Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

দিন দিন কেন আমেরিকানরা ‘অসুখী’ হচ্ছে?

‘আমেরিকা’ শব্দটি কি শুধুই একটি দেশের নাম? না, এটি লাখো স্বপ্নের নাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অর্থনীতির নাম, নিজেদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করা এক জাতির নাম, বিশ্বজুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো মোড়লের নাম, উন্নত যোগাযোগ প্রযুক্তি আর বিজ্ঞান উৎকর্ষতার চরম শিখরে অবস্থান করা একটি দেশের নাম, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর সামরিক শক্তির নাম। এ দেশের মানুষের ধন-সম্পদের কথা ভাবতে গেলে ক্লান্ত হয়ে যায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দরিদ্র দেশের মানুষেরা। মৌলিক চাহিদা তাদের কবেই মেটানো শেষ, এখন তারা ঝুঁকছে অভিজাত জীবনের দিকে, পূরণ করছে ‘আমেরিকান স্বপ্ন’। বিশ্ব যেখানে বেকার সমস্যা সমাধানে হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে কিছুদিন আগেই ১৯৬৯ সালের পর আমেরিকায় বেকারত্বের হার নেমে এসেছে সর্বনিম্ন মাত্রায়। তবুও আমেরিকানরা সুখী নয়, তবুও তারা দিনকে দিন অসুখী হয়ে চলেছে। কেন?

Image Source: englishgoodies.com

‘‘সুখ কী?”, এই প্রশ্নের উত্তর পৃথিবীর কোনো দার্শনিক বা সমাজবিদের পক্ষে এককথায় তো নয়ই, একটি বিশালাকার রচনাতেও দেয়া সম্ভব নয়। কেননা, এটি একটি আপেক্ষিক শব্দ। কারো কাছে ভোগে সুখ, কেউ বা ত্যাগেই সুখ পান। কেউ আবার ক্ষমতার চর্চা করাকে সুখ মনে করেন, তো কেউ সে ক্ষমতাবলয়ে নিজেকে চর্চিত করে সুখ পান। বৃহৎ সংখ্যক মানুষের নিকট সুখের একটি স্থূল ধারণা হচ্ছে অর্থ-সম্পদ। অথচ গবেষণা বলছে, ধনী মানুষই নাকি অধিক ‘ডিপ্রেশন’ বা বিষণ্ণতায় ভুগছে! আবার ধন-সম্পদ কম বা পরিমিত হলেই যে মানুষ সুখী, ব্যাপারটা তেমনও নয়। যেহেতু এই আলোচনার মূল বিষয়বস্তু সুখ নয়, তাই সুখ নিয়ে গভীর আলোচনায় প্রবেশ না করে আমরা বরং একটি সাধারণ ধারণা সামনে রেখে এগোতে পারি, তা হলো, যা কিছু কল্যাণকর, মঙ্গলময়, শুভ, ইতিবাচক, তা-ই সুখ। সমস্যা হচ্ছে, যে চারটি শব্দ সুখকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহার করা হলো, সেগুলোও আপেক্ষিক!

যা-ই হোক, আমরা শুরু করবো গ্যালাপের সমীক্ষা নিয়ে। ‘গ্যালাপ শেয়ারকেয়া অ্যান্ড ওয়েলবিং ইনডেক্স’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান ২০০৮ সাল থেকে আমেরিকার ‘ওয়েলবিং’ বা কল্যাণ ও মঙ্গলের সূচক তৈরি শুরু করে। ২০০৯ সালে যখন বিশাল অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যে পতিত হয় দেশটি, তখন গ্যালাপ সূচকে দেশটির ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মাঝে মাত্র ১৫টির সূচক ছিল নিম্নমুখী। অর্থাৎ, সেসব প্রদেশের মানুষ তাদের জীবনযাত্রার সার্বিক দিকগুলো নিয়ে সন্তুষ্ট নন। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে অর্থনীতিতে পুনরায় সমৃদ্ধি ও স্থিতি ফিরে এলেও গ্যালাপের সূচকে ২০১৭ সাল ছিল আমেরিকার সবচেয়ে অকল্যাণকর বছর!। (যেহেতু ২০১৮ সালের সূচক এখনো আসেনি, আমরা আলোচনা করবো ২০১৭ সাল পর্যন্ত ফলাফলগুলো নিয়েই।)

