Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ওয়াও আন-নামুস: পৃথিবীর বুকে যেন চাঁদের একটি খণ্ড

লিবিয়ার মরুভূমি অনেকটাই বৈচিত্র্যহীন। এটি মূলত বিশ্বের সর্ববৃহৎ মরুভূমি সাহারারই একটি অংশ। সাহারার অন্যান্য অংশের তুলনায় লিবিয়ার অংশটি অনেক বেশি শুষ্ক। এখানে কিছু কিছু স্থানে ৩০ বছরে মাত্র একবার বৃষ্টিপাত হয়। লিবিয়ার মরুভূমি এতই শুষ্ক, নাসা এখানে তাদের ভাইকিং প্রজেক্টের গবেষণা কার্য পরিচালনা করেছিল, যেহেতু তাদের মতে পৃথিবীর বুকে এই জায়গাটির সাথেই মঙ্গল গ্রহের সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি।

এই লিবিয়ার মরুভূমির সবচেয়ে শুষ্ক এবং দুর্গম জায়গাগুলোর একটি হচ্ছে ওয়াও আন-নামুস। লিবিয়ার দক্ষিণের ফেজ্জান প্রদেশের সাবহা শহরের দক্ষিণ-পূর্বে, সাহারা মরুভূমির প্রায় ভৌগলিক কেন্দ্রে অবস্থিত এই স্থানটি হচ্ছে একটি মৃত আগ্নেয়গিরি ক্ষেত্র। বিশাল সাহারার বুকে প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে ঘন কালো কয়লা এবং ছাই জাতীয় পদার্থ দিয়ে আচ্ছাদিত এই আগ্নেয়গিরি ক্ষেত্রটিকে মহাশূণ্য থেকেও দেখা যায়।

গুগল ম্যাপে দৃশ্যমান ওয়াও আন-নামুস; Image Source: Google Maps

উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ওয়াও আন-নামুসের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে বিস্তৃত এলাকা জুড়ে ছড়ানো ঘন কালো আগ্নেয়শিলা, উঁচু-নিচু পার্বত্য ভূমি, লাভা নির্গমনের ফলে সৃষ্ট বিশাল অন্ধকার গহ্বর এবং আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখ দেখে একে প্রথমে পৃথিবীর বুকে মঙ্গল গ্রহের কিংবা চাঁদের একটি খণ্ড বলে ভুল হতে পারে। স্থানীয়ভাবে তাই এটিকে অনেক সময় চাঁদের টুকরো বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে।

কিন্তু একটু ঘুরে বিপরীত দিক থেকে অগ্রসর হলেই চোখে পড়ে অপূর্ব নৈসর্গিক এক দৃশ্য। ছাই রংয়ের মাঝারি উচ্চতার একটি আগ্নেয়গিরির চারপাশ জুড়ে অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো লাল, নীল ও সবুজ রংয়ের পানির তিনটি লেক, আর সেগুলোর চারপাশে বেড়ে উঠা সবুজ গাছপালা, নানান রংয়ের ফুল- মরুর বুকে এরকম নয়নাভিরাম‌ দৃশ্য শুধু লিবিয়াতেই না, সমগ্র পৃথিবীতেই বিরল।

ওয়াও আন-নামুসের মূল লাভাডিন্ড, পাশে সবুজ রংয়ের একটি লেক; Image Source: Alain BEAUVILAIN/ Google Earth
ওয়াও আন-নামুসের মূল লাভাডিন্ড, সামনে লেক এবং কালো মাটি; Image Source: Jacques Taberlet/ Google Earth

ওয়াও আন-নামুস আগ্নেয়গিরি ক্ষেত্রটি মূলত প্রায় ৪ কিলোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট একটি কালডেরা বা আগ্নেয় গহ্বর। কোনো স্থানের ভূ-অভ্যন্তর থেকে লাভা নির্গত হলে তার চারপাশে কিছু এলাকা জুড়ে যে ধ্বস নামে বা গহ্বর সৃষ্টি হয়, সেটাকেই কালডেরা বলে। ওয়াও আন-নামুসের ক্ষেত্রে এই গহ্বরের গভীরতা প্রায় ১০০ মিটার। ধারণা করা হয়, প্রায় ৮০ কোটি ঘনমিটার পাথরের স্থানান্তরের ফলে এই আগ্নেয় গহ্বরের সৃষ্টি হয়েছে।

