১৮৫১ সালে লেখা 'মবি ডিক' উপন্যাসের কথা হয়তো আপনারা অনেকেই জানেন। হারমান মেলভিলের এই উপন্যাসে উঠে এসেছে সমুদ্রের বুকে বিচরণ করা এযাবতকালের সবচেয়ে বড় প্রাণী শিকারের করুণ গল্প। সমুদ্রের অসামান্য শক্তিশালী আর বৃহৎ এই প্রাণীকে বাকি সামুদ্রিক প্রাণীগুলো খুব ভয় পেলেও মানুষ হারপুন আর বর্শা দিয়ে এটি শিকার করত শ'য়ে শ'য়ে। মোটামুটি আঠারো শতক পর্যন্ত বছরে প্রায় ৫০ হাজার তিমি বিভিন্ন দেশের শিকারির হাতে মারা যেত। আর এই মর্মান্তিক শিকার মহোৎসব শুরু হয় ষোল শতকের একেবারে শেষ দিকে।
তিমিকে আসলে আমরা অনেকেই মাছ বলে ভেবে থাকি। কিন্তু তিমি কোনো মাছ নয়, উষ্ণ রক্তের স্তন্যপায়ী প্রাণী। তিমির সবচেয়ে কাছের সম্পর্কের প্রাণী হলো জলহস্তী।
আজকের সাগরের সবচেয়ে বড় 'মাছ' তিমি একসময় ছিল ডাঙার প্রাণী। এই ঘটনা প্রায় পাঁচ কোটি বছর আগেরকার। তিমির এই আদি পুরুষের নাম ছিল পাকিসেটাস। এর পরের প্রাণীগুলো জল-স্থল দু'জায়গাতেই থাকতে থাকতে একদিন পুরোপুরি জলের প্রাণী হয়ে যায়।
প্রথম প্রথম স্থলের এ প্রাণী জলে গিয়ে দারুণ সমস্যার মুখোমুখি হলো। তখনকার সময়ে নতুন জলের প্রাণী তিমির আকৃতি ছিল ছোট। ফলে বড় আকারের হাঙর 'মেগালোডন' সহজেই এদের শিকার করত। কিন্তু একসময় বরফ যুগ এলো। বরফযুগে প্ল্যাঙ্কটন বেড়ে গেল সাগরে, সেই প্ল্যাঙ্কটন খেতে এলো 'ক্রিল' নামের এক প্রাণী, যা কি না তিমির প্রিয় খাবার। সেই সহজলভ্য চিংড়ির আকৃতির খাবার খেয়ে ধীরে ধীরে তিমি এমন বৃহৎ আকার পেল।
মানুষ আসলে কী পাওয়ার জন্য তিমি শিকার করত? এ প্রশ্ন মনে আসাটাই স্বাভাবিক। প্রধানত গভীর সাগরে তিমি শিকার করা হতো তিমির শরীরের 'তেল', তিমির মাথার ভেতরে থাকা 'স্পার্মাসিটি' আর রুগ্ন ও রোগাক্রান্ত তিমির পেটে থাকা 'এম্বারগ্রিস' এর জন্য। এছাড়া তীরের কাছাকাছি শিকার করা তিমির মাংস খাওয়ার জন্যও সংগ্রহ করা হতো। তিমির তেল দিয়ে প্রধানত বাতি জ্বালানো হতো। স্পার্মাসিটি ব্যবহার করা হতো সুগন্ধি মোমবাতি, মুখে মাখার ক্রিম, সুগন্ধী তৈরিতে। এম্বারগ্রিসও সুগন্ধি তৈরিতেই বেশি ব্যবহৃত হতো।
তখনকার দিনে তিমির শরীর থেকে নিংড়ে বের করা এই জিনিসগুলোর যথেষ্ট মূল্যও ছিল। তাই আপনা মাংসে তিমি বৈরী- কথাটি মোটেও অত্যুক্তি হবে না।
এবার আসা যাক তিমির শরীরের এই জিনিসগুলো আসলে কী কাজে লাগত তার শরীরের জন্য সেই আলাপে।
স্পার্মাসিটি কাঁচা দুধের মতো পদার্থ, যা তিমির মাথার ভেতরে তরল অবস্থায় থাকে। তিমি স্পার্মাসিটিকে প্রয়োজন মোতাবেক তরল থেকে মোমের মতো শক্তও করে ফেলতে পারে। স্পার্মাসিটি মূলত তাকে প্রতিধ্বনির মাধ্যমে সাগরের নিচে কোনো বস্তুর উপস্থিতি অনুভব করানোর কাজ করে। আধুনিককালে 'ইকোসাউন্ডার' এর মাধ্যমে সাগরের গভীরতা মাপা হয় অথবা যুদ্ধ জাহাজগুলো সাগরের নিচের সাবমেরিন খুঁজে বের করে। কোটি কোটি বছর আগে এই প্রযুক্তি তিমির শরীরে প্রকৃতিই স্থাপন করে দিয়েছে।
এবার আসা যাক এম্বারগ্রিসের প্রসঙ্গে। আসলে এই পদার্থটি তিমির পেটের মধ্যে তৈরি হয়, যা তিমির ক্ষতিই করে। এটি তৈরি হলে তিমির বদহজম হয়, যার ফলে সে রোগাক্রান্ত হয়ে যায়; এমনকি মাঝে মাঝে মারাও যায়।
তিমির তেল প্রধানত থাকে পেটের দিকের কোঁচকানো চামড়ার নিচের স্তরে, যার নাম 'ব্লাবার'। ব্লাবার কেটে নিয়ে গরম করে অথবা নিংড়ে তেল সংগ্রহ করা হয়।
তিমি শিকার আঠারো শতকের এক নৃশংস ঘটনা। লক্ষ লক্ষ তিমি সাগরের বুকে হত্যা করা হয় সামান্য কিছু তেল আর সুগন্ধি পদার্থ পাবার জন্য, যে পদার্থগুলো তিমির শরীরের মূল আয়তনের কিছু অংশ মাত্র। ব্লাবার, স্পার্মাসিটি কিংবা এম্বারগ্রিস সংগ্রহ করে তিমির অবশিষ্ট বিশাল শরীর সাগরে ফেলে দেয়া হতো। সাগরের বিশাল বিশাল জীবন্ত প্রাণীগুলোকে কী নিদারুণ নৃশংসতায় হত্যা করা হতো খুব সামান্য কিছুর জন্য; এখন যদিও পরিবেশ সংরক্ষণকারী দলগুলোর সচেতনতায় এখন অনেকটাই কমেছে এই ঘটনাগুলো।
তিমির এমন ধ্বংস রোধে বিশ্বব্যাপী তিমি সংরক্ষণের প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয়েছে ১৯৪৬ সালে। তাছাড়া তিমি শিকার এখন খুব একটা লাভজনক না হওয়ায় পূর্বের তিমি শিকারিরাও অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে। ফলে কোটি বছর আগ থেকে সাগরের গভীর রহস্যময় জলে বিচরণ করা তিমিরা আবার তাদের হারানো রাজত্ব ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে।
This is a Bangla article. This is about whale hunting and the misery of whales across the world.
Featured Image: Hakai Magazine
References: