাতিয়ারে পরিণত করেছে। বিশ্বাসীদের অধিকার লঙ্ঘন করে, এমন আইনগুলো রদ করার জন্য ইউক্রেনীয় জনগণের আহ্বানের প্রতি বর্তমান কর্তৃপক্ষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। তদুপরি, ভের্খোভনা রাদায় মস্কো প্যাট্রিয়ার্কেটভুক্ত ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও লক্ষ লক্ষ ধর্মানুরাগীর বিরুদ্ধে নতুন নতুন খসড়া আইন প্রস্তাবিত হচ্ছে।

[২০১৪ সালের ইউরোমাইদান বিপ্লব/অভ্যুত্থানের সময় ইউরোমাইদানের সমর্থকদের বক্তব্য ছিল যে, ইউক্রেনে প্রকৃত গণতন্ত্র নেই এবং তারা ইউক্রেনকে একটি প্রকৃত উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। কিন্তু বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। বস্তুত, ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর ইউক্রেনে কখনোই পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি এবং ইউক্রেনের গণতন্ত্র নিয়ে নানান সমালোচনা ছিল। কিন্তু ইউরোমাইদানের ফলে ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভিক্তর ইয়ানুকোভিচ ক্ষমতাচ্যুত হন, যিনি ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। সুতরাং, আইনগত দিক থেকে দেখলে, ইয়ানুকোভিচের ক্ষমতাচ্যুতি ছিল অসাংবিধানিক এবং অগণতান্ত্রিক। তদুপরি, ইউরোমাইদান–পরবর্তী ইউক্রেনীয় সরকারগুলো একের পর এক এমন সব পদক্ষেপ নিয়েছে, যেগুলো ইউক্রেনকে একটি উদার গণতন্ত্রে (liberal democracy রূপান্তরিত করার পরিবর্তে দেশটিকে ক্রমশ একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে (authoritarian state) পরিণত করেছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনীয় সরকার যে তিনটি বিরোধী দলীয় টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে দেয়, সেগুলোর লোগোর চিত্র; Source: Deutsche Welle

যেমন: ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনীয় সরকার ইউক্রেনীয় সাংবাদিক ও ব্লগার রুসলান কোৎসাবাকে গ্রেপ্তার করে ও রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করে, কারণ কোৎসাবা ইউক্রেনীয় সরকার কর্তৃক প্রণীত কনস্ক্রিপশন (যুবকদের বাধ্যতামূলকভাবে সশস্ত্রবাহিনীতে যোগদানের নিয়ম) প্রবর্তনের বিরোধিতা করেছিলেন। ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ইউক্রেনীয় সরকার এমন সব বই, ম্যাগাজিন ও চলচ্চিত্র নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয় যেগুলো ‘ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি হুমকিস্বরূপ’ (অর্থাৎ, যেগুলোর ভাষ্য দনবাস ও ক্রিমিয়ার বিষয়ে ইউক্রেনীয় সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে যাবে)। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনীয় সরকার তিনটি বিরোধী দলীয় টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়। ২০২১ সালের মে মাসে ইউক্রেনীয় সরকার দেশটির বৃহত্তম বিরোধী দল ‘অপোজিসিনা প্লাৎফর্মা – জা ঝিত্তিয়া’র (ইউক্রেনীয়: Опозиційна платформа – За життя) শীর্ষ নেতা ভিক্তর মেদভেদচুককে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত করে এবং গৃহবন্দি করে রাখে। এগুলোর কোনোটিই উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ভাষণের এই অংশে পুতিন পশ্চিমা বিশ্ব কর্তৃক রাশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটি তুলে এনেছেন এবং সেগুলোকে ‘বেআইনি’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি ইউক্রেনীয় সরকার কর্তৃক নিজস্ব নাগরিকদের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটি উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য, ভলোদিমির জেলেনস্কির শাসনাধীনে ইউক্রেনীয় সরকার বহুসংখ্যক ইউক্রেনীয় ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’, ‘রাশিয়ার সঙ্গে সহযোগিতা’ প্রভৃতি দায়ে অভিযুক্ত করে তাদের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এটি উল্লেখ করে পুতিন তীর্যক মন্তব্য করেছেন যে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ক্ষেত্রে ইউক্রেন তাদের ‘পশ্চিমা প্রভু’দেরকেও ছাড়িয়ে গেছে। পুতিনের এই বক্তব্য থেকে এটি স্পষ্ট যে, ইউরোমাইদান–পরবর্তী ইউক্রেনকে তিনি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং একটি পশ্চিমা আশ্রিত রাষ্ট্র (Western protectorate) হিসেবে বিবেচনা করছেন।