গ্যালাপের সূচকে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশের অবস্থান; Image Source: citylab.com

গ্যালাপ তাদের সূচক তৈরি করতে বছরে আড়াই মিলিয়ন (২৫ লাখ) মানুষের সাথে কথা বলে থাকে। গ্যালাপের প্রশ্নগুলো সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের ভাবনা, সামাজিক পারিপার্শ্বিকতায় তাদের সন্তুষ্টি, পারিবারিক বন্ধন ও সহযোগিতার সম্পর্ক, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণ এবং আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও পাড়া-প্রতিবেশীর সাথে সংযোগ নিয়ে হয়ে থাকে। ২/৩টি সূচক ছাড়া বাকি সবগুলোতেই অবনমন ঘটে ২০১৭ সালে। এমনকি ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে ২১টিতে কেবল অর্থনৈতিক সূচক ছাড়া সব সূচক ছিল নিম্নমুখী, যা মানুষের অসুখী হবার স্পষ্ট প্রমাণ।

উপরের ম্যাপে আশংকাজনকভাবে যে অঙ্গরাজ্যগুলোর সুখ বা কল্যাণ কমে এসেছে সেগুলোকে লাল রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে। সূচক সবচেয়ে নিম্নমুখী ছিল পশ্চিম ভার্জিনিয়াতে। এরপর ওহাইয়ো, ইন্ডিয়ানা, দক্ষিণে আরকানসাস, ওকলাহোমা, লুইজিয়ানা, মিসিসিপি, নেভাডা। কমলা রঙে চিহ্নিত অঙ্গরাজ্যগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো। অন্যদিকে সবুজ রঙে চিহ্নিত অঙ্গরাজ্যগুলোর সুখের সূচক কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে আগের বছর থেকে। একটু পেছনে আছে হালকা সবুজ রঙে চিহ্নিত করা ঘরগুলো। আর নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন আর নিউ মেক্সিকোর মতো অঙ্গরাজ্যগুলো পড়েছে হলুদ অংশে, যাদের অবস্থার তেমন উন্নয়ন বা অবনমন কোনোটিই হয়নি।

এই ২১টি অঙ্গরাজ্যের অবস্থা আশংকাজনক; Image Source: citylab.com

তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বেশি চিন্তিত হবে ক্রিটিক্যাল অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া ২১টি অঙ্গরাজ্য নিয়েই। মিসিসিপ আর লুইজিয়ানার মতো দরিদ্রতম অঙ্গরাজ্যের নাম দেখে হুট করে বলে দেয়া যাবে না যে অর্থনৈতিক সমস্যা এখানকার বড় সমস্যা। কেননা এ তালিকায় নাম রয়েছে নেভাডার মতো ধনী আর সম্পদশালী অঙ্গরাজ্যেরও। এখানকার মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট নয়, তারা বিষণ্নতায় ভুগছে, শারীরিক ও মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত, পারিবারিক বন্ধন অনেকাংশেই দুর্বল, সামাজিক বন্ধন থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন! তবে এই ২১টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে না থাকলেও, হলুদ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত পারিবারিক বন্ধন বিষয়ক সূচকে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় শহর নিউ ইয়র্ক! অনেক তালিকায় এ শহরের নামই উঠে এসেছে আমেরিকার সবচেয়ে অসুখী শহর হিসেবে!