মূল আগ্নেয় গহ্বরের অভ্যন্তরে, কিছুটা উত্তর-পূর্ব দিকে আছে ১.৩ কিলোমিটার ব্যাস এবং ১৪০ মিটার উচ্চতা বিশিষ্ট একটি লাভাপিণ্ড। আর এর অভ্যন্তরে আছে ১৫০ মিটার প্রস্থ এবং ৮০ মিটার গভীরতা বিশিষ্ট একটি জ্বালামুখ। লাভাপিণ্ডটিকে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘিরে আছে তিনটি লেক এবং আরো কিছু ছোট ছোট জলাধার। খেজুর গাছ ছাড়াও লেকগুলোকে ঘিরে আছে নলখাগড়া জাতীয় বিভিন্ন গাছপালা।

সোনালি মরুর বুকে প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়া কালো পাথর কণা, মাঝখানে ৪ কিলোমিটার ব্যাসের কালডেরা; Image Source: Google Maps
৪ কিলোমিটার ব্যাস বিশিষ্ট কালডেরা, মাঝখানে লাভাপিন্ড এবং তিনটি লেক; Image Source: Google Maps
ওয়াও আন-নামুসের লেকগুলো; Image Source: Google Maps

লেকগুলোর মোট ক্ষেত্রফল প্রায় ৩০ হেক্টর এবং এদের গড় গভীরতা ১৪-১৫ মিটার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৩৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত লেকগুলোর একটিতে আছে স্বাদু পানি, একটিতে উষ্ণ পানি এবং অপরটিতে লবণাক্ত পানি। সাহারার তলদেশে অবস্থিত অ্যাকুইফার (ভূ-গর্ভস্থ জলবাহী শিলাস্তর) থেকে প্রাকৃতিক ঝর্ণার মাধ্যমে পানি এসে লেকগুলোকে সবসময় পরিপূর্ণ রাখে। ফলে বৃষ্টিপাতহীন মরুর তীব্র সূর্যতাপে বছরে ১৫ লাখ ঘনমিটার পানি বাষ্পীভূত হয়ে গেলেও অধিকাংশ সময়ই লেকগুলোর পানির উচ্চতার কোনো তারতম্য হয় না।

লোকালয় না থাকলেও লেকের পানির উপস্থিতির কারণে ওয়াও আন-নামুসে বৈচিত্র্যময় পাখি এবং কীট-পতঙ্গের সমাহার দেখা যায়। স্থানীয় কিছু বিরল প্রজাতির পাখি ছাড়াও এটি বিভিন্ন মৌসুমে অতিথি পাখিদেরকেও আকৃষ্ট করে। তবে ওয়াও আন-নামুসের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এর লেকগুলোর আশেপাশে অগণিত মশার উপস্থিতি। এই মশার কারণেই স্থানটির নামকরণ করা হয়েছে ওয়াও আন-নামুস। আরবি নামুস শব্দের অর্থ মশা। আর ওয়াও আন-নামুস অর্থ মশার মরুদ্যান।

লাভাপিণ্ডের গা ঘেঁষে থাকা লেক এবং তার চারপাশে অবস্থিত গাছপালা; Image Source: Rolf Cosar/ Google Earth
ওয়াও আন-নামুসের লেক এবং গাছপালা; Image Source: Erich Kapfenberger/ Google Earth

ওয়াও আন-নামুস আগ্নেয়গিরিটি থেকে প্রথম কবে অগ্নুৎপাত সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা সঠিক জানা যায় না। রেডিওমেট্রিক ডেটিংয়ের মাধ্যমে অনুমান করা হয়, এর বয়স কমপক্ষে ২ লাখ বছর। তবে আগ্নেয় গহ্বরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মূল লাভাপিণ্ড এবং জ্বালামুখটি অপেক্ষাকৃত নতুন। জ্বালামুখটির ভেতরে বৃষ্টির পানির প্রবাহের ফলে সৃষ্ট দাগ থেকে অনুমান করা হয়, এখানে সর্বশেষ অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল মাত্র তিন-চার হাজার বছর আগে