একইসঙ্গে পুতিন রুশ ও ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের মধ্যেকার বিভাজনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন। রুশ ও ইউক্রেনীয়রা প্রধানত অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্মের অনুসারী। বহু শতাব্দী যাবৎ ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চ রুশ অর্থোডক্স চার্চের অধীনে ছিল এবং এর ফলে রুশ ও ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের মধ্যে একটি অত্যন্ত সুদৃঢ় আধ্যাত্মিক বন্ধন ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে ইউক্রেনীয় সরকারের প্রত্যক্ষ সমর্থনে ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চ রুশ অর্থোডক্স চার্চ থেকে পৃথক হয়ে যায়। বস্তুত এটি ছিল ইউক্রেন থেকে রুশ প্রভাব অপসারণ করার জন্য ইউক্রেনীয় সরকারের আরেকটি পদক্ষেপ। স্বাভাবিকভাবেই, রুশ অর্থোডক্স চার্চ (এবং ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের একাংশ) এই পদক্ষেপকে খুবই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছে। পুতিনের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু রাশিয়ার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে পুতিন রুশ অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের ওপর রুশ নিয়ন্ত্রণ ইউক্রেনের ওপর রুশ প্রভাব বজায় রাখার একটি মাধ্যম ছিল, সুতরাং ইউক্রেনীয় অর্থোডক্স চার্চের রুশ অর্থোডক্স চার্চ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াকে পুতিন যে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন, সেটি বলাই বাহুল্য]

ক্রিমিয়া সম্পর্কে অল্প কিছু কথা। উপদ্বীপটির জনসাধারণ মুক্তভাবে রাশিয়ার সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিয়েভ কর্তৃপক্ষ জনগণের স্পষ্টভাবে ব্যক্ত সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে না, সেজন্যই তারা আক্রমণাত্মক কার্যক্রম পরিচালনা, উগ্রপন্থী ইসলামি সংগঠনগুলোসহ চরমপন্থী সংস্থাগুলোকে সক্রিয়করণ, অতি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোয় সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ পরিচালনার জন্য অন্তর্ঘাতক প্রেরণ এবং রুশ নাগরিকদের অপহরণের পথ বেছে নিয়েছে। আমাদের কাছে এই বিষয়ে বাস্তবিক প্রমাণ রয়েছে যে, এসব আগ্রাসী কার্যক্রম পশ্চিমা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর সহায়তায় পরিচালিত হচ্ছে।

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ইউক্রেনীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘এইচইউআর’–এর তত্ত্বাবধানে রাশিয়ায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ক্রিমিয়ান তাতার উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘কিরিমতাতার মিল্লি মজলিসি’র কতিপয় সদস্য রাশিয়ার ক্রিমিয়ায় একটি গ্যাস পাইপলাইন উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু রুশ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফএসবি’ তাদেরকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃতদের মুক্তির দাবিতে কিছু সংখ্যক ইউক্রেনীয় নাগরিক ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে অবস্থিত রুশ দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে; Source: Radio Free Europe/Radio Liberty

[২০১৪ সালে ইউক্রেনে ইউরোমাইদান বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পর রাশিয়া ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় এবং ক্রিমিয়ার অধিবাসীরা একটি গণভোটে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পক্ষে ভোট প্রদান করে। ফলশ্রুতিতে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ ‘ক্রিমিয়া প্রজাতন্ত্র’ ও ‘সেভাস্তোপোল কেন্দ্রশাসিত শহর’ এই দুইটি অংশে বিভক্ত হয়ে রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়। ইউক্রেন ক্রিমিয়ার রাশিয়ায় অন্তর্ভুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেছে এবং ইউক্রেনসহ বিশ্বের সিংহভাগ রাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে, ক্রিমিয়া এখনো ইউক্রেনীয় ভূখণ্ড। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে রাশিয়ার ক্রিমিয়া অধিকারের বৈধতা নেই, কিন্তু ক্রিমিয়ার সিংহভাগ অধিবাসী জাতিগত রুশ এবং তারা রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত থাকার পক্ষপাতী।