শার্লট ম্যালেন্ডার সূচক; Image Source: citylab.com

উপরের তালিকাটি লক্ষ্য করুন। গবেষক শার্লট ম্যালেন্ডার বিশেষ পদ্ধতিতে জীবনযাত্রার বিভিন্ন ধাপে ১ থেকে -১ পর্যন্ত (ধনাত্মক থেকে ঋণাত্মক) সাংখ্যিক পরিমাপ করেছেন উপরোল্লিখিত সবচেয়ে অসুখী অঙ্গরাজ্যগুলোতে। এর ফলাফল অভূতপূর্ব। এখানে দেখা যাচ্ছে, অধিক আয় সুখী থাকার খুব বড় নিয়ামক নয়। বরং লেখাপড়া আর ভ্রমণ সহজলভ্য হলেই মানুষ অধিক সুখী মনে করছে নিজেদের। বিপরীতক্রমে উপার্জন কম হওয়াকে অসুখী হবার কারণ মনে করছে খুব কম সংখ্যক মানুষই, যদিও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষজনের হিসাব আলাদা। অসুখী মানুষের সংখ্যা বেশি কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে, ধার্মিক মানুষ আর শ্রমজীবীদের মাঝে। এ শ্রেণীগুলো ছাড়াও প্রায় সকল শ্রেণীর মানুষের মাঝেই জীবন নিয়ে সন্তুষ্টির পরিমাণ কমেছে, বেড়েছে হতাশা ও গ্লানি। উতাহ, হাওয়াই আর আইওয়ার মতো অঙ্গরাজ্যগুলো যেখানে ২০০৯ সালে ছিল সবচেয়ে সুখী, সেখানে ২০১৭ সালে তারা সবচেয়ে অসুখীদের তালিকায়। গবেষকরা এ ব্যাপারগুলো নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন এবং করছেন, পাশাপাশি তুলে ধরেছেন এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ। কারণগুলো সংক্ষিপ্তাকারে আলোচনা করা যাক।

অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ আমেরিকার মানুষের ধীরে ধীরে অসুখী হয়ে ওঠার কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা প্রথমেই বলেছেন ‘আমেরিকান ড্রিমস’ এর কথা। ব্রিটিশ নিউরোসার্জনদের এক গবেষণায় প্রমাণিত হয়, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি তাকে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে যায়। অগ্রগতি না থাকলে মানুষ সুখী হতে পারে না। মাসে ৫০ হাজার ডলার আয় করা লোকটি স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন চালিয়ে নিতে পারে। কিন্তু কয়েক বছর পর যদি তার আয় বৃদ্ধি না পায়, তাহলে সে অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে, যদিও তার আয় তার জীবনধারণের জন্য যথেষ্ট। ঠিক এ ব্যাপারটিই ঘটছে আমেরিকানদের ক্ষেত্রে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে তারা অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিশ্বাস করে এসেছে এবং তা বাস্তবায়নও করেছে। ধনী পিতামাতার চেয়ে তাদের সন্তান আরো অধিক আয় করেছে। কিন্তু বর্তমানে এই অগ্রগতি অনেকটাই স্তিমিত। গবেষণা বলছে, এখন সন্তান তার পিতার চেয়ে অধিক আয় করতে পারছে না, উপরন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা কমছে। আর তাতেই বাড়ছে হতাশা আর অসন্তুষ্টি।

জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে এখন অসীম প্রতিযোগিতা; Image Source: thetattooedbuddha.com

প্রতিযোগিতা আরেকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ, যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে সম্পর্কিত, তা সম্পৃক্ত আরো অনেক কিছুর সাথে। পরিমিত পরিমাণে প্রতিযোগিতা অবশ্যই ভালো। কারণ, প্রতিযোগিতা থাকলে মানুষের মধ্য থেকে সেরাটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রই যখন প্রতিযোগিতামূলক ভাবতে শুরু করে মানুষ, তখন তা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় বৈকি। ১৯৮০’র দশক থেকে আমেরিকায় নব্য উদারবাদ প্রসার লাভ করতে শুরু করে। ফলে পুঁজিবাদ ব্যাপকভাবে শক্তিশালী হয়। আর এই পুঁজিবাদী কাঠামোর মূলে রয়েছে জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং ব্যক্তি পর্যায়ে অর্থনৈতিক অগ্রগতি। বাজার ব্যবস্থা হয়ে ওঠে যেকোনো সময়ের চেয়ে অধিক প্রতিযোগিতামূলক আর তা মানুষকে ঠেলে দেয় এক অসীম প্রতিযোগিতার মাঝে, যেখানে চূড়ান্ত অগ্রগতি বলতে কিছু নেই।