গভীর সাহারার বুকে অবস্থিত হওয়ায় ওয়াও আন-নামুস এলাকাটি জনমানবহীন। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকেই স্থানীয় অধিবাসীরা এর অস্তিত্ব সম্পর্কে অবহিত ছিল। ওয়াও আন-নামুসের আশেপাশে সন্ধান পাওয়া প্রাচীন কবর থেকে ধারণা করা হয়, শিকারী এবং যাযাবররা এই স্থানটি ভ্রমণ করত। আফ্রিকায় প্রথম লোহার ব্যবহার প্রচলন করা প্রাচীন নক সভ্যতা এই স্থান থেকেই আয়রন পাউডার সংগ্রহ করত বলে ধারণা করা হয়।

ওয়াও আন-নামুসের লাল রংয়ের একটি ছোট লেক; Image Source: Jacques Taberlet/Google Earth

ওয়াও আন-নামুস ক্ষেত্রটির অবস্থান লিবিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত সাবহা এবং দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কুফরার মধ্যবর্তী যাত্রাপথে। লেকগুলোতে সুপেয় পানির উপস্থিতি থাকার কারণে শতশত বছর ধরেই সাবহা এবং কুফরার মধ্য দিয়ে যাতায়াতকারী কাফেলাগুলো এই স্থানে যাত্রাবিরতি করত। কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে এই অপূর্ব সুন্দর স্থানটি বহির্বিশ্বের কাছে অজানাই রয়ে গিয়েছিল।

১৮৬২ সালে জার্মান পরিব্রাজক কার্ল ভন বরম্যান প্রথম বহির্বিশ্বের কাছে ওয়াও আন-নামুসের অস্বিত্বের কথা তুলে ধরেন। কিন্তু তিনি নিজে কখনো জায়গাটি ভ্রমণ করেননি। ওয়াও আন-নামুস স্বচক্ষে দেখা এবং বহির্বিশ্বকে জানানো প্রথম বিদেশি ছিলেন লরেন্ট ল্যাপিয়ের নামে একজন ফরাসি সেনা কর্মকর্তা। ১৯২০ সালে যুদ্ধবন্দী অবস্থায় কুফরায় নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে আটককারীরা ওয়াও আন-নামুসে যাত্রাবিরতি করলে তিনি এর সৌন্দর্যে অভিভূত হন এবং মুক্তি পাওয়ার পর এর অস্তিত্বের কথা প্রচার করেন।

ওয়াও আন-নামুসের কালো মাটি, দূরে লাভাপিন্ড এবং গাছপালা; Image Source: Juergen Buettner/ Google Earth
ওয়াও আন-নামুসের মরুদ্যান; Image Source: Panoramio

তবে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াও আন-নামুস প্রচার লাভ করে আরো পরে। ১৯৩১ সালে ইতালিয়ান ভূতত্ত্ববিদ আরদিতো দেসিও সেখানে ভ্রমণ করেন এবং তার পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে ১৯৩৫ সালে প্রথম এই এলাকার ভূতাত্ত্বিক বিবরণ প্রকাশ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেশ কিছু জার্মান বিজ্ঞানী এবং ভূগোলবিদ জায়গাটি ভ্রমণ করেন। তাদের একজন, নিকোলাস রিখটার, ১৯৬০ সালে তার ভ্রমণের উপর একটি বই প্রকাশ করেন। এরপর ১৯৬৬ সালে লিবিয়ার পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত ইতালিয়ান ভূতত্ত্ববিদ অ্যাংলিও পেশচের একটি বইয়ে ওয়াও আন-নামুস সম্পর্কে গবেষণামূলক বিভিন্ন তথ্য স্থান পায়।