এমতাবস্থায় ইউক্রেন ক্রিমিয়ার ওপর রুশ নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে অঞ্চলটিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি অঘোষিত ‘অপ্রতিসম যুদ্ধ’ (asymmetrical warfare) পরিচালনা করেছে। ইউক্রেনের (বর্তমানে রুশ–নিয়ন্ত্রিত) খেরসন প্রদেশে অবস্থিত ‘উত্তর ক্রিমিয়ান খাল’ ক্রিমিয়ার জনসাধারণের প্রয়োজনীয় পানির প্রায় ৮৫% সরবরাহ করত, কিন্তু ২০১৪ সালে ইউক্রেন উক্ত খালটি বন্ধ করে দেয় এবং এর ফলে ক্রিমিয়ায় তীব্র পানি সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। ক্রিমিয়ায় বসবাসরত ক্রিমিয়ান তাতারদের রুশবিরোধী কার্যক্রমে লিপ্ত হতে উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ইউক্রেনীয় সরকার ক্রিমিয়ান তাতার উগ্র জাতীয়তাবাদী সংগঠন ‘কিরিমতাতার মিল্লি মেজলিসি’কে (ক্রিমিয়ান তাতার: Къырымтатар Миллий Меджлиси) বিস্তৃত সমর্থন প্রদান করেছে, যে সংগঠনটি রাশিয়ায় নিষিদ্ধ এবং চরমপন্থী হিসেবে চিহ্নিত।

তদুপরি, ইউক্রেন সময়ে সময়ে ক্রিমিয়ায় অন্তর্ঘাতমূলক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য গুপ্তচর প্রেরণ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সালের নভেম্বরে রুশ অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থা ‘এফএসবি’ ক্রিমিয়ায় ইউক্রেনীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ‘এইচইউআর’–এর তিনজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে, যারা ক্রিমিয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও পানি বিশোধন কেন্দ্রগুলোয় নাশকতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে চেয়েছিল। একই সময়ে ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘এসবিইউ’ ক্রিমিয়ায় মোতায়েনকৃত দুইজন রুশ সৈন্যকে অপহরণ করে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এফএসবি কিরিমতাতার মিল্লি মেজলিসির পাঁচজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে, যারা এইচইউআরের সহায়তায় ক্রিমিয়ার একটি গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেছিল। এভাবে ইউক্রেন ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে অপ্রতিসম যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার জন্য ক্রিমিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখাকে কঠিন করে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছে]

২০২১ সালের মার্চে ইউক্রেনে একটি নতুন সমরকৌশল গৃহীত হয়েছে। এই নথিটি প্রায় সম্পূর্ণরূপে রাশিয়ার সঙ্গে সংঘর্ষের প্রতি নিবেদিত এবং আমাদের দেশের সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোকে সংঘাতে লিপ্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এই কৌশলপত্রে রাশিয়ার ক্রিমিয়ায় এবং দনবাসে এমন কিছু স্থাপনের কথা বলা হয়েছে যেটিকে একটি সন্ত্রাসবাদী গুপ্ত সংগঠন হিসেবে আখ্যা দেয়া যেতে পারে। এটিতে একটি সম্ভাব্য যুদ্ধের রূপরেখাও নির্ধারণ করা হয়েছে, কিয়েভের কৌশলবিদদের মতে যেটি “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে ইউক্রেনের জন্য অনুকূলভাবে” শেষ হবে এবং – মন দিয়ে শুনুন – “রুশ ফেডারেশনের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক সংঘাতে বিদেশি সামরিক সহায়তা” নিশ্চিত করবে। প্রকৃতপক্ষে এটি আমাদের দেশ রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

ইউক্রেনে অবস্থিত একটি সোভিয়েত–নির্মিত মিসাইল সাইলো, যেখানে ইতিপূর্বে সোভিয়েত পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েনকৃত ছিল; Source: Michael/Wikimedia Commons