ফলে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমেরিকানরা অর্থনৈতিকভাবে ভাবতে শুরু করলো, অধিক প্রতিযোগিতায় নিমজ্জিত হয়ে ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক বন্ধন এসব ধীরে ধীরে শিথিল হলো। তাছাড়া নব্য উদারবাদ আমেরিকায় যে ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তার অশেষ চাহিদা পূরণের জন্য বাজারকে সর্বদা প্রয়োজনের অধিক উৎপাদন করতে হয়। ফলে উৎপাদন যন্ত্রে বাড়ছে চাপ, যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা, বাড়ছে প্রতিযোগিতা আর ভাগ হয়ে যাচ্ছে মুনাফা। কিছু ক্ষেত্রে আবার তৈরী হচ্ছে মনোপলি (একচেটিয়াত্ব)। আর সবকিছু মিলিয়ে শেষতক সেই আয়-উপার্জনের অসমতা, স্থির অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং জনমনে হতাশা

মার্ক্সের এলিয়েনেশন তত্ত্বের সংক্ষিপ্ত ডায়াগ্রাম; Image Source: researchgate.net

এই আলোচনায় কার্ল মার্ক্সের ‘এলিয়েনেশন’ বা বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব অপরিহার্য। এ তত্ত্বটি আলোচনা করে কীভাবে পুঁজিবাদ মানুষের জীবনকে কেবলমাত্র ভোগবাদের দিকে ঠেলে দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে তোলে। মার্কিন সমাজে (পৃথিবীর সর্বত্রই ঘটছে) যৌথ পরিবার এখন আর নেই বললেই চলে। পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোয় যৌথ পরিবারের ধারণাটিই আসলে অচল। মানুষের পারিবারিক বন্ধন, আবেগ অনুভূতিগুলো এখানে অর্থহীন। অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সে অগ্রগতির জন্য অসীম প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করে মানুষ হারাচ্ছে তাদের স্বাভাবিক জীবন, সম্পর্ক, যোগাযোগ। ফলে বয়সকালে বিচ্ছিন্ন জীবন যাপনকারী মানুষের সংখ্যাও ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। আর এই শ্রেণীর মানুষ, যাদের বয়স ৬৫ বা ততোধিক, বিচ্ছিন্ন জীবনে অন্যদের তুলনায় অধিক বিষণ্ণতায় ভোগেন। ২০১৭ সালের হিসেব অনুযায়ী, কর্মজীবন থেকে অবসরপ্রাপ্ত (৬৫ বছর বা তার বেশি) ২০ লক্ষাধিক আমেরিকান বিষণ্ণতায় ভুগছেন বিচ্ছিন্ন জীবনযাপনের দরুন। পুঁজিবাদী সমাজে এটি আসলে স্বাভাবিক।

এরকম বিচ্ছিন্ন জীবনে অভ্যস্ত একাকী কেবল বয়স্করাই হন, এ ধারণা ভুল। চরম প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক কাঠামোতে টিকে থাকতে আমেরিকানরা পরিবার, পাড়া-প্রতিবেশী ছেড়ে পাড়ি জমাচ্ছে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রে, যা তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ফলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা মিললেও, মিলছে না মানসিক শান্তি। ১৯৮০ সালে যেখানে আমেরিকায় একাকিত্বে ভোগা মানুষের পরিমাণ ছিল শতকরা ২০ ভাগ, সেখানে ২০১০ সাল অবধি তা দ্বিগুণ হয়ে ৪০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ভাবা যায়? একটি দেশের প্রতি ১০০ জন মানুষের ৪০ জনই বলছেন যে তারা একাকিত্ব বোধ করেন! আর এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাজারেও। স্বাভাবিকভাবেই বিষণ্ণতায় ভোগা কর্মীর সেই বিষণ্ণতা কাজকে প্রভাবিত করবে। এক হিসাবে দেখা গেছে, বছরে ৩.৫ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে আমেরিকান বাজার এই একাকিত্বের কারণে!

