Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যান্টার্কটিকা কি পরাশক্তিগুলোর সংঘাতের কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে?

ভৌগলিকভাবে পৃথিবীর সর্বদক্ষিণে অবস্থিত বরফাচ্ছাদিত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ দক্ষিণ মহাসাগর দ্বারা পরিবেষ্টিত। পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম এই মহাদেশের আয়তন প্রায় ৫৫ লক্ষ বর্গ মাইল। প্রায় ৯৮ শতাংশ এলাকা ঘন বরফ দ্বারা আবৃত; প্রায় স্থায়ী জনমানবহীন মহাদেশটি পূর্ব অ্যান্টার্কটিকা এবং পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকা– এই দুই অংশে বিভক্ত।

বৈশ্বিক মানচিত্রে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের অবস্থান; image source: Encyclopædia Britannica

১৯৫০–এর দশকের মধ্যে সাতটি রাষ্ট্র আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, চিলি, ফ্রান্স, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে এবং যুক্তরাজ্য অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশের উপর নিজেদের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব দাবি করে। দক্ষিণ অর্কনি দ্বীপপুঞ্জ আর্জেন্টিনা এবং যুক্তরাজ্যের দাবিকৃত এলাকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে আর্জেন্টিনা, চিলি এবং যুক্তরাজ্যের দাবিকৃত অঞ্চলের মধ্যে দক্ষিণ শেটল্যান্ড দ্বীপপুঞ্জ অবস্থিত। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং নরওয়ে একে অন্যের দাবিকৃত অঞ্চলগুলোকে পারস্পরিকভাবে স্বীকৃতি জানিয়েছে।

অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশে কয়েকটি রাষ্ট্র নিজেদের আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব দাবি করেছে; image source: Australian Antarctica Data Centre

একই সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন, বেলজিয়াম, জার্মানি, পোল্যান্ড, সুইডেন, জাপান এবং দক্ষিণ আফ্রিকা অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের বিভিন্ন অংশে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমদিকে, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে বিভিন্ন রাষ্ট্রের অনুসন্ধান কার্যক্রম পারস্পরিক সহযোগিতামূলকভাবে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে শুরু হয়। তবে, এই অনুসন্ধান কার্যক্রমের বিভিন্ন সময়ে অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ উত্তোলনযোগ্য প্রাকৃতিক সম্পদ প্রাপ্তির ঘটনা, এই মহাদেশের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে ভবিষ্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রবল সম্ভাবনা তৈরি করে। এক্ষেত্রে, কয়েকটি আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সংস্থার সমন্বিত উদ্যোগে বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যৌথ বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে ১৯৫৭ সালের ১লা জুলাই থেকে ১৯৫৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘আন্তর্জাতিক ভূ-পদার্থবিদ্যা বর্ষ’ পালন করা হয়।

তাত্ত্বিকভাবে, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের কর্তৃত্ব কোনো একক দেশের অধীনস্থ নয়, বরং নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে, এবং এটি ‘অ্যান্টার্কটিক চুক্তি’র শর্তাবলী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে সব ধরনের অস্ত্রের পরীক্ষা ও ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ১৯৫৯ সালের ১লা ডিসেম্বর মোট ১২টি দেশের উপস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র এর ওয়াশিংটনে ‘অ্যান্টার্কটিক চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের আরও বেশ কয়েকটি দেশ এই চুক্তির পক্ষভুক্ত হয়।

১৯৬১ সালের ২৩শে জুন থেকে কার্যকর হওয়া এই চুক্তিতে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক বিরোধের বিষয়বস্তুতে পরিণত না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, একে সমস্ত মানবজাতির কল্যাণের জন্য শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের বিষয়ে অঙ্গীকার করা হয়। এছাড়াও, এই চুক্তিতে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে মহাদেশটিতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার পরিসর বৃদ্ধি করা এবং অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। ইতোমধ্যে, বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে স্থায়ী গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করেছে।

চিলির একটি অ্যান্টার্কটিক গবেষণা কেন্দ্র; image source: Peter Prokosch/GRID-Arendal

বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল খাতে মৌলিক গবেষণা বাস্তবায়নের জন্য কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন ২০১৯-২০ সালের অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে কর্মসূচি পরিচালনার জন্য প্রায় ৪৮৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের প্রায় ৪২ শতাংশ জায়গাকে অস্ট্রেলিয়ার অ্যান্টার্কটিক সংস্থা নিজেদের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে থাকে। নিজেদেরকে এই মহাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দিতে অস্ট্রেলিয়া বদ্ধপরিকর। ২০২০-২১ সালের অ্যান্টার্কটিক কার্যক্রমে দেশটি প্রায় ১৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বরাদ্দ করেছে। তবে, সম্প্রতি পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য রাশিয়া এবং চীন বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ফলে এই অঞ্চলে মৎস্য আহরণ, মজুদকৃত জ্বালানি তেল এবং খনিজ সম্পদ ক্ষেত্রে কার্যত একধরনের প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়েছে।

অস্ট্রেলিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন বরফভাঙা জাহাজের কার্যক্রম; image source: Doug Thost/Australian Antarctic Program

চীন ১৯৮৩ সালে ‘অ্যান্টার্কটিক চুক্তি’র অংশ হলেও দেশটি অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে গবেষণা এবং উন্নয়নের জন্য বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে। চুক্তির অংশ হওয়ার ত্রিশ বছরের মধ্যে চীন চারটি অ্যান্টার্কটিক স্টেশন স্থাপন করেছে এবং দেশটি আগামী ২০২২ সালের মধ্যে রস সাগরের নিকটবর্তী এলাকায় পঞ্চম অ্যান্টার্কটিক স্টেশন স্থাপনের কার্যক্রম শেষ করতে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে রস সাগরের কিছু অংশে ঘোষিত পরিবেশগত সংবেদনশীল অঞ্চলের সংরক্ষিত এলাকায় মৎস্য আহরণ কার্যক্রম সংকোচনের বিরুদ্ধে একপর্যায়ে চীন এবং রাশিয়া অবস্থান গ্রহণ করে।

একটি চীনা অ্যান্টার্কটিক গবেষণা কেন্দ্র; image source: Xinhua

ক্রিল হচ্ছে একধরনের কঠিন আবরণযুক্ত ছোট জলজ প্রাণী, যেটি অ্যান্টার্কটিকের সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ক্রিল শিকারের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা অ্যান্টার্কটিক এর বাস্তুতন্ত্রের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এদিকে, চীনের সাংহাই চোংহে মেরিন ইন্ডাস্ট্রি ২০২৩ সাল নাগাদ ক্রিল শিকারের জন্য বিশ্বের বৃহত্তম ট্রলার তৈরি করতে কাজ করছে। চীনে তৈলজাতীয় পণ্য হিসেবে ক্রিল ব্যবহৃত হয়ে থাকে, এবং ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে এই তৈলজাতীয় পণ্যের বাজার মূল্য ৪০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

রাশিয়ার একটি অ্যান্টার্কটিক গবেষণা কেন্দ্র; image source: Sputnik/Science Photo Library

অন্যদিকে, অন্যান্য প্রভাবশালী রাষ্ট্রের মতো অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে রাশিয়ার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে, রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ভূতাত্ত্বিক জরিপকারী সংস্থা ‘রসজিওলোজিয়া’ অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে অফশোর তেল ও গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাব্যতা যাচাই কার্যক্রম শুরু করেছে। ১৯৮২ সালের শুরুতে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে ভারতের আনুষ্ঠানিক তৎপরতা শুরু হয়। অন্যদিকে, পাকিস্তানও অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে দেশটির কার্যক্রম জোরদার করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও, তুরস্ক মহাদেশটিতে নিজস্ব অ্যান্টার্কটিক স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা করছে। এদিকে, ইরান অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে দেশটির তৎপরতা শুরু করতে আগ্রহী।

১৯৪৮ সাল নাগাদ ‘অ্যান্টার্কটিক চুক্তি’র শর্তাবলীর পুনঃমূল্যায়ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের জন্য, বিদ্যমান বিধিনিষেধ শিথিল করার জন্য পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে তৎপরতা শুরু করা প্রতিটি রাষ্ট্র বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করার দাবি করে যাচ্ছে। তবে, মহাদেশটিতে পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর স্বার্থের সংঘাত তৈরি হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে, অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে কোনো সংঘাত সৃষ্টি হয় কিনা, সেটা সময়ই নির্ধারণ করতে পারবে।

Related Articles