[২০২১ সালের মার্চে ইউক্রেনীয় সরকার ইউক্রেনের জন্য একটি নতুন ‘সামরিক নিরাপত্তা কৌশল’ (military security strategy) প্রণয়ন করেছে। এটিতে রাশিয়াকে খোলাখুলিভাবে ইউক্রেনের ‘প্রধান সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। উক্ত সামরিক কৌশলপত্রে গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্কের বিরুদ্ধে এবং ক্রিমিয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘অপ্রতিসম যুদ্ধ’ পরিচালনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এর পাশাপাশি এটিতে রাশিয়ার সঙ্গে সংঘর্ষের ক্ষেত্রে রুশ ভূখণ্ডের ওপর আক্রমণ চালানোর প্রস্তাবনা উল্লেখ করা হয়েছে। তদুপরি, এই কৌশলপত্রে ক্রিমিয়া, গণপ্রজাতন্ত্রী দনেৎস্ক ও গণপ্রজাতন্ত্রী লুগানস্কের ভূখণ্ড পুনর্দখলকে ইউক্রেনের ‘প্রতিরক্ষা কৌশলে’র লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বোপরি, উক্ত কৌশলপত্রে ন্যাটোয় যোগদান এবং ইউরোপীয় ও ইউরো–আটলান্টিক সামরিক জোটগুলোয় ইউক্রেনকে অঙ্গীভূত করা এবং এর পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে সম্ভাব্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে উক্ত রাষ্ট্রগুলোকে সম্পৃক্ত করাকে দেশটির লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে]

যেমনটা আমরা জানি, আজকে ইতোমধ্যেই বলা হয়েছে যে ইউক্রেন তাদের নিজস্ব পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চায় এবং এটি কেবল বাগাড়ম্বর নয়। ইউক্রেনের কাছে সোভিয়েত আমলে সৃষ্ট পারমাণবিক প্রযুক্তি আছে এবং বিমান ও ১০০ কিলোমিটারের বেশি পাল্লাবিশিষ্ট সোভিয়েত–নির্মিত তোচকা–উ প্রেসিশন ট্যাকটিক্যাল ক্ষেপণাস্ত্রসহ এই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের ডেলিভারি ভেহিকলও আছে। কিন্তু তারা আরো কিছু করতে পারে; এটি কেবল সময়ের ব্যাপার। সোভিয়েত আমল থেকেই তাদের এরকম ভিত্তি রয়েছে।

অন্যভাবে বললে, অন্য বেশ কিছু রাষ্ট্রের, যাদেরকে আমি এখানে উল্লেখ করছি না, যারা এরকম গবেষণা চালাচ্ছে, তাদের তুলনায় ইউক্রেনের পক্ষে ট্যাকটিক্যাল পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ অনেক সহজ হবে, বিশেষত কিয়েভ যদি বিদেশি প্রযুক্তিগত সহায়তা লাভ করে। আমরা এই সম্ভাবনাটিও উড়িয়ে দিতে পারি না।

যদি ইউক্রেন গণবিধ্বংসী অস্ত্র পেয়ে যায়, বিশ্বের এবং ইউরোপের পরিস্থিতি, বিশেষ করে আমাদের জন্য, রাশিয়ার জন্য ব্যাপকভাবে পাল্টে যাবে। আমাদেরকে অবশ্যই এই বাস্তব বিপদের প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে, কারণ, আমি পুনরাবৃত্তি করতে চাই, ইউক্রেনের পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকরা আমাদের দেশের প্রতি আরেকটি হুমকি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এইসব অস্ত্র পেতে তাদেরকে সাহায্য করতে পারে। আমরা দেখতে পাচ্ছি কীভাবে কিয়েভ জান্তাকে নিয়মিতভাবে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাই এই উদ্দেশ্যে অস্ত্র ও সরঞ্জাম সরবরাহ এবং বিশেষজ্ঞদের প্রশিক্ষণ বাবদ শত শত কোটি ডলার ব্যয় করেছে। বিগত কয়েক মাসে গোটা বিশ্বের চোখের সামনে ইউক্রেনে নিয়মিতভাবে পশ্চিমা অস্ত্র প্রবাহিত হয়েছে। বিদেশি উপদেষ্টারা ইউক্রেনের সশস্ত্রবাহিনী ও বিশেষ সংস্থাগুলোর কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করছে এবং আমরা এই বিষয়ে সচেতন।

২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি জার্মানির মিউনিখে প্রদত্ত একটি ভাষণে ইঙ্গিত দেন যে, ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের উদ্যোগ নিতে পারে; Source: The Guardian