বিষণ্ণতা মানুষকে সামাজিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়; Image Source: thewarrencentre.org.au

একাকিত্ব আর বিষণ্ণতায় ভোগা যে আমেরিকান শ্রমজীবী শ্রেণীর জন্য কত বড় অভিশাপ, তার একটি উপাত্ত উল্লেখ করার প্রয়োজন বোধ করছি। বিগত দশ বছরে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট ওষুধের বাজার বেড়েছে ৪০০ শতাংশ! এ বাজারের প্রধান ক্রেতাই হচ্ছে বিষণ্ণ শ্রমজীবী সমাজ, যারা এখন ধীরে কোকেইন, এম্ফেটামিন আর মেথ-এম্ফেটামিনের মতো মাদকের দিকে ঝুঁকছে। ‘কোয়েস্ট ডায়াগনস্টিক’ নামক একটি কোম্পানি ২০১৫-১৭ সালে ৬৬ লক্ষ মূত্র পরীক্ষার ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে জানায় যে, ৫০ শতাংশের অধিক পরীক্ষায় ডিপ্রেশনরোধী ওষুধ পাওয়া গেছে। ৪.৭ শতাংশ পরীক্ষায় মিলেছে অবৈধ এবং বিপদজনক মাদকের উপস্থিতিও। এ থেকে বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় যে, ডিপ্রেশন তথা বিষণ্ণতা আমেরিকায় কেমন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।

“জনমনে অশান্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে সরকার, যারা নিজেরাই বিশৃঙ্খল হয়ে আছে।”- ইজাবেল সহিল, ব্রুকিং ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ

এবার আসা যাক রাজনৈতিক কারণে। অনেক গবেষকের মতেই, দূষিত রাজনীতি এবং মেরুকরণ আমেরিকানদের অসুখী করে তুলছে। দেশের মানুষ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে দ্বিধাবিভক্ত। ডেমোক্রেট বনাম রিপাবলিকান, ড্রাগ বৈধকরণ বনাম ড্রাগ নিষিদ্ধকরণ, ডানপন্থী বনাম বামপন্থী, অস্ত্র অধিকারের সমর্থক বনাম অস্ত্রের অধিকার রহিতকরণের সমর্থক, ধার্মিক বনাম অধার্মিক, যুদ্ধবিরোধী বনাম যুদ্ধের সমর্থক ইত্যাদি ভাগে বিভক্ত মার্কিনরা প্রায় কোনো ক্ষেত্রেই আর সমস্বরে কথা বলতে পারছে না। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর তো রাজনৈতিক তিক্ততা যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। হোয়াইট হাউসে দু’পক্ষের কলহ এখন নিত্যকার খবর। আর স্বাভাবিকভাবেই, একটি দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া পুরো দেশের সামষ্টিক কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে।

আমেরিকার রাজনৈতিক মেরুকরণ; Image Source: difficultrun.nathanielgivens.com

বর্ণপ্রথা নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। আমেরিকার বহু পুরনো রোগ এই বর্ণপ্রথা। সাথে আছে লিঙ্গ বৈষম্যও। নারীরা, আফ্রিকান আমেরিকান আর হিস্পানিকরা বছরে ৪৮ হাজার ডলারের কম আয় করেন, যা শ্বেতাঙ্গদের গড় আয়ের তিনভাগের একভাগ। এই বৈষম্য কেবল আয়ের ক্ষেত্রে নয়, সকল প্রকার নাগরিক সুযোগ-সুবিধা আর আইন-কানুনের ক্ষেত্রেও এটি বহাল। সমান অপরাধের জন্য কৃষ্ণাঙ্গদের অধিক সাজার ব্যাপার তো খুবই সাধারণ। উপরন্তু, একজন কৃষ্ণাঙ্গ একবার কোনো অপরাধে অভিযুক্ত হলে তার বাকি জীবন পুরোটাই নানা প্রকার সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হয়ে কাটাতে হয়। ফলে এই শ্রেণীর মানুষের অসুখী হওয়াটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।