গত কয়েক দশকে এটি লিবিয়ার অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র হিসেবে বিখ্যাত হয়ে ওঠে। এর চারপাশের ভূ-প্রকৃতি সমতল হওয়ায় এবং গহ্বরের ভেতরে অবস্থিত লাভাপিন্ডের উচ্চতাও খুব বেশি না হওয়ায় দূর থেকে এটিকে কয়েকটি কালো বিন্দু ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। আদিগন্ত বিস্তৃত বৈচত্র্যহীন সোনালি মরুর বুকে শতশত কিলোমিটার পাড়ি দেয়ার পর হঠাৎ করেই পর্যটকদের সামনের প্রকৃতির রং রূপান্তিরত হয়ে যায়

উপর থেকে ওয়াও আন-নামুসের লাভাপিন্ড; Image Source: Majeed Alani
ওয়াও আন-নামুসের জ্বালামুখের সামনে; Image Source: Jacques Taberlet/Google Earth

শুরুতে তাদের চোখে পড়ে শুধু মাইলের পর মাইল জুড়ে বিস্তৃত কালো পাথর কণার আবরণে ঢাকা ভূ-প্রকৃতি। কিন্তু এরপর যখন তারা আগ্নেয় গহ্বরের বাইরের দিকে কয়েক কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ঢাল বেয়ে ধীরে ধীরে গহ্বরের পরিসীমার চূড়ায় এসে পৌঁছেন এবং ভেতরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন, তখন তাদের চোখে পড়ে প্রকৃতির নানান রংয়ের খেলা। সাহারার মাঝখানে লাল-নীল-সবুজ রংয়ের লেক, সবুজ গাছপালা এবং ছাই রংয়ের লাভাপিন্ডের অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে তাদের বিস্ময়ে অভিভূত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

আগ্নেয় গহ্বরের চারপাশে যে কালো রংয়ের পাথর কণাগুলোর কারণে ওয়াও আন-নামুসকে মহাশূণ্য থেকেও দেখা যায়, সেগুলোর আকার মাত্র ২ থেকে ৫ মিলিমিটার। কিছু কিছু স্থানে বাতাসে এবং অন্যান্য স্থানে গাড়ির চাকার ঘর্ষণে সেগুলো সরে গিয়ে নিচের সোনালি বালুকণা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। কালো-সোনালির পরিববর্তনশীল রংয়ের এ খেলাও ওয়াও আন-নামুসের সৌন্দর্যে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। কিন্তু এটি একইসাথে এর সৌন্দর্যকে হুমকির সম্মুখীনও করে তুলেছে। তবে ২০১১ সালের গৃহযুদ্ধের পর থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে পর্যটকদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ায় আপাতত স্থানটি মানুষের দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে।

উপর থেকে ওয়াও আন-নামুস; Image Source: George Steinmetz/ Google Earth

লিবিয়াতে গর্ব করার মতো প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম বিষয় খুব কমই আছে। যে অল্প কিছু আছে, তার মধ্যে দুটিকেই লিবিয়ানরা অষ্টম আশ্চর্য হিসেবে অভিহিত করে। এর একটি হচ্ছে সাহারার তলদেশে লক্ষ বছর ধরে সঞ্চিত বিপুল পরিমাণ পানিকে এক অবিশ্বাস্য রকমের জটিল এবং বিস্তৃত পাইপলাইনের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সমগ্র লিবিয়ায় পৌঁছে দেওয়ার গাদ্দাফীর ‘ম্যান মেড রিভার’ প্রজেক্ট এবং অপরটি হচ্ছে ওয়াও আন-নামুস। লিবিয়ানদের দৃষ্টিতে প্রথমটি হচ্ছে আধুনিক বিশ্বের মনুষ্য নির্মিত অষ্টম আশ্চর্য এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে প্রাকৃতিক অষ্টম আশ্চর্য। ওয়াও আন-নামুসের ক্ষেত্রে অন্তত ছবিগুলো দেখলেও তাদের এই দাবিকে খুব বেশি অত্যুক্তি বলে মনে হয় না।

This article is in Bangla language. It's about the volcanic field Waw An-Namus, a beautiful tourist attraction in Libya. All the references are hyperlinked inside the article.

Featured Image: Juergen Buettner/ Google Earth

Related Articles