[সোভিয়েত ইউনিয়নের পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের প্রায় এক–তৃতীয়াংশ ইউক্রেনীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের ভূখণ্ডে মোতায়েনকৃত ছিল। এর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার ছিল ইউক্রেনে। অবশ্য ইউক্রেনের হাতে কেবল উক্ত পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডারের ‘প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ’ (administrative control) ছিল; উক্ত অস্ত্রভাণ্ডারের ‘কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ’ (operational control) ছিল রাশিয়ার হাতে। ইউক্রেনীয় সরকার উক্ত পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার নিজেদের হস্তগত করতে ইচ্ছুক ছিল, কিন্তু রাশিয়া বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই চাইছিল না যে, ইউক্রেন একটি পারমাণবিক অস্ত্রধারী রাষ্ট্রে পরিণত হোক। এজন্য তারা উক্ত পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করার জন্য ইউক্রেনের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে শুরু করে।

অবশেষে ১৯৯৪ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র ও ইউক্রেন হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তি অনুসারে, ইউক্রেন তার পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার রাশিয়ার কাছে হস্তান্তর করতে এবং ‘পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার নিরোধ চুক্তি’তে (Nuclear Non-proliferation Treaty) স্বাক্ষর করতে সম্মতি প্রদান করে। এর মধ্য দিয়ে ইউক্রেন একটি অপারমাণবিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়। কিন্তু ২০১৪ সালের ইউরোমাইদান বিপ্লব/অভ্যুত্থানের পর ইউক্রেনে যে তীব্র রুশবিরোধী নতুন সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়, তারা রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যেকার ক্ষমতার ভারসাম্যকে ইউক্রেনের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য পারমাণবিক অস্ত্র ও পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করতে আগ্রহী ছিল। সময়ে সময়ে ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা এরকম ইঙ্গিত প্রদান করছিলেন।

২০২২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি জেলেনস্কি জার্মানির মিউনিখে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সেখানে প্রদত্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন যে, যদি বুদাপেস্ট চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনের ভৌগোলিক অখণ্ডতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করে, সেক্ষেত্রে ইউক্রেন উক্ত চুক্তির শর্তাবলি পালন করতে দায়বদ্ধ থাকবে না। উক্ত চুক্তিতে ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি থেকে বিরত থাকতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিল। জেলেনস্কি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে, ইউক্রেন সেই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নিতে পারে।

রুশদের দৃষ্টিকোণ থেকে, জেলেনস্কির এই বক্তব্য ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করলে সেক্ষেত্রে রাশিয়ার সীমান্তে একটি অত্যন্ত ক্ষমতাধর ও বিপজ্জনক শত্রুরাষ্ট্র স্থাপিত হতো এবং সেটি রুশদের জন্য চিরস্থায়ী নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রূপ নিতো। স্বাভাবিকভাবেই ইউক্রেনের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের সম্ভাবনাকে রুশরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রপতি কর্তৃক সরাসরি এরকম ইঙ্গিত প্রদান ছিল চলমান রুশ–ইউক্রেনীয় যুদ্ধ শুরুর নানাবিধ কারণের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ]

ইউক্রেনের ওচাকভ বন্দরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘মেরিটাইম অপারেশন্স সেন্টার’ স্থাপন করেছিল এবং কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবাহিনীর জন্য এটি ছিল একটি গুরুতর হুমকি; Source: Sergei Gunenyuk/EFE/EPA via Politico

বিগত কয়েক বছরে ন্যাটোভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সামরিক দলগুলো প্রায় সবসময়ই মহড়ার অজুহাতে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে উপস্থিত থেকেছে। ইউক্রেনীয় সৈন্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ইতোমধ্যে ন্যাটোর সঙ্গে অঙ্গীভূত করে ফেলা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে, ন্যাটো সদর দপ্তর থেকে ইউক্রেনীয় সশস্ত্রবাহিনীকে, এমনকি তাদের পৃথক ইউনিট ও স্কোয়াডগুলোকেও সরাসরি নির্দেশ দেয়া সম্ভব।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডকে সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহারের একটি উদ্ধত কার্যক্রম শুরু করেছে। তাদের নিয়মিত যৌথ মহড়াগুলো স্পষ্টতই রুশবিরোধী। কেবল গত বছরেই ২৩,০০০–এর বেশি সৈন্য এবং এক হাজারের বেশি সংখ্যক সরঞ্জাম এগুলোয় অংশ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই এমন একটি আইন প্রণীত হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে বিদেশি সৈন্যরা বহুজাতিক মহড়ায় অংশ নেয়ার জন্য ইউক্রেনে আসতে পারবে। বোঝাই যায় যে, এরা হচ্ছে প্রধানত ন্যাটোর সৈন্য। এই বছর অন্তত দশটি এরকম যৌথ মহড়া করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