২০০৯ সালের অর্থনৈতিক মন্দা থেকে আমেরিকা সেরে উঠলেও একটা শ্রেণী এখনো নিজেদের ফিরে পেতে পারেনি। তাছাড়া, সে মন্দার পর বড় রকমের মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে বলে মুদ্রার মূল্য হ্রাস পেয়েছে। সে অনুপাতে বাড়েনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বেতন ও উপার্জন। ৬০ শতাংশ কর্মজীবী মানুষের কোনো সঞ্চয় নেই বর্তমানে, মার্কেট ওয়াচের এক গবেষণায় উঠে এসেছে এ তথ্য। মূল্যস্ফীতির সাথে সাথে তাদের উপার্জন বৃদ্ধি না পাওয়ায় সঞ্চয় করার কোনো সুযোগই পাচ্ছেন না তারা। ফলে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চিত হয়ে পড়ছেন তারা।

এছাড়াও ধর্মীয় অনুশাসন হ্রাস পাওয়া, সামাজিক প্রথা-প্রতিষ্ঠানগুলোর বিলুপ্তি, শ্রমক্ষেত্রে বিরামহীনতা, খ্যাতিমান ব্যক্তিদের (সেলেব্রিটি) অভিজাত জীবনযাপন দেখে সাধারণে অনুকরণ স্পৃহা, মাত্রাতিরিক্ত প্রযুক্তির ব্যবহারে বাস্তব জীবন থেকে দূরে সরে যাওয়া, স্বাস্থ্য সমস্যা, স্থূলতা সহ মার্কিনদের ক্রমশ অসুখী হয়ে যাবার পেছনে আরো শতাধিক কারণ চিহ্নিত করেছেন গবেষকগণ। এই সমস্যাগুলো সামনে আরো বাড়বে বৈ কমবে না। অনেকেই এককথায় এসকল সমস্যার সমাধান হিসেবে নব্য উদারবাদের বিলুপ্তি ঘোষণা করে দেন, যা আদতে অসম্ভব, কিংবা সম্ভব হলেও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তার চেয়ে বরং প্রতিটি সমস্যার গোড়া থেকে কাজ করলে বিরাজমান অর্থনৈতিক কাঠামোর সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া সম্ভব। মানুষের অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূরীকরণ, পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার জন্য জনসচেতনতা তৈরি করা, বিষণ্ণতা রোধে ওষুধের চেয়ে জনসম্পৃক্ততার উপর গুরুত্বারোপ করা, কর্মক্ষেত্রে মালিক শ্রমিক বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করা, কর্মজীবীদের যেন কাজের জন্য পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে না হয় সে জন্য পরিকল্পনা ঠিক করা, শ্রেণী ও বর্ণ বৈষম্য রোধ করা, সকল ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার আবহ প্রশমিত করা, শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতা নিয়ে সরকারি উদ্যোগে কর্মশালার আয়োজন, প্রচার-প্রচারণা ও বিজ্ঞাপনে মাদক রোধ সহ ইত্যাদি নানামুখী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।

সর্বোপরি, বিশেষজ্ঞদের পাশে নিয়ে কাজ করতে হবে সরকারকে। অন্যথায়, সকল অর্থনৈতিক উন্নয়ন আর অভিজাত জীবনযাপনের মাঝেও কাঙ্ক্ষিত সুখ খুঁজে পাবে না মার্কিনীরা।

This article is written in Bangla language. It's about the decline of gross happiness among American peoples and reasons behind it.

Necessary references are hyprlinked inside the article.

Featured Image: vox.com

Related Articles