স্পষ্টতই ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে ন্যাটোর সামরিক বাহিনীর দ্রুত শক্তিবৃদ্ধিকে আড়াল করার জন্য এসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।   বোরিসপোল, ইভানো–ফ্রাঙ্কোভস্ক, চুগুয়েভ এবং ওদেসায় মার্কিন সহায়তায় সংস্কারকৃত বিমানঘাঁটিগুলোর নেটওয়ার্ক খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সেনা ইউনিট স্থানান্তর করতে সক্ষম। যেসব মার্কিন কৌশলগত ও গোয়েন্দা বিমান ও ড্রোন রুশ ভূখণ্ডের ওপর নজরদারি করে, সেগুলোর জন্য ইউক্রেনের আকাশ উন্মুক্ত।

আমি যোগ করতে চাই যে, ওচাকভে মার্কিন–নির্মিত মেরিটাইম অপারেশন্স সেন্টারের মাধ্যমে রুশ কৃষ্ণসাগরীয় নৌবহর ও পুরো কৃষ্ণসাগরীয় উপকূলে আমাদের অবকাঠামোর বিরুদ্ধে প্রেসিশন অস্ত্রের ব্যবহারসহ ন্যাটোর যুদ্ধজাহাজগুলোর কার্যক্রমকে সমর্থন করা সম্ভব। একসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রিমিয়াতেও একই ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করতে চেয়েছিল, কিন্তু ক্রিমিয়ানরা ও সেভাস্তোপোলের অধিবাসীরা সেই পরিকল্পনাগুলো গুঁড়িয়ে দিয়েছে। আমরা এটা সবসময় মনে রাখব।

আমি পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে, ওচাকভে এরকম একটি কেন্দ্র ইতোমধ্যেই স্থাপন করা হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আলেক্সান্দর সুভোরভের সৈন্যরা এই শহরের জন্য যুদ্ধ করেছিল। তাদের সাহসিকতার জন্য এটি রাশিয়ার অংশে পরিণত হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতেই কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী ভূখণ্ডগুলোকে, যেগুলো ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, নভোরোসিয়া নামকরণ করা হয়েছিল। এখন ইতিহাসের এই চিহ্নগুলোকে, সেইসঙ্গে রুশ সাম্রাজ্যের সেইসব রাষ্ট্রীয় ও সামরিক ব্যক্তিত্বের নামগুলোকে যাদের পরিশ্রম ছাড়া আধুনিক ইউক্রেনের এতগুলো বড় শহর থাকতো না বা এমনকি কৃষ্ণসাগরে প্রবেশাধিকারও থাকতো না, নিশ্চিহ্ন করে ফেলার চেষ্টা চলছে।

ইউক্রেনের ওদেসা প্রদেশের ইজমাইল শহরে অবস্থিত বিখ্যাত রুশ সমরনায়ক জেনারিলিসিমো আলেক্সান্দর সুভোরভের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ; Source: V1snyk/Wikimedia Commons

সম্প্রতি পলতাভায় আলেক্সান্দর সুভোরভের একটি স্মৃতিসৌধ ধ্বংস করা হয়েছে। কীই বা বলা যায়? তোমরা নিজেদের অতীতকে অস্বীকার করছো? রুশ সাম্রাজ্যের তথাকথিত ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যকে? ঠিক আছে, সেক্ষেত্রে সামঞ্জস্য বজায় রাখো।

এরপর, উল্লেখ্য যে, ইউক্রেনের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে তাদের ভূখণ্ডে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন বেআইনি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এটি কেবলই একটি আনুষ্ঠানিকতা যেটিকে সহজেই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। ইউক্রেনে ন্যাটোর প্রশিক্ষণ মিশন রয়েছে, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি। তারা কেবল ঘাঁটিকে মিশন বলে এবং এতেই কাজ হয়ে যায়।

[পুতিন তার ভাষণের এই অংশে ইউরোমাইদানের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইউক্রেনে বিস্তৃত সামরিক উপস্থিতি গড়ে তুলেছে তার একটি বিবরণ দিয়েছেন। ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি গড়ে তোলার পশ্চাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধানত তিনটি ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল: ইউক্রেনের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা, ইউক্রেনে সামরিক উপস্থিতি গড়ে তোলার মাধ্যমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে ভূকৌশলগত আধিপত্য অর্জন করা এবং কৃষ্ণসাগরে রাশিয়াকে কোণঠাসা করে রাখার মধ্য দিয়ে রাশিয়ার বিশ্বশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করা। রাশিয়া কেন মার্কিন–ইউক্রেনীয় সামরিক মৈত্রীকে গুরুতর হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে, পুতিনের ভাষণের এই অংশ থেকে সেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

ইউক্রেনীয় সংবিধান অনুসারে, ইউক্রেনের ভূখণ্ডে বিদেশি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন নিষিদ্ধ। সাংবিধানিক বিধিনিষেধ এড়ানোর উদ্দেশ্যে ইউক্রেনীয়রা ও তাদের পশ্চিমা মিত্র রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনে অবস্থিত পশ্চিমা সামরিক স্থাপনাগুলোকে ‘ঘাঁটি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে না, বরং ‘মিশন’, ‘অপারেশন্স সেন্টার’, ‘প্রশিক্ষণ কেন্দ্র’ প্রভৃতি নামে আখ্যায়িত করে। এই বিষয়টিকে তুলে ধরে পুতিন দেখিয়েছেন যে, ইউক্রেনীয় সরকার রুশবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশ্যে কার্যত পরোক্ষভাবে তাদের নিজেদের সাংবিধানিক আইন লঙ্ঘন করছে।

ভাষণের এই অংশে পুতিন ইউক্রেনীয়দের উদ্দেশ্যে একটি তীর্যক বক্তব্য রেখেছেন। ইউক্রেনের পলতাভা প্রদেশে ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা রুশ সময়নায়ক জেনারেলিসিমো আলেক্সান্দর সুভোরভের স্মৃতিসৌধ ধ্বংসের বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেছেন যে, ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা দাবি করে, এর মধ্য দিয়ে তারা রুশ ‘ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য’কে ধ্বংস করছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বর্তমান ইউক্রেনের ভূখণ্ডের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ জেনারেলিসিমো সুভোরভের নেতৃত্বেই অর্জিত হয়েছিল। ১৭৬৮–১৭৭৪ এবং ১৭৮৭–১৭৯২ সালের রুশ–ওসমানীয় যুদ্ধে রাশিয়া ওসমানীয় রাষ্ট্রকে পরাজিত করে এবং ওসমানীয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে কৃষ্ণসাগরের তীরবর্তী বেশ কিছু ভূখণ্ড অধিকার করে নেয়, যেগুলো বর্তমানে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত। এই বিজয়গুলোতে সুভোরভের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।

পুতিন ব্যঙ্গ করে বলেছেন যে, ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা যদি ‘রুশ ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য’ ধ্বংস করতে চায়, সেক্ষেত্রে তাদের সামঞ্জস্য বজায় রাখা উচিত। অর্থাৎ, ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীরা যদি সুভোরভকে নিজেদের ইতিহাস থেকে অপসারণ করতে চায়, সেক্ষেত্রে সুভোরভ কর্তৃক বিজিত যেসব ভূখণ্ড বর্তমান ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত, সেগুলোও তাদের পরিত্যাগ করা উচিত]

This is the fourth part of a Bengali article that provides a translation of (along with a brief commentary on) the speech of the Russian President Vladimir Putin on 21 February 2022 regarding the ongoing crisis in Ukraine. In this part of the speech, Putin discussed a range of topics, including

(i) the deliberate government policy of discrimination against ethnic Russians and Russian-speakers in Ukraine;

(ii) Ukrainian asymmetrical warfare against the Donetsk People's Republic and the Lugansk People's Republic, as well as the Republic of Crimea of the Russian Federation;

(iii) possible Ukrainian attempts at nuclearization; and

(iv) the growing US/NATO military presence in Ukraine.

Source of the featured image: Aleksei Nikolsky/Sputnik/AFP/Getty Images via Foreign Policy

Related Articles

Exit mobile version